Miles to go before I sleep..... ০১।
ঔদ্ধত্য আর নীতিহীনতা নাকি একসাথে যায় না, উদ্ধত মানুষ তার ঔদ্ধত্বের জন্যই নাকি নীচে নামতে পারে না, নিজের সম্পর্কে তার অতিমাত্রায় উচ্চধারণা থাকে, তাই নীতিস্খলন হতে গেলে তার সেল্ফ-রেস্পেট বা ইগোতে লাগে অথবা লোকে কি বলবে সেটা সম্পর্কে সে অতমাত্রায় সচেতন হয়। বিনয়ী মানুষই সুবিধাবদী হয়। বলেছিলেন ডঃ আহমদ শরীফ। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণেও ব্যাপারটা অনেকাংশে সত্য।
সবচেয়ে বড় ব্যতিক্রম চোখে পড়েছে ডঃ হুমায়ুন আজাদকে। এই লোকের মত এত উদ্ধত লোক খুব কমই ছিল/আছে, কিন্তু চুরি করে সাহিত্যকর্ম করতে তার তেমন বেগ পেতে হয়নি। একজীবনে যা লিখেছেন তার অর্ধেকই চুরি-চামারি করা, তখন তাঁর ঔদ্ধত্য তাঁকে বাঁধা দেয়নি কেন? উনি কি মনে করেছিলেন তাঁর চুরি সম্পর্কে কেউ কোনদিন জানবেনা? সেজন্যই কি উদ্ধত হওয়া স্বত্ত্বেও চুরি করতে তেমন তাঁর মানসিক যন্ত্রণা হয়নি?
০২ক।
আমরা যখন কোন বিখ্যাত মানুষকে (গায়ক, লেখক, কবি) পছন্দ করি তখন তার সবটুকুই পছন্দ করি, তার ব্যক্তিগত এবং লেখক/কবি/সাহিত্যিক জীবন ইত্যাদি সত্ত্বাকে আলাদা করিনা। তার ব্যক্তিগত জীবনও আমাদের কাছে পাবলিক প্রপার্টী হয়ে যায়।
এবং আমরা তার ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়েও অনেক সময় মুগ্ধ হয়, তার স্ত্রী-পুত্র-কণ্যার ফিলিংস, তার বন্ধু-বান্ধব, তার লাইকস-ডিসলাইকস সবকিছুই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ন মনে হয়। তারপরে একসময় বের হয় যাকে দেবদূত ভেবেছিলাম সে আসলে দেবদূত না, তার ব্যক্তিগত জীবন অত নিষ্কলুষ না। বাঙালিরা সাধারণতা মানুষকে ফেরেশতা এবং শয়তান এই দুই ক্যাটাগরীতে ভাগ করে, তার কাছে ভাল-খারাপের মিশ্রণে স্বাভাবিক মানুষের আবেদন কম। হয় হিরো না হয় ভিলেইন, এই হচ্ছে মোটাদাগে ভাগ। তবে যখন যে ব্যক্তিকে অসম্ভব পছন্দ করা হল, লেখক, গায়ক, কবি বা অন্যকোন সুকুমার বৃত্তির সাথে জড়িত কাউকে, কিন্তু পরে দেখা গেল তার ব্যক্তিগত জীবন অত নিষ্কলুষ না, হয়ত সে তার স্ত্রী ছেড়ে পরস্ত্রীর দিকে তাকাল বা তার বিয়ে ভেঙ্গে গেল, বা তার অন্য কোন অধঃপতন হল।
শুরুতে খুবই হতাশ হয় আমরা, এমন একজন লোক কিভাবে এরকম কিছু করতে পারল সেটা ভেবে মনঃক্ষুন্ন হয়, তার সাহিত্য, বই বা গান উপভোগ করবনা আর কোনদিন সেরকম শপথ নিই। তবে আস্তে আস্তে আমরা সেই ক্ষোভ কাটিয়ে উঠি, তাকে সম্পূ্র্ণভাবে হয়ত ক্ষমা করতে পারিনা, কিন্তু অনেকাংশে ক্ষমা করে দই। এ পর্যায়ে এসে আমরা তার ব্যক্তিগত আর শিল্পীগত জীবনকে পৃথক করি, তাকে দুটা স্বত্ত্বা দিই। তার ব্যক্তিস্বত্তাকে তার শিল্পীস্বত্ত্বা থেকে পৃথক করি, ভেবে নিই শুধু তার শিল্পী স্বত্ত্বাকেই আমরা পছন্দ করব, তার ব্যক্তি স্বত্ত্বা নিয়ে ভাববনা। এটা একটা র্যাশনালাইজেশান।
তবে এই র্যাশনালাইজেশান আমাদের জীবনকে সহজ করে। জীবনকে সহজ করার জন্য এই র্যাশনালাইজেশানের দরকার আছে। হুমায়ুন আহমেদের ভক্তরা এই শ্রেণীর।
০২খ।
কিন্তু দেখা যায় অনেক সময় সেই বিখ্যাত লেখক, গায়ক, কবি বা সুকুমারবৃত্তির অনুশীলনকারী ব্যক্তি তার শিল্পকর্মেই অসততার আশ্রয় নিয়েছে।
তখন অনেক বড় শক খেতে হয়। তখন তার ভক্তদের দুইটা শ্রেণী বের হয়, একপক্ষকে বলা যায় ব্রুটালো অনেস্ট। এদের পাপপূণ্য মাপার বা ভালমন্দ মাপার নিক্তি খুবই কড়া, এরা নিজেদেরকে যেমন সর্বোচ্চ প্রফেশনাল মান দ্বারা বিচার করবে তেমনি তাদের প্রিয়জনদেরকেও, তাই তার সেই প্রিয় লেখক/কবি/সাহিত্যিকের অধঃপতন দেখে সে সেই লোকেরই গোষ্টী উদ্ধার করতে লেগে যায়। আগে যতটুকু আবেগ নিয়ে যে তাকে পছন্দ করত ঠিক ততটুকু আবেগ নিয়ে সে তাকে অপছন্দ করে এবং অন্যরাও যাতে তাকে অপছন্দ করে সেজন্য সবাইকেই তার কাহিনী বলে বেড়ায়, অন্যেরা কেন তবুও এই লোককে পছন্দ করে সেটা তার মাথায় ঢুকেনা। "এই লোকে অসৎ, তাকে কেন পছন্দ করবা বা কেন তাকে গালি দিবানা" - অন্যদের এই মনোভাব সে বুঝতে পারেনা, চারপাশের মানুষদেরকেই তার ভন্ড মনে হয়।
কাছের এরকম অনেক এক্সাম্পল দেয়া যায়, তবে দূরের এক্সাম্পলই দিব। এরকম একজন লোকের উদাহরন হবে ক্রিস্টফার হিচেনস।
অন্য আরেক শ্রেনীর ভক্ত আছে যারা তার প্রিয় লোকের অসততার কথা জানতে পেরেও তার অন্য কোন হায়ার অবজেকটিভের দোহায় দিয়ে তাকে শ্রদ্ধা করে যাবে, তার অসততাকে দেখবেনা, বা দেখলেও সেটাকে গুরুত্ব দিবেনা। তাদের কাছে সেই হায়ার অবজেকটিভের জন্য যদি কেউ অসৎ হয়, তাতেও আপত্তি নেই। যেমন হুমায়ুন আজাদের ভক্তরা অনেকেই নিজেদেরকে সততার নিক্তিতে উপরের দিকে রাখলেও হুমায়ুন আজাদ চোর ছিলেন সেটা শুনে প্রথমে একটু মনঃক্ষুন্ন হবেন।
কিন্তু পরে র্যাশানালাইজ করবেন এই ভেবে যে তার আরো অনেক গুরুত্বপূর্ন অবদান আছে, তিনি মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন সারাজীবন, লাল নীল দীপাবলী লিখেছেন, তাই তিনি সাহিত্যকর্মে চুরি করলেও আরো হায়ার অবজেকটিভ "মৌলবাদিদের বিরুদ্ধে লড়া" সেটা করে গিয়েছেন, তাই তাঁর চুরিকে ক্ষমাদৃষ্টিতে দেখা যায়! তারা সমানে এই চোরের প্রবচন, যেসবে সে বাঙ্গালি সমাজকে/মানুষকে সততার নসিহত করেছেন, সেসব প্রবচন সমানে সবাইকে বলে বেড়াবেন। নরমান ফিংকলস্টাইন আর এলান দারশোয়িজের মাঝেও এরকম কাহিনী ঘটেছল। দারশোয়িজ চুরি করে বই লিখেছিলেন, ফিংকলস্টাইন সেটা ধরে দিলেন। দারশোয়িজ এরপরে ফিংকলস্টাইনের জীবনকে দোজক বানিয়ে ছাড়ল, তার ওয়েবসাইটে ফিংকলস্টাইনের নামে মিথ্যা ছড়াল, হার্ভার্ডের ওয়েবসাইটে আরেকজনের নামে এভাবে মিথ্যা বলাতে ফিংকলস্টাইন রিপোর্ট করলে ডীন মনে করল দারশোয়িজ ইসরাইলের পক্ষের লোক, নামকরা জায়নিস্ট, ফিংকলস্টাইন ফিলিস্তিন-পন্থী। তাই ইসরাইলের এবং জায়নিজমের স্বার্থের জন্য দারশোয়িজের চুরি এবং মিথ্যাকে তেমন আমলে নিলেন না, কারন তাদের কাছে হায়ার অবজেকটিভ হচ্ছে ইজরায়েলের স্বার্থ, সেটা রক্ষা করতে গিয়ে যদি নীতিহীন হতে হয় তাও সই, কেননা হায়ার অবজেকটিভ তো অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ!
পূনশ্চ১: আমি নিজেও হুমায়ুন আহমেদের ব্যক্তিগত আর সাহিত্যিক স্বত্ত্বাকে আলাদা করে তার সাহিত্যিক স্বত্ত্বাকেই পছন্দ করা শুরু করেছি যখন তিনি গুলতেকিনকে ডিভোর্স দিয়ে শাওনকে বিয়ে করলেন।
এর আগে তার ব্যক্তিসত্ত্বাকেও সমানভাবে পছন্দ করতাম।
হুমায়ুন আজাদকে আমি খুবই পছন্দ করতাম, তার নামে ব্লগে আমার পোস্টও ছিল! তারপর একদিন তার চুরির কথা জানতে পারলাম, বিশ্বাস হতে চাইলনা! অধ্যাপক মৃণালকান্তির সাথে যোগাযোগ করলাম, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে ফোন করলাম, জানলাম আসলেই আজাদ বিরাট চোর। তারপর থেকে তাকে যতটুকু পছন্দ করতাম তার থেকেও বেশি পরিমান ঘৃণা জমা হতে লাগল!
একই মানুষ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন টাইপ হতে পারে। তবে হুমায়ুন আহমেদকে মাফ করেছি কারন তিনি বড় রকমের অসততা দেখান নি, অন্তত আমার মনে হয়নি, আজাদ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অসততাগুলোর মধ্যে অন্যতম বড় অসততা দেখিয়েছন - লেখাচুরি!
আমার টাইপ তো বললাম, আপনার টাইপ কি?
পূনশ্চ২: একটানে টাইপ করেছি, বানান ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আছে, বাক্যগঠনেও হয়ত তেমন পারদর্শিতার পরিচয় দিইনি, কিন্তু আবার সম্পূর্ন পড়ে এডিট করার ইচ্ছে হচ্ছে না।
পূনশ্চ৩: আগে একবার হুমায়ুন আজাদের চুরি-চামারি নিয়ে পোস্ট দিছিলাম, সেটা কর্তৃপক্ষ ডিলিট করেছিল আর আমাকে জেনারেল করেছিল।
এইটাও হয়ত ডিলিট করবে। করুক গে! আমার কী?! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।