আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।
ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার যদুনন্দী ইউনিয়নের বড় খাড়দিয়া গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ তার এলাকায় পরিচিত “খাড়দিয়ার বাচ্চু” নামে।
একাত্তরে ‘বাচ্চু রাজাকার’ নামে পরিচিত ফরিদপুরের আবুল কালাম আজাদকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাই ডরে পালীয়ে গেল পালিয়ে গেলেন বাচ্চু রাজাকার ।
একাত্তর সালে আবুল কালাম আজাদ জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
তবে স্বাধীনতার পর তিনি জামায়াতে যোগ দেন। আশির দশকের শেষ দিকে তিনি জামায়াতের সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে মসজিদ মিশন গঠন করেন। তিনি কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করলেও মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তার কর্মকাণ্ড প্রকাশ হয়ে পড়লে সেখান থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। বর্তমানে গদাম খেয়ে রাজনীতি ও সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে একদম নিশ্চুপ।
ফরিদপুরের বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিত আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানে সুনির্দিষ্ট ১৪ ব্যক্তিসহ অসংখ্য মানুষকে হত্যা, ৩ জনসহ অসংখ্য নারী ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগি্নসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা।
পলাতক বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের কাছে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। গতকাল বেইলি রোডে তদন্ত সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান। এ সময় তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক, তদন্ত কর্মকর্তা নুর হোসেন ও প্রসিকিউটর সাইদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। বাচ্চু রাজাকার অসংখ্য নিরীহ মানুষকে নিজ হাতে হত্যা করার প্রমাণ মিলেছে।
তদন্ত সংস্থার আবেদনে বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-২ আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে গত ৩ এপ্রিল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
এর পর ওই দিনই রাজধানীর উত্তরা এবং উত্তরখানে বাচ্চু রাজাকারের দুটি বাড়িতে 'অভিযান' চালিয়ে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি ভোরে উত্তরখানের আজাদ ভবনের বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। প্রেস ব্রিফিংয়ে তদন্ত
সংস্থার দাবি, বাচ্চু রাজাকার পালিয়ে নেপাল হয়ে এখন পাকিস্তানে অবস্থান করছেন। তাকে ধরার জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা (রেড অ্যালার্ট) জারি করা হবে। এ জন্য ট্রাইব্যুনালে শিগগিরই আবেদন করা হবে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে সানাউল হক বলেন, একাত্তর সালে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতন, অগি্নসংযোগ, লুণ্ঠন, দেশান্তর ও ধর্মান্তরিতকরণসহ ১০টি ঘটনার অপরাধসংশ্লিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। তদন্ত শেষে ৫৯ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদনসহ মোট ৩৮৪ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুর সদর, নগরকান্দা, সালথা, বোয়ালমারী থানাসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সঙ্গেও আবুল কালাম আজাদ মানবতাবিরোধী অপরাধ কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। সানাউল হক বলেন, বাচ্চু রাজাকার ফরিদপুর শহরে একটি হিন্দু বাড়ি (মাড়োয়ারি বাড়ি) দখল করে সেখানে নির্যাতন কেন্দ্র স্থাপন করেন।
ফরিদপুরে তার শ্বশুর চাঁন গাজী রাজাকারের হাত ধরে রাজাকার বাহিনীর অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন বাচ্চু রাজাকার।
তিনি বলেন, বাচ্চু রাজাকার অন্যতম নৃশংস হত্যাকারী ও ধর্ষণকারী। তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট জোরালো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র থাকাকালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। এ সুবাদে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
ফরিদপুর স্টেডিয়াম ও সার্কিট হাউসের নির্যাতন কেন্দ্রে মুজাহিদের সঙ্গে দেখা গেছে বাচ্চু রাজাকারকে। তার ভয়ে দেশান্তরিত হন ফরিদপুরের অসংখ্য মানুষ। তিনি বলেন, বাচ্চু রাজাকার ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে বিচার মোকাবেলা করলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম। কিন্তু তিনি পলাতক থাকায় তার অনুপস্থিতিতেই আইন অনুযায়ী বিচার কাজ পরিচালিত হবে।
প্রধান সমন্বয়ক হান্নান খান বলেন, ফরিদপুর শহরে ১২শ' বধ্যভূমিতে যে হাজার হাজার মানুষ শায়িত আছেন, তাদের হত্যার নির্দেশদাতা এবং নিজেও সরাসরি হত্যাকারী আবুল কালাম আজাদ।
তিনি নিজে গুলি করে অসংখ্য নিরীহ ও স্বাধীনতাকামী মানুষকে হত্যা করেছেন। ফরিদপুর স্টেডিয়াম ছিল তাদের মূল নির্যাতন কেন্দ্র। হত্যা করে তারা অসংখ্য মানুষের লাশ ফরিদপুর স্টেডিয়ামে মাটিচাপা দিয়েছেন, নদীতে ফেলে দিয়েছেন, শহরের বিভিন্ন স্থানে মাটিচাপা দিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন স্থান থেকে নিজে লোকজনকে ধরে আনতেন। আবার অন্যদের দিয়েও ধরিয়ে আনতেন।
বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে অর্ধ শতাধিক সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেবেন বলেও জানান তিনি।
বাচ্চু রাজাকার পালিয়ে যাওয়ার দায়ভার কার_ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কারও দায়ভার আছে কি-না তা খতিয়ে দেখবে সরকার। তবে ট্রাইব্যুনাল তাকে গ্রেফতারের জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমরা যতটুকু জানি, এ ব্যর্থতার জন্য কয়েক জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুরে দুটি গণহত্যার সঙ্গে আবুল কালাম আজাদ সরাসরি জড়িত।
এর মধ্যে ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল ফরিদপুর শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রথম প্রবেশ করে। সেদিনই ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট এলাকার জগদ্বন্ধু আশ্রমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে হামলা চালিয়ে ৮ ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন বাচ্চু রাজাকার। ফরিদপুর পুলিশ লাইনে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। ফরিদপুর শহরের জসীম উদ্দীন রোডে রাজাকার ক্যাম্প ও নির্যাতন সেল স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া ১৭ মে ফরিদপুরের হাশামদিয়া গ্রাম ও নন্দিয়া বাজারে বাচ্চু রাজাকারের নেতৃত্বে হামলা চালিয়ে ব্যাপক গণহত্যার পর বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
বোয়ালমারী থানার নদীরদিয়া গ্রামে দুই বোনসহ বেশ কয়েকজন নারীকে ধর্ষণের সঙ্গে বাচ্চু রাজাকার জড়িত বলে প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। নির্যাতিত হওয়ার পর ওই দুই নারী দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান।
বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে করা দুটি মামলার নথি থেকে জানা গেছে, ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার দাদপুর ইউনিয়নের নতিবদিয়া গ্রামের শোভা রানী বিশ্বাস একাত্তরে এই রাজাকারের কাছে সম্ভ্রম হারান। একই গ্রামের নগেন বিশ্বাসের স্ত্রী দেবী বিশ্বাসেরও সম্ভ্রমহানি হয় তার বাচ্চুর হাতে। বাচ্চুর রাইফেলের গুলিতে মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন ফরিদপুরের ফুলবাড়িয়ার চিত্তরঞ্জন দাস।
মামলার তদন্ত কাজে ফরিদপুরসহ কলকাতা সফরের বর্ণনা দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা নুর হোসেন বলেন, তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট অনেক জায়গা পরিদর্শন করতে হয়েছে। সেসব জায়গায় বাচ্চু রাজাকারের বিভিন্ন অপরাধের প্রমাণ পেয়েছি। তিনি বলেন, কলকাতায় এমন চারজন সাক্ষী পেয়েছি, যারা একাত্তর সালে বাচ্চু রাজাকারের সংঘটিত অপরাধসহ একই অভিযোগে অভিযুক্ত আরেক জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের করা বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রত্যক্ষদর্শী। মামলার প্রয়োজনে সরকারিভাবে তাদের আনার ব্যবস্থা করা হবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।