বিচ্যুত যৌবনে জোছনা আমায় করেছে উম্মাদ ১.
প্রতিদিনই কথা হয় তার সংগে। ফোনতো করেই তার পরেও অনলাইনে ভিডিও চ্যাটিংও হয় সপ্তাহে কম করে হলেও দুএকবার। কাজের সময়টুকু বাদ দিলে চিন্তার সবটুকুন জুড়ে থাকে সে। আর সত্যি কথা হচ্ছে কাজের সময়েও সে ভূলে যায় না তাকে। তাকে যে সত্যিই ভালোবাসে সে।
তার জন্য মন কাঁদে, তার থেকে দূরে থাকা বিষন্ন এ মন কিছুতেই ভালো নেই।
ফাতিমা, এ এক ধ্রুপদি নাম। যদিও আজকাল এ ধরনের নামের খুব একটা প্রচলন নেই বাংলাদেশে। তবুও নাহিয়ান ভাবে ফাতিমা আর আমিনা এই দুটি নামেরই বোধ হয় এক কালে এই উপমহাদেশে মানুষের নামকরনে সবচেয়ে বেশী প্রভাব ছিলো। সে ভাবে আহা ফাতিমা কি অসাধারন মনোমুগ্ধকর এক নাম।
নাহিয়ান কবি মানুষ, কিন্তু আজকাল কবিতায় পেট ভরেনা, তাই পেটের জ্বালায় সে দূর দেশে পরবাসী। সাত সাগর আর তেরো নদীর ওপারে এসেছে পরাশুনা করবে বলে। কিন্তু জীবনের তাগদায় পড়াশুনার পাশাপাশি কাজ করতে গিয়ে আজ প=ড়ায় লেজে গোবরে হয়ে গেছে তার জিবন। এই প্রবাস জীবনে যখন সূর্য উঠার সময় বাসের জন্য অপেক্ষা করে তখন ভোরের এই এলোমেলো ঠান্ডা হাওয়ায় নিজের অজান্তেই গুনগুন করে...।
সূর্যোদয়ে তুমি
সূর্যাস্তে তুমি
ও আমার বাংলাদেশ......
তারপরই একটা বেদনার বিষাক্ত হাসি চেপে রাখতে চায়, নাহিয়ান পারেনা।
নাহিয়ান কাঁধ ঝাঁকায়, অভিনয় করে কিছুই হয়নি। তারপর তার চোখটা ঝাপসা হয়ে যায়। আর তখনি বাস চলে আসে। নাহিয়ান চোখ মুছতে মুছতে বাসে উঠে।
সারাদিন হাড় ভাঙা খাটুনিতে প্রচন্ড ব্যাস্ত ছিলো নাহিয়ান।
তার পরে প্রায় বিপর্যস্ত শরীর নিয়ে পাতাল রেলে চেপে বসলো বাসার উদ্দেশ্যে। পাতাল রেলে আবার নেট থাকেনা। এতো উন্নত দেশ, বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষতার যুগেও যখন ফোনের বা ইন্টারনেটের কভারেজ থাকেনা পাতাল রেলে তখন অবাক হতেই হয় বৈকি। নাহিয়ান ভাবে কি হতো এই সামান্য উপকারটুকু করলে। সারাদিন সে ফাতিমার সাথে কথা বলেনি।
তাই মন খুব একটা ভালো নয়। ফাতিমা নিশ্চয় অভিমান করে বসে আছে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক তাকে এখন এই টিউব নামক চলন্ত কবরে বসে থাকতে হবে।
এই ভাবতে ভাবতে নাহিয়ান কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে ক্লান্তিতে তা সে নিজেও জানেনা। যখন উঠলো তখন তার গন্তব্যের স্টেশন পার হয়ে গেছে।
নিজের উপর খুব অভিমান হলো। পরবর্তী স্টেশানে নেমে উল্টো পথের ট্রেন ধরে বাসার দিকে রওয়ানা হলো নাহিয়ান। না এবার আর ঘুমানো যাবে না কোনভাবেই।
২.
-হ্যালো।
-হুম..
হ্যালো
-হুমমমমমমমম বলো
-হ্যালো, শুধু কি হুমমমম হুমমমই করবে..
-হুমমমমমম শুনতে পাচ্ছিতো বলো।
কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ফাতিমা উত্তর দেয়।
নাহিয়ান বুঝতে পারে এই হুমমমম এর মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। এরকম পরিস্থিতিতে তার কি করা উচিত সে বুঝতে পারছেনা। চিন্তা করছে সম্রাট শাহজাহান কি কোন দিন এমন কোন পরিস্থিতিতে পরেছিলেন। মনে হয় না।
কারন তার অঢেল সম্পদ ছিলো, ভারতবর্ষের সম্রাট ছিলেন। তার ক্যানো এমন পরিস্থিতিতে পরতে হবে?? এমন পরিস্থিতিতে পরলে নিশ্চয় তিনি তাজমহল বানাতেন না। বানাতেন মনোবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়। নারীর মন বোঝার জন্য যে বিশ্ববিদ্যালয়, সেটার নাম হতো 'দারুল উলুম মমতাজ'। আর মমতাজ শব্দটা মেয়েদের মনের প্রতিশব্দ হতো।
-আচ্ছা বুঝতে পারছি তুমি অনেক রেগে আছো। কিন্তু কথা তো বলবে। তাহলে তো অন্তত বুঝতে পারবে চারিদিকে কি হচ্ছে। আমি কি অবস্থার মধ্যে আছি।
-শোন নাহিয়ান এমন করে তো চলে না।
এভাবে তো আমি পারবো না। আর কতদিন আমাকে তুমি এভাবে একা ফেলে রাখবে?
-হুমমম
-আর কতদিন আমি এমন করে ভবঘুরেদের মতো ঘুরে বেড়াবো?
-হুমমমম
- আমি আর এভাবে থাকতে চাইনা। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আমি চাই তুমি তাড়াতারি করে দেশে চলে আসো। এসে বিয়ের একটা ব্যবস্থা করো।
-হুমমমমম
আমি কোন বিরাট অনুষ্ঠান চাইনা। শুধু কোন রকমে একটা দোআ দুরুদের ব্যাবস্থা করে আমাকে বাঁচাও। আমি আর এক মুহুর্তও একা থাকতে চাইনা।
-হুমমমমমম
-এখন তুমি ক্যানো হুমমমম হুমম করছো??
নাহিয়ানও ভাবে আসলেই তো সে হুমমম হুমম করেই চলছে। তার হুম হুমম করা আর ফাতিমার হুমম হুমম করার মধ্যে কত আকাশ পাতালই না ব্যবধান।
নাহিয়ান হুমমম করে আসলে নিজেকে লুকাতে চাচ্ছিলো, নিজের অপারগতাকে। আর ফাতিমার হুমমমম হুমমমম করা ছিলো বিশাল ঝড়ের আভাস, একটা ঝড় বইয়ে দেয়ার জন্য আসলে সে প্রিপারেশান নিচ্ছিলো।
- না আমি আসলে তোমার কথা গুলো শুনছিলাম তো। খুব গুরুত্বপূর্ন কথা, এগুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। একটা বিহিত করে ফেলতে হবে কিছু দিনের মধ্যেই।
- এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে?? চিৎকার দিয়ে উঠে ফাতিমা। তুমি কি এখনো ভাবোই নি? ভালো নাহিয়ান, সুন্দর বলছো। আমার জন্য তোমার ভালোবাসা কতটুকু তা আমি বুঝতে পারছি।
-তোমার এভাবে চিন্তা করার দরকার নাই। তুমি বেশী রেগে যাচ্ছো ক্যানো।
আলোচনা করে আমরা একটা সমাধান করি।
আলোচনা টালোচনা কিছুই না। নাহিয়ান শুধু ফাতিমাকে একটু ঠান্ডা করতে চায়। ও একটু ঠান্ডা হলেই সবকিছু ঠিকটাক হয়ে যাবে।
ফাতিমা ঠান্ডা হয়না।
ফাতিমা বিমর্ষা হয়ে যায়। ফাতিমা এবার করুন সুরে আর্তি করে। সে কাকুতি মিনতি করে, বলে নাহিয়ান প্লিজ, তুমি দেশে আসো, কিছু একটা করো। আমার বয়স বাড়ছে এভাবে এই বয়সে স্বামী সংসার ছাড়া চলা যায় না। চলা ঠিকনা।
লোকে নানান কথা বলে। বন্ধু বান্ধব নানান প্রশ্ন করে।
নাহিয়ান জানে ওর বন্ধু বান্ধব কি প্রশ্ন করে। আকারে ইংগিতে ওকে বুঝাতে চায় ছেলে বিদেশে চলে গেছে ও তো আর আসবে না। দ্যাখ এতোদিনে কোন সুন্দরীকে পটিয়ে হয়তো সংসারই পেতে ফেলেছে।
ফাতিমা প্রশ্ন করে, তোমার কি হয়েছে বলো তো?? তুমি কথা দিয়েছিলে তুমি এক বছরের মধ্যেই আসবে। বাবা-মা সবাই তোমার কথার উপর বিশ্বাস করে আমাকে কিছু বলেনি। আমিও ভাবলাম এই সময়ের ভেতরে আমি নিজেকে গুছিয়ে নিবো।
-হুমমমম
-আমি এটাও ভাবলাম যে তুমিও নিজেকে এর ভেতরে গুছিয়ে নিবে। আমি ঠিকই পারলাম কিন্তু তোমার কি হলো? আজ তিনটি বছর এখনো তোমার মাঝে কোন বোধ সৃষ্টি হয়না ক্যানো...????
নাহিয়ান আর হুমমম করলোনা।
আসলেই তারওতো উচিত ছিলো এর ভেতরে নিজেকে গুছিয়ে রাজার বেশে দেশে ফিরে গিয়ে ফাতিমাকে সাজিয়ে ঘরে তুলবে বউ করে। কিন্তু সেটা আজো হয়ে উঠলোনা। নাহিয়ান হারিয়ে যায় অজানা কোন এক ভাবনায়, অজানা এক চিন্তায়। মনে মনে খেদোক্তি করে 'রাজার বেশে'। প্রবাসের জিবন এমনই কষ্টের যে বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে যাচ্ছে।
পেটের ধান্ধায় ঘুরতে হয় সারাবেলা। ধান্ধা বলাই ভালো। বিদেশে যেখানে মা-বাবা ছেড়ে থাকবে সেখানে একবেলা কেউ এক মুটো ভাতও দেয় না।
তাছাড়া বাড়িতে প্রায় অসুস্থ বাবা-মা, তিনটে বোন ও একটা ভাই এমন সংসারের বড় ছেলে হলে কি পরিমান বোঝা থাকে তা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কৈশোর ও তারুন্যের সব হাসি মুছে গেছে নাহিয়ানের জিবন থকে।
শুধু কাজ আর কাজ। ইউকেতে স্টুডেন্ট ভিসা তার কাছে একটা অভিশাপের মতো মনে হচ্ছে। প্রতি ৬ মাস অন্তর অন্তর নিয়ম নীতি পরিবর্তন করে এদেশে স্টুডেন্টদের কে সান্ডউইচের চিপায় ফেলে দিয়ে টোরি গভার্নমেন্ট ভিলেনের হাসি হাসছে বলেই মনে করছে নাহিয়ান। আর সাধের ডিগ্রিটাও অধরা হয়ে যাচ্ছে এতো চাপের মাঝে।
নাহিয়ান আকাশের দিকে তাকায়... সকরুন চোখে সূর্যটাকে খোঁজার চেস্টা করে।
কিন্তু ঠান্ডার এই দেশে সূর্য কালে ভাদ্রে দেখা যায়.........। তবুও নাহিয়ান মনে মনে কল্পনা করে একটা নতুন সূর্য উদিত হয়েছে, সেই নতুন সূর্যের আলোতে তার জিবন নতুন করে আলোকিত হবে।
তারপরই সে ফাতিমাকে আর্তির সূরে বোঝানোর চেস্টা করে।
-এভরিথিং উইল বি ফাইন। প্লিজ তুমি চিন্তা করনা।
ফাতিমা এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে। কোন জবাব দেয়না। ওপাশে কোন উত্তের নেই। নাহিয়ান শুধু শুনতে পায় তার ফাতিমা কাঁদছে। ফাতিমা কাঁদছে।
৩.
ফাতিমার কান্না নাহিয়ানের কখনোই পছন্দ না। ফাতিমা এমন একটা মেয়ে যার উচিত হচ্ছে সবসময় এমন একটা মোহনীয় হাসি মুখের মধ্যে রাখা। এমন ভাবে রাখা যেটা কে বলে লেপ্টে থাকা। নাহিয়ান কোন একদিন খুব একটা পশ লাক্সারী শপে গিয়েছিলো সেখানে সব সেলস এসিস্ট্যান্টদের মুখে খালি হাসি ছিলো, সাথে জিনসপত্রের অনেক দামও ছিলো অবশ্য। এই সেলস আ্যাসিস্ট্যান্টরা সব সময় শুধু হাসে।
যেটা তার একদমই ভালো লাগেনা। তখনই তার মনে পরেছিলো ফাতিমার কথা। এমন সুন্দর মোহনীয় হাসি কেবল ফাতিমাকেই মানায়। একবার তার মনে এসেছিলো যে এক্ষুনি যেয়ে মেয়েটাকে বলে, এই মেয়ে একদম হাসবে
না কারন এমন হাসি কেবল মাত্র আমার ফাতিমাকেই মানায়। তোমাকে এই হাসিতে বান্দরের মতো লাগছে।
লাইনটা কেটে যাওয়ার পর থেকে নাহিয়ান শুধু ফাতিমার কথাই ভাবছে। ভাবছে প্রানোজ্জ্বল ফাতিমা আজ ক্যানো কাঁদছে? তার ভালোবাসার ফাতিমা। আজ তারই কারনে কাঁদছে। আজ যেখানে সুন্দর একটা জিবন সাজানোর করার কথা ছিলো সেখানে সে আজ মিনতি করছে তার কাছে। নাহিয়ানের মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।
তার শুধুই মনে হতে থাকে দুনিয়ার যাবতিয় সামস্যা আর ঝামেলা শুধুই কি আমার জন্য? আরো তো কত শত-সহস্র মানুষ আছে তাদের ক্যানো এতো ঝামেলা নাই? এই তো তার খুব কাছের এক বন্ধু হাসানের কি সুন্দর চাকরিতো হলোই সাথে ওয়ার্ক পারমিটও অফার করলো কম্পানী থেকে।
নাহিয়ান আবারও আকাশের দিকে তাকায় এবার আর সূর্যটাকে খুঁজে না। খুঁজে চাঁদ। শুভ্র একটা চাঁদ দেখতে তার খুবই ইচ্ছা করছে। এই রাতের সব দুঃখবোধ আর বেদনাকে দূর করে দেবে এমন একটা পূর্নিমা চাঁদ দেখতে চায় সে।
কিন্তু আজব এক দেশে বসবাস যেখানে চাঁদ সূর্য দেখাও অমাবশ্যার চাঁদের মতো। নাহিয়ান তবুও আকাশে পানে মুখ চেয়ে বসে থাকে জানালার পাশে। তখনি যাবতীয় গিল্টি ফিলিংস এসে তাকে ঘিরে ধরে। নাহিয়ান ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে............।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।