আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: একশোটি মার্বেল

আমার ভিতরে আমি স্বতন্ত্র জীবন যাপন করি। খেলায় দারুন উত্তেজনা, হাতে মার্বেল নিয়ে চতুর্থ দান মারতে যাবে তখনই ঝুম বৃষ্টি নামলো। “ধুর মাদারীর বৃষ্টি” বলে রেগে গেল খলিল। সাথে যারা ছিলো তারাও বিভিন্নভাবে বিরক্তি জানিয়ে দিয়ে মুখে শব্দ শুরু করলো। মাদারী গালিটা খলিলের সবচে ভালো গালি।

এরচে খারাপ গালি সে দিয়ে থাকে। বয়স বেশী না হলেও মুখ এবং মননে বেশ পরিপক্ক। মার্বেল খেলা পন্ড করায় বৃষ্টিকে গালি দিয়ে যার ভাগের যা মার্বেল তা বুঝে নিলো সচেতনভাবে। ন’বছর বয়সি খলিল আজকে বাড়ী ফিরছে সতেরটা মার্বেল নিয়ে। আগের বায়াত্তরটার সাথে আরও সতেরটা যোগ করে তার মার্বেল সংখ্যা এখন উননব্বইটা।

আর মাত্র এগারোটা হলেই একশোটা হয়ে যাবে। বাজার থেকে কুড়িয়ে পাওয়া দু লিটারের খালি পানির বোতলে এখন মার্বেলের আশ্রয়স্থল। -এতক্ষনে আইছসরে হারামজাদা, আছিলি কই? মায়ের কথায় কান দেয় না খলিল, সোজা ঘরে গিয়ে সবগুলো মার্বেল বিছানায় ঢালে। তারপর এক এক করে উনোনব্বইটা মার্বেল গুণে গুণে বোতলে ঢুকিয়ে রেখে বোতলটা ঝাঁকিয়ে “ঝুপঝুপ” শব্দ উৎপাদন করে নিজের মনে খিলখিলিয়ে হাসি দেয়। “ও মা ভাত খামু” বলে মায়ের কান ফাটিয়ে দেয়।

মায়ের রাগ তখনও পড়েনি। “হ আমারেতো চাকরানী পাইছস,হারাদিন কোন কাম কাজ নাই,না আছে পড়াশোনা, খালি মার্বেল আর মার্বেল। পুসকুনিতে ফালাইয়া দিমু মার্বেল” এবার রেগে যায় খলিল। ঘর থেকে চিৎকার দিয়া উঠে “আমার মার্বেলের কিচ্ছুই হইলে কাটাইলামু হগ্গলরে” ছেলের এমন ব্যবহারে মায়ের অগ্নিমূর্তি ধারন করারই কথা। তাই করলেন কুলসুমা বেগম।

ঘরে ঢুকেই খলিলের চুলের মুঠি ধরে “হারামজাদা” বলে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলেন। খলিল অবশ্য সহ্য করার পাত্র না। মায়ের আঁচল টান দেয়, টানটা সহ্য করতে পারেনা কুলসুমা বেগম। টাল হারিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে খিস্তি করতে লাগে। দরিদ্র ঘরে মায়েরাও ছেলেদের খিস্তি দেয়।

ছেলেওবা কম যায় কই? কুত্তার বাচ্চা বলে বোতলটি হাতে নিয়ে হনহনিয়ে ঘরে থেকে বেরিয়ে যায় খলিল। পিছনে মায়ের খিস্তি কানে নেয়ার সময় নেই তার। খিদার চোটে হাঁটাই যাচ্ছে না। গত তিনমাসে জমানো উননব্বইটি মার্বেলের মায়া মায়ের মায়ার চেয়েও বড়। এরমধ্যে দশটি অবশ্যই নিজের।

দশটি মার্বেল কিনতে তিনটাকা খরচ হয়েছে। বাকিগুলো খেলে খেলে লাভ করতে হয়েছে। পাড়ার ছেলেরা বেশীরভাগ সময় খলিলকে খেলায় নেয়না। প্রত্যেকদিন খেলতে পারলে এতদিন একশোর অনেক বেশী হয়ে যেত। নাহ! আর সহ্য করা যাচ্ছে না।

পকেটে মাত্র এক টাকার একটি কয়েন আছে। তা দিয়ে একটি চকলেটও পাওয়া যাবে না। হাঁটা বন্ধ করে গাছের ছায়ায় বসে খলিল। মার্বেলের বোতলটি বুকে নিতেই ঘুম চলে আসে চোখে। খেলায় খলিলের প্রধান শত্রু হলো রাজিব।

খেলার প্রতিদন্ধিতা হাতাহাতিতেও ঠেকেছে কয়েকবার। “ তর সব মার্বেল মাইরা দিমু” বলে হুমকিও দিয়েছে রাজিব। খলিলের ঘুমের সুযোগ নিয়ে রাজিব নিঃশব্দে বুকে জড়িয়ে রাখা মার্বেলের বোতলটি নেয়ার চেষ্টা করছে। খলিল অবশ্য বেশ শক্ত করেই ধরে আছে। রাজীব হ্যাঁচকা টান দিলো।

“আমার মার্বেল নিস না” বলে চিৎকার দিয়ে উঠে গেল খলিল। নাহ! স্বপ্ন ছিলো। তবে রাজিব ঠিকই সামনে দাড়িয়ে আছে। -কিরে খইল্লা খেলবি নাকি? খলিল কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। নিজের ঘুমানোর জায়গার চারপাশ দেখে নেয়।

সবকিছু মনে পড়ে তার। দুপুরের রোদ পড়ে এসেছে প্রায়। খিদাটা সামান্য কমে গেছে ততক্ষনে। রাজিবের সাথে খেলতে রাজি হয়ে যায় খলিল। এ্ সুযোগে একশোটা মার্বেল হয়ে যাবে।

দুজন নিজেদের খেলার জায়গার দিকে হাঁটা শুরু করে। সকালের পাঁচ মিনিটের বৃষ্টিতে খেলা পন্ড না হলে এতক্ষনে বোতলে একশোটি মার্বেল হয়ে যেত। রাজীবকে হারানো কোন ব্যাপার না। একশোটা কি একঘন্টা খেলতে পারলে হয়ত একশো বিশটা হয়ে যাবে। ভাবতেই খলিলের মুখের কোনে হাসি উথলে পড়ে।

বিশটা মার্বেল বিক্রি করে দেয়ার চিন্তা করে সে। বিশটা বিক্রি করলে পাঁচ ছয় টাকার মত পাওয়া যেতে পারে। পকেটে আছে আরও এক টাকা। পেট ভরে খাওয়া যাবে। খেলা শুরু হয়ে যায়।

প্রথম দানেই পাঁচটা হারিয়ে বসে খলিল। রাগ উঠে যায়। দুইজনের সাথে খেলায় আরেকজন যোগ দেয়। একবারে লাভ উঠানোর জন্য এবারের দানে মার্বেলের দর বাড়িয়ে দেয়। এবারও হেরে বসে।

দুএকজন দর্শকও ইতোমধ্যে জমায়েত হয়েছে। তারা হৈহৈ করে তালি দিয়ে উঠলো। খলিলের রাগটা আরও বেড়ে গেছে। বোতল থেকে প্রতি দানেই পাঁচ-ছয়টা করে বেরুচ্ছেই। কিন্তু ফিরে আসছে না একটাও।

কোন দানে রুবেলের পকেটে, কোন দানে রাজীবের পকেটে ঢুকছে। খলিলের হারের সাথে সাথে বাড়ছে খেলোয়াড় সংখ্যা। দর্শকের সংখ্যা এখন আরও বেশী। হঠাৎ দর্শক সারি থেকে হই করে উঠলো। খলিল আবার হেরেছে।

হাতে মাত্র ২০ টি মার্বেল আছে। খেলবেনা মনস্থির করে ফেলেছে খলিল। বোতল হাতে নিয়ে চলে যাবার সময় সবাই একসাথে খলিলকে “মাইয়ালোক মাইয়ালোক” বলে ক্ষেপিয়ে তোলে। কিছুই করার নেই তার। একদিকে পেটে খিদা, ঠিকমত খেলা হচ্ছে না।

অন্যদিকে মার্বেলের প্রতি মায়া। নাহ যে যা কিছুই বলুক আর খেলা যাবে না। সবার কটাক্ষ উপেক্ষা করে চলে যায় খলিল। খেলা আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। কি মনে করে ফিরে আসে খলিল।

এবার কেউ আর শব্দ করে হাসলো না। একধরনের চাপা হাসি সবার মুখে। খলিল মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে করেই হোক জিততে হবেই এবার। আল্লাহর নাম নিয়ে আবার শুরু করে খলিল। নাহ এবারও পাঁচটা হারিয়ে বসে।

মনে মনে মাকে কয়েকটা গালি দেয় সে। মা কুফা, নিশ্চয় বদ দোয়া দিয়েছে নইলে এমন আগে কোনদিন হয়নি। ভীতুর মত চলে গিয়ে কেন ফিরে এসেছে তা নিয়ে নিজেকেই গালি দিলো একবার। জেদের উপর আবার খেলতে লাগলো। আরও দু দান হেরে খলিলের হাতে পাঁচটি মার্বেল অবশিষ্ট আছে।

তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে খেলাকে ঘিরে। খলিল ততক্ষনে বুঝে গিয়েছে সবাই একসাথে হয়ে তাকে ফুটো করার মতলবে খেলা শুরু করেছে। কিন্তু ফিরে যাবার উপায় নেই। ডাগসহ আরও মাত্র পাঁচটি মার্বেল হাতে আছে। পাঁচটি থেকেও লাভ করা সম্ভব।

সমস্যা হচ্ছে খলিলের কাছে আছে মাত্রই পাঁচটি মার্বেল, এরমধ্যে একটি দিয়ে আবার খেলতে হবে। কিন্তু খেলা প্রথম থেকে প্রতি দান পাঁচ মার্বেল দরে হচ্ছে। কেউ খলিল একার জন্য চারটিতে খেলবে না। খলিলের রাগ আরও উপরে উঠে গেল “খেলবি না ক্যান? আমার কাছে নাই আমি কি পয়দা করুম? -আমার থেইকা কিন্না ল সজীবের কথায় খলিলের মনে পড়লো পকেটে এক টাকার কয়েনের কথা। একটাকায় তিনটি মার্বেল কিনে আবার খেলা শুরু করলো খলিল।

এবার হবে নিশ্চয়। নাহ এবারও হলো না। দান পেল রুবেল। সজীব,শিমুল,রাজীবসহ সবাই হো হো করে হাসছে, অনেকটা বাংলা ছায়াছবির ভিলেনের মত। চোখে পানি আঁটকে রাখতে পারলো না খলিল।

কাঁন্না নিয়েই “কুত্তার বাচ্চা, মাঙ্গের পো” বলে একাই তিনচার জনের উপর ঝাপিয়ে পড়লো। এটা খুব ভালো কিছু হয়নি। চারদিক থেকে কিল ঘুষি খলিলের পিঠে পড়ছিলো বৃষ্টির মত। ঠোঁটের নিচে সামান্য কেটে গেছে, শার্টের কয়েকটা বোতামও ছিড়ে গেছে। পকেটে থাকা বাকি তিনটা মার্বেলও নেই।

হাতে মার্বেলের দুই লিটারের খালি বোতল নিয়ে অসহায়ভাবে হাঁটছে। বাড়ী ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন গতান্তর নেই এই মুহুর্তে। কিন্তু দুপুরেই মাকে গালি দিয়ে এসেছে, এখন মা কাছে পেলে মেরেই ফেলবে। তবুও ভয়ে ভয়ে বাড়ী ফিরলো খলিল। ছেলেকে পেয়েই কুলসুমা খাতুন চিৎকার দিয়ে উঠলো “বাপধন কই আছিলি? সারাদিনতো কিচ্ছু খাস নাই? এত রাগ করস ক্যানরে বাপ? মা হইয়া একটু না হয় মারছি”।

একটানে কথা বলে বুকে জড়িয়ে নেয় খলিলকে। খলিলের চুপচাপ কান্না, শব্দ পেয়ে যায়। -মা আমার সব মার্বেল হারাইলাইছি,একটাও নাই কুলসুমা বেগম অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই ফিক করে হাসি দেয়। -তুই খাড়া এইখানে। খলিলকে উঠানে দাড় করিয়ে ঘরের ভিতর যায় কুলসুমা।

ফিরে এসে মুখের হাসি আরও প্রসারিত করে “চোখ বন্ধ করতো বাপধন” চোখ বন্ধ করা খলিলের হাতে স্বামীকে বলে বাজার থেকে আনা দশটি মার্বেল ধরিয়ে দিয়ে বলেন “এইবার খোল” আনন্দে লাফিয়ে উঠে খলিল। মাকে জড়িয়ে ধরে পরের দিন থেকে নতুন করে মার্বেল জমানোর পরিকল্পনা করে সে। ছবি : ইন্টারনেট।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.