আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জুটিন নিয়ে কিছুক্ষণ…বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশন এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোবারক আহমেদ খান যিনি পাট থেকে আবিষ্কার করেছেন টিনের বিকল্প পরিবেশবান্ধব টিন ‘জুটিন’।গত ২৫ মে GreenMagz.info তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেয়।সাক্ষাৎকারটি নিচে প্রকাশিত হল।

আমি খুব সাধারণ একজন। সাধারণের ভিড়েই আমার বেড়ে ওঠা ,সাধারণের ভিড়েই বিচরণ আর সাধারণের ভিড়েই পথ চলা ...... বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশন এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোবারক আহমেদ খান যিনি পাট থেকে আবিষ্কার করেছেন টিনের বিকল্প পরিবেশবান্ধব টিন ‘জুটিন’। গত ২৫ মে GreenMagz.info তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেয়। সাক্ষাৎকারটি নিচে প্রকাশিত হল। GreenMagz: স্যার আসসালামু আলাইকুম।

Dr Mubarak Ahmed Khan: ওয়ালাইকুম আসসালাম। GreenMagz: স্যার প্রথমেই জানতে চাই জুটিন আসলে কি? Dr Mubarak Ahmed Khan: জুটিন হল পাটের দ্বারা তৈরি ঢেউটিন । যেহেতু পাট থেকে এই টিন তৈরি করা হয়েছে তাই এর নামকরন করা হয়েছে জুটিন । এতে টিন বা মেটাল জাতীয় কিছু নেই । Conventional নামের সাথে মিল রেখে এর নামকরণ করা হয়েছে জুটিন।

GreenMagz: বাজারে প্রচলিত যে ঢেউটিন গুলো পাওয়া যায় এর সাথে জুটিনের পার্থক্য কি? Dr Mubarak Ahmed Khan: হ্যাঁ, বাজারে যে ঢেউটিন গুলো পাওয়া যায় সে গুলোকে Metallic Corrugated Sheet বলা হয় আর আমাদের এটি হলো প্লাস্টিক বেইসড টিন এবং এখানে মূল যে উপাদান তা হল প্রায় ৩৫ -৪০% পাট । এখন পর্যন্ত আমাদের গবেষণায় প্রায় ৭০% পর্যন্ত পাট ব্যবহার করতে পেরেছি। মূল পার্থক্য হল বাজারের ঢেউটিন যেহেতু মেটালিক ঢেউটিন তাতে খুব দ্রুত জং ধরে যায় আর জুটিনে যেহেতু কোন মেটাল নেই তাই এতে জং ধরার কোন সম্ভাবনাই নেই । দ্বিতীয়ত ,জুটিনের Thermal Conductivity বা তাপ পরিবহন ক্ষমতা শূন্য ,যে কারনে প্রচলিত ঢেউটিন দ্বারা তৈরি ঘর এর মত গরম হবেনা বরং গরম কালে ঠাণ্ডা এবং শীতকালে মাটির ঘরের মত গরম অনুভুত হবে । আরেকটি হল এটি ঢেউটিন এর তুলনায় হাল্কা এবং টেকসই ।

বাজারে যে ঢেউটিন পাওয়া যায় তা সম্পূর্ণ বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এবং এতে লেড(Pb) এবং জিঙ্ক(Zn) নামক বিষাক্ত হেভি মেটাল থাকে। জুটিনে এমন কোন বিষাক্ত পদার্থ নেই। GreenMagz: তাহলে আমরা বলতে পারি নিঃসন্দেহে জুটিন একটি পরিবেশবান্ধব পণ্য। Dr Mubarak Ahmed Khan: নিঃসন্দেহে। GreenMagz: ঘরবাড়ি তৈরি ছাড়া জুটিন অন্য কি কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে? Dr Mubarak Ahmed Khan: যদিও টেকনলজিকালি এটাকে বলা হচ্ছে ঢেউটিন ,এই টেকনোলজি দিয়ে চেয়ার ,টেবিল থেকে শুরু করে কাঠের বিকল্প যা আছে সব জায়গাতেই এটি ব্যবহার করা সম্ভব।

GreenMagz: তাহলে আমরা বলতে পারি পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এটি ভুমিকা রাখতে পারবে। Dr Mubarak Ahmed Khan: নিঃসন্দেহে এবং পাটের সদ্ব্যবহার ও বলতে পারি। GreenMagz: জুটিন উৎপাদনে পাট ব্যাতীত অন্য কি কি কাচামাল ব্যবহিত হয়? Dr Mubarak Ahmed Khan: জুটিনে পাট ব্যাতীত আরেকটি যেটা থাকছে তা হল পলিমার বা রেসিন । আমরা বলি Unsaturated polyester Resin এর সাথে যা থাকছে কিছু কেমিক্যাল মিক্সিং যেমন কাপ্লিং এজেন্ট, কালার এবং পারক্সাইড জাতীয় কিছু কেমিক্যাল যাতে এটি জুটের সাথে অনায়াসে বিক্রিয়া করতে পারে। GreenMagz: তাহলে জুটিনে কোন ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ নেই।

Dr Mubarak Ahmed Khan: নিঃসন্দেহে কোন ক্ষতিকারক পদার্থ থাকেনা এমনকি জুটিন উৎপাদন পদ্ধতিটিও পরিবেশবান্ধব। GreenMagz: বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশগত দিক থেকে জুটিন কতটা টেকসই? বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবন অঞ্চল এবং উপকূলের দরিদ্র মানুষেরাই টিন দিয়ে ঘর তৈরী করে থাকে । সেক্ষেত্রে জুটিন কতটা উপযোগী? Dr Mubarak Ahmed Khan: জুটিন বর্তমানে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে তৈরি করা হচ্ছে যা কম দামী ঢেউটিনের তুলনায় আপাতদৃষ্টিতে বেশি দামের মনে হলেও প্রচলিত ঢেউটিন গুলো ৫০০০ টাকা বান্ডল থেকে শুরু করে মেকানিকাল প্রপারটিস এর উপর নির্ভর করে ২০০০০-২৫০০০ টাকা বা তারও বেশি দামের হয়ে থাকে । সেক্ষেত্রে জুটিন যদি কমার্শিয়াল ভাবে উৎপাদন করা যায় তবে বাজারের ঢেউটিন থেকেও এটি সস্তা হবে। জুটিন অত্যন্ত টেকসই ।

আমরা কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে দেখেছি এটি ১০০ বছরের বেশি টেকসই হবে। GreenMagz: বাংলাদেশের সোনালী আঁশের একসময় অনেক চাহিদা ছিল। কিন্তু সেই গৌরবোজ্জ্বল দিন গুলো ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে গেছে ,এই অবস্থায় পাট নিয়ে কিছু করার চিন্তা ভাবনা আপনার মাঝে কিভাবে কাজ করে? Dr Mubarak Ahmed Khan: পাট কে সোনালী আঁশ বলা হত এটিকে past tense না বলে আমি বলব যে সোনালি আঁশ বলা যায় যদিও এই গৌরব আমরা হারাতে বসেছিলাম। এ ক্ষেত্রে জুটিন যা দিয়ে ঢেউটিন ছাড়া অন্যান্য জিনিস যদি আমরা তৈরি করতে পারি ,যেহেতু এটি পরিবেশবান্ধব তবে শুধু বাংলাদেশেই নয় গ্লোবাল মার্কেটে এর প্রচুর চাহিদা থাকবে। যার প্রমাণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুণ শিক্ষার্থীরা আমেরিকা থেকে গ্লোবাল স্যোশাল ভেঞ্চুর প্রতিযোগিতায় ২য় পুরস্কার অর্জন করে।

এটি প্রমাণ করে গ্লোবাল মার্কেটে এর প্রচুর চাহিদা আছে এবং এটি তৈরী করলে আবার বাংলাদেশের পাটের চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পাবে। GreenMagz: জুটিনের শুরুর দিকের কিছু কথা জানতে চাই , জুটিন নিয়ে গবেষণা কিভাবে শুরু হল? Dr Mubarak Ahmed Khan: জুটিন নিয়ে গবেষণার শুরুর কথা বলতে গেলে ,আমি প্রায় দুই –আড়াই দশক যাবত পাট নিয়ে কাজ করছি। পাটের কম্পোসিট তৈরী করা নিয়ে কাজ করি । এক সময় আমি যখন জার্মান এবং আমেরিকার মিশিগান স্টেট ইউনিভারসিটিতে কাজ করতাম তখন তাদের কিছু প্রপোজাল এসেছিল গাড়ির বডি এবং এরোপ্লেন বা ট্রেনের অভ্যন্তরীন বডি তৈরি নিয়ে কাজ করার। তখন আমি চিন্তা করলাম এই দেশের কাজ আমি অন্য দেশে রেখে যাচ্ছি ।

তখন বাংলাদেশের জন্য উপযোগী কিছু তৈরি করার কিছু চিন্তা করি কারন এরোপ্লেনের বডি তৈরি এ দেশের জন্য লাভজনক হবেনা। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে কি তৈরী করা যায় সেটি চিন্তা করতে লাগলাম । তখন আমার মনে হল এই টিনের বিকল্প যদি টেকসই কিছু তৈরি করা যায় কিনা এভাবেই মূলত জুটিনের যাত্রা শুরু । GreenMagz: বর্তমানে সারাবিশ্বে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও গবেষণা নিয়ে কাজ করতে বিজ্ঞানীরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন । সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় বলে আপনি মনে করেন? Dr Mubarak Ahmed Khan: সারা বিশ্বে পরিবেশবাদীরা যেভাবে সোচ্চার হয়ে উঠছে ,পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি করতে বলা হচ্ছে ।

বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা যে পিছিয়ে আছে আমার মনে হয় না কারন বাংলাদেশে বিচিত্র প্রাকৃতিক সম্পদ আছে যা দ্বারা পরিবেশবান্ধব জিনিস তৈরি করা সম্ভব। GreenMagz: যেমন? Dr Mubarak Ahmed Khan: আমরা অনেক সৌভাগ্যবান যে আমাদের একটি সেন্টমারটিন নামক কোরাল আইল্যান্ড আছে । অনেক উন্নত দেশেও এই কোরাল আইল্যান্ড নেই । এই আইল্যান্ড এ যে ধরণের শ্যাওলা জন্মে। এটি অত্যন্ত উপকারি এবং এটি থেকে আমরা পরিবেশবান্ধব পলিব্যাগ তৈরি করছি ।

আমরা এখন ফাইবার অ্যাপ্যারেন্ট কাপড় তৈরি করার চিন্তা ভাবনা করছি। GreenMagz: বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক তরুণ শিক্ষার্থী গবেষণা কাজে আগ্রহী হয়ে উঠছে । একজন সফল গবেষক হিসেবে আপনি তাদেরকে কি পরামর্শ দিতে চান? Dr Mubarak Ahmed Khan: বর্তমানে তরুণদের গবেষণার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে ঠিকই কিন্তু এর পাশাপাশি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাও দরকার আছে এই দেশে ধরে রাখার জন্যে। দেখা যাচ্ছে যে শিক্ষার্থীরা গবেষণা করতে চায় কিন্তু যথাযথ ইনফ্রাস্ট্রাকচার না থাকার কারণে তারা সুযোগ পাচ্ছেনা ফলে তারা বিদেশে চলে যাচ্ছে। যাকে আমরা ব্রেইন ড্রেইনেজ বলছি ।

এখনও সময় আছে সরকার যদি সুযোগ সুবিধা দেয় তবে আমরা এ দেশের শুধু মেধাবী নয় অত্যন্ত মেধাবি শিক্ষার্থী যারা আছে তাদের কে সবাইকে নিয়ে এক সাথে কাজ করতে পারব। GreenMagz: বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্রে কি কি অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় বলে আপনি মনে করেন? Dr Mubarak Ahmed Khan: সবচেয়ে বড় যে সমস্যা সেটি হল অর্থায়ন । গবেষণার ক্ষেত্রে বা বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে যে বাজেট থাকা দরকার জাতীয় বাজেটেও সে পরিমাণ অংশ রাখা হয়না । উপযুক্ত অংশ বাজেটে রাখতে হবে। এখন পৃথিবী অনেক এগিয়ে,অনেক নতুন ধরণের যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ হচ্ছে ।

সেগুলো আমরা ব্যবহার করতে পারলে আমাদের তরুণ গবেষকদের এ দেশে রেখেই কাজ করানো সম্ভব । আর কোন কিছু আমাদের দরকার নেই । আমাদের মেধা আছে ,শক্তি আছে ,ইচ্ছা আছে কিন্তু আমাদের সাধ্য নেই। GreenMagz: ব্যবসায়িক পর্যায়ে জুটিনের উৎপাদন কি শুরু হয়েছে? Dr Mubarak Ahmed Khan: না ,জুটিন পেটেন্টেড প্রোডাক্ট । অনেক ব্যবসায়িরা আমাদের কাছে এসেছেন কিন্তু এ ক্ষেত্রে যেটি প্রয়োজন হয় ল্যবরেটরি থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে যেতে হলে মাঝখানে একটা পাইলট প্রজেক্ট তৈরি করতে হয় ।

সরকারের কাছে আমরা পাইলট স্কেলে তৈরী করার জন্য ফান্ড চেয়েছি । খুব শীঘ্রই ফান্ডটি পেলে ল্যাবরেটরি স্কেল থেকে পাইলটিং করে কি ধরণের মেশিন তৈরি করতে পারলে জুটিন উৎপাদন করা যাবে। তা তৈরি করা যাবে । কারণ জুটিন একটি নতুন আবিষ্কার । কি ধরণের মেশিন দিয়ে এটি তৈরি করা যায় তা এখনও পৃথিবীতে তৈরি করা নাই ।

তখন আমরা চিন্তা ভাবনা করে সেই মেশিনটি তৈরি করব। GreenMagz: সব শেষে Greenmagz.info এর পক্ষ থেকে জুটিনের মত একটি যুগোপযুগী আবিষ্কারের জন্য অসংখ্য অভিনন্দন। Dr Mubarak Ahmed Khan: আপনাকেও ধন্যবাদ ,আপনাদের মাধ্যমে জুটিন বহুল প্রচারিত হোক এই আশাবাদ রাখছি। -সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আদিব খোন্দকার রাতুল এবং ফটোগ্রাফি মাহবুবুর রাহমান অপু। মূল লেখার লিঙ্ক ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।