ছোটবেলায় আমার জন্য অ্যালার্ম ছিল আম্মা। সকাল বেলা স্কুলে যাওয়ার জন্য সময়মত ডেকে তুলতে আম্মার কোনদিনও ভুল হয়নি। মাঝে মাঝে আলসেমীতে গড়াগড়ি করে আমিই দেরী করে ফেলতাম। কাজটা এখনও করি।
অ্যালার্ম ঘড়ির প্রয়োজন প্রথম বোধ করি মেডিকেলে হোস্টেলে থাকার সময়।
এখানে সময়মত ডেকে দেয়ার কেউ নেই। সবাইকে নিজ দায়িত্বে ঘুম থেকে উঠতে হবে। আব্বাকে বললাম একটা অ্যালার্ম ঘড়ি কিনে দিতে। নীল রঙের একটা খুব সুন্দর অ্যালার্ম ঘড়ি কিনে দিয়েছিলেন আব্বা। এই ঘড়িটা এত পছন্দের ছিল যে বছর খানিক পর নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও রেখে দিয়েছিলাম আমার কাছে।
এটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এত মিস করছিলাম এটাকে যে দোকানে গিয়ে ঠিক এই রকমই আরেকটা খুঁজতে থাকলাম। এক দোকানে পেয়েও গিয়েছিলাম, কিন্তু দোকানদার নিজেই বলল যে এটার মান ভালো হবে না, নষ্ট হয়ে যাবে। পরে অনেকটা একই রকম দেখতে গোলাপী রঙের একটা অ্যালার্ম ঘড়ি কিনলাম। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটাও বছর না ঘুরতেই নষ্ট হয়ে গেল। বুঝলাম এই ধরণটাই বাদ দিতে হবে।
এরপর দোকানে গিয়ে অনেক ঘুরে ছাইরঙা স্বচ্ছ একটা অ্যালার্ম ঘড়ি কিনলাম। এটা এতই স্বচ্ছ ছিল যে ভিতরের কলকব্জা সবই দেখা যায়। এই ঘড়িটার দাম একটু বেশি হলেও সবচেয়ে বেশিদিন টিকেছিল এটাই। হোস্টেলে যে-ই দেখত, জিজ্ঞেস করত কোথা থেকে কিনেছি। কাছাকাছি ধরণের পেলেও ঠিক এই রকমটা আর কেউ খুঁজে পায়নি।
এটাও আমার খুব প্রিয় একটা ঘড়ি হয়ে উঠল। মাঝখানে মেজপার হাতে একটা ছোট দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এর ঢাকনিটা বিসর্জন দিতে হয়েছে। তারপরও এই ঘড়িটা অনেকদিন ঠিকমত চলেছে। এখনও ব্যাটারী দিলে ঠিকমতই চলে। এখন আর চালানো হয় না, তারপরও এখনও এটা আমাদের বাসায় কম্পিউটার টেবিলের উপর শোভাবর্ধন করে যাচ্ছে।
হোস্টেলে সবারই অ্যালার্ম ঘড়ি থাকত। কেউ কেউ এমন ছিল যে অ্যালার্মের শব্দে তাদের কোনদিনও ঘুম ভাঙত না। তারপরও তারা নিয়মিত অ্যালার্ম ঘড়ি ব্যবহার করত। আমার সামনের রুমেই এক সখী ছিল এমন। অনেকবার এমন হয়েছে খুব সকালের ক্লাসে যাওয়ার জন্য আমরা তৈরী হচ্ছি।
সেই সখীর রুম থেকে তার অ্যালার্মের টুট টুট শুনতে পাচ্ছি। আমরা ক্লাস করে এসে হোস্টেলে এসে শুনি তখনও চলছে সেই টুট টুট। এক-দেড় ঘন্টা টানা বেজে গেলেও সখী নিশ্চিন্তে আরামের ঘুম দিয়ে যেতে পারে।
আমার আবার ঘুম যতই গভীর হোক, অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙবেই। অ্যালার্মের প্রথম বিপ হওয়ার সাথে সাথে আমার ঘুম ভেঙে যেত, আর আমি উঠে পড়তাম।
তবে মাঝে মাঝে আলসেমির স্বভাব তো ছিলই। অ্যালার্ম বন্ধ করে আরেকটু ঘুমিয়ে নেয়ার বদভ্যাসের কারণে মাঝে মাঝে আফসোসই করা লাগত। বিশেষ করে রোজার সময়। সেহরীর সময়ে অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙত, বন্ধ করে আরও দশ মিনিট ঘুমিয়ে তারপর উঠতাম। একদিন এমন দশ মিনিটের ঘুম দেয়ার জন্য শুয়েছি।
পরে যখন এক সখী দরজায় নক করল, উঠে দেখি সেহরীর সময় বাকী আর মাত্র দশ মিনিট। ভাগ্যিস সখী আমার রুমে এসেছিল পানি খেতে, সে না এলে আমার না খেয়েই রোজা থাকতে হত সেদিন।
তবে সকালের ক্লাসের জন্য আমার অ্যালার্মের একটা স্টাইল ছিল। আমি অ্যালার্মের শব্দে উঠতে চাইতাম না। অ্যালার্ম দিতাম এমন সময়ে যখন না উঠলেই নয়।
আমার ঘুম ভাঙত অ্যালার্ম বাজার আগেই। আর উঠেই বালিশের পাশে রাখা অ্যালার্ম বন্ধ করে দিতাম। টুট টুট শব্দটা বড়ই বিরক্তিকর ছিল। তারপরও দিয়ে রাখতাম সাবধানতার জন্য। কোনদিন যদি সময়মত ঘুম না ভাঙে তাহলে শেষ ভরসা হবে সেটা।
অ্যালার্ম বাজার পর বন্ধ করে আবার ঘুম দেয়ার স্বভাব আমার একার ছিল না। এক সখী ছিল যে এমনটা করত বলে অ্যালার্ম ঘড়ি রাখত অনেক দূরে। যাতে ঘুম ভেঙে উঠে গিয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করতে করতে ঘুম কেটে যায়। কিন্তু সে যা করত, আলমারীর উপর অ্যালার্ম ঘড়ি রাখার পরও ঘুম থেকে উঠে দূরে গিয়ে আলমারীর উপর থেকে ঘড়িটা নিয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করে বাথরুম সেরে এসে আবারও ঘুম দিত। তবু আরেকবার ঘুম দিতেই হবে।
এটা মনে হয় অ্যালার্ম ঘড়ির উপরই একটা জেদ যে তুমি ডাকলেও আমি আবার ঘুমাবই।
যা হোক, অ্যালার্ম ঘড়ির ব্যবহার বন্ধ হয় যখন থেকে মোবাইল ফোন হাতে পাই। হোস্টেলে জীবনের শেষ দিকেই এটা ঘটে। তখন থেকে মোবাইলেই অ্যালার্ম ব্যবহার করি। এরপর মোবাইল ফোনের সেট কয়েকবার পরিবর্তন হলেও অ্যালার্মের ব্যবহার করেছি সবগুলো সেটেই।
এখনও চলছে এই ব্যবহার। তবে এখন আর আগে-ভাগে উঠে গিয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করি না। বরং আগে ঘুম ভেঙে গেলেও অপেক্ষা করি কখন অ্যালার্ম বাজবে, আর আমি স্নুজ দিয়ে আরও দশ মিনিট আলসেমী করব। মাঝে মাঝে দশ মিনিট দশ মিনিট করে স্নুজ দিতে দিতে আধা ঘন্টাও পার করে ফেলি।
তবে অ্যালার্ম বাজার সাথে সাথে ঘুম ভাঙবেই।
একবার এমন হয়েছিল খুব ভোরে আমার বাসে করে ঢাকায় আসার কথা। টিকেটও করা হয়ে গিয়েছে। সময়মত অ্যালার্মও দিয়ে রেখেছি। কিন্তু ঘুম ভেঙে দেখি আমার বাস ছাড়ার আর মাত্র দশ মিনিট বাকী। কোনমতেই এর মধ্যে তৈরী হয়ে গিয়ে বাস ধরা সম্ভব না।
বাধ্য হয়ে আরও পরের একটা বাসে গেলাম নতুন করে টিকেট করে। কিন্তু সারাদিন ধরে শুধু এই গবেষণাই করলাম যে আমার ঘুম কেন সময়মত ভাঙল না। অ্যালার্ম তো ঠিকমতই দেয়া আছে দেখছি। আর যদি এমনও হত যে প্রথমবার অ্যালার্ম বেজেছে আমার ঘুম ভাঙেনি, তাহলেও দশ মিনিট পর পর অ্যালার্ম বাজার কথা। কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছিলাম না।
অবশেষে আবিষ্কার করলাম আসল ঘটনা। আমি সেদিন অ্যালার্ম সেট করেছিলাম আমার মর্নিং অ্যালার্ম হিসেবে, আর আমার মর্নিং অ্যালার্ম সেট করা আছে সপ্তাহের ছয় দিনের জন্য, শুক্রবার বাদে। ঐ দিনটা ছিল শুক্রবার। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।