যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবী করছি কানাডা যখন আফগানিস্তানে সেনা পাঠায় তখন কানাডার প্রাইম মিনিষ্টারকে একটা ইমেলই করেছিলাম। আমার মতো একজন সাধারন নাগরিকের ইমেইলের কারনে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয় না - তারপরও প্রাইম মিনিষ্টারের ইনফরমেশন অফিসার মেইল প্রাপ্তি এবং যথাসময়ে প্রাইমিনিষ্টারের গোচরীভুত করার কথা বলে একটা উত্তরও দিয়েছিলেন।
কথা সেইটা না - যে জন্যে কথাটা বলা তা বলি। মেইলে বলেছিলাম আফগানিস্তানের সৈন্য পাঠানোর আগে আফগানিস্তানের ইতিহাসটা একটু ভালভাবে পড়া উচিত। কারন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবেই।
আজ যারা আফগানিস্তানে তালেবান নামে যুদ্ধ করছে - তার দাদা যুদ্ধ করেছে বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে - তারপরই বৃটিশ রাজের ধ্বংশ শুরু হয়। এই যোদ্ধার বাবা যুদ্ধ করেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে - তারপর দেখাগেলো সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতন। এখন আমেরিকা আর ন্যাটোর এখন নাকানিচুবানী অব্স্থা।
হয়তো কানাডার সরকার ইতিহাস জানতো - হয়তো জেনেই গেছে সেখানে। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা তারা পেয়েছে শতাধিক সৈন্যর জীবন, হাজার খানেক আহত আর পাঁচ বিলিয়ণ ডলারের উপরে ব্যয় করে এখন ফিরে আসার জন্যে উগ্রীব হয়ে গেছে।
(২)
বাংলাদেশের মানুষও ইতিহাস নিয়ে চিন্তা করতে চায় না - বা বলা যায় না করতে উৎসাহিত করা হয়। একসময় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হল বলা হতো - কি দরকার পুরোনো বিষয় নিয়ে কথা বলে দেশকে বিভক্ত করা! এখানে একটা চালাকি আছে। ১৯৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত মুত্তিযুদ্ধ প্রায় নির্বাসিত ছিলো। চলছিলো ইতিহাসের উল্টো স্রোত। কিন্তু ৯০ এর স্বৈরাচারের বিদায়ের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আবার সঠিক রাস্তায় ফিরে আসার শুরু করেছে।
শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী। সেই সময়কার একটা ঘটনা ছিলো খুবই নজরের পড়ার মতোই। বাংলা ১৪০০ সাল পালনের একটা হিড়িক পড়ে গিয়েছিলো। কেন্ত্রীয় ভাবে সন্মিলিত সংস্কৃতিক জোট একটা কমিটি করেছিলো ১৪০০ পালনের লক্ষ্যে - তার আহ্বাবায়ক ছিলেন শামসুর রাহমান। সেই কমিটি ঢাকার দেওয়ালে একটা পোস্টার লাগিয়েছিলো - সেখানে বঙ্গবন্ধুকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো।
তার কিছু দিন পর জাতীয়তাবাদী দলের সংস্কৃতিক অংগ (জাসাস) দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে প্রধান করে ১৪০০ সাল পালনের আরেকটা কমিটি করে - তারা দেওয়ালে পোস্টার লাগালো সিরাজউদ্দৌলাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংগালী হিসাবে চিহ্নিত করে। মজার বিষয় ছিলো - সিরাজ যে বাংগালী ছিলো না তা "জাতীয়তাবাদী" বুদ্ধিজীবি মহল মনে রাখেনি - একটা ইতিহাসকে অবজ্ঞা করার কি নিদারুন প্রচেষ্টা। তারপর দেখেছি সেই বছরই পহেলা বৈশাখ পালন করতে কৌশলে কিভাবে বাঁধা সৃষ্টি করেছিলো তৎকালীন রাজাকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মতিন চৌধুরী। এগুলো সবই ছিলো ইতিহাসের বিপরীত দিকে হাঁটার চেষ্টা। তারই ধারাবাহিকতায় দেখি মুক্তিযুদ্ধে পরাজিতদের গাড়ীতে জাতীয় পতাকা - ভয়াবহ ভাবে ইতিহাসকে অবহেলা করার আরেকটা চেষ্টা ছিলো সেইটা।
(৩)
অনেকেই ইতিহাস নিয়ে নানান ধরনের বাতচিত করেন - রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগীতে ইতিহাস দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে যে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বলার মতো কারন আছে তা এড়িয়ে যান।
কেন শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী আসনে বসার যোগ্যতা অর্জন করলো?
একটা কথা আজ নির্ধিধায় সবাই বলবে যে - মুক্তিযুদ্ধ বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ঘটনা আর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় বাঙ্গালী জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। কেন মুক্তিযুদ্ধ এতো বড় অর্জন?
জানা ইতিহাসে বাঙ্গালী জাতি সব সময়ই পরাধীন ছিলো - তুর্কী থেকে বখতিয়ার খিলজী, আফগান থেকে বাবর বা ইংলেন্ড থেকে লর্ড ক্লাইভ অথবা পাকিস্তান থেকে খান গোষ্ঠী হাজার বছর ধরে বাংলাকে শাসন করেছে। এই হাজার বছরের পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেয়েছে ১৯৭১ সালের নয় মাসে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবন আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে।
প্রকৃত অর্থেই বাঙ্গালী জাতি স্বাধীন হয়েছে ২৬ শে মার্চ ১৯৭১ সালে - যার মাধ্যমে নিজেরকে নিজেরা শাসনের সুযোগ পেয়েছে।
এই মহা অর্জনের অবিসংবাদিত নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান একন নেতৃত্বে এই জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহনের সুযোগ করে দিযেছে - তাই শেখ মুজিবর রহমানের অবদান হাজার বছরের সকল বাঙ্গালীর অবদানের চেয়ে বেশী। সংগত কারনেই শেখ মুজিবুর রহমান "হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীর আসনে" বসার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
(৪)
যেমনটা বলছিলাম - ১৯৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত ইতিহাসের উল্টোরথের সুযোগে বাংগালীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি নিজেদেরকে মুল ধারা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে। কিছুটা সফল হয়েছেও।
কিন্তু ইতিহাস কখনই অবজ্ঞাকে প্রশ্রয় দেয় না। তাই দেখি নতুন প্রজন্ম তাদের মনোভাব জানিয়ে দিয়েছে। তারা স্পষ্ট উচ্চারন করেছে - যুদ্ধাপরাধী বিচার চাই!
যুদ্ধাপরাধীর বিচার বিষয়টা এতো গুরুত্বপূর্ণ হলো কেন? তাদের ক্ষমা করা বা এড়িয়ে গেলেইতো হতো।
তাতে কি এমন ক্ষতি হতো?
আসল কথা হলো ইতিহাসই পরাজিত শক্তি আর বিজয়ী শক্তিকে আলাদা করে দিয়েছে। একদল অত্যাচারী আর অত্যাচারিত যেমন এক সাথে বসবাস করতে পারে না - তেমনি পরাজিত শক্তির সাথে বিজয়ী শক্তি বসবাস করতে পারে না।
তাতে প্রতিনিয়ত বিজয়টা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। প্রতিনিয়ত পরাজিত শক্তি তাতের অপকর্মগুলো আড়াল করার লক্ষ্যে বিজয়কে ভুলিয়ে দিতে চায় - বিতর্কিত করতে চেষ্টা করে বিজয়কে - বিতর্কিত করতে চেষ্টা করে বিজয়ের নায়কদের।
মুলত বিজয়কে সুসংহত করা আর ইতিহাসকে মুক্ত করার জন্যে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের মাধ্যমে বিজয়ের সর্বশেষ ঘোষনাটা আসবে। বলা যেতে পারে ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের পর কিছু অসম্পূর্ন কাজ রয়ে গিয়েছিলো। তা দালাল আইনের আওতায় বিচার শুরু হলেও ১৯৭৫ সালে ইতিহাসের মহানায়কে হত্যা করে বন্ধ করা হয় - ধীরে ধীরে মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দেওয়া হয় - বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করা হয়েছিলো।
কিন্তু ইতিহাস বড়ই নির্মম - তার অবজ্ঞা সহ্য করেনি। ফলাফল দেখছি বিপুল ভাবে বিচারের দাবী উঠে এসেছে - শুরু হয়েছে বিচার।
(৫)
এখনও যারা বিভ্রান্তিতে আছে - যারা বিচারকে রাজনৈতিক দৃষ্টি ভংগীতে দেখার চেষ্টা করছেন (পক্ষে অথবা বিপক্ষে) সবাই একটা মস্তবড় ভুলের মধ্যে আছেন। ইতিহাসকে লুকিয়ে রাখা যায় না - ইতিহাসকে মুক্ত ভাবে প্রবাহিত হতে বাঁধা দেওয়া মানেই নিজেদের জন্যে ধ্বংশের পথ খুজে বেড়ানো। যারা আজও যুদ্ধাপরাধী বিচারকে একটা অপ্রয়োজনীয় কাজ বিবেচনা করছেন - তারা মুলত ইতিহাসকে অবজ্ঞা করছে - জেনে অথবা না জেনে।
তাদের উচিত দল মত পথ সব কিছুর উদ্ধে উঠে ৩০ লক্ষ মানুষের আত্নত্যাগেন ইতিহাসটা ভাল ভাবে বুঝার চেষ্টা করা। তাতেই তাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির স্বরূপটা বুঝতে সুবিধা হবে। সামান্য সাময়িক রাজনৈতিক লাভের আশায় ইতিহাসের উল্টো স্রোতে সাঁতার কাঁটার মতো আত্নঘাতী পথ পরিহার করা জরুরী - নতুবা ইতিহাসই নির্ধারন করবেন কোন আস্তাকূঁড়ে তাদের স্থান হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।