একদিন তুমি ডাক দেবে, আমি প্রতীক্ষায় আছি
সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
আমাদের উপমহাদেশের মুসলিমরা খুব ঘটা করে এপ্রিল ফুলের বেদনাবহ স্মরণদিবস পালন করেন। ইসলামি ঘরানার ম্যাগাজিন, পত্র-পত্রিকা, প্রতিষ্ঠান তো বটেই আমাদের অনেক জাতীয় দৈনিকও দিবসটি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের হামদর্দি প্রকাশ করে কলাম বা আবেগী লেখা ছাপে। ইদানীং ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারসহ অনলাইনের হেন কোনো মাধ্যম নেই যেখানে এপ্রিল ফুল নিয়ে অতি আবেগী মুসলমানরা হামদর্দিতে আহা উহু করেন না। কী কারণে? কারণ, এপ্রিলের ১ তারিখে মুসলমানদের করতল থেকে সম্মিলিত আক্রমণের মাধ্যমে স্পেনের তৎকালীন রাজধানী গ্রানাডা দখল করে নেন পার্শ্ববর্তী অ্যারাগোন রাজ্যের রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং ক্যাস্টিলের রানি ইসাবেলা।
কিন্তু এটা ইতিহাসের কত খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয়েছিলো? সেটা কি এপ্রিল মাসে হয়েছিলো নাকি অন্যকোনো মাসে? এখানেই আসল রহস্য।
চলুন আমরা আলোচনার গভীরে প্রবেশ করি।
৩০ এপ্রিল ৭১১ খ্রিস্টাব্দ।
মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ জাবালুত্তারিক (জিব্রাল্টার) বন্দরে অবতরণ করেন এবং ক্রমান্বয়ে স্পেন দখল করেন। এরপর ৭৮০ বছর পর্যন্ত মুসলিমরা স্পেন শাসন করে। কিন্তু শেষদিকে অর্থাৎ ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে মুসলিম শাসকদের নৈতিক অধঃপতন শুরু হলে স্পেনের ভাগ্যাকাশেও দেখা দেয় দুর্যোগের ঘনঘটা।
আশপাশের খ্রিস্টান রাজারা ক্রমাগত আক্রমণ করতে থাকে স্পেনের মুসলিম রাজ্যসমূহে। ফলশ্রুতিতে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ২ জানুয়ারি গ্রানাডার তৎকালীন মুসলিম শাসক আবু আব্দুল্লাহ (পাশ্চাত্যে তাকে ববডিল নামে ডাকা হয়) রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং রানি ইসাবেলার সঙ্গে এক চুক্তির মাধ্যমে পরাজয় স্বীকার করে নেন।
গ্রানাডার সর্বশেষ মুরিস শাসক (Moorsih king) ছিলেন নাসরিদ বংশীয় আবুআব্দুল্লাহ মোহাম্মদ (Abu Abdullah Muhammad XII)। বিলাস-ব্যসনে মত্ত ও উচ্ছন্নে যাওয়া আবু আব্দুল্লাহ ছিলেন গ্রানাডার তাইফার সুলতান আবুল হাসানের ছেলে। ছেলের ষড়যন্ত্র ও কুচক্রের কারণে অনেকটা সিরাজুদ্দৌলার মতোই বাবা আবুল হাসান পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
মির জাফরের মতো আবু আব্দুল্লাহকে বানানো হয় নামকাওয়াস্তে সুলতান। এই পুতুল সুলতানের কাছেও ১৪৮৯ সালে ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলার কাছ থেকে চূড়ান্তরূপে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণের নির্দেশনা আসে এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় অস্বীকারের ভয়াবহ পরিণতির কথাও।
বিভিন্ন এনসাইক্লোপিডিয়া অনুযায়ী আবু আব্দুল্লাহ উপায়ান্তর না দেখে গ্রানাডা সম্পূর্ণভাবে হস্তান্তর করতে বাধ্য হন ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারিতে। একটি উদাহরণ পাওয়া যেতে পারে এম বি সিঞ্জ (M B Synge) তার দ্যা বাল্ডউইন্স প্রজেক্ট (The Baldwins Project) প্রকাশিত ‘সাহসী মানুষদের সাহসী কাজ’ (Brave Men and Brave Deeds)’ নামক আর্টিকেলে। তিনি লিখেছেন, December had nearly passed away. The famine became extreme, and Boabdil determined to surrender the city on the second of January.
“ডিসেম্বর শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
দুর্ভিক্ষ চরম আকার ধারণ করেছে। আর ববডিল (আবু আব্দুল্লাহ) গ্রানাডা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলেন ২ জানুয়ারি। ”
এখানে উল্লেখ্য যে, খ্রিস্টানবাহিনী কয়েক মাস ধরে গ্রানাডার চারপাশে অবস্থান নিয়ে এ নগরীকে অবরোধ করে রেখেছিলো। ফলে সেখানে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
স্পেন থেকে মুসলমানদেরকে ১৪৯২ সালেই বের করে দেয়া হয়নি।
শাসক আবু আব্দুল্লাহর সাথে ইসাবেলা আর ফার্ডিন্যান্ডের যে চুক্তি হয়েছিলো তাতে গ্রানাডার মুসলমানদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীকালে মুসলমানদের হয় ক্যাথলিক নয়তো স্পেন ছাড়ার পছন্দ দেয়া হয়েছিলো। যারা স্পেন ছাড়েনি তারা ক্যাথলিক ছদ্মবেশে মুসলিমই থেকে যান। খ্রিস্টানরাও জানতো তারা মুসলমান। আর এদেরকেই তারা মরিস্কো উপাধি দেয়।
মরিস্কোদের পুরোপুরি স্পেন থেকে বহিষ্কার করা হয় ১৬০৯ থকে ১৬১৪ সালের মধ্যে। এটাও করা হয়েছিলো রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা হারানো মরিস্কোদের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য বিদ্রোহ করার পর।
এই হলো স্পেনে মুসলমানদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। আমাদের আলোচনায় ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি তারিখটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আমাদের মাঝে প্রচলিত আছে যে, মুসলমানদের সঙ্গে চুক্তি করার নামে খ্রিস্টানবাহিনী ষড়যন্ত্র করে রাতের আঁধারে গ্রানাডায় ঢুকে পড়ে এবং শহরবাসীকে নিরাপত্তার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে মসজিদে ঢুকিয়ে সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
পুড়িয়ে মারা হয় হাজার হাজার মুসলিম শহরবাসীকে। আর এই তারিখটি ছিলো এপ্রিলের ১ তারিখ। যেহেতু মুসলমানদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বোকা বানিয়ে অগ্নিদগ্ধ করে মারা হয় তাই খ্রিস্টানরা বলতে থাকে ওরা এপ্রিলের বোকা- ‘এপ্রিল ফুলস’ (April Fools)। সেখান থেকেই এপ্রিল ফুল বিষয়টি এসেছে এবং মুসলমানদের মাঝে তা আবেগতাড়িত বেদনায় পালিত হয়।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।