বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ মাইক্রোবাস থেকে নেমে খুব অবাক হয়ে যায় নায়লা । সামনের ওই সাদা রঙের লাল টালির দোতলা বাড়ি, তার সবুজ রং করা দরজা-জানালা, দোতলার লাল রংকরা কারুকার্যময় লোহার রেলিং, বাড়ির সামনের ছোট বাগান, সেই বাগানের ফোয়ারা, পরীমূর্তি, সূর্যমুখির ঝাড়- সবই তার পরিচিত লাগছে। অথচ এই বাড়িতে এই প্রথম এল নায়লা।
নায়লার কেমন শীত করতে থাকে। আর ওর মাথার ভিতরে মেয়েবেলায় শোনা একটি গান বাজতে থাকে ... ঝুনঝুন ময়না নাচ না/ তা থৈ তা থৈ নাচ না ...
একতলায় গ্রিলবারান্দাটি বেশ বড়। তাতে মাধবীলতার ঝাড়। ইজনান দৌড়ে গিয়ে গ্রিল বেয়ে উঠতে চেষ্ট করছে। জাফরিন ওর ছেলেকে ধমক দেয়।
অ্যাই! অ্যাই! ইজনান! এদিকে এসো! এদিকে এসো বলছি!
এই দস্যিছেলেকে সামলাতে হিমসিম খায় জাফরিন । ইজনান পড়ে ক্লাস ফোরে। এই বয়েসেই সবাইকে জ্বালিয়ে মারছে। নায়লার মেয়ে তাবাসসুম অবশ্য সেই তুলনায় অনেক শান্ত। তাবাসসুম পড়ে ক্লাস থ্রিতে।
আজ নীল রঙের একটা ফ্রক পড়েছে তাবাসসুম । চোখ বড় বড় করে নতুন বাড়িটা দেখছে। অবিকল মায়ের মতো চোখ-নাক-মুখ তাবাসসুমের । যেন অবিকল ছোট্ট নায়লা।
মাইক্রো থেকে নেমে এসেছে রাইসুল।
নীল ট্র্যাকসূট আর সাদা গেঞ্জি পরা পয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের থলথলে শরীর। সাইদ আর নায়লার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি কেমন?
চমৎকার । নায়লা কোনওমতে বলল। ওর বিস্ময় আর শীতবোধ তখনও রয়ে গেছে। মাথার ভিতরে গানটা অবশ্য এখন আর বাজছে না।
রিয়েলি নাইস। বলে সাইদ একটা সিগারেট ধরায়। ছুটির পুরো সময়টা সিগারেট খাবে ও; নায়লা চিৎকার চেঁচামেচি করবে না। এমন একটা সমঝোতা হয়েছে দু-পক্ষের।
ইজনান আর তাবাসসুম সূর্যমূখির ঝাড়ের সামনে।
সেদিকে একবার তাকিয়ে নায়লা জিজ্ঞেস করে, বেশ পুরনো বাড়ি, তাই না রাইসুল ভাই?
হুমম। তা দুশো বছর তো হবেই। রাসেল তো সেরকমই বলল। ওর বাবা মুকতাদির আনসারি বছর সাতেক আগে কোন্ এক মল্লিকদের কাছ থেকে বাড়িটা কিনে নেন। পরিবার নিয়ে মাঝেমাঝে বেড়াতে আসেন।
ড্রাইভার আনোয়ার স্যুটকেশগুলি মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে নিচ্ছে। নীল রঙের হাফহাতা শার্ট পরা আঠাশ-উনত্রিশ বছরের শ্যামলা মতন দেখতে আনোয়ারের চেহারা বেশ গাট্টাগোট্টা, বলিষ্ট। মাইক্রোটা রাইসুলের। ওদের বাইংহাউজ আর গারমেন্টসের ব্যবসা। এসব বিজনেসে মাইক্রোবাস বেশ কাজে দেয়।
গ্রিলের দরজা খুলে বেড়িয়ে এল পায়জামা- পাঞ্জাবি পরা একজন বৃদ্ধ । মাঝারি উচ্চতার বৃদ্ধটির গায়ের রং ফরসা। মাথায় কিস্তি টুপি। মুখে দরবেশদের মতন ধবধবে পাকা দাড়ি। চোখ দুটি ঘোলা ।
ঘন ভুরু দুটিও পাকা। কে ইনি? নায়লা আতরের গন্ধ পায়।
রাইসুল জিজ্ঞেস করে, তুমি মানে ... আপনি কি মুসলেহউদ্দীন?
জ্বী, হজুর। আমিই মুসলেহউদ্দীন। এই বাড়ি দেখাশোন করি।
আমি রাসেলের ফ্রেন্ড।
জ্বী। ছোটসাব আমাকে ফুন করেছিলেন।
আমরা ক’দিন থাকব।
জ্বী।
ছোটসাব আমারে বলছেন।
বাজার কাছেই, নাকি দূরে?
বাজার দূরেই। কিন্তু কুন অসুবিধা হইব না। আপনেরা যা খাইতে চাইবেন, বলবেন, আমি সব এন্তেজাম করে রাখব।
রাইসুল এই বয়েসে বেশ মুটিয়েছে।
ওর আবার সিঁড়ি ভাঙতে অসুবিধে। থাকার জন্য ওরা একতলায় একটি ঘর বেছে নিল । অবশ্য নায়লার দোতলার একটি ঘর পছন্দ হয়েছে । দেওয়াল আলমিরা, আরামকেদারা আর আলনা ছাড়াও সেই ঘরে রয়েছে মান্ধাতার আমলের একটি বিশাল পালঙ্ক। এই মুহূর্তে সেই পালঙ্কের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে আছে সাইদ।
দু-হাতের মধ্যে একটি দশ ইঞ্চি স্যামসং ট্যাব। অ্যারি বার্ডস খেলছে। বাবার গা ঘেঁষে বসে আছে তাবাসসুম। বলছে, বাবা, এখন এটা মার। না, না এইটা এইটা ।
আজ বেশ গরম পড়েছে। তাবাসসুম ফ্রক খুলে রেখেছে।
দুপুর একটার মতন বাজে। নায়লা বাথরুমে। বাথরুমে ঢুকেও অবাক হয়ে গিয়েছিল নায়লা।
বিশাল বাথরুম। অনেক উচুঁতে সিলিং। সবুজ রংকরা কড়িকাঠ। এমন একটা জায়গা যেন ও স্বপ্নে দেখেছিল। হঠাৎই ধিতাং ধিতাং মাদলের বোলের আওয়াজ পেল ও।
দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলায় শালজঙ্গলে ঘেরা এই জায়গাটি সাঁওতাল অধ্যুষিত । মাদল কি ওদেরই কেউ বাজাচ্ছে?
পয়তাল্লিশ মিনিট পর চুলে নীল তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে নায়লা জিজ্ঞেস করে, দেজাভ্যূ ওয়ার্ডটার মানে কি যেন?
প্রশ্নটা শুনে সাইদ কে কেমন বিমূঢ় দেখাল। অ্যাংরি বার্ডস থেকে জেগে উঠতে পারছে না।
আহা, মনে না এলে উইকি দেখ না। নায়লা ঝাঁঝালো গলা বলল।
তাবাসসুম ফিক করে হেসে উঠল। মা যখন বাবাকে বকে তখন ওর ভীষন মজা লাগে।
সাইদ ট্যাবের স্ক্রিনের ওপর কয়েক বার টাচ করে। তারপর পড়তে থাকে: ডেজাভ্যূ ... ডেজাভ্যূ । ফেঞ্চ প্রোনাউনসিয়েসন- ডেজাভি।
লিটারালি-‘অলরেডি সিন’; ... ইজ দ্য ফিলিং অভ সারটেনটি দ্যাট ওয়ান হ্যাজ ওলরেডি উইটনেসড অর এক্সপিরিয়েন্সড আ কারন্টে সিচুয়েশন, ইভন দো দ্যা এক্সঅ্যাক্ট সারকামসটানসেস অভ দ্য প্রিওর এনকাউন্টার আর আনক্লিয়ার অ্যান্ড ওয়্যার পারহেপস ইমাজিনড।
বারান্দার দিকে যেতে যেতে নায়লা বলল, হুমম। এ বাড়িতে আসার পর থেকে আমার ডেজাভ্যূ হচ্ছে।
তোমার ডেজাভ্যূ হচ্ছে? চশমার ফাঁকে সাইদের চোখের মনি বিস্ফারিত।
হুমম।
দেন এনজয় ইট। সাইদ বলল।
তাই তো করছি।
আম্মু আমারও ডেজাবি হচ্ছে। তাবাসসুম রিনরিনে কন্ঠে বলল।
ওরা হেসে ফেল। সাইদ আদর করে মেয়ের চুল নেড়ে দিল।
নায়লা রোদ ভরতি বারান্দায় এল । গভীর নির্জন ঝিম-ধরা দুপুর। নীচের বাগানে ঘাসের ওপর এক দঙ্গল শালিক পাখি।
দৃশ্যটায় কি ছিল, নায়লার মাথার ভিতরে কী যেন এক সুর রিনরিন করে বেজে উঠল।
ঘরে ফিরে জাফরিন-এর ম্যাসেজ পেল নায়লা: খাবার রেডি। তোমরা চলে এসো।
ওরা আরও দশ-পনেরো মিনিট পর নীচে নেমে এল।
মান্ধাতার আমলের খাওয়ার টেবিলটি বিশাল।
সেই বিশাল টেবিল ঘিরে কুড়ি-বাইশটি আবলুস কাঠের চেয়ার। খাওয়ার ঘর আর বসার ঘরের মধ্যে পার্টিশন নেই। বসার ঘরে পুরনো দিনের আসবাবপত্র। দেওয়ালে হরিণের স্টাফ করা মাথা, উনিশ শতকীয় সাদাকালো ছবি, পেইন্টিংস। এক পাশে কালো রঙের গোবদা গোবদা সোফা।
তারি একটি সোফায় মুখ কাঁচুমাচু করে বসে আছে ইজনান ।
কি হয়েছে ওর? নায়লা জিজ্ঞেস করে।
জাফরিন বিরক্ত হয়ে বলল, আর বোলো না। চিনের মাটির একটা ডিস ভেঙে ফেলেছে ইজনান । ওর কপালে আজ লাঞ্চ জুটবে না।
নায়লা জানে ইজনান ঠিক কোন্ ডিসটি ভেঙেছে। ওর ভিতরে রিনরিন শব্দে জলতরঙ্গ বেজে উঠল।
রাইসুল খেতে বসে গেছে। ওর ডায়াবেটিস আছে। খিদে সহ্য করতে পারে না।
বলল, বসো নায়লা, দেখো আজ সাঁওতালী কুইজিন করেছে ।
ভাত, সরপুঁটি মাছ ভাজা, ছোট আলু দিয়ে বনমোরগের ঝালঝাল রান্না।
আচ্ছা, এই তাহলে সাঁওতালী কুইজিন?
জাফরিন চটজলদি বলল, না, না । রান্না সৌমি সরেন করেছে বলে রাইসুল ওরকম বলল।
কে? নায়লা চমকে ওঠে।
সৌমি সরেন। এ বাড়ির রাঁধুনী। মেয়েটা নাকি কাছেই সাঁওতালী পল্লীতে থাকে।
ওহ্। সৌমি সরেন নামটা ভীষণ পরিচিত।
এটাও কি দেজাভ্যূ? নায়লার মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে । প্লেটে ভাত আর বনমোরগের তরকারি নিয়েছিল। খেতে পারল না। প্লেটটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল ।
কি হল? সাইদ জিজ্ঞেস করে।
কিছু না। বলে পায়ে পায়ে সোফায় গিয়ে বসল। ইজনান-এর পাশে। বলল, খাও তো বাবা।
ইজনান দুষ্টু হলেও নায়লার কথা শোনে।
হঠাৎ নায়লার চোখ গেল তাবাসসুম এর দিকে । খেতে খেতে তাবাসসুম এদিকে চেয়ে আছে। চোখে টলটলে ঈর্ষা। ব্যথায় নায়লার বুক মুড়চে ওড়ে। কই, তাবাসসুম তো এমন ছিল না।
হঠাৎ কি হল মেয়েটার?
ঠিক হল, দুপুরে ঘুমিয়ে নিয়ে বিকেলের দিকে সবাই বেড়াতে বেরুবে। সাইদ দুপুরে ঘুমায় না। ও পালঙ্কের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে ট্যাব নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়ল। অ্যারি বার্ডস-এর নেশা চেপেছে। অফিসে থাকলে খেলতে পারে না।
এই সুযোগে খেলে নিচ্ছে। বিকেলে বেরুতে বের বের হবে কিনা কে জানে।
নায়লা মেয়ের হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যায়। একটা শালিক রেলিংয়ের ওপর বসেছিল। ওরা বারান্দায় যেতেই ফুরুৎ করে উড়ে গেল।
নায়লা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, তাবাসসুম, আমি ইজনান কে খাইয়ে দিয়েছি বলে তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ?
না তো।
তাহলে?
কি তাহলে?
তাহলে তখন তুমি আমার দিকে ওভাবে তাকালে কেন?
কই, তোমার দিকে তাকালাম? আমি তো দালু কে দেখছিলাম। ওর হাতে একটা ময়ূরের পালক ছিল।
কে দালু? চমকে ওঠে নায়লা।
দালু, দালু সরেন।
নায়লার শরীর হিম হয়ে যায়। ও দ্রুত মেয়ের হাত ধরে ঘরে চলে এল। বুকটা ভীষণ কাঁপছিল। কি করবে বুঝতে পারছে না।
দালু সরেন তো সৌমি সরেন- এর ভাই । কিন্তু ... কিন্তু ... সে কথা তো তাবাসসুম এর জানার কথা না। নায়লার শীত করছিল। দূরে কোথাও মাদল বেজে উঠল।
ঠিক তখনই কে যেন দরজার পাল্লায় টোকা দিল।
সাইদ বলল, কে?
আমি আনোয়ার স্যার।
এসো। বলে সাইদ উঠে বসল।
আনোয়ার ঘরে ঢুকল।
কি ব্যাপার আনোয়ার?
ইজনান কে পাওয়া যাচ্ছে না স্যার।
ইজনান কে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? কি বলছ কি!
সাইদ ধড়মড় করে বিছানা থেকে নামল। নায়লাও ততক্ষণে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে এসেছে। ওর পিছন পিছন তাবাসসুম ।
রাইসুল আর জাফরিন একতলায় বসার ঘরের সোফায় বসে ছিল । বিধস্ত অবস্থা।
থলথলে রাইসুল ঘামছিল।
কি হয়েছে?
জাফরিন কান্না কান্না কন্ঠে বলল, ইজনান ঘরেই ছিল। ঘুমিয়ে। উঠে দেখি নেই। তারপর আমরা খুঁজে দেখি ... কোথাও নেই।
সাইদ বলল, ওর তো বাইরে যাওয়ার চান্স কম। এ বাড়ির পাঁচিল বেশ উঁচু । তাছাড়া লোহার গেটটাও তো বন্ধ থাকার কথা।
তাহলে কোথায় গেল ও? অস্থির হয়ে বলল নায়লা।
সাইদ বলল, আনোয়ার দেখ তো মুসলেহউদ্দীন কোথায়।
মুসলেহউদ্দীন নেই। রাইসুল বলল।
নেই মানে?
নেই মানে নেই। বুড়োকে কোথাও দেখছি না। রাইসুল তিক্তকন্ঠে বলল।
তাবাসসুম মায়ের শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। এখন নায়লার হাত ধরে টানল।
কি?
এদিকে শোন তো মা।
নায়লা সরে আসে। বলে, কি বল?
তাবাসসুম ফিসফিস করে বলল, মা, আমি জানি ইজনান ভাইয়া কোথায় আছে।
নায়লা চমকে ওঠে। তুমি জান?
হ্যাঁ।
কোথায়?
এসো আমার সঙ্গে।
নায়লা বলে, জাফরিন, ভাই তুমি অত অস্থির হয়ো না। ইজনান কে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
এ বাড়িতেই আছে। আমারও খুঁজে দেখছি। বলে তাবাসসুমের পাশে হাঁটতে থাকে নায়লা। তাবাসসুম রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে।
পিছনে ছোট সিমেন্টের উঠান।
আমলকি গাছের পাশে একটা কুয়া। ওপাশে একটি একতলা একটি টালির ঘর। তাবাসসুম বলল, ইজনান ভাইয়া ওই কুয়ার ভিতরে আছে।
তুমি জানলে কি করে? নায়লার ভুরু কুঁচকে উঠেছে। কিছুতেই তাবাসসুম এর উদ্ভট আচরণের ব্যাখ্যা করতে পারছে না।
ইশ! আমি তো জানিই। তাবাসসুম দু-হাত ঘুরিয়ে বলল।
কুয়ার কিনারায় এসে উঁকি দিল নায়লা । ওর গা ছমছম করে ওঠে। নীচে কিছু দেখা যায় না।
ঘুটঘুুটে অন্ধকার। নীচে কিছু আছে কিনা বোঝা যায় না।
তাবাসসুম বলল, কিছু দেখা যাবে না মা, এসো আমার সঙ্গে। বলে ও দৌড়ে টালির ঘর ঢুকল। ওর পিছন পিছন দৌড়ে যায় নায়লা।
অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে। ছোট ঘর। লাল সিমেন্টের মেঝে। একপাশে একটা দড়ির খাট। ওপাশে জানালা।
শালগাছ চোখে পড়ে। এটা কি মুসলেহউদ্দীন- এর ঘর?
ওটা টেনে সরাও তো মা।
কি সরাবো?
ওইটা।
নায়লা তাকিয়ে দেখে মেঝের ওপর কাঠের একটা পাটাতন। নায়লা উবু হল।
নাহ্, বেশ ভারী পাটাতন। নায়লা পারবে না। ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল আনোয়ার । নায়লা বলল, আনোয়ার, দেখ তো এটা তুমি সরাতে পার কি না।
আনোয়ার উবু হয়ে বসল।
একটু ঠ্যালা দিতেই কর্কস শব্দে পাটাতন সরে গেল। নীচে নিকষ অন্ধকার। পকেট থেকে মোবাইল বের করে টর্চ জ্বালাল আনোয়ার। নীচে সিঁড়ি। আনোয়ার নীচে নামতে যাবে- নায়লা বলল, নীচে নামা কি ঠিক হবে?
সমস্যা নাই ম্যাডাম।
বলে আনোয়ার নেমে যায়।
কিছু সময় কাটল। নায়লা উদ্বেগ টের পায়। অনোয়ারের কোনও বিপদ হল না তো। ইজনান কি আসলেই কুয়ার নীচে আছে? হঠাৎ নায়লার মনে হল সিঁড়ির নীচের পথটা ওর চেনা।
একটা সরু করিডোর। শেষ মাথায় একটা ইউ সেপের দরজা। কিন্তু, কিন্তু তাবাসসুম জানল কি করে?
একটু পর ইজনান বেড়িয়ে এল। খালি গা, সবুজ হাফপ্যান্ট। ওর পিছনে আনোয়ার।
আন্টি! বলে নায়লার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইজনান ।
ইজনান কে নিয়ে উঠানে এসে নায়লা দেখল আকাশে মেঘ জমেছে। বাতাস অশান্ত হয়ে উঠছে।
জাফরিন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদল। বার বার বলতে লাগল, আমি আর এই মড়ার বাড়িতে থাকব না।
আমি এখনই চলে যাব। বলে ছেলেকে নিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। তারপর ব্যাগ গোছাতে লাগল।
রাইসুল নিরুপায়। সে শ্রাগ করে।
বাইরে খুব জোরে ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করল। সেই সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি । ছাদের টালি ফুটো । তারপর ভয়ানক ঝড় উঠল।
বাড়িটা নিকষ আঁধারে ঢেকে আছে।
আনোয়ার কোত্থেকে একটা চার্জার যোগাড় করে জ্বেলেছে। ঝড় থামল সন্ধ্যার মুখে। তবে ঝোড়ো বাতাস আর বৃষ্টি অব্যাহত ছিল। রাত্রে আর মুসলেহউদ্দীন ফিরল না। সঙ্গে শুকনো খাবার ছিল।
তাই খেল ওরা।
বাকি রাত ঘুম হল না নায়লার। পালঙ্কে নিথর হয়ে পড়েছিল। অশান্ত বাতাসে ঘরের সাদা পর্দা ভৌতিক ভঙ্গিতে উড়ছিল। তারি সঙ্গে অন্ধকারে অল্প অল্প বিদুত্যের ঝিলিক।
পিছনের শালবনে হাওয়ার দাপাদাপি। এই অনুভূতি ওর পরিচিত। দোতলার এই ঘর, এই অন্ধকার, এই পালঙ্কও ওর পরিচিত । দেজাভ্যূ? কিন্তু সৌমি আর দালু সরেন? ওরা দু’জন ভাইবোন। টুডু পাড়ায় থাকে।
আশ্চর্য! আমার এমন কেন মনে হচ্ছে যে ... সৌমি আর দালু সরেন ভাইবোন। আর ওরা টুডু পাড়ায় থাকে।
সারারাত ঘুম হল না। বিছানায় শুয়েই টের পেল জানালার ওপাশের ভোরের আলোর আভাস । শাড়িটা ঠিকঠাক করে ঘরের বাইরে চলে এল নায়লা ।
তাবাসসুম ওর বাবার কোল ঘেঁষে ঘুমিয়ে আছে।
পুরো বাড়িটা নির্জন হয়ে আছে। একতলায় গ্রিলবারান্দায় চলে এল নায়লা। মাধবীলতার ঝাড় বৃষ্টির ছাঁট পেয়ে সজীব। বৃষ্টিভেজা বাগানের গাছপালাও সতেজ আর উজ্জ্বল ।
পরীমূর্তিটাও ঝকঝক করছে, যেন কেউ ধুয়েছে। তবে সূর্যমূখীর ঝাড় তছনছ। নায়লা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পাঁচিল ঘেষাঁ লিচুগাছে, বকুলগাছে কাকপাখিরা আড়মোড়া ভাঙছে। কিচিরমিচির শুরু করেছে।
চায়ের জন্য শরীরে ক্ষীণ অস্বস্তি টের পাচ্ছিল নায়লা। সকালের দিকে এক কাপ চিনি ছাড়া লেবু চা খায় ও।
পিছনে পায়ের শব্দ। মুসলেহউদ্দীন । হাতে চায়ের কাপ ।
নায়লা অবাক। আপনি? কাল কই ছিলেন?
আমি টুডু পাড়ায় গেছিলাম।
নায়লা চমকে ওঠে। সামলে নিয়ে মুসলেহউদ্দীন- এর হাত থেকে চায়ের কাপ নেয়। র চা।
বলে, টুডু পাড়ায়? কেন?
আমি টুকটাক কবিরাজী করি আপা। টুডু পাড়ায় ছোট একটা ছেলের জ্বর। তারে দেখতে দেখতে ঝড়বৃষ্টির জন্য আটকায় গেলাম।
ও। তা ছেলের কি নাম? বলে চায়ে চুমুক দেয় নায়লা।
দিয়ে অবাক হয়ে গেল। লেবু চা। চিনি ছাড়া ।
দালু, দালু সরেন।
চায়ের কাপ হাত থেকে পড়েই যেত নায়লার।
কোনও মতে সামলে নেয়।
যাই আপা, নাশতা বানাতে হবে। বলে মুসলেহউদ্দীন চলে যায়।
গ্রিলবারান্দায় বেতের চেয়ারটেবিল। চেয়ারে বসে চাটুকু ধীরেসুস্থে শেষ করে নায়লা।
মাধবীলতার ঘ্রান ধীরেধীরে ঢুকে যাচ্ছে ¯œায়ূতন্ত্রে। সূর্য উঠি উঠি করছে। কাপটা টেবিলে রেখে বাগানে নেমে এল নায়লা। তারপর পায়ে পায়ে গেটের কাছে চলে এল । কালো রঙের বড় লোহার গেট।
বন্ধ। একপাশের ছোট গেটটা অবশ্য খোলা। ওপাশে পিচরাস্তা। তারপর শালজঙ্গল ধূসর কুয়াশা আর সোনালি রোদে মাখামাখি। দূরে শালকাঠে ভরতি একটি হাফট্রাক আসছিল।
নায়লা বাঁ-দিকে ঘুরে হাঁটতে থাকে। ভোরের ভেজা হাওয়ার পরশ ভালো লাগছিল। এ দিকটায় পাঁচিল ঘেঁষে মেহেদি আর করমচার ঝোপ। একটা হরীতকী গাছ। তারপর শালজঙ্গল।
মাঝখান দিয়ে কুয়াশাজড়ানো পথ। পায়ের তলায় ভিজে ঘাস। কোত্থেকে একটা হরিণ এসে ছুটে পালাল। হরিণের পিছনে শিকারী, হাতে তীরধনুক। শিকারী সাঁওতালী এক কিশোর।
কি যেন নাম ওর। মনে পড়ছে না। একটা সজারু দৌড়ে পালাচ্ছে। দু’জন সাঁওতালী পুরুষ একটা কলাগাছ সজারুর ওপর ফেলল। ওই দৃশ্যটা মুছে গেলে ধিতাং ধিতাং মাদলের বোল শুনতে পায়।
এত ভোরে কে মাদল বাজায়? ঘোরের মধ্যে হাঁটতে থাকে নায়লা। শালগাছের ফাঁকে ছোট মাটির তৈরি ঘর। চমৎকার নিকোন উঠান। বাড়িটা পরিচিত মনে হল। এই প্রথম মনে হল ওর, আমি কি তাহলে জাতিস্মর? উঠানের মাঝখানে তাবাসসুম।
ওর পরনে পাঞ্চি আর পারহাটি। তাবাসসুম নাচছে। আর গাইছে। ঝুনঝুন ময়না নাচ না তা থৈ তা থৈ নাচ না ... ওকে ঘিরে নাচছে সৌমি আর দালু সরেন। চমকে ওঠে নায়লা।
ওর সারা শরীর জমে যায়। পা বাড়াতে যাবে। পা আটকে গেছে। ওর চারদিকে বাতাসের ঘূর্নি। আর সেই ঘূর্নির কী টান! আসেন আপা।
বলে নায়লার হাত ধরে কে যেন টানল। নায়লা ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে দেখে মুসলেহউদ্দীন। বৃদ্ধের ঘোলা চোখে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আতরের গন্ধ পায় নায়লা। মুসলেহউদ্দীন নায়লাকে টানছে; পিছন থেকে ঘূর্নি বাতাস টানছে নায়লাকে ।
এভাবে টানাপোড়েনের ভিতর কখন গেটের কাছে চলে এল নায়লা । দূরে শালকাঠে ভরতি একটি হাফট্রাক আসছিল। তাহলে কতক্ষণ কেটেছে? মাথা কাজ করছে না। মুসলেহউদ্দীন কোথায়?
একতলায় কাউকে দেখতে পেল না। অবশ শরীরে দোতলায় উঠে এল নায়লা।
ঘরে ঢুকল। সাইদ ব্যাগ গোছাচ্ছিল। মুখ তুলে বলল, কোথায় ছিলে?
এই তো নীচে ... বাগানে বাগানে।
তাবাসসুম কোথায় ?
বুকটা ধক করে উঠল। তাবাসসুম? ও তো ..., দাঁড়াও দেখছি।
বলে চকিতে বারান্দায় বেড়িয়ে আসে নায়লা। তাবাসসুম নেই। বুক ভীষণ ধড়ফড় করছে। দৌড়ে সিঁড়ির কাছে যায়। তাবাসসুম সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে।
কোথায় ছিলে?
কেন? তোমার সঙ্গেই তো ছিলাম।
নায়লার সারা শরীর শিরশির করে ওঠে । মেয়েকে নিয়ে ঘরে ফিরে এল। সাইদ বলল, এখুনি তৈরি হয়ে নাও। আমরা ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি।
জাফরিন থাকবে না। রাতে জাফরিন নাকি কি সব ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখেছে ।
জাফরিন এসেছিল?
না।
তাহলে?
রাইসু ফোন করেছিল।
ওহ্ ।
জাফরিন কি স্বপ্ন জান?
কি যেন কয়েক জন লোক একটা সজারুর ওপর কলাগাছ ফেলে দিল।
ওহ্ ।
মুসলেহউদ্দীন টেবিলে নাশতা সাজিয়েছে। পরোটা, হালুয়া, বনমোরগের রোষ্ট, ঘন ডাল, চমচম। ঘিয়ের গন্ধ ম ম করছিল।
রাইসুল বলল, না চাচা। আমরা এখন আর নাশতা খাব না। পথে মাইক্রো থামিয়ে কোথাও খেয়ে নেব।
আনোয়ার স্যুাটকেশগুলি মাইক্রোবাস তুলছিল। জাফরিন ছেলেকে নিয়ে উঠে পড়েছে।
ফরসা মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে । মাথায় ঘোমটা। বোঝাই যাচ্ছে- দোওয়াদরুদ পড়ছে। নায়লা ঘোরের মধ্যে উঠে পড়ে। তাবাসসুম কে কোলে নিয়ে বসেছে।
মুসলেহউদ্দীন গেট খুলে দাঁড়িয়ে আছে। মাইক্রোবাস গেটের কাছাকাছি চলে এসেছে। নায়লা তাকিয়ে দেখল: তাবাসসুম মুখ ঘুরিয়ে লাল টালির বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। দোতলার বারান্দায় রেলিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে সৌমি আর দালু সরেন ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।