ইদানীং প্রায়ই বিভিন্ন জ্ঞানী গুণী জনের সমাবর্তন বক্তিতা পড়ার সৌভাগ্য হয়, সবাই বলেন ভাললাগার কাজ টা খুঁজে বের করে সেটা করতে, সফল হতে। সেটা করতে গেলে আমি কখনই আজ কে একটা ওষুধ কিভাবে অটোম্যাটিক ভাবে বানানো যায়, সেটা নিয়া ঘুম নষ্ট করতাম না। ওষুধ জিনিসটা আমি দুই চোখে দেখতে পারি না !! সেটা না বানাতে পারলেই আমি খুশি !!
ছোটবেলায় আমার বড় ভাই পড়ত এক ক্লাস উপরে। আমি সব সময় তার নতুন বাংলা বইয়ের গল্প কবিতা সব মুখস্ত করে ফেলতাম। প্রতিবার নতুন ক্লাসে উঠে আমার বাংলা পড়ার কিছুই থাকত না !! সমাবর্তনের সফল মানুষদের বক্তিতা আমার বাবা মা শুনলে আমাকে নিশ্চিত সাহিত্যিক - ভাষাবিদ কিছু একটা বানাত।
কিন্তু এখন আমি পড়তাম বিপদে। স্কুল-কলেজে প্রেমে পড়ে তুমুল উৎসাহে সবার মত আমিওকবিতা তবিতা নামক কিছু একটা লেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু রবিবাবু আর বেয়াড়া নজরুল চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, লেখালেখি করাটা আমার জন্য নেহায়েত বেয়াদপি, গুনাহর কাজ। মাঝখান দিয়ে জীবনানন্দ তার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে তাল দিয়ে গেলেন। হেলাল হাফিয আর রুদ্র এসে বলল, ভাইরে লেখো-টেখো ভাল কথা, মানুষকে আবার বলতে যেও না।
আমরাই বিপদে আছি। বরং যার প্রেমে পড়েছ, তাকে দিও। তোমার চেহারা দেখে তো প্রেমে পরবার কোন কারন নেই, কবিতা পড়ে যদি পরে!! যাহা ধর্ম, তাহাই কর্ম... আমার লেখালেখির সাক্ষী হয়ে রইল নোকিয়া, মটরোলা, রেস্টুরেন্ট এঁর টিস্যু পেপার আর ক্লাসের দারুন সুন্দরী মেয়েটা। আমার কবিতার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত আমাকে বিয়েই করে বসল! একঘরে থাকলে আমি নিশ্চয়ই তাকে মেসেজ দিয়ে জ্বালাব না !!
ইঞ্জিনিয়ার হবার একটা সুপ্ত বাসনা আমার মধ্যে ছিল, বিশেষ করে এরনেতিকাল ইঞ্জিনিয়ার। যাহ্ বাবা, এই বিষয়টাই আমাদের দেশেই ছিল না।
অন্য ইঞ্জিনিয়ার হওয়া হল না। যেতে হল ডাক্তারি পড়তে। আমার দেশের মানুষের অনেক কষ্ট – দুঃখ থাকলেও, আল্লাহ্ এই যাত্রা তাদের কে বিরাট বাঁচা বাঁচিয়ে দিলেন। আমাকে ডাক্তার বানালেন না। দেশের মানুষের নিরাপত্তা একটু হলেও বাড়ল!!
ভালো লাগার ব্যাপারটা বোঝার আগেই আমি এসে পড়লাম ঢাকা ইউনিভার্সিটি এঁর ফার্মেসী বিভাগে।
পড়া লেখা ব্যাপারটা যে কিভাবে করা যায়, সেটা নিয়ে প্রতিবারই রেজাল্ট নামক বিভীষিকা এঁর পর আমরা কয়েক বন্ধু বিস্তর গবেষণা করতাম। একদম ফুল্প্রুফ পরিকল্পনা করতাম, কিন্তু প্রতিবারই পরিকল্পনার “পরী” আকাশে উরে গেল, শুধু “কল্পনা” পরে থাকল !! এঁর মাঝে একদম প্রানের বন্ধু ফাস্ট হয়ে বসল। আমি ভাবলাম আমার বন্ধুই যখন ফাস্ট হয়ে গেছে, আমি আর পড়ালেখা করে কি করব!! কিছু জানার থাকলে ওর কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে নেয়া যাবে!! আমি পড়ালেখা একবারেই বাদ দিলাম। বলার জন্য বলা না, সত্যি সত্যি। একবার এক শিক্ষক ক্লাসে হটাত বলে বসলেন, “আমি তোমাদের মধ্য থেকে একজন কে একটা মাত্র প্রশ্ন করব, এবং আমি বলে দিতে পারি সে উত্তর দিতে পারবে না” এই বলে উনি আমাকে দাড়া করালেন।
জীবনটা সিনেমা না, সুতরাং আমি সিনেমার নায়ক দের মত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে হিরো হলাম না। আমি শুধু অবাক হলাম এই ভেবে, উনি যদি জানতেনই যে আমি উত্তর জানি না, সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কেন! কি জানি, শিক্ষক হয়ত নিজেকেই হিরো ভাবলেন!! আমার পি এইচ ডি টা শেষ হোক... আমারও কিছু প্রশ্ন থাকবে উনার কাছে!! যাই হোক, পড়ালেখা ব্যাপারটা আমার কাছে কখনোই ভাল লাগার মত কিছু ছিল না। তাহলে আমি ডক্টরেট করতে আসলাম কেন!! এই উত্তর টা দেবার জন্যই এই লেখাটা লেখা।
অনার্স এ পড়ালেখা না করি, কিছু একটা তো করতে হবে! আমি ক্লাসের বিভিন্ন প্রোগ্রামগুলোতে যুক্ত হতে শুরু করলাম। কাজের কাজ সব কিছু আরিফ ই করত, আমি শুধু শুধুই খুব বাস্ত একটা ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম।
একবার মনে হল কালচারাল লাইনটা খারাপ না। বাবা এই লাইনের লোক ছিল। বাবাকে একবার বলেছিলাম মঞ্চ নাটক করব। বাবা এমন একটা তাচ্ছিল্যর ভাব করল মঞ্চ নাটক নিয়ে। যদিও আমার ধারনা, সে মঞ্চ নাটক নিয়ে তাচ্ছিল্য করেনি, কারন সে নিজেই মঞ্চের লোক।
তার রক্তে রক্তে, শিরায় শিরায় মঞ্চ নাটক... সে আসলে তাচ্ছিল্য করেছিল আমার সামর্থ্য নিয়ে। আমার আর কালচারাল লাইনে যাওয়া হল না।
প্রোগ্রামের সময় কোম্পানি গুলোতে যেতে হত। কোম্পানির ভাইয়াদের ব্যাপক ভাব-সাব দেখে মনে হল মার্কেটিয়ার হওয়া যায়। তুখোড় মার্কেটিয়ার।
অনার্স শেষে একসময় ঢুকলাম ও মার্কেটে। কিন্তু সেখানে শুধুই কথার ফুলঝুরি। ওই সময় আমরা যে কথা বলতাম, আমরা নিজেরাই সেটা বিশ্বাস করতাম না। আর যেটা বিশ্বাস করতাম, সেটা সম্বন্ধে আমাদের কোন ধারণাই ছিল না। আমার ভালোলাগা অল্পদিনেই শেষ।
এই সময় আমি সত্যি সত্যি ভাবলাম পড়ালেখা করার কথা। যেতে চাইলাম ইউরোপ এ। সুযোগ ও আসল, কিন্তু আমার ভালোবাসার মানুষটি আসতে চাইল আমেরিকা। আমিও চলে আসলাম। যে বিষয় টা নিয়ে কোন ধারনাও ছিল না।
সেটা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। ফার্মেসী থেকে আমি চলে আসলাম কন্ট্রোল ম্যানুফেকচারিং এ। আমাকে বসতে হল কন্ট্রোল সিস্টেম নিয়ে, রিয়েল টাইম এনালাইসিস নিয়ে, লিখতে হল ২০০ – ৩০০ লাইনের প্রোগ্রামিং কোড !! এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আমি এটাতে আনন্দ পাচ্ছি। আমার ভালো লাগছে। আমি সফটওয়্যার এঁর ভাষা বুঝতে শিখছি, মেশিনের সাথে কথা বলছি...!!
যারা বলে, যেটা ভাল লাগে সেটা কর, তারা ভুল বলে।
কারন মানুষের ভালোলাগা বদলায়। শুধুমাত্র ভালোলাগার জন্য একটা কাজ করতে বেশিদিন ভালো লাগে না। সেই ভাললাগার সাথে অন্য মানুষের স্বার্থ জড়িত থাকতে হয়। মানুষের কল্যাণ জড়িত থাকতে হয়। একটা সৎ উদ্দেশ্য থাকতে হয়।
অর্থনৈতিক আর চিন্তা ভাবনার স্বাধীনতা থাকতে হয়। এই ব্যাপার গুলি কাজটার প্রতি ভালোবাসা টিকিয়ে রাখে।
আমার আর মারিয়ার একটা স্বপ্ন ছিল। আজো আছে। একদিন সমুদ্রের পারে আমরা একটা ফুলের দোকান দিব।
কফি খাবার বাবস্থাও থাকবে, থাকবে বই পড়ার বাবস্থা। ও ওই দোকান চালাবে, আর আমি হব কোন এক সারেং। সন্ধ্যাবেলা কুরানো ঝিনুকের মালা নিয়ে আসব আমি, আর নিয়ে আসব রাশি রাশি ফুল। আর কোন কোন স্বপ্নের দিনে, সেই ঝিনুকে মুক্তো ও পেয়ে যেতে পারি আমরা।
এই স্বপ্নের মত করে, এই ভাললাগার মত করে আমরা সারা জীবনটা কাঁটিয়ে দিতে পারতাম।
কিন্তু তার কোন অর্থই থাকত না। তার চাইতে একটা অর্থপূর্ণ জীবন কাটানোর পরে আমরা চলে যাব সমুদ্রে। কফি শপ হবে। ফুলের দোকান হবে। পূর্ণিমার রাতে লাল টকটকে কফির মগ হাতে আমরা ফেলে আসা জীবনের গল্প বলব।
যে জীবনের একটা সুন্দর অর্থ ছিল। যে জীবনে আমরা কিছু মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে ছিলাম...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।