mail.aronno@gmail.com
ব্যাক্তিগতভাবে কোনো রোমান্টিক চলচ্চিত্রের প্রতি আমার বিশেষ ভাললাগা তৈরী হবার প্রথম শর্ত নায়ক-নায়িকা নির্বাচন ও সাবলীল অভিনয়, যাদের দেখে মনে হবে, তারা উভয়েই চরিত্রদ্বয়ের জন্য পারফেক্ট, আর তখনই কেবল আমি কোনো রোমান্টিক ছবির প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। মাস কয়েক আগে জন এইচ. লি-র ‘এ মোমেন্ট টু রিমেমবার’ মুভিটি তেমন করেই নাড়া দিয়েছিল, আর কয়েক মাস পর গতকাল পুনরায় দারুণভাবে নাড়া দিল ওমর ফারুক সোরাক পরিচালিত ‘লাভ লাইক কোইন্সিডেন্সেস’নামে ২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই তুর্কি মুভিটি। মুভিটি নিয়ে লেখার পূর্বে অবশ্যই বলব, যারা সুখোকর পরিসমাপ্তির ছবি দেখে অভ্যস্ত, তারা যেন এই মুভিটি না দেখেন, কেন না মুভিটি অনিবার্যভাবেই দারুণ মনোবেদনা তৈরী করতে সক্ষম, আর যারা সত্যিকার অর্থেই অনুভব করেছেন, ভালবাসার প্রকৃত স্বরূপ, গভীরতা, তারা জলদি দেখে নিন মুভিটি, আশ্বস্ত করছি নিরাশ হবেন না।
আমি আগেও লিখেছি, যে কোনো চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন হল পরিচালকের প্রথম মুন্সিয়ানা, কেন না চিত্রনাট্যর সাথে চরিত্রগুলো যদি একাকার হতে না পারে তবে দর্শক হতাশ হতে বাধ্য। একজন দক্ষ পরিচালক অবশ্যই অপেক্ষাকৃত দুর্বল অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দিয়ে ভাল অভিনয় করিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু সেই অভিনেতা-অভিনেত্রী যদি চিত্রনাট্যর সাথে খাপ না খায়, তবে যত সুন্দর-ই হোক না কেন অভিনয়, কোথাও না কোথাও অতৃপ্তি রয়েই যায়।
নায়ক-নায়িকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব মত এই, তারা চিরকালই হবে নায়ক-নায়িকার মতো। এ যেন কল্পলোকের সেই রাজপুত্তুর অথবা রাজকন্যে, যাকে কোনোভাবেই সেই অবস্থানের নিচে কল্পনা করা যায় না, আর যদি তা করাও যায়, তবু তাদের সেই অপরুপ সৌন্দর্য্য মলিন করা অসম্ভব। হয়ত সে জন্যই সুচিত্রা সেন অথবা উত্তম কুমার চিরকালিন নায়ক-নায়িকা, আজও, আর বোধহয় এ কারণেই ‘লাইফ ইজ বিউটিফুলের’ মত অসাধারণ একটি মুভি নিয়ে লেখার তাড়না অনুভব করিনি সেভাবে, কেন না রবার্ট বেনিগনিকে একটু বেশিই বুড়ো লেগেছিল, যা চিরাচরিত নায়কের কল্পিত সৌন্দর্য্য থেকে আপনা-আপনিই ছুঁড়ে দিয়েছিল তাকে।
কিন্তু এই ছবিতে অজগুর চরিত্রে অভিনয় করা মেহমেত গুনসুর ও ডেনিজ চরিত্রে বেলসিম বিলজিনকে দেখার পর আমার বিশ্বাস সবাই এ ব্যাপারে একমত হবেন যে, তারা সত্যিই যেন চরিত্র দুটির জন্য পারফেক্ট, আর জুটি হিসেবেও মানিয়েছে চমৎকার, এবং হয়ত এমন বোধ তৈরী হবার কারণেই ডেনিজকে পরের দিকে যতবার তার পুরোনো প্রেমিকের পাশে দেখি বেমানান লাগে, এমন কী ডেনিজ তাকে ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলেও প্রেমিকের অসহায় আর্তির সামনেও তাকে বিশ্বাসঘাতিনী বা নিচ মনে হয় না। আপাতভাবে বিলজিনের অভিনয় কিছুটা দুর্বল মনে হলেও মেহমেতের অভিনয় সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয়, এবং অবশ্যই সামনের দিনগুলোতে তাকে আরও কিছু ভাল চলচ্চিত্রে দেখব বলে আশা করছি।
মুভির অন্যান্য চরিত্রগুলোরও অভিনয় শৈলীর প্রশংসা না করে পারা যায় না। বিশেষ করে অরগুজ ও ডেনিজের বাল্য চরিত্রে অভিনয় করা বালক-বালিকা দ্বয়ের অভিনয় বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছে। মুহূর্তের জন্যও তাদের দেখে মনে হয়নি যে কোথাও কোনোরূপ জড়তা রয়েছে। তাদের এমন সাবলীল অভিনয় চলচ্চিত্রটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে, কেন না শিশু চরিত্রের বলিষ্ঠ অভিনয় সবসময়-ই একটি মুভিকে ভিন্ন মাত্রা দিতে সক্ষম, আর তা যদি হয় রোমান্টিক মুভি, তবে বলব, আপনারা নিজে মুভিটি আগে দেখে নিন, তারপর এদের অভিনয় শৈলীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। এছাড়া অজগুরের পিতার চরিত্রে আলতান আরকেকলির অভিনয় মুগ্ধ না করে পারে না।
একজন সার্থক পিতার উৎকৃষ্টতম উদাহরণ ইলমাজ চরিত্রে অভিনয় করা এই ফটোগ্রাফার পিতা, যে তার দুর্বল হৃদপিন্ডের সন্তানকে আগলে রাখে সর্বোতভাবেই, এবং একজন আদর্শ পিতার রূপে বিচরণ করে কাহিনী জুড়ে।
ছবির কাহিনী শুরু একটি আকস্মিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে, যেখানে একই দিনে দুই জননী একই হাসপাতালে দুটি সন্তান প্রসব করে, যারা সম্পূর্ণ অপরিচিত, কিন্তু জন্মের পর শিশুদুটিকে একত্রে রাখা হলে তাদের ছবি তোলার হয়। এই ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যায়, এবং পরে দুটো পরিবারই ভুলে যায় সেই অকস্মাৎ যোগাযোগের কথা। যদিও তারা একই মহল্লাতে বসবাস করে, এবং সেই শিশু দুটি একই সাথে বেড়ে উঠতে থাকে। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে এক ধরনের অন্তরঙ্গতা তৈরী হয়, এবং ঘটনাক্রমে একে-অপর থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়।
মেয়েটি পরে ভুলে যায় ও অন্য একটি ছেলের সাথে প্রণয়ে আবদ্ধ হয়, কিন্তু ছেলেটি বাল্যকালের সেই সখ্যতা মনে রাখে আর দীর্ঘ ২৫ বছর পর মেয়েটি তার বাল্যকালের একটি ছবির সূত্র ধরে পুনরায় ছেলেটির সাথে মিলিত হয়। মূলতঃ এখান থেকেই সিনেমাটি মূল রোমান্টিসিজমের মধ্যে ঢুকে পড়ে, এবং মেয়েটি অুনভব করে যে, যাকে সে এতদিন ভালবেসেছে তাকে সে কখনোই বুঝতে পারেনি ও চায়নি, বরং হৃদয়ের গোপন কোণে আজও রয়ে গেছে সেই বালকটি যার সাথে বালিকাবেলায় সখ্যতা হয়েছিল, আর একদিন ইচ্ছে করে তার সাইকেলের নিচে লাফ দিয়েছিল। এমন কী বালকটির বাবার স্টুডিওতে তার দাদা তাকে ছবি তুলতে নিয়ে গেলে সেখানে সে বালকটিকে চুমু খেয়ে দৌড়ে পালায়। এই হলো সিনেমার কাহিনী সংক্ষেপ, যেখানে দীর্ঘ ২৫ বছর পর বাল্য সখ্যতার রেশ ধরে সত্যিকার ভালবাসার টানে নায়িকা তার বর্তমান প্রেমিককে ছেড়ে যায় আর মুভিটি সমাপ্ত হয় মর্মান্তিক এক দূর্ঘটনায়।
ছবিটি দেখতে দেখতে আমার নিজস্ব উপলব্ধি ঘটেছিল ভিন্নভাবে, যা ছিল মানসিক বোধ সম্পর্কিত।
অরগুজ যে কিনা ২৫ বছর অপেক্ষা করল সেই মেয়েটির জন্য এই বিশ্বাসে যে, কখনও না কখনও তাদের দেখা হবে আর তখন সে নায়িকাকে ফিরিয়ে দেবে তার বালিকা বেলার সেই কৌটা যার মধ্যে সে লুকিয়ে রাখত মূল্যবান সব, যা সে হারিয়ে ফেলেছিল দাদার মৃত্যুর পর গাড়িতে উঠার সময়, আর ডেনিস যে কিনা দীর্ঘদিন প্রেম করার পর বাল্য সখ্যতার জের ধরে নতুন করে প্রেমে পড়ল, এবং পুরোনো প্রেমিককে ত্যাগ করল, এইসব মানসিক ব্যাপারগুলো আমাকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল। এছাড়া ডেনিসের পিতা যে অন্য নারীর প্রেমে তার স্ত্রী ও সন্তানকে ত্যাগ করল, ফলে বাকি জীবন তার মা এমন এক অবিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকল, যার দরুণ মেয়েকে বলে, পুরোনো প্রেমিককেই বিয়ে করতে কেন না সারাজীবন এমন একজন পাওয়া সত্যিই কষ্ঠকর যে বিশ্বস্ত। এইসব নানাবিধ বাস্তবতা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল দারুণ আর মানব মনের প্রকৃতি ভিন্নরূপে উঠে এসেছিল চেতনায়।
মজার তথ্য এই যে, ১১৮ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার তাদের কাছের মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া নানাবিধ আকস্মিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে বানিয়েছেন। পুরো ছবিটি নানারূপ আকস্মিক ঘটনায় পূর্ণ, যা হয়ত ছবিটির নামকরণ তথা চিত্রনাট্যকে সার্থকতা প্রদান করেছে, কিন্তু কোথাও যেন চলচ্চিত্রটির শেষাংশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছে।
যদিও রোমান্টিক সিনেমাগুলো মনের অজান্তেই সুখোকর পরিণতি দাবী করে করে বসে, ফলে এই সিনেমার সমাপ্তি স্বভাবতই এক ধরনের অতৃপ্ততা তৈরী করে। তারপরও এর কাহিনীজুড়ে আকস্মিক ঘটনাসমূহের বিস্তার একটু বেশিই মনে হয়ছে, যা কাহিনীর বাস্তব প্রহণযোগ্যতাকে ব্যাহত করেছে, আর শেষাংশে যত দ্রুত কাহিনী এগিয়েছে তাতে শুরু থেকে দুটি মানুষের জীবন যে গতিতে সমান্তরালভাবে এগিয়েছে, তা পুরো কাহিনী জুড়ে চমৎকার এক ছন্দ তৈরী করে রাখলেও, এমন দ্রুত গতির সমাপ্তি ও অতি নাটকীয়তা তা নষ্ট করে দিয়েছে। নতুবা এত চমৎকার অভিনয় ও চিত্রনাট্যর চলচ্চিত্রটি আরও অধিক সুন্দর হয়ে উঠতে পারত, নিঃসন্দেহে।
মূলতঃ ৮০-র দশক থেকেই তুর্কি চলচ্চিত্র বিশ্ব সিনেমার দর্শক টানতে সক্ষম হয়েছে, এবং চমৎকার কিছু সিনেমা যেমন বিশ্বকে উপহার দিয়েছে, তেমনি এমন কিছু মেধাবী পরিচালকও আমরা পেয়েছি, যাদের নির্মাণ না দেখলে আধুনিক সিনেমার একটা বিশেষ অংশ অদেখা রয়ে যায়। গত দু’তিন বছর ধরেই আমি তুর্কি সিনেমার প্রতি ক্রমশঃ আসক্ত হয়ে পড়েছি যার শুরু ছিল ইলমাজ গুনের ‘ইওল দিয়ে’।
তারপর নুরি বিলগ ছেলান, ফতেহ আকিন, কাগান ইরমাক এবং সম্প্রতি ফারুক সোরাক। আলোচ্য চলচ্চিত্রটির প্রায় সব বিভাগেই পরিচালকের মুন্সিয়ানার ছাপ স্পষ্ট। নির্দেশনা, কলা-কুশলী নির্বাচন, কাহিনী নির্মাণ ও বিন্যাস, ক্যামেরা শৈলী, শুটিং লোকেশন (বিশেষ করে ইস্তাম্বুল ও আংকারার মনোরম দৃশ্যাবলি সত্যিই মনোমুগ্ধকর), সংলাপ, সঙ্গীত ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই প্রশংসার দাবি রাখে। পরিশেষে বলব, যারা রোমান্টিক মুভি দেখতে পছন্দ করেন, তারা জলদি দেখে ফেলুন মুভিটি, আর নারী দর্শকের বলব, খুব সাবধান, ছবিটি দেখার পর আপনার প্রেমিকটিকে পুনরায় যাচাই করার আগে অবশ্যই ভেবে নেবেন, আপনি চলচ্চিত্র দেখছেন, জীবন নয়,কেন না জীবন সর্বদাই অপেক্ষা করে থাকে সামনে, কোনো সুনির্দিষ্ট সমাপ্তি ছাড়াই।
৩১.০৫.১২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।