আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ১০১ দিন

ইতিহাসের পেছনে ছুটি তার ভেতরটা দেখবার আশায় রোদ কতো আগে শুকিয়ে দিয়েছে রক্ত, বৃষ্টি ধুয়ে নিয়ে গেছে সব চিহ্ন। মনের ভেতর এখনও ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন নিহত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির মায়েরা। দু’জনের মায়ের বিলাপ এখনো থামেনি। প্রিয় সন্তানের জন্য এখনো ডুকরে ওঠে মায়ের মন। অবুঝ মেঘ এখনও বাসায় কলিংবেলের শব্দ শুনলেই দৌড়ে দরজার পাশে যায়; আশায় বুক বাঁধে।

এই বুঝি এসেছে তার আব্বু-আম্মু। তাকে জড়িয়ে ধরবে। কপালে চুমু খাবে। কতো মানু্ষ আসে মেঘের বাসায় অথচ মেঘের বাবা মা আসে না। মাহিন সরওয়ার মেঘও এখন জানে তার বাবা মা চলে গেছে মেঘের ওপারে; তবুও মেঘ অপেক্ষায় থাকে! মেঘ তার কষ্টগুলো প্রকাশ করতে পারে না বড়দের মতো করে।

শনিবার কথা হয় মেঘের সঙ্গে। ‘কেমন আছো?’-- জিজ্ঞেস করতেই মুখে উত্তর না দিয়ে মাথা ডান দিকে হেলিয়ে জানায় ‘ভালো আছি’। অনেকবার প্রশ্ন করার পর মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ সূচক জবাব দেয়। সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনির হত্যাকাণ্ডের আজ ১০১তম দিন। সাগর রুনির হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা যায়নি।

দেশের সর্বস্তরের মানুষের এ নিয়ে এক ধরণের গুমোট কষ্ট, হতাশা তৈরি হয়েছে, শোক ছাপিয়ে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। সাংবাদিক সমাজ, নিহত সাংবাদিক দম্পতির পরিবারের আকুতি যেনো স্পর্শ করছে না রাষ্ট্রকে। পুলিশ খুনিদের চিহ্নিত করতে পারেনি। পুলিশের তদন্তের ফলাফল শূন্য। তাই তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে।

তদন্তে অগ্রগতি নেই, কেবলই প্রতিশ্রুতি! হত্যাকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিচক্রকে গ্রেফতার করা হবে। ’ ৪৮ ঘন্টা কবে হবে এ-প্রশ্ন এখন সাংবাদিক সমাজসহ দেশবাসীর। তিনি আরও বলেছিলেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এ হত্যা মামলা মনিটরিং করছেন। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ১০০ দিন পার হলেও তদন্তে কার্যত কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় অনেক ইস্যুর ভিড়ে সাংবাদিক দম্পতির হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে।

জানা গেছে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ ৪১ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের খুনিচক্র কারা, সে ব্যাপারে পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)—সরকারের এতগুলো সংস্থা থাকতে এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ১০০ দিনেও কোনো কিছুই জানা গেল না। পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, ‘তদন্তে প্রনিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ’ ডিবির ডিসি মনিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘খুনিরা হাতের নাগালের মধ্যেই আছে।

’ কিন্তু হাইকোর্ট তদন্তকারী সংস্থা ডিবিকে তলব করলে তারা হাইকোর্টে হাজির হয়ে বলেছেন, তদন্তে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। আদালতে ব্যর্থতা স্বীকার করার পর হাইকোর্ট সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের এ চাঞ্চল্যকর মামলা গত ১৮ এপ্রিল এ মামলা র্যাবে স্থানান্তর হয়। র‌্যাব তদন্তকাজ শুরু করার পর দেখা যায় এর আগে ভিসেরা পরীক্ষা ছাড়াই সাগর-রুনির লাশ দাফন করা হয়েছে। ফলে র্যাবকে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য লাশ কবর থেকে তুলতে হয়েছে। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং সূত্রে জানা গেছে, প্রথম শ্রেণীর তিন কর্মকর্তা তদন্তকাজ দেখভাল করছেন।

এ তদন্তদল ছুটির দিনসহ প্রতিদিনই কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে নানা ধরনের তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে সম্ভাব্য বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ চলছে। সাগরের মা সালেহা মনির বাংলানিউজকে বলেন, ঘটনার পর দীর্ঘদিন পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় আশা অনেকটা ছেড়ে দিয়েছি।

কিন্তু তারপরও আবার আশায় বুক বাঁধি। কারণ এছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। পারিবারিক সূত্র জানায়, ওই বাসা থেকে ঘাতকরা সাগরের মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, একটি নেটবুক ও সোনার গহনা নিয়ে গেছে। মেঘের স্বজনরা জানান, হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে ডেকে তাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। তিনি মেঘের দায়িত্ব নেয়ার কথাও বলেছেন।

কিন্তু এরপর সরকারের পক্ষ থেকে আর কেউ খবর নেয়নি। সাগর ও রুনির মা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, আপনিও আমাদের মতো স্বজনহারা। আপনি আমাদের কষ্ট বোঝেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সরকার যে কোনো মূল্যে খুনিদের গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। কিন্তু এ পর্যন্তই শেষ।

আরেকটি জজ মিয়া নাটক সাজাতে ব্যর্থ! নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংবাদিক নেতা বলেন, ‘সাংবাদিক সমাজসহ দেশের সাধারণ মানুষ এ ঘটনায় সোচ্ছার থাকায় সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে গোয়েন্দা পুলিশ ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজাতে ব্যর্থ হয়। ’ তিনি বলেন, ‘সেই রাতে সাগরের বাসায় সিঁদ কেটে চুরি হয়েছে এমন গল্প তৈরির কাজ প্রায় চূড়ান্ত হয়েছিল! একপর্যায়ে তা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়বে তাই রান্নাঘরের জানালায় একটি গ্রিলের কাটা অংশ আবিষ্কার করে পুলিশ। তাত্ক্ষণিকভাবেই পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়ে দেন, যেটুকু গ্রিল কাটা আছে, তা দিয়ে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পক্ষে ঢোকা বা বের হওয়া সম্ভব নয়। এরপরও তিনদিন ধরে ওই ফাঁকা অংশ দিয়ে অল্প বয়সী শিশু প্রবেশ করিয়ে গোয়েন্দারা মহড়া দেয়। ’ র‌্যাব কি পারবে ক্লু উদঘাটন করতে ঘটনার ক্লু উদঘাটনের জন্য অবশেষে র্যাবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

দায়িত্ব পাওয়ার পর র্যাব সাগর-রুনি নিহত হওয়ার ৭৫ দিন পর গত ২৬ এপ্রিল আজিমপুর কবরস্থান থেকে তাদের লাশ ওঠায় ভিসেরা রিপোর্ট তৈরির আলামত সংগ্রহের জন্য। কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে দেখে দেহের পুরোটাই পচে গেছে। হাড় থেকে মাংসপেশি ও চামড়া সরে কঙ্কালে পরিণত হয়েছে। একটি সূত্র বলছে, প্রথমেই তদন্তের দায়িত্ব র্যাবের কাছে দেওয়া হলে তারা সফলতার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারত। এখন রহস্য উদঘাটনের সম্ভাবনা অনেকটা ক্ষীণ।

হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। এসব বক্তব্য ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। তদন্তের শুরু থেকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় বিভ্রান্তিমূলক ও স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, খোদ প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক দম্পতি হত্যা মামলার বিষয়টি তদারকি করছেন। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে আরও বলেছেন, আপনারা অপেক্ষা করুন, যে কোনো সময় সুখবর শুনতে পাবেন।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, সাগর-রুনি হত্যা মামলা তদন্তে তিনি সন্তুষ্ট। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার বেনজির আহমেদ বলেছিলেন, পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে। পরে তিনি আবার বলেছেন, ডেডলাইন দিয়ে এসব হয় না। সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। ডিসিডিবি মনিরুল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন সার্ভিস সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘হত্যারহস্য উন্মোচন সময়ের ব্যাপার।

এরই মধ্যে অনেক তথ্য পাওয়া গিয়েছে। আসামি শনাক্ত হয়েছে। শিগগিরই জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু তাদের এসব কথার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। উল্লেখ্য, গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি।

সাগরের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ২৫টি ও মেহেরুনের পেটে তিনটি ছুরিকাঘাত করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পরদিন সকালে ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তায়, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়তো ক্রমেই চলে যাবে বিস্মৃতির আড়ালে। যে হত্যাকাণ্ড ঘটার সঙ্গে সঙ্গে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে, ১০০ দিন হতে চললেও সেই ঘটনার কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। এ কারণে সাগর-রুনির স্বজন ও সাংবাদিক মহলসহ দেশের সাধারণ মানুষও উদ্বিগ্ন, ক্ষুব্ধ।

 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।