মনোনয়নপত্র বাতিলের পর আপিল। তারপর আদালতের নির্দেশে প্রতীক পেয়ে বিশাল আয়োজনে প্রচার শুরু। কিন্তু সেদিন রাতেই প্রার্থী ‘গায়েব’। প্রচার করা হলো, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এরপর কর্মী-সমর্থকদের উৎকণ্ঠা।
নানা গুজব। অবশেষে পাঁচ দিন পর হাজির হলেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে ঘোষণা দিলেন, তিনি আর ভোটের লড়াইয়ে নেই।
জাহাঙ্গীর আলম গতকাল রোববার বিকেলে গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে এবং দলের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পাশাপাশি ১৪ দল-সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা খানের পক্ষে প্রচারণা চালানোর ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি।
এভাবেই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আলোচিত প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে নাটকের অবসান হলো। কিন্তু নাটক কি আসলেই শেষ হলো? গাজীপুরের সাধারণ ভোটাররা জাহাঙ্গীরকে নিয়ে শাসক দলের এই নাটককে ভালোভাবে নেননি। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা বলেন, সময় থাকতেই জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সমঝোতা করা যেত। ডেকে নিয়ে চাপ, হুমকি, তারপর হাসপাতালে ভর্তি, সবশেষে কান্নাকাটি—এতসব করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
তা ছাড়া, জাহাঙ্গীর আলম এমন কোনো রাজনৈতিক নেতা নন যে তাঁকে নিয়ে সরকারের এত সময় ব্যয় করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে বিএনপিও রাজনীতি শুরু করেছে। তবে, রিটার্নিং কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও ব্যালটে তাঁর নাম ও আনারস প্রতীক থাকবে। কারণ, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি এ ঘোষণা দেননি। সংবাদ সম্মেলনে জাহাঙ্গীর আরও বলেন, ‘আমি সব সময় তৃণমূল মানুষের সঙ্গে ছিলাম।
মানুষকে নিয়ে সব সময় কাজ করেছি। সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে নিয়ে আমি একসঙ্গে কাজ করতে চেয়েছিলাম। আমি আনারস প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিলাম। আমার প্রাণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দল ও নেতৃত্বের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে।
প্রধানমন্ত্রী আমার মায়ের মতো। তাঁর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখে আমি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি। ’ এ কথা বলার পরই কান্নায় ভেঙে পড়েন জাহাঙ্গীর। এরপর তিনি বলেন, ‘আমি ১৪ দল-সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লার প্রতি সমর্থন ঘোষণা করছি। আশা করি, সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে তাঁকে জয়ী করবেন।
’ স্বেচ্ছায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে আমি স্বেচ্ছায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি। ’ আজমত উল্লার পক্ষে প্রচারণায় থাকবেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি ও আমার মা অসুস্থ। আমি আজকে হাসপাতাল থেকে দলের স্বার্থে এখানে এসেছি। আমার অনেকগুলো স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাকি। আমি চেষ্টা করব নির্বাচনের সময় পর্যন্ত থাকতে।
’ জাহাঙ্গীরের বক্তব্য শেষে আজমত উল্লা বলেন, ‘গাজীপুরে অনেক নেতা রয়েছেন, যাঁরা মেয়র হিসেবে নির্বাচন করতে পারেন। আজ জাহাঙ্গীর আলম যে ত্যাগ স্বীকার করলেন, দলের সিদ্ধান্ত তিনি যেভাবে মেনে নিলেন, সে জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। ’ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য জাহিদ আহসান বলেন, ‘সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে আমরা এখানে নির্বাচিত হতে পারব। ’ সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান, সাংসদ আ ক ম মোজাম্মেল হক, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল হোসেন, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ওয়াজউদ্দিনসহ ১৪ দল ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
পাল্টাপাল্টি ধাওয়া: ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে গতকাল বেলা তিনটায় গাজীপুরের বাসন সড়কে নিজের বাড়িতে এসে পৌঁছান জাহাঙ্গীর।
এ সময় রাস্তার দুই ধারে তাঁর সমর্থকেরা ‘আনারস’ ‘আনারস’ ধ্বনি দিতে থাকেন। নিজের বাড়ি থেকে গাড়িতে করে শহরের জয়দেবপুর এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে যাওয়ার পথে রেলগেট এলাকায় সমর্থকেরা তাঁর গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েন। এক ঘণ্টায়ও তাঁরা পথ ছাড়ছিলেন না। পরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা এসে তাঁদের পিটিয়ে ও লাথি মেরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় দুই পক্ষে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়।
পরে গাজীপুরের দুজন সাংসদ পুলিশ এনে পরিস্থিতি শান্ত করেন। গাড়ির সামনে অবস্থান নেওয়া টঙ্গীর এরশাদনগরের জাহাঙ্গীর-সমর্থক শেফালী বেগম বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, জাহাঙ্গীর সংবাদ সম্মেলন করে আজমত উল্লা খানকে সমর্থন দেবেন। আমরা এটা চাই না। তাই আমরা রাস্তায় শুয়ে তাঁকে বাধা দিচ্ছি। ’ জাহাঙ্গীর তাঁর খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে করজোড় করে সমর্থকদের সরে যেতে বলেন।
কর্মীরা সরে গেলে ধীরে ধীরে গাড়িতে করে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের দিকে যান তিনি।
আলোচিত জাহাঙ্গীর: গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আলোচিত নাম জাহাঙ্গীর আলম। শুরু থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন তিনি। গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। নির্বাচন করার জন্য সেখান থেকে পদত্যাগ করেন।
কিন্তু জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাঁকে ছাড়পত্র দেয়নি। ফলে রিটার্নিং কর্মকর্তা মনোনয়নপত্র বাতিল করেন। এরপর তিনি আপিলের জন্য যান বিভাগীয় কমিশনারের কাছে। বিভাগীয় কমিশনার তিন দিন ঘোরানোর পর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার কথা জানান। সবশেষে যান হাইকোর্টে।
হাইকোর্টের আদেশে প্রতীক পাওয়ার পর ১৮ জুন থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন জাহাঙ্গীর। তাঁর এই দৌড়ঝাঁপ চলে ২৭ মে থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত।
কিন্তু প্রচারণা শুরুর দুই ঘণ্টার মাথায় ১৮ জুন রাতেই টঙ্গী থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে অনেকটা জোর করে ঢাকায় নিয়ে যান। এরপর জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা ঘোষণা দেন, জাহাঙ্গীর নির্বাচন থেকে সরে গেছেন। এর পরের চার দিন জাহাঙ্গীরের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।