আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুমায়ুন আহমেদের প্রকৃত ভক্ত তারাই, যারা......

নো ওয়ান ক্যান মেক মি ফিল ইনফেরিওর উইদআউট মাই কনসেন্ট! প্রথমেই একজন সুরাসক্ত যুবকের ডায়েরী থেকে কিছু অংশ - (প্রথম তিন প্যারা স্কিপ করে গেলেও পড়তে সমস্যা হবে না) জুলাই ১৯, ২০১২ বৃহস্পতিবার ‘‘সপ্তাহে দুইটি বা একটি সন্ধ্যায় বারে বসে 'সংযত' মদ্যপান করাটা ইদানিং অভ্যাসে পরিনত হয়ে যাচ্ছে। 'সংযত' মানে হচ্ছে বেহেড মাতাল না হওয়া (অনেকেই এটাকে 'সোশ্যাল ড্রিংকিং' নামে অভিহিত করে থাকে), যাতে অন্ততঃপক্ষে ড্রাইভ করে বাসায় ফিরে যাওয়া যায়। অসংযমী মদ্যপানও করা হয় বটে; তবে সেগুলো বরাদ্দ থাকে বিশেষ দিনগুলোতে - ঈদের দিন, থার্টি ফার্স্ট, কারো ব্যাচেলর পার্টি, গায়ে হলুদ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই আজকেও এই সোশ্যাল ড্রিংকিং করতে কয়েকজন বন্ধু বসেছি লা ডিপ্লোম্যাটে। চিয়ার্সের পরপরই একজন মনে করিয়ে দিল, কাল বাদে পরশু শনিবার থেকেই কিন্তু শুরু হয়ে যাচ্ছে মাহে রমজান।

একমাসব্যাপী সুকঠিন সংযম করতে হবে এটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই ঘোষনা করলাম ‘আজকে সংযমী মদ্যপানের গুষ্টি কিলাই’! ধূমপান ত্যাগের আগের দিন যেমন অনেকে মাত্রাতিরিক্ত সিগারেট খায়, সেরকম ব্যাপার আর কি। শুরু হয়ে গেল অর্ডারের পর অর্ডার, বিরামহীন! অসংলগ্ন, মাতাল অবস্থায় বার থেকে বের হয়ে এক গিটারিস্ট বন্ধুর বাসার সামনে খোলা বাতাসে অনেকক্ষন ধরে চললো আড্ডা-গান, সাথে পাঁড় মাতলামী! কয়েকজন এরই মধ্যে বাসায় চলে যাচ্ছে; তবে আমি ইচ্ছে করেই খানিকটা দেরী করছি। প্রথমত এখনো গাড়ী চালানোর মত সুস্থ অবস্থায় আসি নাই; দ্বিতীয়ত রাত বারোটা-সাড়ে বারোটার পরে বাসায় যেতে চাই যাতে আব্বা-আম্মার মুখোমুখি পড়তে না হয়! কিন্তু বিধি বাম, কোন আযান না দিয়ে হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল দুনিয়া ওলট-পালট করা বমি! অসম্ভব শরীর খারাপ করলো, প্রচন্ড অসুস্থ বোধ করছি, চোখে সবকিছুই কেমন অন্ধকার ঠেকছে! আমার এহেন অবস্থা দেখে গাড়ীসহ ডেকে আনা হলো সুস্থ এক জুনিয়র বন্ধুকে। ধরাধরি করে আমাকে তোলা হলো তার গাড়ীতে, আর আমারটা রেখে দেওয়া হলো গিটারিস্ট বন্ধুর বাসায়। গাড়ীর সিটে যখন বসছি তখন আমার চেতনা বলতে গেলে প্রায়-শূন্য অবস্থায়, এবং হেলান দেয়া মাত্রই এলিয়ে পড়ে যাবো ঘুমে, ঠিক তখনি বেজে উঠলো ফোন।

অনেক কসরত করে ফোন বের করে দেখি প্রিয় মা-জননী! সময়টা স্পষ্ট মনে আছে - রাত ১১টা বেজে ৫০ মিনিট। আমার এহেন দূরবস্থায় ফোনটা না ধরাই উত্তম ছিল, তারপরও সিটে হেলান দেয়ার ঠিক আগমুহুর্তে কোনরকমে উচ্চারন করতে পারলাম ‘হ্যালো’; এবং সাথে সাথেই হারিয়ে গেলাম ঘুমের অতল গভীরে! মনে হলো মুহুর্তখানেক বাদেই বন্ধুটি ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাংগালো; ক্ষেপে গিয়ে ঝাড়ি মারতে যাবো, সে হেসে বললো ‘ভাই, আপনার বাসায় পৌঁছে গেছি’। কঠঠিন অবস্থা দেখা যাচ্ছে, এক মুহুর্তের ঘুমেই চলে এলাম বাসায়! কিছুটা সুস্থবোধ করছি, তথাপি বাসায় ঢুকে আর দেরি না করে চুপচাপ হারিয়ে গেলাম ঘুমের গহীন রাজ্যে। ভোর ছয়টার সময় সারা শরীর কাঁপুনি দিয়ে ভয়াবহ এক কান্নার স্রোতে ঘুম ভেঙ্গে গেল! কি হলো ঠিক বুঝতে পারছি না, চেতনা কেমন যেন দ্বিধাগ্রস্ত - অবচেতন অংশ ডুকরে ডুকরে কাঁদছে, অপরদিকে অর্ধ-সচেতন অংশ সেই কান্না দেখে হতবিহবল! সম্পূর্ন সচেতনতা ফিরে পাওয়া মাত্রই যেন পুনরায় দৃশ্যায়িত হল স্বপ্নটি - আর শুনতে পাচ্ছি আম্মার কন্ঠঃ ‘অ্যাই শুনছিস, হুমায়ুন আহমেদ একটু আগে মারা গেছে’! সটান করে বসে পড়লাম বিছানায়। অর্ধ-মাতাল অবস্থা, কিন্তু চেতনা সম্পূর্ন জাগ্রত! কি শুনলাম এটা? স্বপ্নটা যেন মিথ্যা হয় -পরম করুনাময়ের কাছে এই প্রার্থনা করতে করতে 'অন' করলাম কম্পিউটার।

মাতালের প্রার্থনায় কাজ হলো না, আমাকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে সর্বত্র জ্বলজ্বল করছে কেবল একটাই স্ট্যাটাস - RIP হুমায়ুন আহমেদ!’’ জুলাই ২৩, ২০১২ মঙ্গলবার ‘‘প্রিয় মানুষটিকে আজকে সমাহিত করা হলো। সেদিন ভোরে সেই যে ঘুম থেকে ডুকরে উঠেছিলাম, সে শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারি নাই; বরং শোকের মাত্রা বেড়ে গেছে আরো কয়েকগুন! অবশ্য এই মাত্রা কমানো কোন ব্যাপারই ছিল না - এ কয়টি দিন টিভি-মিডিয়ার টকশো, সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী রিপোর্ট, ব্লগে আর ফেসবুকে শাওন-নোভা-শীলা-নুহাশ-গুলতেকিন চর্চা, নুহাশপল্লী-কবরস্থান বিতর্ক ইত্যাদি বিষয়ে এত মুখরোচক গল্প ছিল যে, সেগুলোর প্রচন্ডতায় মৃত্যুশোকের আরো দূরে গিয়ে মরার কথা! তবে দূর্ভাগ্যই বলতে হবে আমার, কেননা এইসব গসিপ বা গোয়েন্দাগিরি কোনটাই আমাকে টানে নাই। আমাকে বরং টেনেছে আমার শেলফের দুই তাক ভর্তি তাঁর অপূর্ব সৃষ্টিসমূহ, যেগুলোর মাধ্যমে শৈশবেই পরিচয় হয়েছিল এই মহান ঔপন্যাসিকের সাথে। সেদিন ভোর থেকে তাই শুধু পাতা উল্টেই যাচ্ছি। মাঝে মাঝেই অতি পরিচিত কোন দৃশ্য অথবা মজাদার কোন ডায়লগ চোখে পড়লে থমকে দাঁড়াচ্ছি।

এতগুলো বছর এই দৃশ্যগুলো কতই না আনন্দ দিয়ে গেছে, অথচ আজ সেগুলো থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে কেবলই বেদনার রশ্মি! যে ডায়লগ পড়ে আগে হাসতে হাসতে মারা যাওয়ার দশা হতো, আজ সেটা দিচ্ছে শুধুই কান্না! যতই পাতা উল্টাচ্ছি, আমার শোকের মাত্রা তত বেড়েই চলেছে। কবে যে এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারবো! ............আচ্ছা, টিভির সামনে বসে নাইটশো বা এক্সক্লুসিভ রিপোর্টগুলিতে শীলা-শাওন-নোভাদের কান্না দেখার কোন প্রয়োজন আছে কি? হুমায়ুন আহমেদের মাধ্যমে আমি তো কোন শীলা-শাওন-নুহাশদের চিনি নাই; আমি যদি কাউকে চিনে থাকি তবে তারা হচ্ছে মিসির আলী, শুভ্র এবং হিমু! পাতা উল্টালেই চোখের সামনে শুধু দেখতে পাচ্ছি - দু'হাতে মুখ ঢেকে অঝোর ধারায় কান্না করছে হিমু, অথবা বিমর্ষ চিত্তে বারবার চশমার কাঁচ পরিষ্কার করছে শুভ্র, অথবা ইজিচেয়ারে বসে আকাশপানে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মিসির আলী! হায় ঈশ্বর, মিসির আলীর চোখেও দেখতে পাচ্ছি অশ্রুকনা! ওরা সবাই কাঁদছে, সাথে আমাকেও কাঁদাচ্ছে। হুমায়ুন আহমেদ চলে গেছেন না-ফেরার দেশে, ওদেরও সময় চলে এসেছে চিরপ্রস্থানের। আরে, ওই তো দেখতে পাচ্ছি হলুদ পাঞ্জাবী পড়া হিমুকে - খালি পায়ে এতিমের মত সে হেঁটে ফিরে যাচ্ছে অচিনপুরের উদ্দেশ্যে! ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে তার অপসৃয়মান অবয়ব......ক্রমশঃ যা বিন্দুতে পরিনত হচ্ছে!’’ --------------------------------------------------------------------- ----------------------------------- হুমায়ুন আহমেদের প্রকৃ্ত ভক্ত তারাই, উনাকে কোথায় সমাহিত করা হবে সেটা নিয়ে যারা চিন্তিত নয়! হুমায়ুন আহমেদের প্রকৃত ভক্ত তারাই, যারা শাওন-শীলা-নোভাদের কান্না দেখার প্রয়োজন বোধ করে না, বরং হিমু-মিসির আলী-শুভ্রদের অব্যক্ত কান্না উপলব্ধি করে! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।