অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়
জীবিত মানুষের এটাই শেষ সুযোগ। এমন সুযোগ বারবার আসে না। সূর্যকে অতিক্রম তা’ও আবার শুক্রের। ভাবা যায় না। বিজ্ঞানে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।
লাল চাকতির সূর্যর ওপর দিয়ে শুক্রের ছোট্ট কালো টিপের মতো ছায়া এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে চলে যাওয়া, এবার দেখা যাবে পৃথিবীতে বসেই। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটাই শুক্রের সরণ বা পরিক্রমণ। ইংরাজিতে বলে ট্রানজিট অফ ভেনাস।
সূর্য, পৃথিবীর একই তলে ৬ই জুন এসে দাঁড়াচ্ছে আমাদের প্রতিবেশী গ্রহ শুক্র। সকলের পরিচিত শুকতারা।
সূর্যোদয়ের আগেই অবশ্য শুক্রের সৌর পরিক্রমা শুরু হয়ে যাবে। ভারতের সর্বত্র দেখা যাবে শুক্রের সৌর চাকতির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাওয়া। ভোর ৩-৪১মিনিটে শুরু হবে সেই পরিক্রমা। কিন্তু ঐ দিন সূর্য উঠবে একটু দেরিতে। ভোর সাড়ে চারটের পর।
তাই পরিক্রমণের মোট সময় কমে দাঁড়াবে ৫ঘন্টা ৪০মিনিট। গোটা পরিক্রমণের পূর্ণ যাত্রাপথে চার চারবার সৌর চাকতিতে স্পর্শ করবে শুক্রের ছায়া। পূর্ব অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পূর্ব কানাডা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, নিউগিনি, ফিলিপিনস, পূর্ব এশিয়া, পূর্ব চিন, কোরিয়া, হাওয়াই, রাশিয়া, আলাস্কা এবং উত্তর-পশ্চিম কানাডা থেকে শুক্রের সরণ দেখা যাবে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের গোটা সময় ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে শুক্রের এই বিরল চলন দেখা যাবে। ভারতে শুক্র পরিক্রমণ শেষ হবে সকাল ১০-২১মিনিটে।
শেষ শুক্রের সরণ হয়েছিলো ২০০৪ সালের ৮ই জুন। কিন্তু সেসময় প্রচারের অভাবে সবার সেই বিরল মহাজাগতিক ঘটনা দেখার সুযোগ হয়নি। তবে এযাত্রায় সুযোগ হারালে আর জীবৎকালে দেখা সম্ভব হবে না। কারণ পরবর্তী শুক্রের সরণ ঘটবে ১০৫.৫ বছর পরে। মানে সেই ২১১৭ সালে।
ততদিন আমরা কেউ জীবিত থাকবো না। এই সময়ের মধ্যে অনেকের জন্ম হবে ঠিকই কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে পরবর্তী শুক্র সরণের আগেই চলে যেতে হবে। চাক্ষুস করতে পারবেন না। তাই কিছুতেই শুক্র সরণের এই সুযোগ হারানো ঠিক হবে না।
মহাজাগতিক যেসব বিরল ঘটনা দেখতে পাওয়া যায় তার মধ্যে শুক্র বা বুধের সরণটা বেশ আকর্ষণীয়।
সূর্য গ্রহণের মতোও এই সরণ বা পরিক্রমণকে বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সূর্যের অবয়ব আর গঠন নিয়ে যা কিছু গবেষণা করা হয় তা হয় সরণ ও গ্রহণের সময়। কারণ, এই সময়ই সূর্য নিয়ে গবেষণার উৎকৃষ্ট সময়। তাই এই ধরণের পরিক্রমণকে অনেকে পুঁচকে সূর্য গ্রহণ বা মিনি সোলার ইক্লিপস্ বলে থাকেন। শুক্রের সরণের সুন্দর দৃশ্য দেখার পাশাপাশি ৬ই জুনের দিনটিতে চালানো হবে নানা ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা।
সৌর জগতের গঠন নিয়ে গবেষণা করার এটাই সবচেয়ে বড় সময়। শুক্র পরিক্রমণের ফাঁকে বিজ্ঞানীরা চালাবেন তাঁদের অনুসন্ধান। সৌর কলঙ্কের গণনা, শুক্র আর সূর্যের আকারের তুলনা, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব নির্ণয়, সূর্যের ব্যাস মাপার চেষ্টা চলবে। শুক্রের সরণের কথা প্রথম জানিয়েছিলেন বিশিষ্ট জ্যোর্তিবিদ জোহানেস কেপলার। তিনিই প্রথম গ্রহদের পরিক্রমণের কথা জানিয়েছিলেন।
তাঁর হাতেই প্রথম গ্রহের গতিতত্ত্ব বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি পেয়েছিলো।
শুক্রের সরণের একটি অদ্ভূত হিসাব আছে। সরণ ১০৫.৫ বছরে একবার আর ৮বছরের ব্যবধানে পরপর ২বার হয়। এরপর ১২১.৫ বছর অপেক্ষা করার পরে আবার ৮বছরের ব্যবধানে পরপর ২বার হয় শুক্র সরণ। তারপর আবার ১০৫.৫ বছর পর।
এভাবেই চলতে থাকে। সেই জন্যই প্রাতঃস্মরণীয় বহু জ্যোতির্বিদ শুক্রের সরণ নিয়ে প্রবল আগ্রহী হয়েও জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি। জোহানেস কেপলার, এডমন্ড হ্যালি অতি উৎসাহী হয়েও দেখে যেতে পারেননি শুক্রের এই পরিক্রমা। ১৬০৯সালে দুরবীন আবিষ্কারের পর থেকে ৭বার শুক্রের পরিক্রমণ ঘটেছে।
ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ জেরেমিয়া হোরকস্ ১৬৩১ সালে ৭ই ডিসেম্বর সর্বপ্রথম শুক্রের সরণটি পর্যবেক্ষণ করেন।
এরপর ১৬৩৯ (৪ঠা ডিসেম্বর), ১৭৬১ (৬ই জুন), ১৭৬৯ (৩রা জুন), ১৮৭৪ (৯ই ডিসেম্বর), ১৮৮২ (৬ই ডিসেম্বর) এবং ২০০৪ (৮ই জুন)। হতে যাওয়া ২০১২সালের ৬ই জুনের পর শুক্রের পরবর্তী সংক্রমণটি ঘটবে ২১১৭সালের ১১ই ডিসেম্বর। ৬ই জুন, বুধবার ঘটতে চলা শুক্রের ঐ সৌর পরিক্রমার বিরল সুযোগ হারালে বিশ্বের কোন জীবিত মানুষের পরবর্তী শুক্র পরিক্রমণ দেখতে পারবেন না।
সকালবেলায় পূর্ব দিকে তাকিয়ে যদি আমরা সূর্যকে দেখি তাহলে সূর্যের উপর দিকটা হবে সূর্যের পশ্চিম দিক। নিচের দিকটা হবে সূর্যের পূর্ব দিক।
বাঁ দিকটা হবে সূর্যের উত্তর দিক আর ডান দিকটা হবে দক্ষিণ দিক। সূর্যোদয়ের আগে শুক্র পরিক্রমার দৃশ্য আমরা দেখতে পাবো না। সৌর চাকতির পূর্ব দিকের দিয়ে শুক্র প্রথম যাত্রা শুরু করবে। শুক্রের ব্যাস যেহেতু সূর্যের ব্যাসের চেয়ে ৩২ভাগ কম, তাই সৌর চাকতির পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রকে ঠান্ডা একটি কালো টিপের মতো দেখতে লাগবে। সূর্যের পূর্ব বিন্দু মানে নিচের দিকের ৪৮ডিগ্রি উত্তর দিক শুরু হবে শুক্রের পথ চলা।
সেই হিসাবে ১ম স্পর্শ আর শেষ ৪র্থ স্পর্শের মধ্যবর্তী দূরত্বটাই আদপে হবে শুক্রের সরণ পথ। ২য় স্পর্শের অব্যবহিত ঠিক পরেই (২০ সেকেন্ড) মনে হবে শুক্রের চাকতি যেন সরেও সরছে না। একটা কালো ফোঁটা ঝুলে আছে। একে ব্ল্যাক ড্রপ এফেক্ট বলা হয়। এটি দেখতে বেশ আকর্ষণীয়।
কলকাতায় শুক্রের পরিক্রমা শুরু হবে ভোর ৩.৪০মিনিটে। শেষ হবে সকাল ১০.২১মিনিটে। তবে ভারতের এক একটা শহরে যেহেতু একেক সময় সূর্যোদয় হবে তাই যারা আগ্রহী তাঁদের অপেক্ষা করতে হবে সূর্য ওঠা পর্যন্ত। তবে যখন আমরা দেখার সুযোগ পাব ততক্ষণে শুক্রের ছায়া সৌরচাকতির ভিতরে ঢুকে পড়বে। সৌর চাকতির সবচেয়ে ভিতরদিকে ঐ কালো টিপ পৌঁছাবে সকাল ৭.০২নাগাদ।
৬ই জুন কলকাতায় ভোর ৪.৫১মিনিটে সূর্যোদয় ঘটবে। দিল্লিতে ৫.২৩, মুম্বাইয়ে ৬.০১ এবং চেন্নাইয়ে ৫.৪২মিনিটে সূর্যের উদয়। তবে যেখানে যখনই সূর্যোদয় হোক না সূর্য ওঠার পর পরে কমপক্ষে ৩ঘন্টা সময় আমরা বেশ ভালোই দেখতে পাবো এই সরণকে।
কিভাবে দেখতে হবে শুক্রের সরণ ? এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খালি চোখে কক্ষনো সরণ দেখা যাবে না।
খালি চোখে সূর্যের দিকে তাকালে চোখের রেটিনা পুড়ে যাবে। যা করতে হবে তা সব সময়ই চোখকে সামলে। সরণ দেখতে দরকার কিছু জিনিসপত্রের। অ্যালুমিনিয়াম সমৃদ্ধ মাইলার ফ্লিম বা ১৪নম্বর ওয়েল্ডিং গ্লাসের চশমা পড়ে শুক্র সরণ দেখাটাই ভালো। যারা হাতের কাছে এই দুটোর একটাই পাবেন না তাঁদের জন্য অবশ্য একটি বিকল্পের সন্ধান দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাদা-কালো ফিল্মের নেগেটিভকে সূর্যের আলোতে এক্সপোজ করে তা ডেভেলপ করে তার তিনটি টুকরো একসঙ্গে পরিক্রমণ চশমা হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন। তবে যা দিয়েই সূর্যের ঐ বিরল রূপ দেখুন না কেন একনাগাড়ে তা দেখার চেষ্টা করবেন না। এক মিনিট, দুই মিনিট দেখার পরে কিছু সময় চোখকে অবশ্যই বিশ্রাম দেবেন। সরণের ঘটনাটি দীর্ঘক্ষণের। তাই তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
চোখ ঢেকে ফিলটার চশমা লাগিয়ে সূর্যের দিকে তাকাতে হবে। পিন হোল ক্যামেরা তৈরি করেও সম্পূর্ণ নিরাপদে শুক্র সরণ ভালোই দেখা যায়। তবে তাতে সত্যি সত্যি মন ভরবে না। তবে পরিক্রমণ দেখতে পারুন না আর নাই পারুন এমনকি সানগ্লাস, এক্স-রে ফিল্ম বা টেলিস্কোপ দিয়েও নয়।
পরিশেষে এইটুকুই বলা যায় নির্ভয়ে দেখুন ৬ই জুনের বিরল মহাজাগতিক ঘটনাটি।
সূর্যের তপ্ত চেহারার ওপর দীর্ঘক্ষণ দাপিয়ে বেড়ানো শুক্রের ঐ বিরল দৃশ্য দেখতে কখনোই ভুলবেন না। শুক্রের সঙ্গে পৃথিবীর বিস্তর পার্থক্য। আগ্নেয়গিরিতে ছেয়ে শুক্রের ঘন বায়ুমণ্ডলের ৯৬ভাগই কার্বন ডাই অক্সাইড। পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা প্রায় ৪৮০ডিগ্রি সেলসিয়াস। চাপও বিপুল।
প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ৯০কিলোগ্রাম। সেই সঙ্গে রয়েছে ৩০-৩৫কিলোমিটারের পুরু সালফিউরিক অ্যাসিডের ঘণ মেঘ। সম্পূর্ণ প্রাণ ধারণের অনুপযুক্ত এই নিষ্প্রাণ গ্রহ কীকরে কারো কাছে প্রসন্ন বা রুষ্ট হতে পারে তা বোঝা দায় ! তবু এই গ্রহের দোষ (?) কাটাতে অনেকে ধাতু রত্ন বা শেকড় বাকড় দেওয়ার কথা বলে থাকে। এটা বুজরুকি ছাড়া কিছু নয়। সংস্কারের সব ধরণের বাঁধন ছিঁড়ে তাই বিজ্ঞান চেতনা নিয়ে দেখতে হবে শুক্রের বিরল পরিভ্রমণ।
সূর্যোদয়ের শুরুতেই ঐ অবিস্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী থাকুন সব্বাই। সবার কাছে ৬ই জুনের দিনটি হোক মেঘমুক্ত, শেই সঙ্গে সংস্কার ভাঙার দিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।