বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ স্বামীর মৃত্যুবাষির্কী ঘটা করেই করেন মরিয়ম বেগম । ফকির-মিসকিন ডেকে খাওয়ান, মসজিদের ইমাম সাহেব, মৌলভী সাহেব, ক্বারী সাহেব আসেন। সকালের দিকে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ছাত্ররা এসে একতলার বারান্দার ওপর বসে সুর তুলে দুলে দুলে কোরাণ তেলওয়াত করে ।
খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন জোহরের নামাজের পরে। বাড়িতে লোকজন থাকলেও মরিয়ম বেগম নিজেই তদারকি করেন। এরা সবাই বৃদ্ধার পরিচিত। বিপদে-আপদে ছুটে আসে। এলাকার মসজিদটি তো তার শ্বশুরই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মরিয়ম বেগম- এর ছেলেমেয়েরা কেউই রূপপুর থাকে না। নাতী- নাতনীরা সব স্কুলকলেজে পড়ে। দাদুর মৃত্যুবার্ষিকীতে ইচ্ছে সত্ত্বেও আসতে পারে না। মরিয়ম বেগম- এর ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছোট ছেলে সারওয়ারের এখনও বিয়ে হয়নি। ব্যবসা করছে সারওয়ার।
ভীষণ ব্যস্ত। বাড়ি থাকেই না বলতে গেলে।
আজ খাওয়ার সময় মাদ্রাসার একটি ছেলেকে দেখে ভারি অবাক হয়ে গেলেন মরিয়ম বেগম । ছেলেটিকে আগে কখনও দেখেন নি। বেশ ফুটফুটে সুন্দর ছেলেটি।
বয়স তেরো-চৌদ্দর কাছাকাছি। বড় মাসুম নিষ্পাপ চেহারা। বড় বড় চোখ। গায়ের রং ধবধবে ফরসা। ছেলেটির পরনে ঘিয়ে রঙের পায়জামা-পাঞ্জাবি।
তার ওপর মেরুন রঙের কুর্তা। মাথায় সোনালি জরির কাজ করা টুপি।
কি নাম তোমার বাবা? মরিয়ম বেগম সস্নেহে জিগ্যেস করলেন।
ছেলেটি চুপ করে থাকে। ঘাড় গুঁজে খেতে থাকে।
লাজুক মনে হল। বড় বড় চোখের পাপড়ি । ঘন কালো জোরা ভুঁরু। মরিয়ম বেগম এত বছরের জীবনে এত সুন্দর বালক এর আগে কখনও দেখেননি। তিনি ভীষন কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।
ওপাশে বসে সাত্তার মৌলবী খাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, জ্বী, বেগম সাহেবা। এই পোলার নাম হইল মরম। গত মাসে বাসেত মৌলভী আইসা এরে আমার কাছে রাইখা গেল। বাসেত মৌলভী কইল, এইডা আমার গেরামের পোলা।
এতিম। মা-বাপ নাই। আপনি এরে রাখেন। আমার বয়স হইছে। আল্লায় কখন ডাক দেন ঠিক নাই।
মরিয়ম বেগম বুকটা টনটন করে উঠল। তিনি দেীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আহা। এই বয়সে এতিম।
হ। গতকাল পুবপাড়ার আলতাফ মাষ্টরে কইল, বাসেত মৌলভী ইন্তেকাল করিয়াছেন।
মরম পোলাটা এইবার সত্যি সত্যিই এতিম হইয়া গেল।
মরিয়ম বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, তা হলে মরম আমার এখানেই থাক মৌলভী সাহেব । আল্লাহ্ তো আমায় কম দেননি। তার ওপর ছেলেমেয়েরা রোজগার করে পাঠায়।
একজনের দায়িত্ব নিতে পারব না?
কথাটা শুনে সাত্তার মৌলবী স্বস্তি পেলেন। বেগম সাহেবা মরমের দায়িত্ব নিলে তো তিনি বেঁচে যান। মরম পোলাটা ছোট হলে কি হবে - খায় একটু বেশিই । মরমের ভাত-তরকারি যোগান দিয়ে তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। সাত্তার মৌলবী খুশি হয়ে বললেন, তাহলে তো ভালোই হয় বেগম সাহেবা।
তারপর মরমের দিকে তাকিয়ে বললেন, তাইলে তুই এই বাড়িতেই থাক মরম। তুর কোনও অসুবিধা হইব। আমি তোর মালসামানা মাদরাসা থেইকা পাঠায় দিমুনি ।
রূপপুরে মরিয়ম বেগম -এর বাড়িটা দোতলা। মরম-এর থাকার জন্য একতলার একটি ঘর দেওয়া হয়েছে।
পাশের ঘরেই থাকে জলিল মিঞা। জলিল মিঞা এ বাড়ির দারোয়ান। বৃদ্ধ। এ বাড়ির হাটবাজার সেই করে। হাটবাজার অবশ্য জোছনা বানুও করে।
জোছনা বানু এ বাড়ির রাঁধুনী। বছর তিরিশে এই মেয়েটি দেখতে ফরসা হলেও বেশ বেঢপ। থলথলে। তবে জোছনা বানুর রান্নার হাত বেশ ভালো।
রাতে মরিয়ম বেগম বিছানার ওপর বসে তছবি জপছিলেন।
ঘরের বাতাসে আগরবাতির মৃদু গন্ধ ভাসছিল। ঘরের দেওয়ালে ফুটফুটে একটি বালকের ছবি। ছবিটা মরিয়ম বেগমের ছেলের ঘেরের নাতির। নাম অন্তু। অন্তুরা বড় শহরে থাকলেও প্রায়ই রূপপুর বেড়াতে আসে।
তখন সে পুকুর, পেয়ারা বাগান, লিচুবাগান সব দাপিয়ে বেড়ায়।
জোছনা বানু ঘরে ঢুকে পালঙ্কের কিনারে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। তার মুখ কেমন থমথমে দেখায়। মরিময় বেগম মুখ তুলে তাকালেন। অভিযোগের সুরে জোছনা বানু বলল, নানী, আবার ভাত বসাইতে হইব।
মরিয়ম বেগম তছবিতে চুমু খেলেন। তারপর বললেন, কেন রে? আবার ভাত বসাতে হবে কেন?
মরম পোলাটা একটা জ্যান্ত রাক্ষস। এত বেশি খায়, কী কমু। এক গামলা ভাত একাই খাইয়া ফেলছে।
মরিয়ম বেগম হেসে ফেললেন।
বললেন, আহা, খাক না। গরীব ছেলে। এতদিন হয়তো না খেয়েই ছিল।
হ। না খাইয়া ছিল।
রাক্ষস আবার না খাইয়া থাকতে পারে। বলে দুপদাপ পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে যায় জোছনা বানু ।
অন্তু ওর দাদুবাড়ি এলেই প্রথমে পুকুরঘাটের দিকে ছুটে যায়। পুকুরপাড়টা এ বাড়ির সবচে সুন্দর জায়গা কিনা। পুকুরের চারধারে ফুলের বাগান।
কতরকম যে ফুল। সূর্যমুখীর ঝাড়ও আছে। বাগানের ওপাশে দেয়াল। দেয়ালের ওপাশে ইউক্যালিপটাস গাছের সারি। তারপর একটা খাল।
তারপর রেললাইন। তারপর আবার খাল। তারপর বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। তারপর একটা নদী। সেই নদীর নাম সোনাবালি নদী।
অন্তু আজ দাদুবাড়ি নেমেই সোজা পুকুরঘাটে চলে এল। এসে দেখল ওরই বয়েসি একটি ছেলে গালে হাত দিয়ে ঘাটের ওপর বসে আছে। ছেলেটা কী সুন্দর! ভারি ফুটফুটে। আশ্চর্য! কে এ?
এই, কে তুমি?
ছেলেটি সামান্য চমকে ওঠে। তারপর বলল, আমি? আমার নাম মরম।
বলতে বলতে মরম উঠে দাঁড়ায়।
বুঝেছি। কিন্তু, তুমি এখানে কি করছ?
বসে আছি। আমি ... আমি তো এ বাড়িতেই থাকি। কিন্তু, তুমি কে?
আমি হলাম অন্তু ।
এটা আমার দাদুবাড়ি। আমরা ঢাকায় থাকি। এখন ইস্কুল ছুটি। তাই বেড়াতে এসেছি। দুদিন পরই অবশ্য চলে যাব।
একটু আগে ছোটচাচা আমাকে জিপ দিয়ে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। বড় রাস্তা থেকে আমি অবশ্য একাই এসেছি। ছোটচাচা মানিকনগর গেলেন। কাল বাদে পরশু এসে আবার আমায় ঢাকায় নিয়ে যাবেন ।
ওহ্ ।
অন্তু বলল, আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। তুমি?
আমি মাদরাসায় পড়ি।
তা এখানে বসে কি করছ?
কি আর করব? আমার মন খারাপ। মরম বলল।
কেন ? তোমার মন খারাপ কেন?অন্তু অবাক হয়ে যায়।
আমার ভীষন মা-বাবার কথা মনে পড়ছে যে।
তোমার মা-বাবা কোথায় থাকেন?
মরম কিন্তু তা বলল না। এড়িয়ে গেল। অন্তু কিছুটা ছটফটে বলে বুঝতে পারল না। বলল, চল পেয়ারা বাগানে যাই।
চল। মরম বলল। মনে হল সে নতুন বন্ধুকে পেয়ে খুশি। তার মন খারাপ কাটতে শুরু করেছে।
রাতে খেতে বসে অন্তু বলল, মরম ছেলেটা কিন্তু বেশ।
না দাদি?
হ্যাঁ রে । বলে নাতীর প্লেটে একটা ভাজা কই তুলে দিলেন মরিয়ম বেগম। অলখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অন্তরা ঢাকায় থাকে। কি খায় না খায়।
ঢাকায় সব জিনিসে ভেজাল। মরিয়ম বেগম ঢাকায় পারতপক্ষে যান না।
বেশ না ছাই। রাক্ষসের মতো খায়। সকালে এক ধামা মুড়ি খাইয়া শেষ করে।
জোছনা বানু অন্তুর প্লেটে আচার তুলে দিতে দিতে বলল।
অন্তু ফিক করে হেসে ফেলল। বলল, কই খায়? তখন তো একটাও পেয়ারা খেল না। কী টসটসে পেয়ারা। আমি তিনটে খেলাম।
পেয়ারা আবার কখন খেলি? মরিয়ম বেগম অবাক।
বিকেলে। আমি আর মরম পেয়ারাবাগানে গিয়েছিলাম। মরমই তো গাছে উঠে পেয়ারা পেড়ে দিল।
মরম গাছে উঠতে পারে? নাতীর কথা শুনে মরিয়ম বেগম অবাক।
পারে না আবার? কেমন বেড়ালের মতন তরতর করে গাছে উঠে পড়ল।
মরিয়ম বেগম বললেন, মরম গ্রামের ছেলে, সেজন্যই হয়তো গাছে চড়তে জানে। আচ্ছা, ওকে কাল ডাব পেড়ে দিতে বলিস তো। জলিল মিঞা আজকাল চোখে দেখে না বলে গাছে চড়ে না।
জোছনা বানু দুধ আনতে চলে যায়।
তখন অন্তু বলে, জান দাদি, মরমের না ওর মা-বাবার জন্য মন খারাপ।
ওর মাবাবা মারা গেছেন। ওর মন খারাপ তো হবেই।
মরমের মা-বাবা মারা গেছেন?
হ্যাঁ। কেন তোকে বলেনি?
কই, আমাকে তো কিছুই বলেনি ।
মরিয়ম বেগম ফজরের নামাজের পর ভোরের ফিকে আলোয় উঠানে কিছুক্ষণ পায়চারি করেন। আজ ভোরে নামাজ সেরে বারান্দায় এসে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। বারান্দার ওপর দশ-বারোটা ডাব পড়ে আছে। ডাব কে পারল? মরম? আশ্চর্য! ফুটফুটে চেহারা দেখে তখনই সন্দেহ হয়েছিল। মরিয়ম বেগম- এর বাবা ইয়াজ উদ্দীন সরদার অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ ছিলেন।
তিনি একবার জ্বীন হাছিল করেছিলেন। সেই জ্বীনের নাম ছিল সোলাইমান। সোলাইমান জ্বীন মরিয়ম বেগম কে কত কিছুই না খাইয়েছিল। এই যেমন কাবুলের হালুয়া, বাগদাদের শরবত, লাহোরের পেস্তা, দিল্লির বাদাম। সেই কথা মনে পড়ে যাওয়ায় মরিয়ম বেগম- এর মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল।
তিনি মনের আনন্দে পায়চারি করতে থাকেন। তাঁর শরীর ঝরঝরে লাগছিল। খোদাতালার কত মেহেরবানী। তিনি জ্বীন পাঠিয়েছেন। মনে মনে দোওয়া-দরূদ পড়তে লাগলেন মরিয়ম বেগম।
জোছনা বানু তখনও ওঠেনি। ভারি ঘুমকাতুরে জোছনা বানু । মরম- এর নামে খালি যাতা বলে। মরম কোন্ দিন না আবার বেগানাটার ঘাড় মটকে দেয়। মরম নাকি খালি খায়।
আরে ছুড়ি, মরম কি তোরটা খায় নাকি?
চৈত্রমাসের সবে শুরু। গ্রামাঞ্চলে ভোরের দিকে কুয়াশা পড়ে। মরিয়ম বেগম দেখতে পেলেন আবছা কুয়াশায় জলিল মিঞা দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর ঘাটের দিকে যাচ্ছে। জলিল মিঞার বেশ বয়েস হয়েছে। তার বাড়ি শ্যামনগর।
সে আর চাকরি করতে চাইছে না। কিছুদিন ধরে ছুটি চাইছে। মরিয়ম বেগম এবার বুড়োকে ছুটি দিয়ে দেবেন । বাড়ি পাহারা দেবার জন্য লোক পোষার মানে হয় না।
জলিল মিঞা?
জলিল মিঞা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, বলেন আম্মা?
আমাকে দুটো ডাব কেটে দিও তো।
আচ্ছা দেবোনি। তার আগে মুখ ধুয়ে আসি।
জলিল মিঞার বয়েস হয়েছে। এত ভোরে কে ডাব পারল সেটি জিগ্যেস করতে ভুলে গেছে।
আজ দিনটা বেশ ঝলমলে।
অন্তু আর মরম পুকুরের দক্ষিণে লিচুবনে ঘুরছিল। লিচুবাগানের মাটিতে সাদা ধুলোর পরত। তাতে হলদে রোদের ইকড়িমিকড়ি। চিৎকার করে কাক ডাকছিল। লিচুগাছের মগডালে একটা কেরোসিনের টিন, তাতে কাঠের ডান্ডায় দড়ি লাগানো ।
লিচুর মরসুমে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়েপাখি এলে তখন দড়ি ধরে টেনে পাখি তাড়ানো হয়।
অন্তু বলল, কই, তোমার মা-বাবা যে বেঁচে নেই তা আমাকে বলনি যে?
মরম বলল, আমার মা-বাবা তো বেঁচে আছেন।
তাহলে দাদি যে বলল ...
না। দাদিমা সত্য কথা জানেন না। সাত্তার মৌলবীও সত্য কথা জানেন না।
সত্যি কথা জানতেন বাসেত মৌলবী। তিনি তো আর বেঁচে নেই। আসলে তো সাত্তার মৌলবী জানার কথা না-মরম কথাটা শেষ করল না।
কি জানার কথা না?
আমি জ্বীন।
যাঃ।
মরমের কথা শুনে অন্তু হাসবে না কাঁদবে।
সত্যি আমি জ্বীন। আমাদের দূনঈয়াতে চার-পাঁচ বছর করে থাকতে হয়। তাই আমিও আছি। এক সময় আমি আমাদের রাজ্যে চলে যাব।
তখন অন্য কেউ আসবে। তবে দূনঈয়া ভালো লাগলে সারাজীবনও থাকতে পারি।
অন্তুর তবুও বিশ্বাস হয় না। ও হাসে। পেয়ারায় কামড় দেয়।
মরম বলল, বিশ্বাস না করলে না করলে। এখন বল লিচু খাবে কিনা।
খাব।
মরম তরতর করে একটা লিচুগাছে উঠে পড়ল। থোকা থোকা লিচু ধরে আছে।
অথচ সবে চৈত্র মাস। লিচু ধরতে আরও কয়েক মাস বাকি। অন্তু ব্যাপারটা খেয়াল করল কিনা কে জানে। মরম একটা টিয়ে পাখির রূপ ধরে ঠুকরে ঠুকরে লিচু ফেলতে লাগল নীচে। পাতার আড়ালে ছিল বলে অন্তু টিয়েটা দেখতে পায়নি।
মরিয়ম বেগম-এর পায়ে ব্যথা। মোছলেম কবিরাজ পায়ে রোজ কালিজিরার তেল মালিশ করতে বলেছে। তো কালিজিরা তেলের শিশিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জোছনা বানু খালি ঘুমায় আর জিনিস হারায়। মরম কি রান্নাবান্না পারে? একে বাদ দিতে হবে?
মরিয়ম বেগম বললেন, ও জোছনা।
মরমকে ডাক তো।
মরমকে ডাকতে জোছনা বানু ঘর ছেড়ে বেরোতে না বেরোতেই মরম এসে ঘরে ঢুকল।
মরিয়ম বেগম নরম স্বরে বললেন, বাবা, কালিজিরার তেলের শিশিটা পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি একটু খুঁজে দেখ তো।
নানী আমি এখুনি নিয়ে আসছি।
বলেই মরম হাওয়া।
এর পর কয়েক সেকেন্ডও কাটেনি। মরম হাজির। হাতে কালিজিরার তেল শিশি।
জোছনা বানু অবাক।
মরিয়ম বেগম-এর মুখে ক্ষীন হাসি।
জোছনা বানু বলল, আমার চিরুনি, জবাকুসুম তেলের শিশি আর চুলের কিলিপ পাই না। ও নানী ওরে একটু কন না খুঁইজা দিত।
মরম সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজল। না, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও জোছনা বানুর চিরুনি, জবাকুসুম তেলের শিশি আর চুলের কিলিপ পাওয়া গেল না।
মরিয়ম বেগম এর মুখে মিটিমিটি হাসি। জোছনা বানুর মুখ ভার।
দাদুবাড়ি এলে অন্তু দোতলায় থাকে। সেদিন রাত্রে ওর ঘুম ভেঙে গেল। এখন কত রাত? মা ওকে একটা মোবাইল কিনে দিয়েছেন।
ডিসপ্লে তো দেখল: রাত আড়াইটা বাজে। ও উঠে বসল। খুব হাওয়া ছিল। দরজার পাল্লায় শব্দ হচ্ছে। ও বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
পূর্ণিমার আলোয় চতুর্দিক ভেসে যাচ্ছে । কী নির্জন! কী নির্জন! এমন রাতে নাকি আকাশ থেকে পরীরা নামে। সত্যি? আচ্ছা, মরম যে বলল, ও জ্বীন। আসলে কি মরম জ্বীন?
হঠাৎ দেওয়ালের দিকে চোখ যেতেই জমে গেল অন্তু। দেয়ালের ওপর কতগুলো ষন্ডাপ্রকৃতির লোক।
তারা ঝুপ ঝুপ করে নীচে লাফিয়ে নামল। লোকগুলোর হাতে রামদা। কারা এরা? ডাকাত!অন্তু ভীষণ চমকে ওঠে। এখন কি করা যায়। ওর হাতের তালু ঘেমে যাচ্ছিল।
হঠাৎই অন্তু দেখতে পেল- পুকুরের পাড় ঘেঁষে তীরবেগে দৌড়াচ্ছে মরম । ওর পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি আর কুর্তা। মাথায় টুপি। দৃশ্যটায় কী ছিল- গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটু পরই একটা আশ্চর্য দৃশ্য দেখল অন্তু।
দৌড়তে দৌড়াতে একটা বড় জাল হয়ে গেল মরম। তারপর সেই জালটা ছড়িয়ে গিয়ে পড়ল ঠিক ডাকাতগুলোর ওপরে। ডাকাতগুলি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
অন্তু দ্রুত ঘরে চলে এল। বিছানার ওপর থেকে মোবাইল তুলে নিল।
কাঁপা কাঁপা হাতে বাটন টিপল। এত রাতে ছোটচাচা মোবাইল অফ না করলেই হয়। ওপাশে রিং বাজছে।
হ্যালো। ছোটচাচা?
হ্যাঁ।
বল। ছোটচাচার কন্ঠস্বরে ঘুমের রেশ।
এতরাতে ঘুম ভাঙালাম বলে সরি।
ইটস অল রাইট। এখন কি হয়েছে বল ।
তুমি কি রূপপুর থানার কাউকে চেন?
হ্যাঁ, চিনি। কেন? কি হয়েছে?
ওদের এখুনি বাসায় আসতে বল। বাড়িতে ডাকাত পড়েছে।
ডাকাত?
হ্যাঁ। ডাকাত।
তবে ভয় নেই। ওরা কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। ওদের আটকে ফেলা হয়েছে।
কে আটকালো? দাঁড়া, আমি .. আমি এখুনি থানায় ফোন করছি।
অন্তু আজ ঢাকা ফিরে যাবে।
ছোটচাচা জিপে উঠে বসেছেন। অন্তুর জন্য অপেক্ষা করছেন। অন্তু আর মরম পুকুরধারে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তুর দাদুবাড়ি লোকেলোকারণ্য। তাজুডাকাত ধরা পড়েছে যে।
তাজুডাকাত অত্র অঞ্চলের কুখ্যাত ডাকাত । পুলিশ তাকে ধরার জন্য বহুবছর ধরে হন্যে হয়ে খুঁজছিল। আজ ভোরে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে পুকুর পাড়ে বড় একটা মাছধরা জালে জড়িয়ে পড়ে ছিল সে । রূপপুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন কড়া পুলিশ পাহারায় ডাকাতের দলটাকে থানায় নিয়ে গেছে। এরই মধ্যে নাকি ডাকুটাকে প্রক প্রস্থ উত্তম-মধ্যম দেওয়া হয়েছে।
আশ্চর্য এই -যে জালে ডাকাতের দল ধরা পড়ল সেই জালটাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ডামাডোলে ব্যাপারটা নিয়ে কেউ মাথাও ঘামাচ্ছে না।
ছোটচাচা হর্ন দিলেন। কলাঝোপের পাশে জিপটা দাঁড়িয়ে। দিদা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন ছোটচাচার সঙ্গে।
অন্তু বলল, ইস্কুল ছুটি হলে আমি আবার রূপপুরে আসছি মরম । ততদিন তুমি কোথাও যেও না কিন্তু।
আরে না। আমি আর কই যাব? আমি এখানেই আজীবন থেকে যাব। তোমার দাদুবাড়িটা না আমার ভীষন পছন্দ হয়েছে।
চারিদিকে তাকিয়ে বলল মরম জ্বীন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।