জেমস-এর একটা গান আছে এরকম : আমি তোমার প্রথম দাবি... নিয়ম ভাঙ্গার নিয়মে... শ্লোগানে শ্লোগানে, মিছিলে মিছিলে...। গ্রামগুলোর অবস্থা এখন জেমস-এর এই গানের মত। চারদিক মিছিলে মিছিলে, শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত। প্রার্থীরা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুড়ছেন। আবুল, কুদ্দুস, মদন, মাখন সামনে যাকেই পাচ্ছেন তাকেই বুকে জড়িয়ে ধরছেন।
মুরুব্বী দেখলেই অ্যাডভান্স এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করছেন। হাটে-মাঠে, পথে-ঘাটে চলছে প্রার্থীদের চুলচেরা বিশ্লেষণ। বটতলার বক্করের চায়ের দোকানে এখন ঈদের বেচাকেনা। সেদিন বক্করের দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়ে সবেমাত্র বসেছি এমন সময় শুনি একজন আরেকজনকে বলছে—
: আক্কাছ ভাইরে এইবার ঠেকাবি কুন শালা? সে চেয়ারমেন এইডা কনফারম তুই ধইরা রাখ।
: তুই এইডা কনফারম হলি কীভাবে? ও বুঝছি, তুমি তো শালা আক্কাছের বাও হাত।
তাইলি তো তরে দিয়াই আক্কাছ ভাই ইয়ে করার পর পানিখরচের কাম সারে, কী কইস? খিক... খিক... খিক...
: দ্যাখ, উল্টাপাল্টা কথা কইয়া চান্দি গরম করিস না। আক্কাছ ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মত পবিত্র।
: তা অবশ্য ঠিক। কিন্তুক এইডা হইল ধুতুরা ফুল।
: ফজু চেয়ারমেন যে কোন জাতের ফুল মাইনষের জানা আছে।
যে লোক বউয়ের সামনে দাড়াইতে পারে না, সে দাড়ায় নির্বাচনে। অ্যাক!
এরপরের স্টেজে কী ঘটবে বক্করের সেটা ভালোই জানা আছে। হাত থাকতে মুখে বেশি কথা বলার লোক এরা না। বক্কর ধমক দিয়ে দুজনকেই থামায়। কিন্তু একটু পর স্টলের কোণা থেকে ধমকে ওঠে আরেকজন।
: বক্কর, এইডা কী চা বানাইলি? দুধ-চিনি কিচ্ছু নাই। শরবত!
বক্করের চায়ের সুনাম আছে। কিন্তু চা মুখে দিয়ে হতাশ হলাম। বক্করকে বলতেই ও কানের কাছে মুখ এনে বলল, ভাইজান, খাইয়া ফালান। এইডা হইল নির্বাচনের চা।
ফজু চেয়ারমেন খওয়াচ্ছে। ট্যাকা লাগবে না।
এতক্ষনে বক্করের দোকানে ভিড়ের কারণ বোঝা গেল। বাঙালি মাগনা আলকতরা খায়, আর এতো চা।
বক্করের দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি।
চারপাশে পোস্টারের ছড়াছড়ি। গ্রামের সবুজ ঢেকে গেছে নির্বাচনী পোস্টারে। কার পোস্টার কে লাগাচ্ছে, কোথায় লাগাচ্ছে, আইন না মেনে কেন লাগাচ্ছে ধুলায় অন্ধকার। অনেক পোস্টার আবার লেমিনেটিং করে ঝোলানো। বৃষ্টির কারণে এই বাড়তি ব্যবস্থা।
হঠাত্ পেছনে ভটভটযুক্ত মিছিলের শব্দে চমকে তাকালাম। মিছিল আসছে নসিমনে চেপে। নসিমনের অবস্থা বিশ্ব এস্তেমার ট্রেনের মত। চালক এবং চাকা ছাড়া নসিমনের কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। চালক কাছা মেরে ‘শাহেনশাহ্’ মুডে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে।
মাথায় সাদা টুপি। টুপির সামনে কপালের উপর আনারসের ছাপ। নসিমনের চারপাশেও আনারস ঝোলানো। অবাত্তি আনারস। একজন নসিমনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মহাউত্সাহে কিছুক্ষণ পরপর হাক ছাড়ছে—
: চাচিরে চাচি...
বাকিরা তার সাথে তাল মিলিয়ে গলা ফাটাচ্ছে—
: কিরে চাচি?
: মার্কাটা কী?
: আনারস।
: খালারে খালা...
: কিরে খালা?
ব্যাস, চাচা-চাচি, খালা, ফুফু এভাবেই চলছে। এই নসিমন যাচ্ছে বটতলা বক্করের দোকানে। সেখানে নির্বাচনী চা পানের পর মিছিলের সমাপ্তি। এদের অনেককেই আবার কাল দেয়ালঘড়ির মিছিলে দেখা যাবে। তার মিছিলে গেলে নাকি গুড়, চিড়া-মুড়িও পাওয়া যায়।
চেয়ারম্যান, মেম্বররা পাঁচ বছর খাবে। সাধারণ মানুষ খাবে এই কটা দিন। তাছাড়া গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোও এখন জানে ইলেকশনে জেতার পর চেয়ারম্যানের প্রথম কাজই হবে ইলেকশনের খরচ উঠানোর ধান্দা করা। সুতরাং খেতে দোষ কী?
সাত-পাঁচ ভাবছি আর গোবর বাঁচিয়ে গ্রামের মেঠো পথে হাঁটছি। পথে পরিতোষ জ্যাঠার সাথে দেখা।
জ্যাঠা গ্রামে এসে অবসর জীবনযাপন করছেন। কেমন চেয়ারম্যান চান? জিজ্ঞেস করতেই জ্যাঠা তার স্বভাবসুলভ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ডানপন্থী, বামপন্থী বুঝি না। লিডার হিসেবে আমি চাই মিডল অফ দ্যা রোডম্যান। শুনে মুচকি হেসে বললাম, তাহলে তো ট্রাক ড্রাইভারকে ভোট দিতে হবে। কারণ ওরাই হলো খাঁটি মিডল অফ দ্যা রোডম্যান।
বলা শেষ হতে না হতেই চ্যালা-চামুন্ডা নিয়ে ফজু চেয়ারম্যান উপস্থিত। এসেই আমাকে ওভারটেক করে সে সটান ঝাঁপিয়ে পড়ল জ্যাঠার বুকের উপর।
: আফনে গিরামের মুরুব্বি। আফনের দোয়া না পাইলে আমি চেয়ারমেন হয়াও শান্তি পামু না।
: দোয়া করলাম।
: তাইলে কন, আমারে ভুট দিবেন?
: আচ্ছা দেব।
কথা আদায় করে ফজু চেয়ারম্যান চলে যেতেই আমি জ্যাঠাকে বললাম, আপনি কথা দিয়ে দিলেন! জ্যাঠা মুচকি হেসে বললেন, হ্যাঁ, সে তো ‘ভুট’ চেয়েছে। ভোট তো চায়নি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।