এক, সাল ধরে সময়টার কথা মনে নেই। মোহাম্মদ রফিকের স্বর্ণযুগ চলে। নিউজিল্যান্ড সফরে গেলে ওই মুহূর্তের বাহাতি সেরা স্পিনারের তুলনা করে ড্যানিয়েল ভিটোরি আর মোহাম্মদ রফিককে পাশে রেখে ফিচার ছাপে শীর্ষ দৈনিকগুলো। নিউজিল্যান্ড বাংলাদেশে আসলেও তাই। প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা বাংলাদেশ দলের একজন প্লেয়ারকে নিয়েই হোমওয়ার্ক করে।
প্লেয়ারটার নাম মোহাম্মদ রফিক। আমার অসম্ভব প্রিয় স্পিনার। আজকে এই কী-প্যাড হাতে যখন জানি রাজ্জাক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী, সাকিব দীর্ঘদিন বিশ্বের এক নাম্বার অলরাউন্ডার ছিলেন; এখনও বাংলাদেশের একজন স্পিনারকে বেছে নিতে বললে, মাইসেল্ফ উইল ডেফিনেটলি পিক মোহাম্মদ রফিক।
খুলনায় শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম ছাড়াও আরেকটা স্টেডিয়াম আছে। সার্কিট হাউজের পাশে।
ওটায় এক স্থানীয় খেলায় একবার রফিককে হায়ারে খেলতে নিয়ে এসেছিলো। শোভনের সাথে খেলা দেখতে গেছিলাম মা কে মিথ্যে বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে। একটা ছক্কা মেরেছিলো রফিক যেটাকে স্টেডিয়ামের অনেক উঁচু দিয়ে যেতে দেখেছিলাম। পরে বের হয়ে শুনেছিলাম বলটা পাশের প্রাকটিস গ্রাউন্ডের একটা টোকাইয়ের মাথায় লেগে থেতলে দিয়েছিলো। আমি জীবনেও লাইভ এত বড় ছক্কা দেখিনি।
শোভনের সাথে তর্কে বলেছিলাম একবার, রফিকের যদি ভিটোরির বয়সে অভিষেক হতো আর বাংলাদেশ অন্য দলগুলোর মত নিয়মিত খেলতো, রফিক সর্বকালের সেরা তিন স্পিনারের একজন হয়ে যেত। কথাটা শুধু আবেগ দিয়ে বলা ছিলো না, তখন ব্যাপারটা বিশ্বাসও করতাম।
ছোটকাল থেকে একটা অভ্যাস ছিলো। আমার মতে বিশ্বের সেরা ওয়ানডে একাদশ, টেস্ট একাদশ সাজিয়ে খাতার এক কোনায় লিখে রাখতাম। মুরালিকে আমার কখনোই খুব বেশি পছন্দের ছিলো না তাই বিশ্ব একাদশে শেন ওয়ার্নের সাথে দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে নাম লিখতাম রফিকের।
অলরাউন্ডার থাকায় ওয়ার্নের নামের উপরেই লিখতাম রফিকের নাম।
দুই, এখন অনেক উইকেটকিপারই পেস বোলিংয়ে উইকেটের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। টি-টুয়েন্টির আগ্রাসনে ব্যাটসম্যানরা চাপে পড়লেই আজকাল হুটহাট স্টেপ আউট করে। এটা যাতে না করতে পারে সেজন্য পেস বোলিংয়ে উইকেটের সামনে এসে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা আজকাল প্রায় ডালভাত হয়ে গেছে। সব উইকেট কিপাররা এতেই অভ্যস্ত।
খালেদ মাসুদের সময় ব্যাপারটা এমন ছিলো না। বাউচার-গিলিরা ছাড়া এই দু:সাহস খুব বেশি কিপার করতো না। নয়ন মঙ্গিয়া-সাবা করিমরা স্পিনেই নাক ফাঁটিয়ে নিতো। সেই যুগে খালেদ মাসুদ পাইলট শান্ত-তাপস বৈশ্যদের বলে উইকেটের সাথে দাঁড়িয়ে নিঁখুত কিপিং করতো। দেখার মত ছিলো ব্যাপারটা।
খুব বেশি কিপারের পাইলটের মত স্কিল ছিলো না।
পাইলটের উপর শ্রদ্ধাটা বাড়ে রাজশাহীতে একটা ক্রিকেট একাডেমী করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অক্লান্ত পরিশ্রম করার সময়। মাথা নিছু করে স্পনসর খুঁজতে ও দ্বিধা করেনি ক্রিকেটের স্বার্থে। ক'জন ক্রিকেটার আছে যারা অবসরে গিয়েও দেশের ক্রিকেট নিয়ে ভেবেছে?
তিন, গুটি গুটি পায়ে মিডিয়াম পেস। টুকটাক ব্যাটিং।
কোনোটাই ঠিকমত হয়নি, তারপরেও শুধু একটা ম্যাচের জন্য খালেদ মাহমুদকে কোনো বাংলাদেশি ভুলতে পারবে না। আজকের দিনে, ১৯৯৯ সালের এই ৩১শে মে তেই, ওয়ার্ল্ড কাপে খালেদ মাহমুদের ব্যাটিংয়ে ২৭ রান আর বোলিংয়ে ১০ ওভারে ৩১ রানে ৩ উইকেটের জন্য। স্পষ্ট মনে আছে, তখন বাড়িতে ২১ ইঞ্চি সাদাকালো ন্যাশনাল টিভি। সাকলাইন মোস্তাক গলার কাঁটা হয়ে ক্রিজে আটকে রয়েছে। আমার অল্প ক্রিকেট বোঝা মা ৪/৫ বছরের ছোট ভাইটাকে কোলে নিয়ে উত্তেজনায় কাঁপতেছে।
রান আউট হয়ে গেলো সাকলাইন। রাত দশটার দিকেই সম্ভবত ম্যাচ শেষ হলো। যেখানে সন্ধ্যার আযানের পর এক সেকেন্ড বাইরে থাকার সাহস ছিলো না সেখানে ওই রাতেই আমি রাস্তায় বের হয়ে গেলাম। অবিশ্বাস্য ভাবে মা বাঁধা দিলো না। প্রেস ক্লাব, গোলকমনি পার্কের সামনে আধঘন্টা চিৎকার করার পর সাদা গেঞ্জিটাকে ঘামে ভিজিয়ে আর মুখে আবির মেখে ফিরলাম।
অন্যদিন হলে ভূমিকম্প ঘটিয়ে দিতো মা। ওইদিন কিচ্ছু বললো না। এই ঘটনা ঘটানো খালেদ মাহমুদ সুজনকে ভুলি কিভাবে?
উপরের স্মৃতিচারণাগুলো একান্তই ব্যক্তিগত। কী মনে হওয়ায় লিখতে বসে গেলাম। পরে যদি তাদের নিয়ে লেখার আর ইচ্ছেই না হয়, এজন্যই হয়তো।
উৎপল দা'র কলামে একটু আগে পড়লাম আশরাফুল উপরের তিনজনের নাম বলে দিয়েছেন 'আকসু'র জিজ্ঞাসাবাদে। তিনজন যথারীতি অস্বীকারই করেছেন। সে যাই হোক, সচেতন এবং বুদ্ধিমানেরা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, সিডর আসছে সামনে। শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেটে না, বিশ্ব ক্রিকেটেও। ঘরোয়া টি-টুয়েন্টির মাঝে আর ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ নেই।
এবং কতটুকু পারবে জানি না তবে 'গেন্টেলসম্যানস গেম' ক্রিকেটের যে ভাবমূর্তিটা নষ্ট হলো তা পুনরুদ্ধারে আইসিসি যে একটা ডেসপারেট সিদ্ধান্তে পৌছাবে, এই ছোট্ট মাথায় তা বেশ ভালোই অনুমান করতে পারছি।
ক্রিকেট বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব সম্মানের জায়গায় ছিলো। এই তো সেদিনও একজন আরেকজনের ছায়া না মাড়ানো দুই নেত্রীকে এশিয়া কাপে একই গ্যালারিতে নিয়ে এলো সাকিব-তামিম-মুশফিকরা। বাংলাদেশের আর কেউ এটা করে দেখাতে পারবে?
বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচটায় গ্যালারিতে ছিলাম। বাংলাদেশ জেতার সাথে সাথে পাশের অচেনা অজানা এক লোক এমন ভাবে জাপটে ধরলো, আমি আর নিজেকে ছাড়াতে পারি না।
জাপটে ধরেই লাফায়। কয়েক মিনিট পর যখন ছাড়লো তখন দেখি উনিই চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকানো। তীব্র শব্দের মাঝে কানের কাছে মুখ এনে বললো, 'ভাই কিছু মনে কইরেন না, মাথা ঠিক আছিলো না!'
আবেগের কথা বাদ দিয়ে সিরিয়াস কথায় আসি। আশরাফুল যখন বলেছে ২০০৪ সালের কথা এবং তা যদি আসলেই সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বিষয়টা নিয়ে চিন্তার অনেক কিছুই আছে। ২০০৪ এ আশরাফুলের বয়স ছিলো মাত্র ২ এখন এইচএসসি দেওয়া ছাত্রদের বয়সই থাকে ২০ এর মত।
এই বয়সী একটা ছেলে নিশ্চয়ই নিজে নিজে ফিক্সিংয়ে জড়ানোর ক্ষমতা রাখে না, তাই না? পিছনে যে কেউ ছিলো, এটা নিশ্চিতই। কিন্তু কথা সেখানে থামছে না। ধরে নিলাম, রফিক-সুজন-পাইলটরা ছিলোই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাদেরকে কে এই লাইনে এনেছে, তাদেরকে কে মোটিভেট করেছে? এই গোঁড়াটা কোথায়? শুধু আশরাফুলের মাধ্যমেই তিন-চারটা আন্তর্জাতিক ম্যাচে ফিক্সিং চললে বাকিরা কয়টা ম্যাচে করেছে? আশরাফুলের কাছে তিনটে নাম থাকলে রফিক-সুজন-পাইলটদের কাছে কি আরও তিনটে করে নাম নেই? দ্যাট মিনস, এতদিন কী দেখেছি? ক্রিকেট না রেসলিং? কী দেখে হৃদস্পন্দন বাঁড়িয়েছি? কী দেখে চোখ ভরে জল এসীছে?
বাংলাদেশের খেলা থাকলে আমার দৈনিক রুটিন বদলে ফেলি। ক্লাস-ওয়ার্ড বাদ দেই।
অমিত জানে ওইদিন ক্লাসে আমার প্রক্সিগুলো ওরই দিতে হবে। আমার ক্লাসমেটরা লাইব্রেরিতে যাওয়ার আগে বলে যায়, বাংলাদেশের খেলা আছে, আজকে তো তুই যাবিনা, তাই না? এখন থেকে কোনো ওভারে একজন ব্যাটসম্যানকে অহেতুক ব্যাট চালাতে দেখলে বা একটা হাফ ভলি-ফুলটস চেজ না করতে দেখলেই মনে হবে, এটাও কি ফিক্সিং? আমি জানিনা, সেই আবেগ নিয়ে এরপর আর বাংলাদেশের খেলা দেখতে পারবো কি-না, জানিনা একটা চার-ছক্কা হওয়ার পরে অজান্তেই দেয়ালে ঘুষি মেরে হাতে ব্যথা পাবো কি-না, জানিনা ক্লোজ ম্যাচগুলোতে হৃদস্পন্দন কমাতে বল করার আগে মুঠি বুঝে চোখ বন্ধ করে বলতে পারবো কি-না, 'আজকে জিতে যাক, আর কিছু চাওয়ার নেই আমার। '
অ্যা সিরিয়াস গিল্টি ফিলিং। ভীষন প্রতারিত হওয়ার অনুভব হচ্ছে। মোর দ্যান অ্যা শক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।