আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাংখ্য থেকে বাউল: বাংলার দার্শনিক উত্তরাধিকার

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ বাংলার দার্শনিক ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরনো। দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষ করে বাংলার দার্শনিক চিন্তাধারা ষোড়শ শতকের বাউলমতে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। এর পর সেটি উনিশ শতকে পৌঁছে যেন লালনের গানের বাণীতে তার শেষ যতিচিহ্ন এঁকেছে।

লালনের যে গান সাংখ্য, তন্ত্র, যোগ, বৌদ্ধ সহজিয়া, সুফি ও বৈষ্ণব ধর্ম -এই ছ’টি সমৃদ্ধ ও সুগভীর মরমি চিন্তাধারা আত্বস্থ করে এরই মধ্যে গভীরতরো এক আধ্যাত্বিক স্তরে উন্নীত হয়েছে। বাংলার দার্শনিক চিন্তাধারার নিগূঢ় বক্তব্যটি যেন লালন- এর গানে যথার্থভাবেই প্রতিফলিত। সাংখ্য, তন্ত্র, যোগ, বৌদ্ধদর্শন, সুফি ও বৈষ্ণব -প্রভৃতি সমৃদ্ধ চিন্তাধারার সংর্স্পশে ঋদ্ধ হয়ে বাংলার দার্শনিক ঐতিহ্য আজ বাঙালির স্বকীয় ভাবরাজ্যে অতুল এক মানসসম্পদে রূপ লাভ করেছে। প্রাচীনকালেই বাংলার দার্শনিক ভাবনাটির উদ্ভব ও বিকাশ বাংলার তত্ত্বানুসন্ধিৎসু চিন্তাশীল সমাজে । তবে ‘দর্শন’ শব্দটি বাংলার চিন্তাজগতে তেমন প্রয়োগ হয় না।

দার্শনিক চিন্তাধারা বাংলায় ‘ভাব’ নামে পরিচিত। বাংলার ভাব বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একই সঙ্গে বিশ্বাসী ও সংশয়ী, চরিত্রে নারীবাদী, দায়বদ্ধতার দিক থেকে জাতপাত ও সামাজিক বৈষম্যের ঘোর বিরোধী। এ কারণে বাংলার ভাব কেবলই বাংলার সচেতন চিন্তাশীল মানুষের অবাধ কল্পনার রাজ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং সে হয়ে উঠেছে অসাম্যের বিরুদ্ধে নিরন্তর এক দ্রোহী কন্ঠস্বর । লালনকে এজন্যেই আমরা দেখেছি একতারার বদলে শোষিত কৃষকের পক্ষে হাতে লাঠি তুলে নিতে! বাংলার দর্শনচিন্তার গোড়ায় রয়েছে সাংখ্য, তন্ত্র ও যোগ-প্রভৃতি প্রাচীন লোকায়ত ভাবনার জটিল চিন্তজাল। সাংখ্যা, তন্ত্র ও যোগ দর্শনের প্রাথমিক সূত্রপাত হয়েছিল প্রাচীন বাংলার সেই আদিম সমাজে- সেই অনার্য নিষাদ-কিরাত-এর চিন্তাচেতনায়।

তবে সাংখ্য বিশুদ্ধ দর্শন হলেও -তন্ত্র ও যোগ দর্শনের ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তবুও এ দুটি চিন্তাধারার যথার্থ দার্শনিক ভিত্তিও রয়েছে। সে যাই হোক। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, ইরান থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে দলে দলে বৈদিক আর্যরা ভারতবর্ষের পশ্চিম সীমানায় প্রবেশ করে এবং পরবর্তী দেড় হাজার বছরে পূর্ব দিকে -অর্থাৎ প্রাচীন বাংলার অভিমূখে অগ্রসর হয়। এই প্রক্রিয়ায় বৈদিক আর্যরা খ্রিস্টপূর্ব নবম থেকে অস্টম শতকের দিকে প্রাচীন বাংলায় অনুপ্রবেশ করে এবং বসতি স্থাপন করে বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন।

তবে বৈদিক আর্যরা বাংলায় সম্পূর্ণভাবে আর্যায়ণে ব্যর্থ হয়। কেননা, বাংলার সাংখ্য, তন্ত্র ও যোগ দর্শন আর্য ধর্মভাবনাকে প্রভাবিত করে এবং প্রাচীন বাংলার অনার্য জনগোষ্ঠী বৈদিক দেবতাকে গ্রহন না-করে তারা অনার্য দেবতা শিবকে আঁকড়ে থাকে। তা ছাড়া অনার্য বাঙালির রক্তের মধ্যে রয়েছে-তত্ত্বানুসন্ধিৎসা। পরবর্তীকালে সাংখ্য, তন্ত্র ও যোগ এর ধারণার মাধ্যমে আর্যবৈদিক ধর্মভাবনা অনেকখানিই বদলে দিয়েছিল। সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক কপিল।

তাঁর সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৮০০। ইনি প্রাচীন বাংলার একজন অত্যন্ত মেধাবী চিন্তাবিদ ছিলেন । এ প্রসঙ্গে "গঙ্গা: তত্ত্ব ও তথ্য" বইতে তপোব্রত সান্যাল লিখেছেন: ‘ প্রাচীনকালের লেখকরা বঙ্গকে উপেক্ষা করলেও মহামুনি কপিলের সঙ্গে গঙ্গার সম্পর্কে কে মান্য করেছেন। সাংখ্য-দর্শনের প্রবর্তক কপিল যে বঙ্গবাসী ছিলেন, তার প্রমান আছে। সাংখ্যই ভারতের প্রাচীনতম দর্শন।

বৌদ্ধধর্মের মূলতত্ত্বের উৎসও এই সাংখ্যদর্শন। বস্তুত, বুদ্ধের দু’জন গুরুই ছিলেন সাংখ্যমতাবলম্বী। সনাতন ধর্মাবলম্বী আর্যশাস্ত্রীরা কপিলের লোকায়ত সাংখ্যশাস্ত্রকে কখনোই মেনে নেন নি, কারণ কপিল বেদকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেননি। মনে হয় এই কারণেই বৌদ্ধ-অধ্যুষিত বঙ্গ আর্যদের দ্বারা অবহেলিত হয়েছে। ’ (পৃষ্ঠা ১৬)।

বিশ্বজগতের উদ্ভব কেন হয়েছে? কপিল তাঁর মতো করে তারই ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করতেন, বিশ্বজগতের উদ্ভব কীভাবে হল -সেটি ব্যাখ্যার জন্য "পুরুষ" ও "প্রকৃতি" সম্বন্ধে জ্ঞানলাভই যথেষ্ট। যে কারণে বিশ্বজগতের উদ্ভব ব্যাথ্যা করার জন্য ঈশ্বর-কল্পনা অপ্রয়োজনীয়। এ কারণেই সাংখ্য দর্শনের মূল বিষয় হল: পুরুষ ও প্রকৃতি। প্রকৃতি হল আদিবস্তু ।

প্রকৃতিই বিশ্বজগতের সূক্ষ্ম এবং স্থূল বস্তুর উদ্ভবের কারণ। তবে প্রকৃতি অচেতন অর্থাৎ চেতনাশূন্য। প্রকৃতি বিশ্বজনীন, সূক্ষ্ম বস্তু, (অপ্রকাশিত অর্থে) যা স্থান ও কালে নির্ধারিত হয়। অপরদিকে পুরুষ হল- আত্মা। পুরুষ সর্বব্যাপী, চেতন, সর্বত্রগামী, কিন্তু গতিহীন বা অনঢ়, অপরিবর্তনীয়, অবস্তুগত এবং আকাঙ্খাহীন।

পুরুষ প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে। প্রকৃতি তিনটি গুণের সমন্বয়। স্বতঃ রজঃ এবং তমোঃ। স্বতঃ হল সুখ। রজঃ হল গতিময়তা এবং তমোঃ অজ্ঞাতা এবং নিষ্ক্রিয়তা।

কপিলের একটি উক্তি হল- ‘প্রকৃতি ত্রিগুণাত্বক চঞ্চলা, পুরুষ অপ্রধান। ’ অপ্রধান অর্থে নিষ্ক্রিয়। কেননা উল্লেখ করেছি: পুরুষ হল-অনঢ়, অপরিবর্তনীয়, অবস্তুগত এবং আকাঙ্খাহীন। সে যাই হোক। পুরুষ-এর অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই প্রকৃতি প্রকাশ পায়।

এই বিষয়টি ঘটে এভাবে-বিশ্বজগতে বিবর্তন প্রক্রিয়া সূচিত হয় তখনই যখন পুরুষ প্রকৃতির সংস্পর্শে আসে (যেমন চম্বুক লোহার গুঁড়োকে টানে)। যে পুরুষ আগে ছিল চেতনা বিশুদ্ধ এখন প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে উঠল প্রকৃতিকেন্দ্রিক। এতে করে বোধির (আধ্যাত্বিক চেতনার) উদ্ভব এবং বিবর্তন ঘটতে থাকে। এর পর বিবর্তন ঘটে অহংচেতনার বা অহংকারের। এই অহংচেতনা অনেকটা ভ্রান্ত ধারণা বশতই আরোপিত হয় পুরুষের ওপর ।

কারণ এতে মনে হয় যেন পুরুষের অস্বিত্বের মূলে অহংই রয়েছে । অহংকার এরপর পাঁচটি স্থূল বস্তু তে ভাগ হয়ে যায়। যেমন: স্থান, অগ্নি, বায়ূ, মৃত্তিকা এবং জল। অহংকার এরপর আবার পাঁচটি উপাদানে বিভক্ত হয়। যেমন, শব্দ, স্পর্শ, দৃষ্টি, স্বাদ ও গন্ধ।

এতে অনুভূতির পাঁচটি উপাদান যা দিয়ে শোনা, স্পর্শ করা, দেখা, স্বাদ গ্রহন, গন্ধ পাওয়া-এসব সম্ভবপর হয়। একই সঙ্গে কথা বলা, কোনও কিছু ধরা, চলা ফেরা, প্রজনন এবং অপসারণ- এসব ক্ষমতাও তৈরি হয় । একই সঙ্গে মন ও চিন্তারও উদ্ভব হয়। এসবের বিন্যাস ও সমন্বয়ই বিশ্বজগতের উদ্ভব ও সেটি প্রবাহমান থাকে। সাংখ্য দর্শনের পর প্রাচীন বাংলায় উদ্ভব হয়েছিল তন্ত্রের ।

তন্ত্র অবশ্য প্রাচীন বাংলার আদিম অধিবাসী সেই নিষাদ-কিরাতের চিন্তাচেতনায় প্রাথমিক স্তরেই ছিল। এ প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন, ‘বৈদিক ভাষায় দেশী শব্দ যেমন গৃহীত হয়েছে, তেমনি যোগপদ্ধতিও হয়েছে প্রবিষ্ট। বস্তুত এই দ্বিবিধ প্রভাব ঋগে¦দেও সুপ্রকট। তা ছাড়া দেশী জন্মান্তরবাদ প্রতিমা পূজা, নারী, পশু ও বৃক্ষ-দেবতার স্বীকৃতি, মন্দিরোপসনা, ধ্যান, কর্মবাদ, মায়াবাদ এবং প্রেততত্ত্ব দেশী মানস প্রসূত। কাজেই যোগ ও তন্ত্র সর্ব ভারতীয় হলেও অষ্ট্রিক, নিষাদ ও ভোট -চীনা কিরাত অধ্যূষিত বাঙলা-আসাম-নেপাল অঞ্চলেই হয়েছিল এসবের বিশেষ বিকাশ।

যোগীর দেহশুদ্ধি এবং তান্ত্রিকের ভূতশুদ্ধি মূলত অভিন্ন ও একই লক্ষ্যে নিয়োজিত। বহু ও বিভিন্ন মননের ফলে, কালে ক্রমবিকাশের ধারায় সাংখ্য, যোগ এবং তন্ত্র -তিনটে স্বতন্ত্র দর্শন ও তত্ত্বরূপে প্রতিষ্ঠা পায়। এবং প্রাচীন ভারতের আর আর ঐতিহ্যের মতো এগুলি আর্যশাস্ত্র ও দর্শনের মর্যাদা লাভ করে। ’(বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব; পৃষ্ঠা,৪১) তন্ত্রের একটি অন্যতম সিদ্ধান্ত হল -‘ব্রহ্মান্ডে য গুণাঃ সন্তি তে তিষ্টন্তি কলেবরে’। এর মানে -যা আছে ভান্ডে (মানে শরীরে/মানবদেহে) তাই আছে বিশ্বভ্রহ্মান্ডে বা ইউনিভার্সে ।

ড.আহমদ শরীফ একবার মন্তব্য করেছিলেন: ‘বাঙালির ধর্মতত্ত্বে পাপ-পুন্যের কথা বেশি নেই। অনেক বেশি রয়েছে জীবন রহস্য জানবার বুঝবার প্রয়াস। ’ (বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব: আহমদ শরীফ পৃষ্ঠা; ৪৮) পন্ডিতের এ কথা একালেও সত্য - সেই আদিম নিষাদ-কিরাত কালেও সত্য। প্রাচীন বাংলার সেই আদিম নিষাদ-কিরাত প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করেছিল। কিন্তু, শক্তি কি? বিশ্বজগতে সবই তো শক্তির সমাহার।

তন্ত্র শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করে। বিজ্ঞান প্রাকৃতিক শক্তিতে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তন্ত্র সেরকম চায় না। তন্ত্রসাধক মনে করেন যে সে যদি চৈতন্যময়ী শক্তির অনুগত থাকে তাহলে চৈতন্যময়ী শক্তির কৃপায় কল্যাণ সাধিত হতে পারে। এখানে আরও বলে রাখি যে আর্যদের বৈদিক মত হল ঋষিজ ...তার মানে দার্শনিক বা ফিলোসফিক্যাল।

এ কারণে মানবকল্যাণে এর ভূমিকা পরোক্ষ। অন্যদিকে তান্ত্রিকমত মুণিজ বা বিজ্ঞান ভিত্তিক হওয়ায় জগৎসংসারে জীবজগতে এর প্রভাব প্রত্যক্ষ। দর্শনের সামগ্রিক দৃষ্টি এবং তন্ত্রমতের খন্ডিত বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি একত্রিত হলেই জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়। বেদের যজ্ঞ এবং তন্ত্রের পূজা সম্মিলিত ভাবে সনাতন হিন্দুধর্মকে সামগ্রিক ভিত্তি দিয়েছে। (দ্র. রনজিৎ কর।

সনাতন ধর্ম: মত ও মতান্তর। পৃষ্ঠা; ৭৪) এবার তান্ত্রিক মত ও আর্যবৈদিক মতের কিছু পার্থক্য উল্লেখ করি। আর্যদের বৈদিকমত পুরুষতান্ত্রিক; পক্ষান্তরে অনার্যদের তান্ত্রিক মত মাতৃতান্ত্রিক। তান্ত্রিক মত মাতৃতান্ত্রিক; কেননা প্রাচীন বাংলায় আদিম কিরাত এবং নিষাদদের সমাজটি গড়ন ছিল মাতৃতান্ত্রিক। প্রথমে কিরাত/নিষাদরা ছিল শিকারী।

অরণ্যে ফলমূল কুড়োত। পরে হাতিয়ারের উন্নতি হলে তারা বনভুমি সাফ করে । এভাবে ওদের উত্তরণ ঘটে কৃষিজীবনে । পশ্চাৎপদ কৃষিযন্ত্রের কারণে কৃষিজীবন ছিল অনিশ্চিত। ওদিকে গোত্রের জনসংখ্যা বাড়ছিল।

কাজেই অদৃশ্যলোকের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় ছিল না। সেই আদিম কিরাতনিষাদের সমাজটি মাতৃতান্ত্রিক বলেই অদৃশ্য প্রকৃতির অদৃশ্য শক্তিটিও ছিলেন একজন দেবী। বাঙালিসমাজে পরবর্তীকালে ওই দেবীই কালী, কামেশ্বরী ভীমাদেবী জগদ্বাত্রী গন্ধেশ্বরী অন্নপূর্ণা বাসুলি বিপদনাশিনী সন্তোষীমাতা এবং দূর্গা প্রভৃতি নামে প্রতিভাত হয়েছেন। মনে রাখতে হবে নারীবাদী তন্ত্রের দেবী দূর্গা- কালী- বাসুলী হলেও কিন্তু তন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন শিব। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে কালীর কাছ থেকে।

আবার শিব- এর রয়েছে পৃথক নিজস্ব শক্তি। শিব আবার অনার্য দেবতা। এমনই বিচিত্র সব চিন্তায় তন্ত্রের ইতিহাস আচ্ছন্ন। সে যা হোক। তন্ত্র থেকে তত্ত্ব।

তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য হল তত্ত্বের সিদ্ধান্তকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে রূপদান করা। কাজেই তন্ত্রের প্রচারের মাধ্যম ছিল আচরন বা থিউরি নয় প্রাকটিস। তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ। আদি মাতৃতান্ত্রিক নিষাদসমাজে তন্ত্রের উদ্ভব বলে এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক ছিল । তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তিলাভ করে নারীশক্তি থেকে।

শিব শক্তি লাভ করেছেন গৌড়ীর শক্তি থেকে। তবে শিবের নিজস্ব শক্তিও স্বীকৃত। তন্ত্রসাধনার মূল উদ্দেশ্য হল- দেবীরূপীনি প্রকৃতিক শক্তির সাধনা করে শিবত্ব লাভ তথা শক্তিমান হওয়া। তন্ত্রমতে কেন নারী জগতের আদি কারণ? ঈশ্বর নিরাকার। রূপহীন।

যে কারণে প্রাচীন বৈদিক আর্যরা ঈশ্বরের রূপ বর্ণনা করেছেন এভাবে-রূপংরূপ বিবর্জিতস্য ভবতো ধ্যানেন যদবর্ণিতং। এর মানে- হে রূপহীন ঈশ্বর! ধ্যানে তোমার রূপ বর্ণনা করেছি। তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ এই জন্য যে এই নিরাকার রূপহীন ইশ্বরকে যখন নারী ভাবা হয় তখন ঈশ্বরের মাহাত্ম ক্ষুন্ন হয় না। কাজেই ভক্তের মানসিক প্রবনতার ওপরই মাতৃমূর্তির রূপটি কল্পিত হয়েছে। যে কারণে বলা হয়েছে -‘সাধকানাং হিতার্থায়ৈ ব্রহ্মণে রূপকল্পনা’ এর মানে সাধকের হিতের জন্য ঈশ্বরের রূপ কল্পনা করা হয়েছে।

যোগ দর্শন প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন: ‘যোগ আদিম অস্ট্রিক (নিষাদ)- কিরাত মনন -উদ্ভূত। ’ (বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব: ; পৃষ্ঠা,৪১) তবে পরবর্তী পর্যায়ে যোগ আরও পরিশ্রুত হয়েছে। যোগের মূলে অনার্য দেবতা শিব। গোরক্ষ বিজয় থেকে পাঠ করা যাক- মুন্ডে আর হাড়ে তুমি কেনে পৈর মালা ঝলমল করে গায়ে ভস্ম ঝুলি ছালা। পুনরপি যোগী হৈব কর্ণে কড়ি দিয়া।

ওপরের যোগীর ছবিটি আসলে অনার্য শিবেরই ছবি। এবং কড়ি জিনিসটা অস্ট্রিক নিষাদ/ কিরাতের উপচার (উপকরণ) । আমাদের মনে রাখতে হবে নারীবাদী তন্ত্রের কেন্দ্রেও রয়েছেন অনার্য দেবতা শিব। সে যাই হোক। প্রাচীন বাংলার যোগসাধকগণ শরীরের চৈতন্যকেই প্রাণশক্তি বা আত্মা মনে করতেন।

দেহের বাইরে চৈতন্য সম্ভব নয়। সুতরাং শরীর সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়েছে। (পাঠক এই সুপ্রাচীনভাবনাকে বাউল দর্শনের ভিত্তি মনে করতে পারেন?) দেহকে বোঝা ও একে নিয়ন্ত্রন করে ইচ্ছে মতন পরিচালিত করা যোগ সাধনার অন্যতম ভিত্তি। কায়া মানে শরীর। কায়সাধন মানে শরীরের সাধনা।

‘ কায়সাধন অতি প্রাচীন দেশী শাস্ত্র, তত্ত্ব ও পদ্ধতি। ’(বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব: আহমদ শরীফ পৃষ্ঠা ৪৩) প্রাচীন বাংলার সেই আদিম নিষাদ-কিরাত প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করেছিল। সেই চৈতন্যময়ী শক্তি কি কেবল প্রকৃতিতেই বিরাজ করে? না। চৈতন্যময়ী শক্তি সর্বত্র বিরাজমান। মানবদেহে? অবশ্যই।

প্রাচীন বাংলার বাঙালি যোগীগণ শরীরের ভিতর যে চৈতন্যকেই প্রাণশক্তি বা আত্মা মনে করতেন তিনিই সেই চৈতন্যময়ী । এই মানবচৈতন্য সেই শক্তিরই একটি রূপ। দেহের বাইরে চৈতন্য সম্ভব নয় বলেই জীবন রহস্য জানবার ও বুঝবার প্রয়াস প্রাচীন বাংলার বাঙালি যোগীগণ শরীর সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন এবং এভাবে সেই সুপ্রাচীন কালেই বাউল দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। দেহকেন্দ্রিক চিন্তা ছান্দোগ্য উপনিষদেও রয়েছে। ‘এই পৃথিবীতে দেহেরই পূজা করিবে, দেহেরই পরিচর্যা করিবে।

দেহকে মহীয়ান করিলে এবং দেহের পরিচর্যা করিলেই ইহলোক ও পরলোক-এই উভয়লোকই লাভ করা যায়। ’ (বিরোচন। ৮/৮/৪) এভাবে বাউলধর্মের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। গৌতম বুদ্ধের সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ট শতক। ওই সময়ে অর্থাৎ বুদ্ধের সময়কালে ভারতবর্ষে সাংখ্য দর্শনের ব্যাপক চর্চা ছিল।

আগেই একবার উল্লেখ করেছি-বৌদ্ধধর্মের মূলতত্ত্বের উৎসও এই সাংখ্যদর্শন। বস্তুত, বুদ্ধের দু’জন গুরুই ছিলেন সাংখ্যমতাবলম্বী। যা হোক। বুদ্ধ তাঁর ‘ধম্ম’ প্রচার করতে প্রাচীন বাংলায় এসেছিলেন। বাংলায় ততদিনে আর্যায়ণ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল।

তার মানে বুদ্ধ প্রাচীন বাংলার বৈদিক পরিবেশে তাঁর ‘ধম্ম ’প্রচার করেছিলেন। বৌদ্ধদর্শনের মূল হল- দুঃখবাদ, দয়াশীলতা ও শূন্যতার ধারণা। বুদ্ধ মনে করতেন মানবদেহের উপাদান বা স্কদ্ধ হল পাঁচটি। (১) রূপ:বস্তুগত উপাদান;(২) বেদনা: অনুভূতিগত উপাদান; (৩) সংজ্ঞা: অভিজ্ঞতা লব্দ উপাদান;(৪) সংস্কার: মানসিক উপাদান; (৫) বিজ্ঞান: চৈতন্যময় উপাদান। এই পাঁচটি উপাদান মানব সত্তা গঠন করে।

বুদ্ধ মনে করতেন, এই উপাদানগুলি আত্মাবিহীন (অনাত্ব); অচিরস্থায়ী (অনিত্য) এবং অকাম্য (দুঃখ)। বুদ্ধ বিশ্বাস করতেন-যিনি উপাদান সমূহের মধ্যে আত্মার অনুপস্থিতি উপলব্দি করেন, তিনি জানেন যে ব্যক্তি হিসেবে তার কোনও প্রকৃত অস্তিত্ব নেই, এবং সেই কারণেই তার সঙ্গে তার চারপাশের বস্তজগতের কোনও সর্ম্পক গড়ে ওঠা অসম্ভব। কাজেই জগতে এমন কিছুই নেই যা তাকে আনন্দিত অথবা দুঃখিত করতে পারে। এইই হল বৌদ্ধদর্শনের মূলভিত্তি। তবে পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্ম মহাযান ও হীনযান-এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়।

বাংলায় মহাযানের বিবর্তন ঘটেছিল। মহাযান বৌদ্ধধর্মের অনুসারীগণ ‘বুদ্ধত্ব’ লাভে আগ্রহী ছিলেন। এবং তারা ছিলেন ‘বোধিসত্ত্ব’ মতবাদে বিশ্বাসী। বোধিসত্ত্ব হলেন তিনি- যিনি বারবার জন্মগ্রহন করেন এবং অপরের পাপ ও দুঃখভার গ্রহন করে তাদের আর্তি দূর করেন। মহাযানী বৌদ্ধধর্মে কয়েক জন বোধিসত্ত্ব রয়েছেন।

এঁদের মধ্যে অবলোকিতেশ্বর, মঞ্জুশ্রী এবং বজ্রপানি প্রধান। মহাযান বৌদ্ধধর্মের অন্যতম দেবী ছিলেন- ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’। প্রজ্ঞাপারমিতা কে বোধিসত্ত্বেরই গুণাবলীর মূর্ত রূপ বলে মনে করা হত। তাছাড়া বোধিসত্ত্বদের স্ত্রী (বা দেবী) কল্পনা করা হয়েছিল। এই দেবী ছিলেন দেবতাদের প্রকৃত শক্তি।

দেবতাকে মনে করা হত সুদূর এবং অজ্ঞেয় এবং দেবীকে সক্রিয় মনে করা হত। এই মতবাদের বিবর্তনের ফলে বাংলায় তান্ত্রিক লোকায়ত চিন্তাধারার প্রভাবে উদ্ভব ঘটেছিল বৌদ্ধ সহজিয়া সম্প্রদায়ের। চর্যাপদের কবিগণ ছিলেন এই সম্প্রদায়ের অর্ন্তভূক্ত। পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে পাল আমলে (সপ্তম-দশম শতক) তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বিকাশ লাভ করেছিল । পরবর্তীকালে সেনআমলে (একাদশ-দ্বাদশ শতক) বৌদ্ধ সহজিয়াগণ ব্রাহ্মণ্যবাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিল।

ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় ইসলামের আগমনের কারণে এই চিত্র একেবারে বদলে যায়। তবে বাংলায় মুসলিম রাজশক্তির আগমনের তারও আগেই সুফিদের আগমন ঘটেছিল। সেই সময়টা ধরা হয়- দশম একাদশ শতকে। এবং এই আগমন বাংলায় বড় ধরণের সামাজিক পরিবর্তন সৃষ্টি করেছিল। সুফিবাদ হল ইসলামের মরমি দিক।

এর উদ্ভব আরবে ইসলামের অভ্যূদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই । কোরান শরীফের কয়েকটি নির্দিষ্ট আয়াতে উজ্জীবিত হয়ে সুফিরা অদৃশ্য বস্তু বা ঘয়ব (গায়েব)- এর সঙ্গে মিলন এবং তার মধ্যে বিলীন (ফানা) হয়ে যেতে চান। এই বিলীন হওয়ার জন্য আগি যুগের সুফিরা চারটি পর্যায় নির্দিষ্ট করে। ১ ইমান। (অদৃশ্য বস্তুতে বিশ্বাস) ২. তলব।

(অদৃশ্য বস্তুর অনুসন্ধান) ৩. ইরফান। (অদৃশ্য বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ) এবং ৪. ফানা। (অদৃশ্য বস্তুতে বিলীন। ) পরবর্তীতে এই মূল ধারণার সঙ্গে আরও কিছু ধারণা সংযোজি হয়। সে যাই হোক।

একজন সুফিসাধকের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যই হল আল্লাহতে বিলীন হয়ে যাওয়া। সে উদ্দেশ্য সফল করার জন্য সুফিসাধকদের বেশ কয়েকটি ‘মোকাম’ পার হতে হয়। সুফিবাদে ‘মোকাম’ শব্দটির অর্থ হল: ‘স্তর’। সুফিসাধকদের বেশ কয়েকটি ‘মোকাম’ বা ‘স্তর’ পেরিয়ে আল্লহর সঙ্গে একাকার হতে হয়। সুফির এই মোকাম সুফিবাদ সম্বন্ধে ধারণা দেয় ।

সেরকমই কয়েকটি মোকাম হচ্ছে: ১/ তওবা: তওবা করে একজন মানুষ জীবনভর আল্লাহর ইবাদত করার শপথ নেন। তওবা করে তিনি সংসার ত্যাগ করেন; এবং সজ্ঞানে সুফিজীবন বেছে নেন। ২/ জিহাদ: সুফিরা জিহাদ করেন অন্তরের অশুভ বাসনার বিরুদ্ধে। ৩/ ওয়ারা: জীবিকার জন্য কোনও পেশা গ্রহন না করা। ৪/ জোহদ: সুখ ভোগ থেকে বিরত থাক।

৫/ জো’ওরক আল-শাইওয়া: অনাহারে থাকার সময় ধৈর্য ধারণ করা। ৬/ একিন: দৃঢ়বিশ্বাস। ৭/ সিদক: কাজে ও চিন্তায় সমন্বয়, সত্যবাদিতা। ৮/ জিকর : আল্লাহর স্মরণ। ৯/ ফকর: স্বেচ্ছায় দারিদ্রবরণ।

১০/ তাসাওফ: পবিত্রতা রক্ষা করা। ১১/ আদব: সবার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করা। ১২/ সফর: ভ্রমন। ১৩/ শওক: আল্লাহর সান্নিধ্যের জন্য ব্যাকুল থাকা। ১৪/ মারিফৎ: মহাজ্ঞান লাভের চেষ্টা করা।

১৫/ ইরাদা: কর্মফল ত্যাগ করা। কারণ, সব ঘটছে আল্লাহর ইচ্ছায়। ১৬ মহৎ মৃত্যু: এর মানে মৃত্যুর জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকা। তবে সুফিবাদের তাত্ত্বি¡ক দিকটি বোধগম্য হলেও বাংলার সুফিবাদে গূহ্য জ্ঞান প্রকাশিত হওয়ায় নানান প্রতীক ও ইঙ্গিতের সমন্বয়ে জটিল চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। সেরকমই একটি মারাফতি গান: কামেলিরা কাম করিয়া কোথায় জানি লুকাইছে/ দুই পাহাড়ের মাঝে মওলায় মসজিদ বানাইছে ... কিংবা- দয়ালবাবা কেবলাকাবা আয়নার কারিগর আয়না বসায়া দে মোর কলবের ভিতর ... বিষ্ণু প্রাচীন ভারতের বৈদিক দেবতা।

বিষ্ণু থেকে বৈষ্ণব। যারা বিষ্ণুর উপাসনা করেন তারাই তারাই বৈষ্ণব। বৈষ্ণব ধর্মের উদ্ভব মূলত দক্ষিণ ভারতে। তবে বাঙালি বৈষ্ণবগণ শ্রীচৈতন্যদেব (জন্ম ১৪৮৪) প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী। শ্রীচৈতন্যদেব বাংলায় সুলতানী আমলে বৈষ্ণব ধর্মের নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করে হিন্দুসমাজে নতুন জীবন দান করেছিলেন।

শ্রীচৈতন্যদেব এর মতবাদ সর্ম্পকে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন বইতে লিখেছেন : ‘কৃষ্ণই পরমব্রহ্ম। এবং তাঁর শক্তি মায়াশক্তিরূপে বিশ্বজগৎ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যে শক্তির বলে তিনি বহুরূপে প্রতিভাত হন তার নাম বিলাসশক্তি। বিলাসশক্তি দুই প্রকার। (ক) প্রভববিলাস এবং (খ) ভৈরববিলাস।

প্রভববিলাস এর বশে গোপীদের সঙ্গে রাসলীলাকালে তিনি বহু কৃষ্ণে পরিণত হন। ভৈরববিলাস এর বশে তিনি বাসুদেব (বুদ্ধি), সঙ্কর্ষণ চেতনা), প্রদ্যু¤œ (প্রেম), এবং অনিরুদ্ধ (লীলা) এই চতুর্বুহ্য রূপ পরিগ্রহন করেন। কৃষ্ণের প্রধান শক্তি প্রেম, সর্বগুণবতী রাধা এই মহান প্রেমভাবের মূর্ত প্রতীক বা হ্লাদিনী শক্তি। ’ ( ‘ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট পৃষ্ঠা ১৪১) শ্রীচৈতন্যদেব যে বিরাট পন্ডিত ছিলেন তাতে আর সন্দেহ কী। বৈষ্ণবতত্ত্বের এই নিগূঢ় বয়ান হয়তো তাঁরই উপযোগী।

তবে এই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার কারণে বৈষ্ণববধর্ম বাংলায় জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। বৈষ্ণববধর্ম বাংলায় জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল শাস্ত্রীয় বিধান অগ্রাহ্য করে শ্রীচৈতন্যদেব প্রেমকেই বড় করে তুলেছিলেন বলে। যে কারণে বাংলায় বৈষ্ণবতত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে সহজ সরল গানে। সিলেটের বৈষ্ণব কবি রাধারমন দত্তর একটি গানে রাধাকৃষ্ণের প্রণয় প্রকাশিত হয়েছে এভাবে: আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয় তোমারে না দেখিলে রাধার প্রাণে ... কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙো কদম্বের আগা শিশু কালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনে দাগা রে ... বাউল মতবাদের উদ্ভব ষোড়শ শতকে । উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মনে করেন, ১৬৫০ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত প্রায় পৌনে তিনশো বছর বাউলগানের উৎপত্তি, বিস্তৃতি ও পরিনতির শেষ অবস্থান কাল।

শ্রীচৈতন্যদেব এর মৃত্যুর (১৫৩৩) পর তাঁর প্রধান শিষ্যরা উত্তর ভারতের মথুরা বৃন্দাবনে চলে যান। তবে শ্রীচৈতন্যদেব অন্যতম শিষ্য নিত্যানন্দ সম্প্রদায়টিকে বাংলায় ধরে রাখেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বীরবাহু বাংলার সমাজের অচ্ছুত অন্ত্যজ লোকেদের গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠে ঠাঁই দিলেন। এসব নি¤œবর্গের লোকেদের মধ্যে পূর্বতন বৌদ্ধ তান্ত্রিক মত প্রচলিত ছিল। এর ফলে বৌদ্ধ তান্ত্রিক এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের মিশ্রণে উদ্ভব হয় সহজিয়া বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ।

ওই সময়ে- অর্থাৎ ষোড়শ শতকের বাংলার গ্রামে-গ্রামে গড়ে ওঠে সাধনকুঠির। ড. মুহম্মদ এনামুল হক বলেন, "বঙ্গে ইসলাম প্রবেশের পর এবং এদেশের প্রতি কেন্দ্রস্থলে সুফিদের স্থাপনা স্থাপন হইবার পর, বাঙ্গালাদেশে সাধারণভাবে সুফিদের মধ্যসূত্রতায় প্রাপ্ত যে ইসলামি পারিপার্শ্বিকতার সৃষ্টি হইল, তাহারই প্রভাবে এদেশে ভাব-জাগরণ দেখা দিল:-ইহার প্রথম ফল, গৌড়ীয় বৈষ্ণব-মতবাদ। খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে ইসলামি পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে থাকিয়া বৈষ্ণব ও সুফি -প্রভাবে নিরক্ষর প্রেণির ভিতর যে মর্মমুখী চিন্তা বিকশিত হইয়া উঠে , তাহাই হইল বাউল মত। (বঙ্গে সুফি প্রভাব। পৃষ্ঠা: ১২৮ ) এ কারণে মুসলমান ফকির সম্প্রদায়কেই বাউলসাধনার আদিপ্রবর্তক বলে মনে করা হয়।

(দ্র: আবুল আহসান চৌধুরী। লালন শাহের সন্ধানে। পৃষ্ঠা; ৩৭) গোলাম মুরশিদ লিখেছেন:‘ বৈষ্ণব সহজিয়াদের মতো দেহের দেউলেই এঁরা (অর্থাৎ বাউলেরা) দেহাতীতের সন্ধান পেতে চান। রূপের মধ্যে ধরতে চান অরূপকে। এঁদের কোনও মন্ত্রতন্ত্র নেই।

সমস্ত ধর্মীয় বিধিবিধান এবং ধর্মগ্রন্থকে তাঁরা অস্বীকার করে গানে গানে এক মনের মানুষের খোঁজ করেন। এই মনের মানুষ কোনও দেবদেবী নন। তাঁর কোনও নামও নেই। এক কথায় সমস্ত শাস্ত্রের উর্ধ্বে উঠে তাঁরা এক পরম পুরুষের সাধনা করতে চান। তাঁরা বরং মনে করেন মনের মানুষকে পাওয়ার পথে আনুষ্ঠানিক ধর্ম একটা বড়ো অন্তরায়।

’(হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি। পৃষ্ঠা; ৮৪) এভাবে বাংলার দার্শনিক ঐতিহ্য হাজার বছর পথ পরিক্রমা শেষে উনিশ শতকে পৌঁছে বাউলমতে - যা প্রধানত লালনের গানের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। কী সন্ধানে যাই সেখানে আমি মনের মানুষ যেখানে আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি দিবারাত্রি নাই সেখানে ... লালনের এই নিগূঢ় গান আজ বাঙালির ভাবরাজ্যের এক অতুল মানসসম্পদে পরিনত হয়েছে। এই গানের জন্ম সাংখ্য, তন্ত্র, যোগ, বৌদ্ধ সহজিয়া, সুফি ও বৈষ্ণব চিন্তাধারার সংর্স্পশে ঋদ্ধ বাংলার ভাবদর্শনের জমিনে বলেই । তথ্যসূত্র: ড. আহমদ শরীফ, বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব গোলাম মুরশিদ, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি ড. মুহম্মদ এনামুল হক, বঙ্গে সুফি প্রভাব রজজিৎ কর, সনাতনধর্ম: মত ও মতান্তর নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট আবুল আহসান চৌধুরী, লালন শাহের সন্ধানে।

Click This Link http://indianphilosophy.50webs.com/samkhya.htm http://www.srds.co.uk/begin/samkhya.htm http://www.cix.co.uk/~mandrake/samkhya.htm ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।