বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ। বাংলা। আবহমান বাংলা।
মাতৃতান্ত্রিক বাংলা। এই মাতৃতান্ত্রিক বাংলার দার্শনিক চিন্তার ঐতিহ্যকে বাংলায় বলা হয়: ভাব। বাঙালিমানসে এই ভাবের উদয় হয়েছিল সুপ্রাচীনকালের লোকায়ত কৌমসমাজে । বাংলার এই ভাবটি আজও বাঙালির চিন্তার জগতে হিরণময় দূত্যি বিচ্ছুরিত করে। আজও বাংলার মরমী সুফিসাধক, প্রেমময়ী বৈষ্ণব-বাউলের বিশুদ্ধ জীবনে এই ভাব পুস্পেগন্ধে সুরভিত।
ভাবের শিকড়টি বাংলার আদিম কৌমসমাজে প্রোথিত বলেই সম্ভবত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এই ভাবটি নারীবাদী (যেহেতু ট্রাইবাল-কৌম সমাজ নারীকেন্দ্রিক)। যে নারীবাদী ভাব-দর্শনটি কেবল লোকায়তিক বিজ্ঞজনই নন, শহুরে বিদ্যানুরাগীরও অশেষ কৌতূহলের বিষয়। এমন কী রবীন্দ্রনাথের একটি গানে, যে গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, সে গানেও সেই একই নারীবাদী ভাবনার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই যেন-
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রানে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে-
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো-
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
গানটি বাংলার অপার সৌন্দর্যমন্ডিত প্রকৃতির বন্দনামূলক একটি অতুলনীয় গান। গানটি সেভাবেই আরম্ভ হয়েছিল। অথচ তৃতীয় চরণে সেই বাংলা হয়ে যান-মা। তারপর বাংলার রূপ যেন ¯েœহময়ী এক নারীর অনন্য রূপই হয়ে উঠল।
‘কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো-/কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে। ’
কবিগুরুর এই হৃদয়-ছোঁওয়া গানটিতে যে নারীবাদী ভাবনার প্রকাশ পেয়েছে,অর্থাৎ, স্বদেশভূমির মাঝে মাতৃরূপের দর্শন, এটি নেহাত আকস্মিক - না কবির এই নারীভাবনাটি বাংলার দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য? যদি এটি বাংলার দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যই হয়, তাহলে কবে, কেন এবং কিভাবে এর সূচনা ঘটল?
এ সমস্ত ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি ।
স্মরণ হয় এককালে (মধ্যযুগে) বাংলায় উদ্ভব হয়েছিল ‘তন্ত্রের’ । সেই তন্ত্রের মূলে ছিল একটি দেহবাদী সিদ্ধান্ত - ‘যা নাই দেহভান্ডে, তা নাই ব্রহ্মান্ডে। ’ অর্থাৎ, যা মানবশরীরে নেই, তা মহাবিশ্বেও নেই! ভাবনাটি বেশ চিত্তাকর্ষক বলেই মনে হয় ।
তো, সেই দেহবাদী ভাবনাটি ক্রমশ নারীবাদী একটা রূপ ধারণ করল।
মানবশরীর হয়ে উঠল নারীর শরীর ...
গড়ে উঠল তন্ত্র সাধনার নানাবিধ গুপ্ত বিধিবিধান।
শেষ পর্যন্ত তন্ত্রের মানে দাঁড়াল- আদিম নারীশক্তির আরাধনা করে অতিপ্রাকৃত (সুপারন্যাচারাল) শক্তি অর্জন করা। এই ভাবনাটি একই সঙ্গে বাংলার বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মসম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছিল বলেই বাংলার বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মের স্বরূপটি তান্ত্রিক।
কিন্তু, এই তন্ত্র বা তন্ত্রভাবনার উদ্ভব হল কি ভাবে?
পাঠ করি-Sāmkhya is one of the six orthodox systems (Āstika, those systems that recognize Vedic authority) of Hindu philosophy. The major text of this Vedic school is the extant Samkhya Karika circa 200 CE. This text (in karika 70) identifies Sāmkhya as a Tantra and its philosophy was one of the main influences both on the rise of the Tantras as a body of literature, as well as Tantra sadhana.
তার মানে সাংখ্যদর্শনটিই তন্ত্রের উৎস।
সে তো বোঝা গেল। কিন্তু, সাংখ্যদর্শনের সঙ্গে প্রাচীন বাংলার যোগসূত্র কোথায়? কেননা, একটু আগেই লিখেছি, স্মরণ হয় এককালে (মধ্যযুগে) বাংলায় উদ্ভব হয়েছিল ‘তন্ত্রের’ ।
এবার তাহলে সাংখ্যদর্শনের সঙ্গে প্রাচীন বাংলার যোগসূত্র আবিস্কারের চেষ্টা করি।
প্রাচীন ভারতে ছ’টি দার্শনিক মত গড়ে উঠেছিল। এগুলো হল (১) সাংখ্য, (২) যোগ, (৩) বেদান্ত, (৪) মীমাংশা, (৫) ন্যায় এবং (৬) বৈশেষিক ।
সাংখ্যকে ১ নম্বরে রাখার কারণ? কারণ, এই ছ’টি দার্শনিকমতের মধ্যে সাংখ্যই হচ্ছে সবচে প্রাচীন । সাংখ্য দর্শনটি প্রচার করেছিলেন যে মেধাবী এবং মহৎ দার্শনিক ... তাঁর নাম কপিল (Kapila). মানুষ-কপিল সম্বন্ধে দর্শনের অধ্যাপক Kevin Burns লিখেছেন: There is no evidence for his existence and he may be only a legend. (Eastern Philosophy. Page 37) আমরা অধ্যাপক কেভিন বার্নস এর সঙ্গে একমত নই। কেননা, আমরা মনে করি কপিল ছিলেন প্রাচীন বাংলার একজন চিন্তাবিদ। যশোরের কপোতাক্ষ নদীর কূলে যে কপিলমুনি গ্রাম আছে, কপিলের জন্ম সে গ্রামেই হয়েছে। ইউরোপীয় পন্ডিতবর্গ কপিলের সময় কাল নির্ধারণ করেছেন 7th century. তার মানে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের কোনও এক সময়ে প্রাচীন বাংলায় কপিলের জন্ম হয়েছিল।
এবং তাঁর প্রচারিত দর্শনটিই বাংলার ভাব-দশর্নের আদিমতম স্তর! দর্শনের অধ্যাপক Kevin Burns যে দর্শনটিকে অবহিত করেছেন: one of the most important and influential systems in philosophical history. (Eastern Philosophy. Page 37) বলা হয়েছে। বাংলার ভাব-দশর্নের আদি স্তরটিই সাংখ্য দর্শন প্রভাবিত; এই কারণে আমরা এই দর্শন সম্পর্কে কৌতূহলী হতেই পারি।
আলোচনার সূচনায় একবার বলেছি-ভাবের শিকড়টি বাংলার আদিম কৌমসমাজে প্রোথিত বলেই সম্ভবত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এই ভাব নারীবাদী।
কিন্তু সাংখ্য (Sankha) অর্থ কি?
সাংখ্য অর্থ Enumeration বা তালিকা। দর্শনটি অস্তিত্বের ২৫টি ক্যাটাগরি চিহ্নিত করে তালিকা করেছে বলেই দর্শনটির ওই নাম ।
সে যাই হোক। আমরা এ আলোচনায় সাংখ্যদর্শন সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করব না।
আমাদের প্রশ্ন ছিল- বাংলায় তন্ত্র বা তন্ত্রভাবনার উদ্ভব হল কি ভাবে?
এ প্রসঙ্গে আমাদের বলবার কথাটি হল: কপিল যে বইটি লিখেছিলেন সে বইয়ের নাম সাংখ্যপ্রবচনসূত্র। বইটি বেদবিরোধী বলে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে পন্ডিত ঈশ্বরকৃষ্ণ সাংখ্যপ্রবচনসূত্রর একটি ভাষ্য লিখেন।
(যে বই ধ্বংস করে ফেলা হল সে বইয়ের ভাষ্য লেখা হল কিভাবে? বলছি। ভারতীয় দার্শনিক মহলে একটি বিশেষ রীতি হল এই যে ... যে মতের বিরুদ্ধচারণ করা হবে প্রথমেই সেই মতটি বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করা। সাংখ্যমতবাদবিরোধ দার্শনিকগণ তাই করেছিলেন। সুতরাং ঈশ্বরকৃষ্ণ সাংখ্যদর্শ ন সম্বন্ধে সমস্ততথ্যই পেয়েছিলেন ) ... ঈশ্বরকৃষ্ণের সেই ভাষ্যের নাম সাংখ্যকারিকা। সেই ভাষ্যে দার্শনিক ঈশ্বরকৃষ্ণ সাংখ্যদর্শনকে ‘তান্ত্রিক’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
কেন? পাঠ করি- Samkhya, to some extent, differs from Nyaya -Vaisheshika and Jainism. While Nyaya-Vaisheshika and Jainism contend that the atoms are the ultimate constituents of the physical world, Samkhya differs on the issue. According to Samkhya the cause is always subtler than the effect. The Samkhya theory argues: How can so gross atoms of matter can be the cause of such subtle and fine objects as mind and intellect? The Samkhya proposes that some finest and subtlest stuff or principle underlies all physical existence. Samkhya names it as Prakriti. Prakriti is the primordial substance behind the world. It is the material cause of the world. Prakriti is the first and ultimate cause of all gross and subtle objects. অর্থাৎ, অন্যান্য দার্শনিক মত যেখানে দাবি করছে: ভৌতজগতের গঠনের পিছনে রয়েছে পরমাণু (এটম), সাংখ্য (কপিল ) সেখানে দ্বিমত পোষন করে বলছেন: কারণ কার্যের তুলনায় সূক্ষ্ম। তাই মন এবং বুদ্ধির মতন সূক্ষ্ম বিষয়ের ভিত কি ভাবে পরমাণুর মতন স্থূল জিনিস হতে পারে? তাহলে? তাহলে কপিল বলছেন, কোনও এক অতি সূক্ষ্ম বিশুদ্ধ নীতি বস্তুজগত আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই হচ্ছে ‘প্রকৃতি’। এবং প্রাচীন বাংলার ওই মেধাবী দার্শনিকটি দাবি করছেন: Prakriti is the primordial substance behind the world. It is the material cause of the world. Prakriti is the first and ultimate cause of all gross and subtle objects.
মধ্যযুগের বাঙালি চিন্তাবিদেরা তাদের চিন্তাশীল পূর্বপুরুষের এ রকম গভীর গভীরতর বক্তব্যে নিশ্চয়ই উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন। তাদের পক্ষে উজ্জীবিত হয়ে ওঠাই ছিল স্বাভাবিক।
কেননা, বাংলাদেশ তো জ্ঞানীর আতুর। কবি আল মাহমুদ লিখেছেন:
‘আবাল্য শুনেছি মেয়ে বাংলাদেশ জ্ঞানীর আতুর
অধীর বৃষ্টির মাঝে জন্ম নেন শত মহীরূহ। ’ (সোনালি কাবিন। )
আমরা দেখেছি যে, বিশ্বের প্রতিটি মতবাদকেই যেতে হয় বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে । যে কারণেই বাংলায় সাংখ্যদর্শনের প্রকৃতি-সম্বন্ধীয় ধারণাটিও বিবর্তিত হয়েছিল।
আদিম সূক্ষ্ম প্রকৃতিকে দেহের মাঝে বিরাজমান ভেবেই মধ্যযুগের বাঙালি চিন্তাবিদেরা বলেছিলেন: ‘যা নাই দেহভান্ডে, তা নাই ব্রহ্মান্ডে। ’ তাঁরা হয়তো এমনও ভেবেছিলেন যে এই ‘অধরা প্রকৃতিরে ধইরতে পারলে’, অজানা বিশ ব্রহ্মান্ড কে জানা যাবে। যে ভাবনাটি, আমরা দেখেছি, পরবর্তীকালে অনিবার্যভাবে নারীবাদী ধ্যানধারণায় পর্যবেশিত হয়েছে।
বাংলার দার্শনিক ইতিহাসের এই বাঁক-বদল আমাদের গভীরভাবে বিস্মিত করে বৈ কী। আমরা শিহরণ বোধ করি এবং সবিস্ময়ে লক্ষ্য করি যে, বাংলার ভাব-দর্শনটি আজও কপিলের ওই প্রকৃতি-ভাবনার ওপরই দাঁড়িয়ে আছে।
আজও কপিলের প্রকৃতিপুরুষ তত্ত্বটি বাংলার সাধকমহলে এক অবধারিত অলোচ্য বিষয়। লালনের একটি নারীবাদী গানেও এই ভাবনাটি উঁকি দেয় -
পুরুষ পরওয়ারদিগার
অঙ্গে ছিল প্রকৃতি তার
প্রকৃতি প্রকৃতি সংসার
সৃষ্টি সবজানা
মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা
নিগূঢ় বিচারে সত্য গেল যে জানা ...
আলোচনার এই পর্যায়ের আমরা দেখব কপিল-অনুপ্রাণিত তান্ত্রিক ভাবনাটি কিভাবে বাংলার হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল। তখন একবার বলেছি যে তন্ত্র ভাবনাটি একই সঙ্গে বাংলার বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মসম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছিল বলেই বাংলার বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মের স্বরূপটি তান্ত্রিক।
বৈদিক আর্যরা বাংলায় সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগেই আর্য দেবদেবীর ধ্যানধারনা নিয়ে এসেছিল। প্রাচীন ভারতে ৮০০ খ্রিস্টপূর্বে আবিস্কার হয়েছিল লৌহের।
বস্তুটি কর্তনযন্ত্র নির্মাণের সহায়ক। কাজেই প্রাচীন বাংলার পশ্চিম দিকের অতিক্রম-অসাধ্য গহন অরন্যভূমি কেটে আর্যদের বাংলায় আসতে সুবিধে হয়েছিল। বৈদিক আর্যগণের প্রধান দেবতা তিনজন । যথাক্রমে: ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব। শিব অবশ্য অনার্য দেবতা।
সে যাই হোক। বাংলায় তন্ত্র ধারণার উদ্ভব ও বিকাশের পর অন্যকথা বলা হল। বলা হল এক আদিম মহাদেবী এই তিন দেবতাকেই সৃষ্টি করেছেন!
এই বিস্ময়কর সাহসী দাবিটির পিছনে কি যুক্তি ছিল?
পাঠ করি-সাংখ্য দর্শনের প্রবক্তা কপিল বলছেন, that some finest and subtlest stuff or principle underlies all physical existence. Samkhya names it as Prakriti. Prakriti is the primordial substance behind the world. It is the material cause of the world. Prakriti is the first and ultimate cause of all gross and subtle objects.
এই প্রকৃতিই হলেন নারী-প্রকৃতি। যিনি সূক্ষ্মরূপে সব বস্তু আচ্ছন্ন করে রাখেন। এমন কী কবিগুরুর গানও ...
সে যাই হোক।
এবার আমরা ফিরে যাই মধ্যযুগের বাংলার পাল আমলে। বাংলার পাল আমলে যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার হয়েছিল, সে ধর্মটির অভ্যন্তরীণ চিন্তাকাঠামোটি নারীবাদী তান্ত্রিক প্রভাব এড়াতে পারেনি। তো, কি সেই নারীবাদী তান্ত্রিক ধ্যানধারণা? ব্যাখ্যা করি। বুদ্ধ বেঁচে থাকতে কিছু দার্শনিক প্রশ্ন সম্বন্ধে নিরব ছিলেন। যেমন: ঈশ্বর আছেন কিনা, কিংবা জগতের উদ্ভব কী ভাবে হয়েছে? ইত্যাদি।
বুদ্ধের মহাপরিনির্বানের পর, অর্থাৎ মৃত্যুর পর, উত্তর ভারতের বৌদ্ধ দার্শনিকগণ এসব দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন। বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন বললেন, জগতের উদ্ভব হয়েছে ‘শূন্য’ থেকে। কিন্তু, বাংলায়, বিশেষ করে বিক্রমপুরের বৌদ্ধ দার্শনিকগণ বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের বিরোধীতা করে বললেন, জগতের উদ্ভব হয়েছে ‘বজ্র’ থেকে। ‘বজ্র’ কি? ‘বজ্র’ হল নারীর গুণ। এই বজ্রই কপিল-কথিত ‘primordial substance’ বলা যেতে পারে।
আমরা বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী নামে একটি গ্রামের কথা শুনেছি। ওই গ্রামেই জন্ম হয়েছিল বিশিষ্ট বাঙালি পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান- এর। অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তিনি বাংলার তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের ধ্যানধারণা নিয়ে তিব্বতে গিয়েছিলেন। সে যাই হোক।
বাংলার বৌদ্ধ দার্শনিকদের চিন্তা ভাবনার মূলেও সাংখ্যদর্শনের মূলকথা: Samkhya names it as Prakriti. Prakriti is the primordial substance behind the world. It is the material cause of the world.
বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মকে কয়েকটি স্তরের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। সে সম্বন্ধে কিছুকথা বলা দরকার। বাংলায় যে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়েছিল, সেটি মহাযানী বৌদ্ধধর্ম। মহাযানী বৌদ্ধধর্মের পন্ডিতেরা ‘বির্মূত’ ধারণ নিয়ে বড় বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অথচ বাংলার সাধারণ জনসাধারণের কাছে যাদুবিদ্যা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি বিষয়।
যে কারণে বাংলার একদল বৌদ্ধ আচার্য মহাযান বৌদ্ধধর্মের একটি নতুন রূপ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করেন, যাদের কাছে মন্ত্রই ছিল মূল প্রেরণা। এই হল, ‘মন্ত্রযান’, বাংলার বৌদ্ধধর্মের একটি রূপ। মহাযানের বিবর্তনের দ্বিতীয় স্তরটি হল ‘বজ্রযান’। এর তত্ত্বটি বেশ জটিল এবং এতে নারীপ্রাধান্য রয়েছে। এ ছাড়া বজ্রযানে মহাসুখের ধারণা রয়েছে, সেই সঙ্গে যৌনতারও গুরুত্ব রয়েছে।
বজ্রযানের মূলকথা হল দুঃখ, কর্ম, কর্মফল, সংসার সমস্তই শূন্য। শূন্যতার এই পরম জ্ঞানই নির্বান। যাই হোক। বজ্রযানী সাধনার সূক্ষ্মতর স্তরই সহজযান।
তন্ত্র, বজ্রযানী বৌদ্ধধর্ম এবং সুফিবাদের মিশেলে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে বাংলায় বাউলমতের উদ্ভব হয়েছে।
যে বাউলমতে কপিল-কথিত ‘প্রকৃতি’ শব্দটির রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। এই বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন:
‘বাউলসাধনায় নারীর একটি স্বতন্ত্র গুরুত্ব ও মূল্য আছে। নারী বা প্রকৃতি বাউলের সাধনসঙ্গিনী। বাউলের দেহকেন্দ্রিক যে সাধনা, নারী ছাড়া তা অসম্ভব ও অর্থহীন। ( মনে রাখতে হবে বাংলায় ‘তন্ত্রের’ উদ্ভব হয়েছিল।
সেই তন্ত্রের মূলকথা ছিল-‘যা নাই দেহভান্ডে, তা নাই ব্রহ্মান্ডে। ’ অর্থাৎ, যা মানবশরীরে নেই, তা মহাবিশ্বে নেই! ... সেই ভাবনা ক্রমশ নারীবাদী রূপ নিল। মানবশরীর হয়ে উঠল নারীর শরীর, গড়ে উঠল তন্ত্র সাধনার নানাবিধ গুপ্ত বিধিবিধান। ) ...‘মহাযোগ’ অর্থাৎ রজঃস্বলা রমনীর বিশেষ তিন দিনে পুরুষ ও প্রকৃতির যুগল মিলনেই চলে ‘মানুষ-ধরা’র সাধনা। বাউল মতের উদ্ভবের সঙ্গেও নারীর সম্পর্ক রয়েছে-চৈতন্য-পার্ষদ নিত্যানন্দ -পুত্র বীরভদ্রের গুরু হিসেবে প্রচারিত ‘মাধববিবি’ -কেও কেউ কেউ এই মতের প্রবর্তনার সঙ্গে যুক্ত করে থাকেন।
এই মরমী সাধনার আদিরূপের অনেক গুপ্ত রহস্য নবি-দুহিতা হজরত ফাতেমা অবগত ছিলেন বলেও বাউল -ফকিরদের বিশ্বাস। সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গেও নারীর রয়েছে নিগূঢ় সর্ম্পক। বাউলের সাধনা ও উপলব্দিতে নারীর রূপ-স্বরূপের যে পরিচয়-গুণ-মাহাত্মের যে বৈশিষ্ট্য, তা সবচেয়ে আন্তরিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে বাউলসাধনা ও দর্শনের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার লালন সাঁই -এর পদাবলিতে। ’ ( লালন সাঁইয়ের সন্ধানে। পৃষ্ঠা ৯৫)
এ পোস্টের শুরুতে কবিগুরুর একটি বিখ্যাত গানে কীভাবে বাংলার মাতৃতান্ত্রিক ভাবনাটি মিশে রয়েছে আমরা সেটি লক্ষ্য করেছি।
কিন্তু এ প্রসঙ্গে বাংলার আরেক কাবিক্য দিকপালের কি বক্তব্য? নজরুলও যেন মাতৃতান্ত্রিক বাংলার মাতৃরূপটিকে তাঁর কবিহৃদয় দিয়েই অনুভব করেছিলেন। নজরুলের একটি গানে সেই আদিমাতা পল্লীজননীরূপে প্রতিভাত, যে মায়ের রূপ জগজ্জননী দূর্গার মতো। সেই মাকে নিয়ে নজরুল লিখেছেন-
এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লীজননী
ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবনী ।
রৌদ্র তপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল।
আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল।
ঝঞ্ছার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল লয়ে অশনি।
নজরুলের লাবণ্যপূর্ণ পল্লী-মাটি ঝড়ে দিনে অশনি অর্থাৎ বজ্রবিদ্যুতের সঙ্গে খেলা করেন! যা মধ্যযুগের তান্ত্রিক বৌদ্ধ দার্শনিকদের ‘বজ্র’ শব্দটির কথা মনে করিয়ে দেয়। যে অশনিবজ্রের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন বাংলার দার্শনিক কপিলের ‘প্রকৃতি’। যে প্রকৃতিই হলেন নারী-প্রকৃতি। যিনি সূক্ষ্মরূপে সব বস্তু আচ্ছন্ন করে রাখেন।
এমন কী নজরুলের গানও ...
তথ্যসূত্র:
আবুল আহসান চৌধুরী; লালন সাঁইয়ের সন্ধানে
Kevin Burns; Eastern Philosophy
http://indianphilosophy.50webs.com/samkhya.htm
http://en.wikipedia.org/wiki/Samkhya ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।