মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার, ধর্মান্ধতা ও দলান্ধতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। আমরা বাঙালি। ষড়ঋতু দিয়েই আমরা বাঙালির পরিচয় বহন করি। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর যে প্রান্তেই আমরা ছড়িয়ে আছি, নিজেদের বাঙালি পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। স্বাভাবিকভাবেই যা বেরিয়ে আসে, তা হলো: বাংলার ইতিহাস কি? কারা বাংলার আদিবাসী? কবে কখন কারা আদিবাসীদের তাড়িয়ে বাংলায় নিজেদের বসতি স্থাপন করেছে? সর্বমোট পাঁচবার বাংলার ভৌগলিক সীমারেখার রদবদল ঘটেছে।
এসব ইতিহাস কি আমরা জানি?
পাল,সেন,তুর্কী, আফগান, আরবী, মুঘল, ইংরেজ, এবং সবশেষে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী এতদ অঞ্চল শাসন করেছে ১১’শ বছর। ফলে আদিবাসী, আর্য, মধ্যএশীয়, মোঙ্গলীয় ধাঁচের মানুষ মিলেমিশেই আজকের বাঙালি জাতি।
চক্রাকারে আবর্তিত হয় ষড়ঋতু। গ্রীষ্ম গত হয় তার উত্তাপ ও প্রভঞ্চন আহুতি নিয়ে। বর্ষার মেঘকাজল দিবসের দীর্ঘ ছায়া নামে যমুনার কালো জলে।
বর্ষন মুখর রাত্রির বিদুৎ চমকে উৎফুল ভবন শিখারী নৃত্য করে প্রাসাদের কালো মর্মর আলিন্দে। শরতের আলো ছায়া বিজড়িত প্রভাতে নদী তীরে কাশ বনে লাগেদোলা। হেমন্তে আনে কুহেলী, শীত দেয় উদাসীনতা। বসন্তে ফুলের মঞ্জুরী আন্দোলিত হয় শিরীষের শাখা-প্রশাখায়।
বাঙালির স্বাধীনতার জন্য হাজার বছরের যে লড়াই-সংগ্রাম তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা নামের যে সন্তান প্রসবিত হয়েছিলো ১৯৭১ সালে, সেই আমরাই আমাদের সুস্থ সুন্দরভাবে বেড়ে উঠার জন্য এক নিরন্তর সংগ্রাম করছি। ষোড়শ খ্রিস্টাব্দে শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ও বৈষ্ণব দর্ম, অপরদিকে মুসলিম সুলতাদের (ইলিয়াস শাহ ও হোসেন শাহ) রাজত্বকালে ইসলামী সংস্কৃতির প্রসার উভয়ই বাঙালির জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। তা ছিলো বাঙালির “প্রথম জাগরন”। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইংরেজী শিক্ষার প্রসার এবং ইউরোপীয় দর্শনের প্রভাবে বাঙালির জীবনে এলো “দ্বিতীয় জাগরন”। একেই বলে ঊনবিংশ শতাব্দীর “বেঙ্গল রেনেসাঁ”।
ইতিহাসের পাতায় দেখি সুদীর্ঘ সময়কালে দেশজ এবং বিপবাত্মক রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এবং জীবন-জীবিকার সংগ্রামকে কেন্দ্র করে যে সব কর্মকান্ড সংঘঠিত হয়েছিলো, বাঙালির বর্তমান প্রজন্ম তারই উত্তরাধিকারী। এইসব ইতিহাস আমাদের গৌরবের ও ঐতিহ্যের। ১৯৩৪ সালে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ প্রবাসী বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভায় বলেছিলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবে বাংলা ভারতের অংশ হলেও ভাষা এবং সংস্কৃতির দিক দিয়ে বাংলা স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে অবস্থান করে’। এক সময় মাহাত্মা গান্ধীও বলেছিলেন, আমি যদি গান শুনতে চাই, তাহলে আমাকে যেতে হবে বাংলায়, আমাকে যদি কবিতা শুনতে হয়, তবও যেতে হবে বাংলায়, বাংলার মাঝেই সমগ্র ভারতবর্ষ নিহিত রয়েছে। কিন্তু সমগ্র ভারতবর্ষে আরেকটি বাংলাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
১৯৩৪ সালে রবীন্দ্রনাথের বাঙালির স্বাতন্ত্র্যবোধের চিন্তাধারা আজ অনেক বেশি প্রসারিত। বাঙালিত্বকে কেন্দ্র করে বাঙালির আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ গ্রহন করা হয় ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাবের’ মাধ্যমে। ১৯৫২ সালে ভাষার অধিকারের জন্য আত্মহুতি দিয়ে বাঙালি জাতি আবার জেগে উঠলো নতুন রুপে। ১৯৭১ সালে ভৌগলিক স্বাধীনতা আসলেও, আজো বঙ্গ জননী এক ধরনের পরাধীনতা’র শেকলে আবদ্ধ। কারন আমরা শাসক বদল করেছি মাত্র, শাসনব্যবস্থা বদলের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি।
বারবার শাসক ও সংস্কৃতি বদলের মধ্য দিয়ে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা নিজেদেরকে মানিয়ে নিচ্ছিলো। সে যুগেও বাঙালির প্রান শক্তি ছিলো প্রচুর, প্রতিভা ছিলো প্রখর। নতুন সাহিত্য, বিজ্ঞান ও সভ্যতাকে তারা গলদ গ্রহন করলো না,(!) করলো গ্রহন। অপরের চিন্তাধারাকে সে ধার করলো না, ধারন করলো। সাহিত্য, শিল্পে, ললিতকলায় বাঙালি সূচনা করলো সমৃদ্ধিযুক্ত নব যুগের।
আনলো দেশাত্ববোধেরঅভূতপূর্ব প্রেরনা। যৌবনকে দিলো অভয় মন্ত্র, নারীকে দিলো আত্মচেতনা। সেদিন সর্ব ভারতের অধিনায়িকার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন বঙ্গজননী।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠরি মধ্যদিয়ে বাঙালি তৃতীয় জাগরণের পর্যায়কাল অতিক্রম করছে। এই পর্যায়ে বাঙালিরা বুঝতে শিখছে পশ্চিমা ‘ভাব’ ও পশ্চিমা ‘চোখ’ দিয়ে দেখা রাজনৈতিক সঙস্কৃতির বাঙালির প্রকৃত পরিচয় বহন করে না।
বাঙালির স্বাধীনসত্তবার মধ্যে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত রয়েছে লালন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রতিভাদীপ্ত দিক-নির্দেশনা। ইতিহাস থেকে আরো প্রমান পাওয়া যায় দু’শ বছর ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদ বিরোধী বিপ্লবাত্মক কর্মকান্ড এবং সাংস্কৃতিক উপাদানই ছিলো গণজাগরণের মূলভিত্তি। আজকের বাঙালিরা পৃথিবীর যে যেখানেই দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে তার পেশাগত যোগ্যতা নিয়েই অবস্থান করেছে। একদিকে পঞ্চম বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালি সমগ্র বিশ্বব্যাপী সুদৃঢ় অবস্থান, অন্যদিকে বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পৃথিবীর সকল বাঙালির কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হবে। এই আমাদের লক্ষ্য।
যে কোনো বড় মাপের পরিপূর্ণতাআনতে রাজনৈতিক করণীয় ও সাংস্কৃতিক করণীয় একে অন্যের পরিপূরক হয়েই কাজ করে। বলা ভালো, উন্নত সিাংস্কৃতি কর্মকান্ড দিয়েই রাজনৈতিক কর্মকান্ড পূর্ন করা সম্ভব।
এই মহৎ দর্শনকে চিন্তায় রেখেই আমাদের এইগিয়ে যেতে হবে, নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে এক নতুন প্রভাত ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।