বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ জিল্লুর কথাটা শুনতে পেল সকালের দিকে হাটে পৌঁছে । ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট নাকি হইছে নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্রবিলা গেরামের ঘোষবাড়ির জামাই । খবরটা শোনামাত্রই জিল্লুর গোটা শরীরে একটা তীব্র ঝাঁকুনি টের পায়; টের পায় তার সমস্ত শরীর কেমন ঝমঝম করে বেজে চলেছে।
বাপ রে! কয় কী! ভদ্রবিলা গেরামের জামাই ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট হইছে। ভদ্রবিলা গেরামের কোন্ বাড়ির জামাই? যাউক গা। ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট হওন কি মুখের কথা! সাঁতার দিয়া মড়া চিত্রা নদী পাড় হওন? এসব ভাবতেই জিল্লুর শরীর কি রকম চমমন করে ওঠে।
আজ সকাল থেকে জিল্লুর শরীরে চাপা জ্বর ছিল, সেই সঙ্গে খিদেও ছিল পেটে। তবে হাটে পৌঁছে ওই চাঞ্চল্যকর সংবাদটি শোনার পর শরীরের জ্বর-খিদে কই যে পালাল।
শফিকুলের চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসেছিল জিল্লুর। খবরটা সে জানল গোপালপুর প্রাইমারী স্কুলের তরুণ শিক্ষক রফিক মাস্টারের মুখে । সাত গেরামের মানুষ জানে রফিক মাস্টার মিছা কথা বলার মানুষ না।
শ্রাবণ মাস। গতকাল প্রায় সারাদিনই ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি ঝরছিল।
দিনটা আজ ঝরঝরে। সকাল থেকে নড়াইলের আকাশে মেঘটেঘ নেই। চারিদিকে ফটফটে আলো ছড়িয়ে আছে। জিল্লুর চারিদিকে তাকায়। হাট বেশ জমে উঠেছে।
শাকসবজি, ফলমূল উঠেছে ভালোই। সরু রাস্তার দু’পাশে চাটইয়ের ওপর ডাঁই করে রাখা মানকচু, করলা, লাউ, পেঁপে, চিচিংগা, ঢেঁড়শ, বাঙ্গি। জিল্লুর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই সময় ভ্যানটা থাকলে বাঁশগ্রাম বাজার থেকে শাকসবজি ফলমূল ভ্যানে চাপিয়ে আগদিয়া আড়তে পৌঁছে দিয়ে কিছু আয়রুজি করতে পারত সে। সে উপায় নেই।
শফিকুলের চায়ের দোকানে রফিক মাস্টার ছাড়াও ছিল পুব পাড়ার পরাণ পোদ্দার, শিবতলার বৃদ্ধ ছিরু পাল, দরগাবাড়ির বাসেত মিদ্দা। বাসেত মিদ্দার বয়স ঠাওর করা মুশকিল। তবে শরীর খানিটা থলথলে। শ্যামলা গোলপানা তেলতেলে মুখটি দেখলেই বোঝা যায় লোকটা বেজায় ভোজন রসিক।
তো, প্রত্যেকেই আয়েস করে চা খাচ্ছে, বিড়ি টানছে।
তবে রফিক মাস্টার চায়ের নেশা থাকলেও বিড়ির নেশা-টেশা একদম নেই। মাস্টর বড় ভালো মানুষ। সব সময় সাদা রঙের ধবধবে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরেন । গায়ের রং বেশ ফরসা। মাথায় সযতেœ টেরিকাটা চুল।
চোখে কালো ফ্রেমের চারকোনা চশমা। বেশ আর্দশবাদী চেহারা।
সে যাই হোক। জিল্লুরেরও এখন এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু, সমস্যা হল ট্যাঁকে পয়সা নেই তার।
দশ হাজার টাকা ঋন শোধ করার জন্য শেষ পর্যন্ত ভ্যানটা বেচতে হল। টাকার জন্য শামছু চেপে ধরেছিল। সর্ম্পকে শামছু জিল্লুরের বড় শ্যালক। তবে সে মারধোরের হুমকি দিচ্ছিল। বাচ্চাকাচ্চার সামনে অপমানের হাত থেকে বাঁচার জন্যই ভ্যানটা বেচতেই হল।
তারপর থেকে সে বেকার । মাস দুয়েক হল । সংসার অভাবের নদীতে ভাসছে। আজকাল একরকম অনাহারেই থাকতে হচ্ছে। আজও সকলে একরকম না খেয়েই বেরিয়েছে।
তবে বাঁশগ্রাম বাজারে পৌঁছামাত্র ওই শরীরের রক্ত গরম করা তাজা খবরটা শোনামাত্রই জিল্লুর শরীরে তীব্র আনন্দের তরঙ্গ টের পায়। গেরামের এক জামাই ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট হইছে। এ কি সহজ কথা! দেশে নড়াইলের কত ইজ্জত। ইজ্জত এখন আরও বাড়ব। তার নিজের ইজ্জতও কম কী! তারও বাপদাদার ভিটা এই নড়াইলে।
গায়ে জ্বরের জন্যই বুঝি জিল্লুরের শীত করছিল। চিত্রা নদীর দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস আসছিল। জিল্লুর গায়ের ময়লা চাদর জড়িয়ে নিল। বছর তিরিশের ভাঙাচোরা চেহারা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
গাতে গতরে খেটে কোনওমতে টিকে ছিল এতদিন। তবে ওই ভ্যানটা হাতছাড়া হওয়ার পর থেকেই অভাবে সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। ময়নার গঞ্জনা তো আছেই । তো এসব উদ্বেগ উৎকন্ঠা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে মৌজ করে এক চা খেতে ইচ্ছে হল জিল্লুরের। লুঙ্গির ট্যাঁকে বিড়ির প্যাকেটে দু-তিনটে বিড়িও আছে ।
কিন্তু, শফিকুল কি অখন চা বাকিত দিব? মনে হয় না। শফিকুলে ষাইট টাকা পায়। এসব গ্রামাঞ্চলে পঞ্চাশ-ষাট টাকা অনেক টাকা। জিল্লুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যে করেই হোক।
আজ দু' কেজি চাল নিয়ে ফিরতেই হবে। ময়না খিদা সহ্য করতে পারে। কিন্তু, লুকমান আর জরিনার মুখের দিকে চাওয়া যায় না।
জিল্লুর হাটের ভিড়ে উত্তরপাড়ার নুরু মোল্লাকে দেখতে পেল । লাঠিতে ভর দিয়ে এদিকেই আসছে বুড়ো।
বুড়োর সরপড়া ঘন দুধের চায়ের নেশা। দুবেলা শফিকুলে চায়ের দোকানে এসে বসে। বুড়োর পরনে সবুজ চেক লুঙ্গি আর খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি। মাথায় তালপাখার টুপি। বুড়ো গরুর ব্যাপারী।
সহায়-সম্পদ ভালোই। তবে নড়াইলের ইজ্জতের খবরটা এখনও মনে হয় নুরু মোল্লার কানে যায়নি । বুড়োর হাঁটাচলায় কেমন মনমরা ভাব। মাস তিনেক হল নুরু মোল্লার বউ মারা গেছে। মুখখানা সারাদিন ব্যাজার হয়েই থাকে।
নুরু মোল্লা এসে ধীরেসুস্থে লাঠিতে ভর দিয়ে বেঞ্চির ওপর বসল। রফিক মাস্টার সালাম দিয়ে সামান্য সরে বসে। জিল্লুর আতরের হালকা গন্ধ পায়। বুড়ো শফিকুলের দিকে তাকিয়ে খনখনে কন্ঠে বলল, এই, শফিক। আমারে ভালা কইরা চা বানায়া দে।
বলে কাশতে থাকে বুড়ো।
রফিক মাস্টার চায়ে চুমুক দেয়। একটু পর নুরু মোল্লার দিকে তাকিয়ে বলল, চাচা, আইজ বিকালে বল খেলা আছে ।
বল খেলা? কও কি? কোন মাঠে খেলা? নুরু মোল্লা সামান্য ঝুঁকে রফিক মাস্টারের মুখটা দেখল। কাশি সামলে নিয়েছে।
রফিক মাস্টার বলল, খেলা হইব চাচা আমাগো স্কুলের মাঠে । আপনে বেলা চাইরটার মধ্যে আইসা পইড়েন।
বুড়ো মাথা নেড়ে বলে, আসুম। আসুম। তয় কারা খেলব? ঢাকা থেইকা প্লিয়ার আইব নাকি?
পরাণ পোদ্দার মধ্যবয়েসি লোক।
চায়ে বিসকিট ডুবিয়ে খাচ্ছিল। এখন সেই বলল, না গো কাকা। খেলা হইব গেরামের যা গো বিয়া হয় নাই আর যাগো বিয়া হইছে তাগো মইধ্যে।
নুরু মোল্লা বলল, কথাডা ঠিক বুঝতে পারলাম না পরাণ। বুড়ো কে কেমন বিভ্রান্ত দেখাল।
রফিক মাস্টার বলল, আমাগো ভদ্রবিলা গ্রামের এক জামাই ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট হইছে।
কও কী! ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট হইছে। নুরু মোল্লার সাদা পাকা দাড়ি ভরতি মুখে সোনালি আলোর ছটা ঝিলিক মারে । যেন এই মুহূর্তে স্ত্রীবিয়োগের গভীর বিরহ ব্যথা বিস্মৃত হয়েছেন।
হ।
ছিরু পাল মাথা নাড়ে।
ভদ্রবিলা গ্রামের কোন্ বাড়ি?
দরগাবাড়ির বাসেত মিদ্দা বলল, আরে হিন্দুবাড়ি। ঘোষবাড়ি।
নুরু মোল্লা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বলল, কও কি ঘোষবাড়ির মেয়েজামাই ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট হইছে।
রফিক মাষ্টার বলল, হ।
খেলা সেই উপলক্ষ্যেই। কাইল বহুত রাইত পর্যন্ত সাদেক চেয়ারম্যানের কাছারি ঘরে মিটিং করছি। ঠিক হইল আইজ বাদ জুহর গেরামের মসজিদে মসজিদে শুকরিয়া মোনাজাত হইব। মন্দিরে মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা হইব। মিটিংয়ে গোপালপুরের হাজী রহিমে আছিল।
হাজীছাবই বল খেলার তাল তুলছেন। সাদেক চেয়ারম্যানের বেয়াই গফুর মিঞা কইল যে গেরামের যা গো বিয়া হয় নাই আর যাগো বিয়া হইছে তাগো মইধ্যে খেলা হইলে নাকি ভালো হয়। সাদেক চেয়ারম্যানে সমর্থন দিয়া খেলার স্থান ঠিক কইরা দিলেন। মিটিংয়ে আউরিয়ার সোহরাব হোসেনও ছিল।
কোন সোহরাব হোসেন? ঘরজামাই সোহরাব হোসেন?
হ।
হ। তার কথাই বলতেছি। হেই সোহরাবে কইল, আইজ জোহরের অক্তে মিলাদ শরীফ পড়াইয়া এক মন মিষ্টি কিনা বিলাইব।
শেষ কথাটা কট করে জিল্লুরের কানে ঠেকল। নুরু মোল্লা সুড়ৎ শব্দ করে সরপরা দুধের চায়ে চুমুক দিলেই জিহবায় চায়ের তৃষ্ণা লকলকিয়ে ওঠে জিল্লুরের।
তবে শফিকুল তাকে চা সাধল না। এখন যদি আউরিয়ার সোহরাব হোসেনের মিষ্টি পাওয়া যাইত। কিন্তু কোন্ মরজিদে মিলাদ শরীফ পড়াইব সোহরাব?
জিল্লুরের মনের কথাটা বাসেত মিদ্দা জিজ্ঞেস করেই ফেলল- সোহরাবে মিষ্টি বিলাইব কোন্ জায়গায়?
শিবতলার বৃদ্ধ ছিরু পাল বলল, আরে মিষ্টি তো বিলাইব তার শ্বশুরের গেরামে।
কও কী-আমাগো দরগাবাড়িত?
শিবতলার বৃদ্ধ ছিরু পালের অনিদ্রা রোগ আছে। আজকাল মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে।
খ্যানখ্যানে কন্ঠে বলে, আরে আমি কি কইলাম?
নাহ, আইজ আল্লায় কপালে চাইল-ডাইল চা রাখে নাই। অখন যদি সোহরাব-এর মিষ্টি পাওয়া যায়। জিল্লুর উঠে দাঁড়ায়। আড়মোড়া ভাঙে। তারপর হাঁটতে থাকে।
সামান্য ভ্যানচালক বলেই তার উঠে চলে যাওয়া কেউ লক্ষ্য করে না।
হাটের ভিড় এড়িয়ে হাঁটার গতি কমিয়ে জিল্লুর একটা বিড়ি ধরায়। তারপর হাঁটতে-হাঁটতে হাট পেরিয়ে যায়। বাজারের পরে ইট বিছানো রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে খেজুর, ধৈঞ্চা, জিগা আর গাব গাছ।
তারপর জমি ঢালু হয়ে খালে মিশেছে। খালের কালো পানি। ধার ঘেঁষে কচুরিপানা। খালের ওপাশে কাদের শেখের অড়হর ক্ষেত। ক্ষেতের পাশে আইলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সাদেক চেয়ারম্যানের ভাইগ্না নজু।
মোবাইলে কথা বলছে। নজু বড় শ্যালক শামসুর জানের দোস্ত। টাকার জন্য শালার পুতে গ্রাম্য শালিসের সময় জিল্লুরের শার্টের কলার চেপে ধরছিল । সাদেক চেয়ারম্যানের ভাইগ্না বইল্লা কুত্তাটার বড় দেমাক। বাঁইচা থাক তোরা খানকির পুত।
দিন আমারও আল্লায় দিব।
জিল্লুর থুঃ করে থুতু ফেলে। দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটে। দু’পাশে উদলা মাঠ। বাতাস ঠান্ডা।
তবে শীত শীত করছে না। জ্বরডা সাইরা গেল নাকি। মিষ্টি বিলানো শেষ হয়ে গেল কিনা-এই উদ্বেগ মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় তার। তার পাশ দিয়ে বাঁশগ্রামের হালিম ভ্যান চালিয়ে চলে যায়। ভ্যান ভরতি ওলকচু আর আদা।
আগদিয়া আড়তে পৌঁছে দেবে। আহারে ভ্যানডা আমার যদি থাকত ...তয় আইজ। হাঁটতে হাঁটতে পা কিছু ভারী ঠেকল জিল্লুরের । তবে নড়াইলের জামাইয়ের ভারত জয়ের সংবাদ স্মরণ হয়। জিল্লুর ভদ্রবিলা গ্রামের ঘোষবাড়ির মানুষজনরে চিনে।
তার শরীরে আবারও তীব্র শিহরণ বয়ে যায়। সেই চনমনে ভাবটা ফিরে আসে। আল্লায় আইজ হউক কাইল হউক ভ্যান একটা দিবই দিব।
হাতের বাঁয়ে তাল আর সুপারি গাছে ঘেরা পাকুরদিয়ার মাঠ। তার পিছনে শালগাছের জঙ্গল।
ইটভাটা। আকাশে ধোঁওয়া উড়ছে। দূরে চিত্রা নদী। পাকুরদিয়ার মাঠে কাদা আর পানি। তারই মধ্যে নানা বয়েসি দশ/বারো জন ফুটবল খেলছে।
চিরকুমার রহমত মুন্সি কে চিনতে পারল জিল্লুর। ষাট বছরের টাক মাথা বৃদ্ধ বল নিয়ে দৌড়াচ্ছে। মুখে পাকা দাড়ি। রহমত মুন্সির পরনে সবুজ হাফ প্যান্ট আর হলুদ গেঞ্জি । রহমত মুন্সি জমিজমা ভালো বুঝে।
আমিনি করে খায়। জিল্লুর দেখল পালপাড়ার বিনয় সাহা ছোঁ মেরে বৃদ্ধের পা থেকে বল কেড়ে নিল । বিনয় সাহার বয়স তিরিশের মতন । চেহারা নায়করাজ রাজ্জাকের তরুণ বয়েসের মতন। সে অবশ্য বিবাহিত; দুটি বাচ্চা-কাচ্চার বাপ।
তবে শোনা যায় রাধাপুরে তার দ্বিতীয় পক্ষ আছে। বিনয়ের পরনে লাল হাফপ্যান্ট আর সবুজ গেঞ্জি। রহমত মুন্সি পিছন থেকে বিনয়কে চার্জ করতে গিয়ে কাদাপানিতে আছাড় খেয়ে পড়ল।
সামনে একটা কালভার্ট। খুশি মনে কালভার্ট পেরোয় জিল্লুর।
তার পাশ দিয়ে দরগাবাড়ির বাসেত মিদ্দা থলথলে শরীর নিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে যায়। মিষ্টির লোভে। লোকটার জোতজমির ভালোই। তবে আজ জামাইয়ের মিষ্টি না খেলে তার জীবনই বৃথা। কালভার্ট নীচে লিকলিকে জলের স্রোত।
ওদিকে চোখ পড়তেই জিল্লুরের পেচ্ছাব পায়। দ্রুত ঢাল বেয়ে নেমে উবু হয়ে বসে পেচ্ছাব করে। সামনেই চৈত্যার মার খাল। খালের ওপারে আমানালির কচুশাকের ক্ষেত। ক্ষেতে হানিফা বুড়ি ঝুঁকে কী যেন টোকাচ্ছে।
বুড়ির বেশ বয়েস। ব্লাউজহীন অগোছালো আঁচলের ফাঁকে হানিফার চুপসে যাওয়া মাই দুখানি চোখে পড়তেই জিল্লুরের তলপেট শিরশির করে ওঠে। অভাবের সংসারে আজকাল ময়নাকে তেমন করে আদর-সোহাগ করা হয় না। ময়নাও ভাতকাপড়ের চিন্তায় সাড়া দেয়না। জিল্লুর শরীরও মরে গেছে।
মরা শরীর আজ জেগে উঠল ...
দরগাবাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা হল। এক কালে পুরনো গড় ছিল বলে দরগাবাড়ির মাটি বেশ উঁচু । কালিবাড়ির উলটো দিকে শালজঙ্গল আর ছাড়া ছাড়া ঘরবাড়ি। দোকানপাট। গাছপালা।
কালিবাড়ি পেরিয়ে গেলে বল্লাল সেনের দিঘী। বিশাল দিঘীটির পাড় ঘেঁষে সারি সারি তালগাছ, কদবেল, চালতা আর কাউফলে গাছ । দরগাবাড়ি তে রয়েছে এই অঞ্চলের সবচে পুরনো মাজারটি। লোকে বলে শাহ পীরের মাজার। তবে মাজারটির মূল কাঠামোটি অনেক দিন আগেই ভেঙে পড়েছে; মাজারটি দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত।
মাজারের সামনে শুকনো পাতা আর কচুরি পানা ভরতি একটি মজা পুকুর। দরগাবাড়ি মসজিদটি ওই পরিত্যক্ত মাজারের কাছেই।
জিল্লুর দূর থেকে লোকজনের ভিড় দেখল পেল। ভিড়টা ঠিক দরগাবাড়ির মসজিদের উলটো দিকের জাম্বুরা গাছের তলায়। আরও কাছে এসে ভিড়ের মধ্যে আউরিয়ার সোহরাব হোসেন কে দেখতে পেল।
বেশ ফরসা আর লম্বা চেহারা সোহরাব হোসেনর ঘিয়ে রঙের বাহারি সিল্কের পাঞ্জাবি পরে ছিল। মাথায় রঙিন টুপি। সোহরাবের পাশে একটা ভ্যানগাড়ি। ভ্যানগাড়ি ঘিরে ধীরে ধীরে ভিড়টা বাড়ছে।
চোখে পড়তেই হাত তুলে সোহরাব জিল্লুরকে ডাকে ।
ঠেলেঠুলে কাছে যেতেই দেখল ভ্যানগাড়ির ওপর বড় বড় দু-তিনটি বাঁশের ঝুড়ি ভর্তি ঠোঙা।
সোহরাব জিজ্ঞেস করে, শুনছোস নি জিল্লু - নড়াইলে কি কামডা হইছে?
হ। শুনছি। জিল্লুর মাথা নাড়ে।
জিল্লুরকে মিষ্টির একটা ঠোঙা দিয়ে সোহরাব বলে, ল রে জিল্লু।
মিষ্টি খা। আমাগো জামাইয়ের লাইগা দোয়া করিস।
জিল্লুর ঠোঙা নেয়। তবে সোহরাব মাত্র একটা ঠোঙা দিল বলে ব্যাজার হয়। হায় রে মানুষ! তর কিছু মনে রাখে না।
কত তাড়াতাড়ি ভুইলা যায়। সোহরাব গত বছর শ্বশুরের পয়সায় বাঁশগ্রাম বাজারে ওয়ালটনের একটা শোরুম দিয়েছিল। টাকার টানাটানি চলছিল। তখন ফ্রি টিপ দিয়েছিল জিল্লুর। আরেক ঠোঙার জন্য আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষ করে জিল্লুর ।
না পেয়ে বাড়ির পথ ধরে।
জিল্লুরের ছনে ছাওয়া মাটির ঘরটি বেশ নড়বরে। কবে উড়া বাঁশের খুঁটিতে ঘুন ধরেছে। ঝড়ো বাতাসে ঘরের হাড্ডিগুড্ডি কেমন মড়মড় করে ওঠে। নতুন ঘর তোলার জন্য বায়না ধরেছে ময়না ।
আমার বউডা হইল আস্তা অবুজ। ভাত খাইতে পায় না আবার সালন-সালন করে।
ঘরের পিছনে একটি বিশাল রেন্ডি কড়াই গাছ পূর্বপুরুষের স্মৃতিস্বরূপ আজও দাঁড়িয়ে আছে। তা জিল্লুরের পূর্বপুরুষের সুখেশান্তিই ছিল। জিল্লুরের দাদাজানের ইউসুফগঞ্জে মোকাম ছিল।
তাঁতের কাপড় বিক্রি করে ভালোই আয়রুজি করছিলেন। এইসবই স্বাধীনের আগে কথা। সে সময় একবার বাঁশগ্রামে মাওলানা ভাসানী আইছিলেন। দাদাজান মাওলানা ভাসানিরে নাকি চৌদ্দ পদ দিয়া মেহমানদারী করছিলেন। মাওলানা ছাহেব বংশধরদের জন্য অনেক দোওয়া করে গেছেন।
এসব কথা সত্য কি মিথ্যা - জিল্লুর জানে না । বাপের মুখে শুনেছে জিল্লুর । বাপের ছিল মদের নেশা। ঘটি-বাটি বেচতে বেচতে মরণের দেশে চইলা গেল বাপ। তা না হইলে ভিটে মাটিও বেচতে হইত।
ময়না কে উঠানে দেখল না জিল্লুর। সিদে পাকের ঘরে ঢুকে পড়ল সে। পাকের ঘরটা বেশ বড়। মাটির মেঝে, মাটির চুলা। একপাশে ঢেঁকি আর অন্যপাশে বেড়ার সঙ্গে খাড়া করে রাখা পাঠখড়ি।
ভাঙা বেড়ার ফাঁকে রোদ এসে পড়েছে। চুলার পাশে চাল থেকে দু-তিনটে শিকা ঝুলে আছে।
ময়না পিঁড়ির ওপর বসে আছে। সামনে বঁটি । পাশে একটি কুলা।
কুলার ওপর শুকিয়ে চিমসে হয়ে ওঠা এক টুকরা ওলকচু আর চালকুমড়ার ফালি।
সোয়ামির হাতে পলিথিন ব্যাগ না দেকে ময়না খেঁকিয়ে ওঠে, খালি হাতে আইলা ক্যান ? গাঙ্গে ঝাঁপ দিতে পার নাই?
না। খালি হাতে আসি নাই। মিষ্টি আনছি খাও। বলে হাসতে হাসতে ঠোঙ্গা বাড়িতে দিয়ে ময়নার সামনে পিঁড়ির ওপর বসল জিল্লুর।
লুকমান আর জরিনা পাকের ঘরের পাশে খেলছিল। ভাঙা বেড়ার ফাঁকে ওরা বাপের হাতে ঠোঙা ঠিকই দেখেছিল। লুকমান ছুটে এসে পাকের ঘরে ঢুকে বাপের হাত থেকে ছোঁ মেরে মিষ্টির ঠোঙাটা নিয়েই আবার পাকের ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।
ময়নার মুখ কালো হয়ে উঠল। মুহূর্তের জন্যই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝুঁকে কুলার ওপর থেকে ওলকচু তুলে নিয়ে নরম সুরে বলল, কিয়ের মিষ্টি?
জিল্লুর বিড়ির প্যাকেট বার করে। বিড়ি বের করতে করতে বলে, আরে আমাগো গেরামের এক জামাই ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট হইছে।
কথাটা মুনে ময়না কেঁপে উঠল। মুখ থেকে অস্ফুট স্বর বের হয়- কও কী! আমাগো গেরামের জামাই ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট হইছে!
আয়াস করে জিল্লুর ধোঁওয়া ছেড়ে বলল, হ। হেই খবর না পাইয়া গেরামের মানুষ ফূর্তি-ফার্তা শুরু করছে।
আইজ বিকালে স্কুলের মাঠে বল খেলা হইব। হিন্দুরা মন্দিরে পুজা দিতাতে, মরজিদে দুয়া-মাহফিল হইছে, মিলাদ শরীফ পড়াইছে। আউরিয়ার সোহরাব হোসেনও মরজিদে মিলাদ শরীফ পড়াইছে।
ময়নার শুকনো মুখ। ছোট্ট নাকে পিতলের নথ।
বেড়ার ফাঁকে রোদ পড়ে ঝিকিয়ে উঠছিল। জিজ্ঞেস করে, ঘরজামাই সোহরাব হোসেন?
হ। সোহরাব হোসেনে দরগাপাড়ায় মরজিদের সামনে খাড়াইয়া মিলাদ শরীফের মিষ্টি বিলাতেছে। মিষ্টি তোমার কপালে নাই গো বউ, খাইতে পারলা না ...
আজ চাল-ডাল জোগাড় করতে না পারায় ময়না তার সোয়ামির ওপর ঝাঁঝিয়ে উঠবে কিনা ভাবল। তবে গেরামের এক জামাইয়ের সৌভাগ্যের কথা মনে পড়ে গেল।
কিছু না বলে ফালি ফালি করে ওলকচু কাটতে লাগল ময়না।
জিল্লুর এই মুহূর্তে শান্তি পায়।
তথ্যসূত্র:
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।