আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের সরকারগুলো এটা করে না; করবেও না কোনদিন.......

সময়ের সাথে...... ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে একবার তাজমহল নির্মানের ইতিহাস নিয়ে একটা অনুষ্ঠান দেখেছিলাম। সেখানে একজন ভারতীয় ইতিহাসবিদ, যিনি তাজমহলের ঐতিহাসিক পটভূমি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন, বর্ননা করছিলেন তাজমহল নির্মান করা নিয়ে সম্রাট শাহজাহানের ‘জেদ’ তার রাজ্যের মানুষদেরকে কী দূর্দশায় ফেলেছিল। প্রিয়তমা স্ত্রীর স্মৃতি চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য (বা নিজে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার জন্য) যেভাবে তাজমহল নির্মানের পরিকল্পনা তিনি করেন তার প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল সীমাহীন। অর্থ, মনোযোগ সব নিয়ে তিনি ঝঁপিয়ে পড়েন তাজমহল বানানোর পেছনে; অনেকটাই ভুলে যান রাজ্যের কথা, প্রজাদের কথা। প্রথম বেশ কিছুদিন তিনি কোষাগার থেকে এর নির্মান ব্যয়ের সংস্থান করতে পারছিলেন, কিন্তু একসময় রাজকোষও প্রায় শুন্য হয়ে যায়।

শাহজাহানের মাথায় কিন্তু ততদিনে তাজমহলের ভুত পুরোপুরি চেপে গেছে। এরপর বাড়তি অর্থ সংস্থান করার জন্য তিনি নতুন নতুন মোটা অঙ্কের খাজনা বসাতে থাকেন; বাদ যায়নি নিতান্ত প্রান্তিক মানুষরাও। তারপর একদিন বিরাট একটা অঞ্চলে দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। কিন্তু কোন কিছুতেই দমেন না সম্রাট শাহজাহান। এটা আজ ঐতিহাসিক সত্য যে, এক তাজমহল ওই অঞ্চলে বেশ বড় একটা দূর্ভিক্ষের জন্য দায়ী।

শেষ পর্যন্ত ‘কপাল জোরে’ বেঁচে যায় ওই রাজ্যের মানুষ – শাহজাহান পুত্রের হাতেই ক্ষমতচ্যুত হন। আমরা অনেকেই হয়তো জানি ‘সাদা তাজমহল’ এর পর তার ইচ্ছে ছিল যমুনা নদীর ঠিক উল্টো পাড়ে একই ডিজাইন এবং একই আকারের ‘কালো তাজমহল’ তৈরি করা। ‘কালো তাজমহল’ তৈরি করা শুরু করতে পারলে ওই রাজ্যের মানুষদের কী যে হোত! আমি নির্বোধ নই। না, আমি তাজমহলের মত একটা নিতান্ত ব্যক্তিগত এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পকে আমাদের দেশের জনগনের জন্য অতি দরকারী প্রকল্প পদ্মা সেতুকে তুলনা করছি না। আমি আসলে উপরের গল্পে একজন সম্রাটের জেদটুকু দেখাতে চেয়েছি, কারন পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের দেশে ঠিক একই ধরনের জেদঘটিত কর্মকান্ড ঘটছে, যার মাশুল সাধারণ জনগনকেই দিতে হবে।

পদ্মাসেতু চুক্তি বাতিল করেছে বিশ্বব্যাংক – খবরটা বাসী। আসলে কাল রাতের খবরে অর্থমন্ত্রীর একটা বক্তব্য শুনে অবাক হয়ে আজকের পোষ্টটি লিখার সিদ্ধান্ত নিলাম। পদ্মা সেতুর ঘটনায় কার দোষ বা কার দায় সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা এই পোষ্টের উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য এটা দেখানো এই ঘটনায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আমাদের সরকারের কর্তাব্যক্তিরা অসংলগ্ন কথা বলার মহোৎসবে মেতেছেন, আর ক্ষুব্ধ করছেন আমাদেরকে – তাঁরা আমাদেরকে এত বোকা, অপদার্থ, অসচেতন মনে করেন যে, যে যাচ্ছেতাই বলে আমাদেরকে ‘খাওয়ানো’ যাবে! বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক তাঁর বিদায়ের দিন বাংলাদেশের সাথে এই চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিলেন। সাথে সাথে আমাদের অর্থমন্ত্রী ‘দিব্যচোখে দেখে’ ঘোষণা দিলেন ওটা তাঁর ‘ব্যক্তিগত’ সিদ্ধান্ত; নতুন প্রধান আসার পর সব ঠিক হয়ে যাবে।

তো কাল নতুন প্রধান এসে যা বললেন সেটার জবাবে আমাদের অর্থমন্ত্রী যা বললেন সেটা শুনে পেট ফেটে হাসি পেয়েছে – সে কথায় আসছি পরে। চুক্তি বাতিলের পর আমাদের সরকারের মন্ত্রী (দপ্তরবিহীন মন্ত্রীসহ) দুদক প্রধান, এমনকি দুদকের আইনজীবী নানা কথা বলতে শুরু করলেন টিভি ক্যামেরার সামনে, টক শোতে। শুধু মন্ত্রীরাই নয়, আওয়ামী ‘বুদ্ধিজীবী’ রাও মাঠে নামলেন এই ব্যাপারে সরকারকে সমর্থন করতে আর বিশ্বব্যাংকে তুলোধূনো করতে। কিন্তু সমস্যা হল সবার এই বক্তব্যগুলো এত স্ববিরোধীতায় পূর্ণ যে সেটা ন্যুনতম যুক্তিবোধসম্পন্ন মানুষের কাছে হাস্যকর ঠেকবে। কিছু মানুষ কথা বলতে শুরু করলেন (এর মধ্যে নিজের গড়া তদন্ত কমিটির ‘দুর্নীতিমুক্ত’ সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত কালো বিড়ালও আছেন) বিশ্বব্যাংকের দূর্নীতির বিরুদ্ধে অমুক পত্রিকায় রিপোর্ট এসেছে, তমুক দেশে বিশ্বব্যাংক এই দূর্নীতি করেছে।

তাই বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোন গুরুত্ব নেই। ধরে নিলাম তাঁদের কথাই ঠিক; তো আজ এই কথা বলা হচ্ছে কেন? ওদের প্রথম অভিযোগের সময় পাল্টা অভিযোগ করে সেটা উড়িয়ে দেয়া হল না কেন? কেনই বা আবুল কে অন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হল? কেনই বা একটা ‘দূর্নীতিবাজ’ প্রতিষ্ঠানকে আমাদের ‘ফুলের মত পবিত্র’ সরকার এই দেশের মাটিতে কাজ করতে দিয়ে এই দেশের মাটি কলুষিত করেছে, করছেন। কেউ কেউ এক কাঠি বেড়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে পারলে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজের কাতারে নিয়ে যাচ্ছেন! এই ঘটনায় সরকারের অনড় অবস্থানকে সরকারের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান হিসাবে দেখাতে চেষ্টা করেছেন। সরকার বিশ্বব্যাংকের অন্যায় আবদারে সাড়া না দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছেন! আর বিশ্বব্যাংকের মত সাম্রাজ্যবাদের কার্যসিদ্ধিকারী এমন প্রতিষ্ঠানের না থাকাই উচিৎ এই দেশে। কথাগুলো দলীয় অন্ধ, মূর্খ সমর্থকদের কাছে অমিয় বানী হতে পারে, কিন্তু একটু সচেতন মানুষের কাছে উদ্ভট, হাস্যকর।

এদিকে আবার প্রথম দিন থেকেই আমাদের অর্থমন্ত্রী বলছেন তিনি বিশ্বব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের সাথে যোগাযোগ রাখছেন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য। আচ্ছা লজ্জার মাথা খেয়ে যদি সেটা করা হবে তাহলে আবার বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বিষোদগার কেন? বিশ্বব্যাংক খুব খারাপ (সাম্রাজ্যবাদী, দুর্নীতিবাজ) হলেও আপনি যেহেতু তার কাছে ধর্ণাই দিয়েই যাবেন তাহলে আর তাকে নানা কথা বলে আরো ক্ষেপিয়ে দেয়াটা কি কৌশলগতভাবে আদৌ ঠিক? একটা অতি সাধারণ বুদ্ধির মানুষও কি এমনটা করে? এই বছরের শুরুতে প্রথম অভিযোগের পর আবার মালয়েশিয়ার সাথে বানিজ্যিক ঋন নিয়ে নতুন যোগাযোগ মন্ত্রী খুব দৌড় ঝাঁপ করলেন, সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর করলেন। ভাবখানা এমন যে বিশ্বব্যাংকের মহা ঠেকা পড়ে গেছে আমাদের দেশে এই সেতু বানিয়ে দেবার – মালয়েশিয়াকে দেখলে তারা সুড় সুড় করে চলে আসবে। এদিকে আবার চুক্তি বাতিলের দিন তিনি বললেন এটা ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’। আমরা অতি সাধারণ মানুষ, আমরা কিন্তু বুঝতে পারছিলাম বিষয়টা সেদিকেই যাচ্ছে; কিন্তু স্বয়ং যোগাযগ মন্ত্রী হয়ে তিনি সেটা বোঝেননি! না বুঝলে মালয়েশিয়ার কাছে কেন গেলেন? পরে অবশ্য তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন – সেতু নিয়ে নাকি ‘চমক’ আছে; বিশ্বব্যাংকের চাইতে কম সুদে সেতু বানিয়ে দেখাবেন! আবার পরদিন আবার বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দেখলাম বিশ্বব্যাংকের ঋন আবার পাবার চেষ্টা নিয়ে নানা কথা বললেন।

কি হাস্যকর! এদিকে কাল বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্ট যখন বললেন এই চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত ঠিক আছে, তখন আবার অর্থমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত ‘জোয়েলিকের ব্যক্তিগত’ অবস্থান থেকে সরে এসে বললেন এটাই তাঁর জন্য স্বাভাবিক, তাঁকে তাঁর আগের সিদ্ধান্ত মান্তেই হবে, তারপর…….. অবাক লাগে এটা যে ৩০০ কোটি ডলারের একটা প্রকল্প এক ব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে বাতিল করে দিতে পারেন – আমাদের অর্থমন্ত্রীর ধারণা এটা! কেউ কেউ বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তকে ১৬ কোটি মানুষের প্রতি অপমান হিসাবে দেখিয়ে চেষ্টা করছেন ‘দেশপ্রেম’ এর জিগির তুলে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে’। কিন্তু এই ফালতু কথাও মানুষ বোঝে – সরকারের কিছু মানুষকে দুর্নীতিবাজ বলা মানে জনগনকে অপমান করা নয় কোনভাবেই (সরকার আর রাষ্ট্র কোনভাবেই একই নয়)। ওটা সরকারের জন্য অপমানের; অবশ্য আমাদের এই সরকারের যদি আদৌ মান-অপমানবোধ থেকে থাকে। অন্যদিকে দিকে অনেকে বলছেন (আমি সুরঞ্জিতকেও কাল স্পষ্টভাবে এটা বলতে শুনলাম) বিশ্বব্যাংকের এসব সব নাটক – নাটের গুরু ইউনূস, তাকে গ্রামীন ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরানোর কারণে প্রতিশোধ নিচ্ছেন তিনি ( হতে পারে এটাই মূল কারণ)। তো যদি এটাই হবে মূল কারন তবে আমাদেরকে সব সরাসরি বলে দিলেই হয়।

দূর্নীতি নিয়ে এত কথা বলার কারন কী? এত কিছু ব্যাখ্যা করে বিশ্ব ব্যাংকের কাছে চিঠি লিখার পন্ডশ্রম করার দরকার কী? ঋন চাইলে ইউনূসের সমস্যার সমাধান করলেই হয়। আমি কখনোই মনে করি না ইউনূসকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর কোন নৈতিক অবস্থানের কারণে ওই পদ থেকে সরিয়েছেন – এটা স্রেফ একটা ব্যক্তিগত জেদ। তো আমাদের সরকার প্রধানের তো এটা বোঝা উচিৎ ছিল এই পুঁজিবাদী বিশ্বে এর ফল কী হতে পারে। তিনি কি ভেবেছেন তাঁর উপদেষ্টা গওহর রিজভী সামলাবেন এসব চাপ? তিনি এবং তাঁর চারপাশের মানুষ কি জানতেন না এই পুঁজিবাদী বিশ্বে পশ্চিমাদের কাছে এক ইউনূসের তুলনায় গওহর রিজভীর মূল্য কানাকড়িও না। এইসব অসংলগ্ন, অবান্তর কথার কিন্তু একটা গভীর, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আছে।

সরকারের ক্ষমতার মূল অংশটা প্রচন্ড চাপ, ভয়, আর দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়েছে – মুখে যতই হম্বিতম্বি করুক তারা বুঝে গেছে কী করেছে তারা তাদের এই শাসনামলে, আর সময়ও শেষ প্রায়। ক্ষমতায় আসলে এই দেশের সব দলের সরকারের কাছে ৫ বছরকে অনন্তকাল বলে মনে হয় – কিন্তু না, ৫ বছর শেষ হয়, খুব দ্রুতই হয়। কয়েকজন ব্লগার আমাদের নিজেদের উদ্যোগে পদ্মা সেতু বানিয়ে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন, পথ দেখাচ্ছেন – তাঁদের দেশপ্রেম আমি অনুভব করি। এটা ভাল, মানুষ জানল আমরা সেতুটা নিজেরাই বানাতে পারতেম, এবং কীভাবে পারতাম। কিন্তু যখন দেখি তাঁরা সরকারকে এটা করতে আহ্বান করতে তখন বুঝি এই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নাড়ি চিনতে তাঁদের দেরী আছে।

শেয়ার মার্কেটে শেয়ার বেচে, প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে বৈদেশীক মূদ্রার বন্ড বেচে এমন প্রকল্প সহজেই বাস্তবায়ন করা যায় এমন কথা অনেক অর্থনীতিবিদ অনেকদিন থেকেই বলে আসছেন। কিন্তু তারপরও আমাদের সরকারগুলো এটা করে না; করবেও না কোনদিন........ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।