চারপাশে আত্মমুগ্ধ আদিমতাবোধ, আর গ্রন্থিবদ্ধ চিন্তা; সেখান থেকে মুক্তির পথ খুঁজি...
চিনচিনে ব্যাথাটা এখনো আছে। কাঁপাকাঁপা হাতে গাল স্পর্শ করলো মিনু। পাঁচ আঙুলের দাগ ষ্পষ্ট অনুভব করা যায়। পিঠে হাত দিয়ে পরক্ষণেই সরিয়ে নিল সে, ‘ইস! প্রচন্ড ব্যাথা। চোখ দিয়ে পানির ধারা নেমে এলো গালের উপর।
প্রচন্ড অভিমানে ফুলে উঠতে চাইছে বুক। আজকাল জীবনটাকে অসহ্য লাগে মিনুর। ডুকরে কেঁদে ওঠে ও, একটু যেন আওয়াজ বেড়িয়ে যায় মুখ দিয়ে। সাথে সাথে পাশ থেকে কনুইয়ের গুতো খায় ও, অশ্রাব্য খিস্তি করে ওঠে পাষন্ড লোকটা।
‘ওই হারামজাদি।
নিজেও ঘুমাস না, আমারেও ঘুমাইতে দেস না। ক্যা-কু করবি তো লাত্থি দিয়া তর মুক ভাইঙা দিমু। ’
অন্যদিকে মুখ রেখে কাত হয়ে শোয় দুলু। মিনুর স্বামী। আজ প্রায় দু’বছর হলো বিয়ে হয়েছে তার।
নিজের বউকে এভাবে গালাগাল করতে পারে মানুষ? বালিশে মুখ গুজেদেয় মিনু, যাতে কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ে যায়।
অভাবের সংসারে বড় হয়েছে সে, তাই অভাব তাকে স্পর্শ করে না। বরং মানিয়ে নিতে পারে সে অভাবের সাথে কিন্তু মানাতে পারে না অশান্তিকে। বাবার ইচ্ছাকেই মেনে নিয়েছিল সে সেদিন। অপছন্দ হলেও বিয়ের পিড়িতে বসেছিল দুলুর সাথে।
আজকাল এ দুঃসহ জীবনের নিয়তিতে বাবা-মায়ের ওপর আর অভিমান হয় না। সে নিজেকেই বারবার প্রশ্ন করে, কেন সে প্রতিবাদ করলো না? কেন চুপচাপ মেনে নিল এই বর্বর পুরুষটাকে?
বিয়ের আগে থেকেই মিনুদের বাড়িতে দুলুর যাতায়াত ছিল। সে সময় গ্রামের রটনায় কান দিয়েছিল ওর বাবা, ভাইদেরও অমত ছিল না তাতে। সবাই জানতো দুলু ঢাকায় ব্যবসা করে। সে তখন গ্রামে রীতিমত পয়সাওয়ালা লোক, বেহিসেবী পয়সা খরচ করে।
একদিন মিনুর উপর চোখ পড়েছিল তার। সেদিন সন্ধ্যার কথা ভাবে সে, কি দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছিল সেই সন্ধ্যা তার জীবনে। বাবলিদের বাড়ি থেকে ফিরছিল সে, পথে দুলু হঠাৎ রাস্তা আটকে ধরেছিল। এমন ভাবে তাকাচ্ছিল যেন চোখ দিয়েই গিলে খাবে। গোফে তা দিতে দিতে বলেছিল, ‘এই ছেমড়ি তোর নাম কি রে?’
মিনু ভয়ে জড়সড়, মাথায় কিছু কাজ করছিল না তখন।
এভাবে কেউ হঠাৎ পথ আগলে দাড়াতে পাড়ে সে ভাবতেই পারেনি। তাই দুলুর প্রশ্নের জবাবে কোন কিছু না ভেবেই নিজের নামটা বলে দেয় সে, ‘মিনু’।
‘বাহ! নামটা তো মাক্ষি’
মিনুর দিকে একটু ঝুঁকে এসে আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘কোন বাড়ির মাইয়া তুই?’
‘ঐ বাড়ি’ হাত তুলে নিজেদের বাড়ি দেখিয়ে দেয় ও। তারপর দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটতে যাবে, এমনি সময় হাত ধরে ফেলে দুলু। আকাশ ভেঙে পড়ে যেন ওর মাথায়, দূরে দাড়িয়ে সিকদার বাড়ির বউ ঝি’রা দেখছিল তার দুরাবস্থা, কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না।
মিনু চিৎকার দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে এসেছিল বাড়িতে। কিন্তু এ জগতের অনেক রহস্যই যে তার অগোচরে ছিলো তা বুঝতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল তার। সে আশ্চর্য হয়ে দেখেছে এ দুনিয়ায় পুরুষ মানুষের শক্তিমত্তা। সব কিছুই তাদের দখলে; সেখানে মা বোন স্ত্রী কেউ যেন আপন নয় সব কিছুর সাথে অর্থ আর সম্পদের সম্পর্ক। ভালবাসা মুহুর্তেই যেন অর্থহীন হয়ে যায়।
ঘটনা শুনে মিনুর বাবা রহিদুল মিয়া মেয়ের উপরই ক্ষেপে যান, সব দোষ হয় মিনুর। মিনু অবাক হয়ে শোনে তাঁর বাবা পর্যন্ত বলছে, ‘ক্যান তুই এই ভর সন্ধ্যার সমে বাড়ির বাইরে গেছস? পোলারা তো এমন করবোই। ’ তারপর মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘সব দোষ তোমার ঐ ধিঙি মাইয়ার, অয় যদি লাই না দেয় তাইলে কি আর পোলারা এমুন করে?’
কিন্তু মিনুর ঠিক মনে আছে সে যখন কাস এইটে বৃত্তি পেল, সে সময় বাবা মাকে প্রতিবেলায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন, ‘মাইয়া আমার বংশের ইজ্জত রাখছে, বুচ্ছোনি মইরম। অর দাদায়ও এইরম বুদ্দি নিয়া বেড়াইতো। ’
আজকে বাবা তার কাছে নিমিষেই পর হয়ে গেল।
মা’ও যেন মিনুর পর হয়ে যায় এ সময়ে, তিনি বাবার সাথে সুর মিলিয়ে বলে, ‘বিয়া দিয়া দেও, দ্যাকতাছো না নাচতাছে কেমনে?’
‘হ বিয়া কইলেই বিয়া হইয়া যায়, না?’
‘ক্যান, ওরে তো বিয়া করনের লাইগা মানুষ রাস্তায় খাড়ায়া আছে, হের লগেই দেও না ক্যা?’
‘হেই পোলায় কে?’ মিনুর বাবা সেই প্রথম যেন ঘটনার প্রতি আগ্রহী হয়েছিলেন।
‘কে আবার, মফিজ মোল্লার ছুডো পোলা, দুলু। ’
‘কও কি! তুমি জানলা কেমনে?’
‘দুলুর মায়ে হেইদিন আইছিল আমাগো বাড়িত, কইছিল পোলারে বিয়া দিবো। ’
‘কোন প্রস্তাব দিসে?’
‘না। তেমন কিছু কয় নাই।
তয় এ্যাখোন মনে হইতাছে হেরা মিনুরেই চায়। ’
‘পোলায় করে কি, জানো কিছু?’
‘ঢাকায় ব্যবসা করে শুনছি, রুনু কইলো আয়-উপার্জন ভালই’
‘আমাগো রুনু হেরে চিনে নি?’
‘তোমার পোলাও তো দুই দিন হইলো লাফাইতাছে ঢাকায় গিয়া দুলুর মতো ব্যবসা করবো। ’
‘আইচ্ছা। দেখি, খোজ খবর লই’ মিনুর বাবা যেন দুলুকে সেদিন থেক্ইে মেয়ে জামাই ভাবতে লাগলেন। এবং সত্যি সত্যিই একদিন দুলুর মা সহ চাচা মামারা মিনুকে দেখতে এলেন।
প্রথমে অস্বীকার করলেও মা বাবার সম্মান বাচাঁতে সেজেগুজে তাঁদের সামনে যেতে হয় মিনুর। ট্রেতে নাশতা হাতে তাঁদের সামনে যেতেই এক বৃদ্ধ বললেন, ‘ঘোমটাখান এট্টু খুইল্লা দেখাও তো মা জননী। আমি পোলার চাচা হই। ’
‘বাব্বা সোন্দর। এক্কেরে আমার মাইয়া বিলকিসের মতন পেরায়।
’
‘দেহি মা, তুমার চুলটা এট্টু দেহাও দেহি’ এবার মামা বলে উঠলেন।
এভাবে মিনুকে তাঁরা কোরবানির গরুর মতো বাছাই করলেন। শেষে হবু শ্বাশুড়ি বললেন, ‘এইবার তুমি ভিতরে যাও’ সে সুরটা ছিল যেন কড়া আদেশ।
মিনুর বিয়ে হয়ে গেল। ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটলো যেন রাতের ঘুমে এক গভীর স্বপ্ন দেখেছে সে।
সত্যিকার দুঃস্বপ্ন ছিল সেটা। পুরুষ আর স্বপ্নের পুরুষ তার এক হয়ে যায় নি। কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো মিনু? তার স্বপ্নের পুরুষটা কেমন ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর জানে না সে। অথবা আদৌ কোন পুরুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে কিনা মিনু জানে না। গায়ে হলুদের দিনে বাবলি এসেছিল ওর কাছে।
জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ভাইজানের লগে তোমার কি কিছু হইছে?’
‘না তো। ক্যান রে বাবলি?’
‘ভাইজান রে দেখলাম বুক ফাটায়া কানতাছে। ’
মিনু অবাক হয়। সে ভেবে পায় না কিছু। বাবলি আর বাবু মিনুর মামাতো ভাই-বোন।
শিশুকাল থেকে এক সাথে বেড়ে উঠেছে তারা। গতবার যখন মিনু আর বাবলি কাস নাইনে উঠলো বাবু মির্জা বাজার থেকে মিষ্টি এনে সবাইকে খাইয়েছিল। হাসতে হাসতে মিনুকে বলেছিল, ‘্আর এট্টু বড় হ, কলেজে উঠলে তোরে এই বাড়িতেই রাইখ্যা দিমু’
‘ক্যান?’ মিনু বাবুর কথা বুঝে উঠতে না পেয়ে বলেছিল।
‘আরে বুঝস না, তোগো দুই জনের এক সাথে কলেজে যাওনের রিক্সা লাগবো না?’
‘ও আইচ্ছা বুচ্ছি, তুমি হইবা হেই রিক্সাওয়ালা?’
সেদিন বাবলিদের বাড়িতে এ কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠেছিল। তাহলে কি সেদিন বাবু ভাই ঐ কথায় অন্য কিছু বোঝাচ্ছিল মিনুকে? মিনুর কাছে সেসব দিনের পুরোনো অনেক কথার নতুন অর্থ তৈরি হতে লাগলো।
সেই দিনগুলির কথা মনে পড়তে থাকে তার। বাবু ভাই আর বাবলির সাথে তাঁর বেড়ে ওঠা, এ বাড়ি ও বাড়ির মাঝে দৌড়ে বেড়ানোর স্মৃতিগুলো তার চোখে একের পর এক ভেসে উঠতে থাকে। মুচড়ে ওঠে বুকের ভেতর। মাত্র এই ক’দিন, এই কয়েকদিন যেন ওকে অনেক বেশি অভিজ্ঞ করে তুলেছে। নিতান্ত কিশোরী এক বালিকা থেকে সে এক নারী হবার যাত্রায় এক নিমিষেই যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করলো।
সেখানে মিনুর নিজের কোন পরিচয় নেই, নেই যেন আপন আত্মার কেউ। সবাই তার অযোগের সাথী, যোগ হয় শুধু নিন্দা আর অপমান।
কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠতে থাকে সে, বালিশে মুখ গুঁজেও চাপা থাকতে চায় না। কিন্তু প্রাণ খুলে কান্নাও তাঁর কপালে নেই। মিনুর রাত কাটতে থাকে শুধুই স্মৃতির পিঠে নতুন স্মৃতির মালা গেঁথে।
দুলুর ঢাকার এ বাসা থেকে কিছুদূর হাঁটলেই রেললাইন। ট্রেন যায় কিছু সময় পর পর। রাতে সেই শব্দ আরও জোড়ালো শোনা যায়। মিনু প্রতিবার এই শব্দ কান পেতে শোনে, কি বিরাট দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঐ দানবীয় যন্ত্রটা! ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় ওর, যেন আলিঙ্গন করে ঐ দানবটাকে। আবারও ফুপিয়ে ওঠে ও।
আজ দুপুরে কি অপরাধ ছিল ওর? শ্বাশুড়ির মাথায় তেল দিয়ে ভাত রাঁধতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই বাড়িতে এসে যাচ্ছে তাই ভাবে গালাগাল করে যাচ্ছিল বলে মিনু শুধু আস্তে চিৎকার করতে বলেছিল। সেটাই হলো কাল, শরীরে নেমে এলো অসহ্য অত্যাচার। চিৎকার আরও কয়েক মাত্রা বাড়িয়ে দিল দুলু। চোখ কপালে তুলে হুংকার ছাড়লো, ‘হারামজাদী।
আইজ তর একদিন কি আমার একদিন। ’
ইস্পাতের মতো শীর্ণ একটি হাত নেমে এলো মিনুর কোমল গালে।
‘আমারে মাইরেন না, মাইরেন না। আফনের পায় ধরি। ’ মিনু কাতর আর্তি জানিয়েছিল দুলুর পা জড়িয়ে।
‘তর বাপে কি দিসে রে, খানকি? পা তুইল্লা খাইবার চাস্। ’ দুলু হাতের কাছে বাঁশের বাতা পেয়ে সেটা মিনুর উম্মুক্ত পিঠে নির্দয়ভাবে আঘাত করতে থাকে।
মিনু জ্ঞান হারিয়েছিল দুলুর পায়ের কাছেই। আর তার জ্ঞানহীন দেহটাকে লাথি দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল সেই পাষন্ড। মাথা ঝাকায় মিনু, স্মরণ করতে চায় না ও।
কিন্তু তবুও দুপুরের ঘটনাগুলো বারবার ভেসে ওঠে ওর মনের পর্দায়। চোখ দিয়ে আঝোর ধারায় ঝরতে থাকে অশ্রু। সুখ কি? সুখ কোথায়? সত্যি সত্যি সুখ কি কোথাও নেই?
লেখাপড়ায় মনযোগী ছাত্রী ছিল সে। বিয়ের আগে বাবার কাছে মিনতি করেছিল মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত যেন অপেক্ষা করে। কিন্তু বাবার পরামর্শদাতারা বলেছিল, ‘রহিদুল মিয়া, মাইয়াগো এতো পড়ালেখা করণ ভালা না।
পরে দেইখো তোমার মুখে চুনকালি না লেইপা দেয়। ’
তাই মিনুর বাবা চুনকালির ভয়ে বিয়ের তোড়জোড় বাড়িয়েছিলেন।
বিয়ের পর মিনু সব কিছু মেনে নিয়ে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল। জীবনটা সিনেমার মতো মনে হয়েছিল প্রথমটায়। যেন তার বিনয় আর নমনীয়তায় স্বামী-সংসার আর শ্বশুড়-শ্বাশুড়িকে জয় করে নেবে।
কিন্তু নিয়তি হেসেছিল তার অগোচরে, অচিরেই সে বুঝতে পেরেছিল এ বাড়িতে তাঁর অবস্থান কেবল সেবাদাসী হিসেবে। সেখানে সিনেমার শেষ দৃশ্য, জীবনেরই শেষ দৃশ্যের। মিনু তার জীবন ছবিটা অদৃশ্য পর্দায় দেখতে পায়।
গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে এই ছবিতে নতুন মাত্রা যোগ হয় যখন দুলুকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল। সেদিনই প্রথম সে জানতে পারে তার স্বামী মাদক ব্যবসায়ী।
মধ্য রাতে তার নির্বাক চোখের সমুখে দুলু নিশ্চিন্তে উঠে বসে পুলিশের গাড়িতে। শ্বাশুড়িকে দেখেও মিনু অবাক হয়, ঘটনা তাদের কাছে এতোই সাধারণ যেন প্রাত্যহিক কাজের মধ্যে এটাও একটা। তিনি নির্ভাবনায় প্রতিবেশিদের বাড়ি বাড়ি ছেলের বউয়ের নিন্দা অব্যহত রাখেন। কোমড়ে হাত দিয়ে পাশের বাসায় গিয়ে বলতে থাকেন, ‘বুজলা পলাশের মাও, আমার পোলার বউডা মনে হয় বাঞ্জা, পোলাপাইন হইবো না নাকি?’
‘কি যে কন খালা, বউতো এহনো ছুডো মানুষ। আর কয়েক দিন যাউক।
’ পলাশের মা উত্তর দেয়।
‘আর কত? দুই বৎসর হইয়া গেল। ’
‘কারো কারো তো হুনছি এট্টু দেরী কইরাই বাল-বাচ্চা হয়। ’
‘ভুল শুনছো, তোমরা কি আমার চায়া দুনিয়াদারী বেশি দেখছো?’
‘না না খালা, এইডা কি কন? আফনে মুরুব্বি মানুষ। ’
দুলু বাসায় ফেরে পরদিন দুপুরেই।
মিনু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘পুলিশ আফনেরে ছাইড়া দিল?’
এ প্রশ্নে দুলু হা হা করে হেসে উঠে। বলে, ‘শোন বউ, পুলিশ যাগো আব্বা আব্বা করে, রাইতদিন সালাম ঠুকে, হেরা আমারে ছাড়াইয়া নিয়া আসে। পুলিশের সাধ্যি আছে আমারে আটকায়া রাখার। ’
মিনু আরও অবাক হয়। সে আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘হেরা কারা?’
‘অতো চিনোনের দরকার কি তর?’
এর পর থেকে মিনুর কাছে কিছু ঢেকে রাখার বালাই থাকে না দুলুর, মিনুও কিছু বলতে পারে না।
কেন পারে নি! সংস্কারে? স্বামী সংসারের সংস্কার, নাকি বাবা-মায়ের উপর অভিমান? বুঝে উঠতে পারে নি সে। বাবা বলেছিল, ‘স্বামীর ঘরই মাইয়াগো আসল ঘর মা, সেই ঘরের সুখই তর সুখ। ’
মিনু শুধু তাকিয়ে ছিল বাবার মুখের দিকে, এক ঘোরের মাঝে সে তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে তখন ভাবছিল এ দুঃস্বপ্নের শেষ কখন হবে? তাই তাকে যখন শ্বশুড় বাড়ির একটি ঘরে উঠানো হলো, সে ভেবেছিল এবার হয়তো দুঃস্বপ্নের অবসান হবে। কিন্তু না সেটা যে সবে শুরু তা বোঝার অভিজ্ঞতা তখনো তার হয়নি, তখনো কি জানতো যে স্বামী অর্থ মালিক? সেই মালিকানা শুধু সেবায় নয়, শরীরও অধিকার করে মনের অধিকার পাওয়ার আগেই।
প্রতিদিন গভীর রাতে বাড়ি ফেরে দুলু। রাত জেগে বসে থাকতে হয় মিনুর। কখনো কখনো ঝিমুনি এসে যায় তার আর সেই সময়টুকুতে দুলু এসে হাজির হয়, দরজা ধাক্কায়। বিশ্রী ভাষায় গালাগাল করে উঠে। দুদিন আগের কথা ভাবে মিনু।
সেদিনও এমনি অপেক্ষায় থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে, এরই মধ্যে দুলু হাজির হয়।
‘ওই হারামজাদী। দরজা খোল। ’ ঢুলতে ঢুলতে দরজা ধাক্কাতে থাকে সে।
‘আহি...’
‘কিরে হারামজাদী, পইরা পইরা খালি ঘুমাস...অ্যা।
’
‘আইতাছি খাড়ান’
‘তর আহন বাইর করমু খাড়া। ’
মিনু তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলেছিল। দুলু ঘরে ঢোকে, ওর মুখ দিয়ে উৎকট গন্ধ বেড় হতে থাকে। গন্ধে মিনু নাকে আঁচল চেপে ধরে।
‘কি রে ঘুমাইছিলি ক্যান? জানস না আমি বাইরে।
’ মাতলামি শুরু করে দুলু।
‘ডেলি ডেলি ঐ হারাম জিনিস খাইয়া আইবেন, আর আমি রাইত কইরা জাইগা থাকুম। ক্যান?’
‘কি, কি কইলি! জাইগা থাকবি না? তর বাপ থাকবো হারামজাদী। ’ দুলু চিৎকার দিয়ে ওঠে।
‘দ্যাহেন, খালি হারামজাদী কইবেন না, বিয়ার সমে মনেছিল না?’
‘চোপ।
চোপ কথা কইবি না। ’ ওর চুল ধরে মারতে থাকে দুলু। এক পর্যায়ে পড়ে গিয়েছিল মিনু। দুলু গিয়ে শুয়ে পরেছিল বিছানায়।
জীবনটাকে যদি আবার নতুন করে সাজানো যেত! মিনু অনুভব করে, এই ঘর এই বিছানা আর এই রান্নাঘরের ঘোরটোপ থেকে যদি সত্যিই মুক্তি মিলতো তার।
পাশের বাসার জরিনাকে চেনে সে, যৌতুকের কারণে সংসার ভাঙা মেয়ে; এখন গার্মেন্টসে কাজ করে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে পুরো সংসার টেনে চালাচ্ছে সে। ওর ছোট বোন রুবিনা, পড়ালেখার পাশাপাশি সেও কাজ করে। মিনু কি ইচ্ছে করলেই আবার শুরু করতে পারে না? মনের গহীন থেকে মিনু টের পায় এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
ভোর থেকেই এ গলিতে মহা হুলুস্থুল পড়ে যায়।
জীবিকার সন্ধানে ছুটতে থাকে সবাই। কেউ কেউ সারারাত কাজ করে ফিরে আসে এ সময়। এরই মাঝে রাস্তা খোঁড়াখুড়ির কাজ শুরু হয়। শ্রমিকদের হাঁকডাক আর যানবাহনের ক্রমাগত ভেঁপুর চিৎকারে সরগরম হয়ে উঠে গলির পরিবেশ। দুলু বেড় হয়ে যায়, সাথে কখনো কখনো মিনুর শ্বাশুড়িও যায় তাঁর বড় মেয়ের বাড়িতে, মিনু থাকে একা।
এভাবে গত দুটি বছর তার পার হয়ে গেছে, শ্বাশুড়ি তাঁর মেয়ের বাড়িতে গেলে কোন কোনদিন আর ফেরেন না। মিনু একই মাতালের অপেক্ষায় থাকে মধ্যরাত অবধি একা। আজও সকালে ছুটে গেছে সবাই। কিন্তু আজ দিনটি প্রতিদিনের মতো নয়, আজ মিনু নিজেও প্রস্তুত হয়। নিজের জন্যে তার এখনও অনেক কিছু করার আছে।
[ প্রুফ সংশোধন যোগ্য ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।