আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জেনে নিন রোহিঙ্গাদের উদ্ভব ও বিকাশ

সম্প্রতি মিয়ানমারে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায় এবং বৌদ্ধ রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যকার দাঙ্গায় ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনটা হল খবর। তো যাই হোক। ছোট বেলা থেকে এই রোহিঙ্গা শব্দটা খালি শুনেই আসছি।

কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না। তো আজকে বসে গেলাম রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে। অনেক সময় ব্যয় করে কিছুটা জানতে পারলাম। এই রোহিঙ্গাদের উদ্ভব ও বিকাশ মোটামুটি বিতর্কিত। নানা মুনি নানা মত দিয়েছেন।

আমি এই মত গুলোকে যথাসম্ভব গুছিয়ে মোটামুটি সহজ ভাবে ধাপে ধাপে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। পড়ে দেখুন ভালো লাগলেও লাগতে পারে। প্রথমত, রোহিঙ্গারাই আরাকানের প্রথম বসতি স্থাপনকারী আরব মুসলমান হিসেবে প্রচ্ছন্নভাবে দাবী করে খলিলুর রহমান নামে জনৈক লেখক উল্লেখ করেন যে, "রহম" শব্দ থেকেই রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি হয়েছে। অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দীতে আরাকানে চন্দ্রবংশীয় রাজাদের শাসনামলে বৈশালী ছিল তাদের রাজধানী। সে সময় চন্দ্রবংশীয় রাজা মহৎ-ইঙ্গ-চন্দ্রের রাজত্বকালে (৭৮৮-৮১০ খ্রিঃ) কয়েকটি আরব মুসলিম বাণিজ্য বহর রামরি দ্বীপের পাশে বিধ্বস্ত হলে জাহাজের আরোহীরা রহম রহম বলে চিৎকার করে।

এ সময় স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে আরাকানের রাজার কাছে নিয়ে যায়। আরাকানরাজ তাদের বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত আচরণে মুগ্ধ হয়ে আরাকানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের অনুমতি দান করেন। আরবি ভাষায় অনভিজ্ঞ স্থানীয় লোকজন তাদেরকে 'রহম' গোত্রের লোক মনে করে 'রহম' বলে ডাকতো। ক্রমশ শব্দটি বিকৃত হয়ে রহম>রোঁয়াই>রোয়াই> রোয়াইঙ্গা বা রোহিঙ্গা নামে খ্যাত হয়। দ্বিতীয়ত, আরাকান মুসলিম কনফারেন্সের সভাপতি ও সম্পাদক যথাক্রমে জহির উদ্দিন আহমদ ও নাজির আহমদ এ বক্তব্যের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন।

তারা মনে করেন যে, রহম রহম বলে চিৎকারকারী জাহাজ ডুবি মুসলমানদের ঘটনা সত্য। তবে তা রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয়ে থাম্ভইক্যাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়াই যুক্তিযুক্ত। কেননা আরাকানী থাম্ভইক্যা শব্দের অর্থ হলো জাহাজ ডুবি থেকে রক্ষা পাওয়া। অথচ থাম্ভইক্যাগণ নিজেদের রোহিঙ্গা হিসেবে দাবী করেনা। কিংবা অন্যরাও তাদেরকে রোহিঙ্গা নামে ডাকে না।

যদি রোহিঙ্গা শব্দটি আরবি রহম থেকেই উদ্ভুত হত তবে থাম্ভইক্যারাই রোহিঙ্গাদের প্রথম দল বলে পরিচিত হত। মূলত লেখক খলিলুর রহমান উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আরাকানের রোহিঙ্গাদেরকে কুলীন প্রতিপন্ন করার নিমিত্তে তাদেরকে জাহাজ ডুবি থেকে রক্ষা প্রাপ্ত বসতি স্থাপনকারী আরব নাবিকদের বংশধর হিসেবে দাবী করেছেন বলে তারা মন্তব্য করেন। তারা আরো উল্লেখ করেন যে, রোহিঙ্গারা আফগানিস্তানের অন্তর্গত 'ঘোর' প্রদেশের রোহা জেলার অধিবাসীদের বংশধর। মূলত তারা তুর্কী কিংবা আফগানী। কেননা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজীসহ বাংলার মুসলমান বিজেতা ও শাসকগণ ইসলাম প্রচার ও প্রসারের নিমিত্তে আফগানিস্তানের রোহার অঞ্চলের কিছু ব্যক্তিকে আরাকানে প্রেরণ করেছিলেন।

উক্ত রোহার অঞ্চলের মুসলমানরা আরাকানের নামকরণ করেছিলেন রোহাং। এ রোহা ও রোহাং শব্দ থেকেই রোহিঙ্গা নামকরণ হয়েছে বলে তারা মনে করেন। তারা আরও উল্লেখ করেন যে, আরাকান ও চট্টগ্রামে প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষায় সাধু ভাষার শ,ষ,স, মৌখিক উচ্চারণে 'হ' উচ্চারণ শোনা যায় এবং 'হ'কে শ, ষ, স, উচ্চারণ করে থাকে। এ পদ্ধতিতে হয়তো রোহাং>রোসাঙ্গ হয়েছে। রোহার অঞ্চলের মুসলমানরা যেহেতু নিজেদের রোহাইন বলে পরিচয় দেয় সেহেতু আরাকানে এ রোহাইন শব্দ থেকেই রোহিঙ্গা হয়েছে বলে তারা মনে করেন।

তৃতীয়ত, আরেক ঐতিহাসিক এম এ চৌধুরী মনে করেন রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি ম্রোহং শব্দ থেকে হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আরাকানের বিতাড়িত রাজা নরমিখলা ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহের প্রত্যক্ষ সহায়তায় হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করে মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম নিয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি রাজধানী লংগিয়েতের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে রামু বা টেকনাফ থেকে শত মাইলের মধ্যে লেম্ব্রু নদীর তীরে ম্রোহং নামক স্থানে রাজধানী স্থানান্তর করেন। এটাই ছিল আরাকানের শেষ অবধি (১৭৮৫ খ্রিঃ পর্যন্ত) রাজধানী। এ ম্রোহং শব্দটি মুসলমানদের মুখে এবং লেখায় রোহাং উচ্চারিত হয়।

এভাবে রোয়াং> রোহাং> রোহিঙ্গা নামকরণ হয়েছে। উল্লেখ্য, সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষাল এবং আহমদ শরীফ প্রমুখ মনে করেন যে, রাজধানীকে কেন্দ্র করে লেখকগণ রাজ্যের নাম লিখেছেন। যেমন রোমান সাম্রাজ্য, দিল্লী সাম্রাজ্য প্রভৃতির মত রাজধানী ম্রোহংয়ের নামেই আরাকানকে চিহ্নিত করা হত। তবে ম্রোহং শব্দটি সাধারণ উচ্চারণে রোহাং হয়েছে, আবার পূর্ব বাংলার কথ্য ভাষায় 'স' 'হ' উচ্চারণের রূপান্তরের কারণে রোহাং শব্দটিও রোসাঙ্গ হয়েছে। যেমন ম্রোহং>রোয়াং>রোহাং> রোসাঙ্গ ইত্যাদি।

এ কারণেই রোহাঙ্গ রাজ্যকে রোসাঙ্গ রাজ্য বলে লেখকরা অভিহিত করে থাকেন। এক কথায় বলা যায়, আরাকানের শেষ রাজধানী ম্রোহং; এর সাধারণ উচ্চরণ রোহাং। এ রোহাং এর মুসলিম অধিবাসীদেরকে রোহিঙ্গা বলা হয়। তবে বার্মিজ ঐতিহাসিকরা এই সবগুলো সম্ভাবনাকে এক কথায় উড়িয়ে দেন। খিন মং নাকের এক ইতিহাস বেত্তা মনে করেন ১৯৫০ সালের পূর্বে রোহিঙ্গা বলে কিছু ছিল না।

এমনটা ড. মং মং এর কথায় ও ফুটে উঠেছে। তিনি দেখিয়েছেন ব্রিটিশদের দ্বারা পরিচালিত ১৮২৪ সালের জরিপের কোথাও রোহিঙ্গা বলে কোন শব্দ নেই। জাপানের কান্ডা ইউনিভার্সিটি অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ এর গবেষক আয়ে চান ও এ সম্পর্কে প্রায় একই মত প্রকাশ করেন। তার ধারণা পঞ্চাশের দশক বা এর কাছাকাছি সময় আরাকানে মাইগ্রেটেড হওয়া বাঙালিদের বংশধররা রোহিঙ্গা শব্দের প্রচলন করেন। এদিকে স্থানীয় ইতিহাস বিশারদ আবদুল হক চৌধুরী মনে করেন যে, প্রধানত আরাকানে বসতি স্থাপনকারী চট্টগ্রামী পিতার ঔরসে ও আরাকানী মগ মাতার গর্ভে জন্মগ্রহণকারী আরাকানী ও চট্টগ্রামী উপভাষী মুসলমান বর্ণসংকর জনগোষ্ঠীই হল আরাকানের রোহিঙ্গা গোত্র।

কালক্রমে আরাকানের রোহিঙ্গা গোত্রের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও পরবর্তীতে নতুন নতুন চট্টগ্রামী বসতি স্থাপনকারীদের আগমনের ফলে তাদের সংখ্যা অধিক হয়। তখন নিজেদের গোত্রের মধ্যে মুখ্যত বিয়ে-শাদী সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে তারা চট্টগ্রামী উপ-ভাষাকে আরাকানের রোহিঙ্গা গোত্রের পারিবারিক ভাষা হিসেবে চালু রাখতে সক্ষম হয়। আরাকানে রোহিঙ্গাদের উদ্ভব সম্পর্কে তিনি তিনটি পর্বের উল্লেখ করেন।  আরাকানের রাজা নরমিখলা দীর্ঘ ২৪ বছর (১৪০৬-১৪৩০ খ্রিঃ) বাংলার সুলতানদের আশ্রয়ে গৌড়ে অবস্থান করেন।

অতঃপর সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ কর্তৃক দু’পর্বে পঞ্চাশ হাজার গৌড়ীয় সৈন্য দিয়ে আরাকানের রাজধানী পুনরুদ্ধার করে দিলে নরমিখলা সোলায়মান শাহ নাম নিয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। আরাকানের পুরাতন রাজধানী পুরাতন রাজধানী লঙ্গিয়েত বারবার পরাজয়ের কারণে তার কাছে অকেজো বিবেচিত হয়। সেই সাথে বার্মার সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে থাকার জন্য গৌড়ীয় মুসলিম সেনাপতির পরামর্শে ম্রোহং নামক স্থানে রাজধানী স্থানান্তর করা হয়। নরমিখলা মগদের বিশ্বাস করতে পারেনি হেতু নতুন রাজধানীকে সুরক্ষিত করার জন্য মগ বসতির চারদিকে গৌড়ীয় মুসলমানদের বসতি গড়ে তোলেন। এ সময়ে আগত মুসলিম সৈনিকদের পাশাপাশি পরবর্তীতে তাদের আত্মীয় স্বজন এবং বিভিন্ন পেশার শ্রমিকগণ আরাকানে বসতি স্থাপন করেন।

এ শ্রমিক শ্রেণির বেশীরভাগ লোকই ছিল চট্টগ্রামের অধিবাসী। সুতরাং তাদের বংশধরগণই রোহিঙ্গা নামে খ্যাত হয়।  ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় পঁচাশি বছরব্যাপী চট্টগ্রাম একাধিকক্রমে আরাকানের শাসনাধীনে ছিল। এ সময়টা ছিল পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার পর্তুগিজ ও আরাকানী মগ জলদস্যুদের দাস ব্যবসার কালো যুগ। তখন চট্টগ্রাম ছিল আরাকানীদের শাসনাধীন এবং আরাকান রাজসভায় বড় ঠাকুর, মাগন ঠাকুর, আশরাফ খাঁ, সোলায়মান, নবরাজ মজলিশ, সৈয়দ মুহাম্মদ প্রমুখ বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।

আরাকানের বিচারকের আসনেও অধিষ্ঠিত ছিল মুসলমান কাজি। এমনকি সেনা বিভাগেও ছিল মুসলমান সৈনিক। আরাকান রাজসভায় দায়িত্ব পালনকারী এ সকল মুসলমানগণের অধিকাংশই ছিলেন চট্টগ্রামী। সুতরাং এ সময়ে চট্টগ্রাম থেকে মানুষ চুরি করার চেয়ে তারা বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে অপহরণকার্য বেশি চালিয়েছে। পক্ষান্তরে চট্টগ্রাম-আরাকানে চাকরি ও ব্যবসার উদ্দেশ্যে আরাকান যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।

আরাকানে অবস্থানরত গৌড়ীয় দাসগণও এদের সাথে যুক্ত হতে পারে। সুতরাং এ পর্বেও রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।  ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধে আরাকান ইংরেজদের অধিভুক্ত হয়। তখন বাংলা-চট্টগ্রাম ও আরাকান একই শাসনভুক্ত হবার কারণে বাংলার অনেক জনগণ অস্থায়ী ও স্থায়ী ভিত্তিতে জীবিকার অন্বেষণে চট্টগ্রামে যায়। এভাবে অনেক কৃষক-শ্রমিক আরাকানে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে।

রাজা নরমিখলার মৃত্যুর পর ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা মিনখেরী ওরফে আলী শাহ আরাকানের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে আরাকান গৌড়ের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়। ফলে তখন গৌড়ের কিছু সৈনিক ফিরে এলেও অধিকাংশ সৈনিক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক আরাকানেই স্থায়ী আবাসন গড়ে তোলে। এই হল মোটামুটি রোহিঙ্গাদের উদ্ভব ও বিকাশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.