বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ দু’দিন ধরে মরিয়মের ওপর ক্ষেপে আছে মুনিরা । স্নেহার পুতুলটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মরিয়ম মিনমিন করে বলে, মামী, আমি দেখি নাই।
পুতুলটা স্নেহাকে উপহার দিয়েছিল রেবেকা । রেবেকার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত মুনিরা। তেমন ঘনিষ্টতা অবশ্য ছিল না । রেবেকার ডিপার্টম্যান্টও আলাদা ছিল। কম কথা বলা ধবধবে ফরসা একটা মেয়ে ।
সব সময় বিষন্ন থাকত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর আর রেবেকার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। ...বিয়ের পর বরের সঙ্গে দু বছরের জন্য জাপান চলে যায় মুনিরা।
স্নেহার জন্মদিনে সেই রেবেকা এসে উপস্থিত । দুপুরবেলা।
মুনিরা কিচেনে ছিল। পায়েস রাঁধছিল। কলিংবেল শুনে মরিয়মকে বলল, দেখ তো কে এল। তারপর ড্রইংরুমে এসে মুনিরা অবাক। রেবেকা।
পরনে কালো রঙের সালোয়ার-কামিজ। কালো ওড়না। সেই ফোলা ফোলা ধবধবে ফরসা মুখ।
আশ্চর্য! তুই?
রেবেকা ম্লান হাসে।
ঠিকানা পেলি কই? আশ্চর্য! আমি যে এখানে থাকি কে বলল তোকে?
রেবেকা এসব প্রশ্ন এড়িয়ে গেল।
তেমন কিছু বলল না। বেশিক্ষণ বসল না। কেবল ব্যাগ থেকে একটা পুতুল বের করে স্নেহাকে দিল। ছোট কাপড়ের পুতুল। হলদে রঙের।
কালো সুতার চুল। কপালে লাল টিপ। মনে হয় না ওটা স্নেহার পছন্দ হয়েছে। স্নেহা পুতুলটা লুকিয়ে রাখেনি তো? স্নেহা ক্লাস টুয়ে পড়ে। এই বয়েসেই ওর পছন্দ-অপছন্দ বেশ তীব্র ।
মুনিরা দুপুরে লাঞ্চের পর বেরুল। গত রাত্রে বাবাকে স্বপ্ন দেখেছে। বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনবে । শপিং মলের নাম: ‘মিলি প্লাজা’। কাছেই।
হেঁটেই যাওয়া যায়। মুনিরার বাবা আহাদ উদ্দীন আহমেদ রূপগঞ্জ থাকেন। সরকারি চাকরি করতেন। রিটায়ার করে বৃদ্ধ এখন গ্রামেই বাস করছেন। পোলট্রি আর ফিশারি নিয়ে ব্যস্ত।
সকাল-সন্ধ্যা দরবেশ ইলিয়াস শাহর সঙ্গে জিকির-আজগার করেন। ইলিয়াস শাহ মুনিরার বাবার ছেলেবেলার বন্ধু-আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী বিরাট দরবেশ মানুষ। ইয়া লম্বা- চওড়া আর ফরসা চেহারা। সব সময় কালো পায়জামা আর পাঞ্জাবি পরেন। মাথায় কালো পাগড়ী।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ছিলেন ইলিয়াস শাহ। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে একরাতে কী এক স্বপ্ন দেখলেন। তারপর রাতারাতি বদলে যান তিনি । সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ান। পৃথিবীতে একদল বদ কিসিমের ইবলিশ আছে।
তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দাকে বালামুসিবতে ফেলে। দরবেশ ইলিয়াস শাহ খারাপ আছর থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করেন । তাঁর ঝুলিতে অলৌকিক মেশক মেশানো সুরমা থাকে । সেই অলৌকিক মেশক মেশানো সুরমা ইবলিশের ওপর ছিটিয়ে দিতে পারলেই ইবলিশ কুপোকাত!
পাঞ্জাবি কিনে শপিং মল থেকে বেরুতে বেরুতে তিনটা বাজল। ইলিয়াস চাচা মেশক অম্বর আতর পছন্দ করেন।
ইলিয়াস চাচার জন্য মেশক অম্বর আতর কিনেছে মনিরা। ইলিয়াস চাচা মাঝেমধ্যেই ঢাকা আসেন। তখন মুনিরার ফ্ল্যাটে ওঠেন। ঢাকার তালতলার সুলায়মান পীরের বয়স প্রায় একশ। তিনিই ইলিয়াস চাচার ওস্তাদ ।
ইলিয়াস চাচা ঢাকায় এলে ওস্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। তালতলার সুলায়মান পীর ইবলিশ ধ্বংসের অনেক দোওয়া-দরূদ জানেন। তিনিই নাকি অলৌকিক মেশক মেশানো সুরমা তৈরি করেন।
মোবাইল বাজল। মরিয়ম।
বল কি হয়েছে?
স্নেহায় ঘুমায় না মামী। খালি কয় কাটুন দেখব।
আচ্ছা দেখুক। বলে ফোন অফ করে দেয় মুনিরা। হাসে।
মুনিরা বাইরে থাকলে খোঁজখবর নেয় বলে মরিয়ম-এর কাছে একটা মোবাইল থাকে । অবশ্য মরিয়ম যখন-তখন ফোন করে মুনিরাকে বিরক্ত করে।
সাবরিনার ফ্ল্যাটটা শপিং মলের কাছেই । সাবরিনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত মুনিরা । বিয়ের পর সাবরিনা বছর কয়েক চট্টগ্রামে ছিল।
তারপর ঢাকায় ফিরে এসেছে। ওর বর রাশেদ ভাই এই ওয়ারী তে ফ্ল্যাট কিনেছে। এর আগে একবার সাবরিনার ফ্ল্যাটে গিয়েছিল মুনিরা। ষোল ’শ স্কয়ার ফুটের ছিমছাম সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাট। সাবরিনার বর রাশেদ ভাই অমায়িক মানুষ; শিপব্রেকিংয়ের ব্যবসা করে কোটি টাকা করেছেন বোঝাই যায় না।
অবশ্য অনেক দিন যাওয়া হয় না ওর ওখানে। আজ কী মনে করে ফোন করল মুনিরা ।
সাবরিনা বলল, বাসায় আছি। চলে আয়।
একটা কনফেকশনারিতে ঢুকে ইগলু আইসক্রিমের একটা বক্স কিনল মুনিরা।
সাবরিনা সাদা রঙের ম্যাক্সি পরে ছিল। চোখমুখ কেমন ফোলাফোলা। ঘুমিয়েছিল বোধহয়। দরজা খুলে মনিরাকে দেখে খুশি হয়ে বলল, আয়।
সোফায় বাসার সময় চোখ আটকে যায় মুনিরার ।
মৃদু চমকে ওঠে। উলটো দিকের সোফায় একটা হলদে রঙের পুতুল। ছোট, কাপড়ের তৈরি। মাথায় কালো সুতার চুল। কপালে বড় লাল টিপ।
অবিকল সেই রেবেকার দেওয়া পুতুলের মতো।
ওটা কোথায় পেলি রে? অস্ফুট স্বরে বলল মুনিরা।
ও, ওটা? রেবেকাকে তোর মনে আছে? সোস্যাল ওয়েলফেয়ারে পড়ত?
হ্যাঁ। মুনিরার বুক ঢিপঢিপ করছে।
কয়েকদিন আগে রেবেকা এসে হাজির।
আমি তো অবাক। বললাম- ঠিকানা পেলি কই? আমি যে এখানে থাকি তা জানলি কি করে? ও এসব কথা এড়িয়ে গেল। বলল, এই পুতুলটা রাখ। গিফট। আজ তোর জন্মদিন।
ওর কথা শুনে আমি অবাক। আমার জন্মদিন রেবেকা জানল কী করে ... তারপর ও আর বেশি ক্ষণ বসেনি অবশ্য।
আশ্চর্য! মুনিরার মুখ কালো হয়ে যায়। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে ওঠে। রেবেকা স্নেহার জন্মদিনে এসেছিল।
তাহলে? ক্ষীণ এক রহস্যের আভাস পায় যেন মুনিরা।
আকাশে মেঘ জমছিল বলে দ্রুত বিদায় নিয়ে নীচে নেমে একটা রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরে এল মুনিরা।
গেটের কাছে পৌঁছতেই মরিয়মের ফোন। মামী জলদি আসেন। বৃষ্টি আইতাছে।
আমি নীচে। মুনিরা বিরক্ত হয়ে বলল। তারপর ফোন অফ করে গেট দিয়ে গ্যারেজে ঢুকে পড়ল। ওর ননদের ড্রাইভার আসলাম ওকে দেখে সালাম দিল। এই অ্যাপার্টম্যান্টটা রায়হানদের পৈত্রিক জমির ওপর; রায়হানের ভাইবোনেরা মিলে থাকে।
যে কারণে রায়হান দেশের বাইরে থাকলেও মুনিরা নিরাপদ বোধ করে। মুনিরার বর রায়হান একটা মালটি ন্যাশনালের হিউম্যান রিসোর্সে রয়েছে। একটা সিম্পজিয়ামের যোগ দিতে রায়হান এখন ম্যানিলায় ।
রাতে রূপগঞ্জ থেকে বাবার ফোন এল । বাবা বলল, তোর ইলিয়াস চাচা আগামী সপ্তাহে একবার ঢাকায় যাবে রে মুনিরা।
তোর ওখানেই উঠবে। তুই তোর চাচার যত্নআত্মি করিস মা।
মুনিরা বলল, আব্বা, তোমাকে ও নিয়ে ভাবতে হবে না। ইলিয়াস চাচা মুগের ডালের খিচুরি খেতে ভালো বাসেন। আমি দুবেলা চাচাকে রেঁধে খাওয়াব।
আর শোন আব্বা, তোমার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনেছি। ইলিয়াস চাচার হাতে পাঠাব।
ঠিক আছে মা। ঠিক আছে।
আর ইলিয়াস চাচার জন্য আতর কিনেছি।
মেশক অম্বর।
ঠিক আছে মা। ঠিক আছে।
কয়েক দিন পর সাবরিনার ফোন পেল মুনিরা।
কি রে মুনিরা তোর বর ফিরেছে?
না রে।
ওর ফিরতে সেই নেক্সট মান্থের ফাস্ট উইক। কী যে বাজে সময় কাটছে ...
সেদিন তোর সঙ্গে দেখা হল না বলে রাশেদ কী আফসোস করল। রাশেদ বলল একদিন আমাদের এখানে তোর বরকে নিয়ে ডিনার খেতে।
মুনিরা বলল, ও আগে ফিরুক। তারপর ।
ওকে। তাহলে রায়হান ভাই ঢাকায় এলে আমাকে ফোন করে জানাস কিন্তু।
ওকে, জানাব।
সাবরিনা তারপর বলল, কি হয়েছে জানিস?
কি?
রেবেকার দেওয়া সেই পুতুলটা খুঁজে পাচ্ছি না। আমার ফ্ল্যাটে লোকজন তেমন আসে না।
সামান্য কাপড়ের পুতুল। কে নিল বুঝতে পারছি না। কাজের মেয়েটা বাঁধা, ছুটা না। তার ওপর বিশ্বাসী। ও নেবে না।
সারা শরীরে মুনিরা কেমন ক্ষীণ একটা শিরশিরানি টের পায়। ওর কেমন সন্দেহ জাগে। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে হাজির হল রেবেকা। ও ঠিকানা জানল কি করে? সাবরিনার বাড়ির ঠিকানাই-বা জানল কী করে?
রেবেকারা থাকত পুরোনো ঢাকার আর্মানীটোলায় এক সরু গলির ভিতর। গলিটা আর্মেনীয় গীর্জার কাছেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার গিয়েছিল মুনিরা। যদিও রেবেকা কখনও ওদের বাড়ি নিয়ে যায়নি। মুনিরা কী মনে করে নিজেই গিয়েছিল। ছাই রঙের পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। দোতলায় লোহার কাজ করা রেলিং।
দরজা-জানালার রং সবুজ। বোঝা যায় বনেদী পরিবার। রেবেকার বাবা গালিব চাচা। লম্বা-চওড়া বলিষ্ট গড়ন । মনে আছে সবুজ পাঞ্জাবি পরে ছিলেন গালিব চাচা ।
মাথায় উশকো-খুশকো চুল, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, একমুখ ঘন কালো দাড়ি। উর্দু মিশিয়ে ভীষণ মিষ্টি করে কথা বলেন। যত্ন করে বাদাম দেওয়া সবুজ রঙের শরবত খাইয়েছিলেন। মনে আছে দোতলার একটা বেশ বড়সরো ঘর ... কেমন ঠান্ডা আর মিষ্টি গন্ধ ছড়ানো। দেওয়ালে সাদা রং করা।
দেয়ালে রেবেকার মৃত মায়ের সাদাকালো একটা ছবি টাঙানো। ঠিক তারি নীচে শোকেস। শোকেসে পুতুল। ছোট, কাপড়ের তৈরি । হলদে রঙের।
কালো সুতার চুল। কপালে লাল টিপ। গালিব চাচার মা নাকি শখ করে পুতুল বানাতেন ...
আর্মানীটোলায় সেই সরু গলির সামনে রিকশা থেকে নামল মুনিরা। চারিদিকে দুপুরের রোদ ছড়িয়ে ছিল। মুনিরার চোখে সান গ্লাস।
ফরসা সুন্দর মুখ। আশেপাশের লোকজন তাকাচ্ছিল। ও পাত্তা না দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে গলির ভিতরে ঢুকে পড়ে। অন্ধগলি। শেষ বাড়িটাই ছিল রেবেকাদের।
এত বছর পর বাড়িটা ঠিক চিনতে পারল না মুনিরা। কেবল একটি বাড়ির কাঠামো দাঁড়িয়ে। তবে কাঠামোটা পোড়া বলে মনে হল। দরজা- জানলা নেই। হা হা করছে।
দোতলার রেলিংটাও ভাঙাচোরা।
গলিতে কয়েকজন ঝালাইয়ের লোক বসে ছিল। ওদের কাছে গিয়ে মুনিরা জিগ্যেস করল, এই বাড়ি তে যারা ছিল তারা এখন কোথায় বলতে পারেন?
একটা অল্প বয়েসি ছোকড়া বলল, এই বাড়িতে তো আগুন লাগছিল আফা?
মুনিরা চমকে উঠল। আগুন লেগেছিল? কবে?
চারপাঁচ বছর হইব। এবার এক বৃদ্ধ বলল।
কিন্তু এ বাড়িতে যারা ছিল, তারা এখন কোথায়?
আপনে গালিব সাবের কথা কইতেছেন তো ? সেই বৃদ্ধ জিগ্যেস করল।
হ্যাঁ। আমি তাঁর মেয়ের সঙ্গে পড়তাম।
তারা কেউ বাঁচেনি। আগুনে পুইড়া তারা দুইজনেই মারা গেছে।
মুনিরার শরীর জমে। হঠাৎ শীত করে। মাথা টলে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ পর সামলে নিয়ে বলল, তাহলে এখানে কেউ থাকে না?
বৃদ্ধ বলল, আগে একটা গরীব ফেমেলি থাকত। এখন আর থাকে না।
কেন?
কি নাকি দেখছিল তারা ...
মুনিরা ধীরে ধীরে গলির মুখে ফিরে আসে। বুক ধড়ফড় করছে । রেবেকা কি পুড়ে মারা গেছে? তাহলে সেদিন কে গেল? সাবরিনার বাড়ি কে গেল? মুনিরার সারা শরীর কাঁপছিল। রিকশার জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। ব্যাগের ভিতর মোবাইলটা বেজে উঠল।
মরিয়ম। বলল, মামী, আপনার কি আইতে দেরী হইব?
না। কেন? কি হয়েছে? মুনিরার গলা কাঁপছে।
কিছু হয় নাই।
স্নেহা কি করে?
খেলতেছে।
খেলছে? কার সঙ্গে খেলছে?
হেই দিন না আইল? স্নেহারে হইদা রঙের পুতুল দিল। সেই বেটির লগে খেলে।
রেবেকা! কি বলছিস তুই?
মুনিরা এদিক-ওদিক তাকায়। মাথা ভীষণ টলছিল। আশেপাশে দৃশ্য কেমন আবছা হয়ে যায়।
কানের কানে গুনগুন গুনগুন শব্দ। কপালের দুপাশের শিরা লাফাচ্ছে। তবে আজ বুঝি ওর ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। নইলে ঠিক ওর সামনেই এখটা খালি সিএনজি এসে কেন? মুনিরা ওঠে পড়ে। বলে, ওয়ারী।
জলদি। জলদি যান।
ড্রাইভার বৃদ্ধ। তাকে নির্বিকার দেখাল। হয়তো জানে মেয়েদের অস্থিরতা বেশি।
বৃদ্ধ ড্রাইভার ধীরেসুস্থেই সিএনজি চালাতে থাকে। মুনিরা সিটের ওপর অসাড় হয়ে পড়ে থাকে। ঘামে জবজব করছে ওর ঘাড়, পিঠ। একটু পর সিএনজিটা থেমে গেল। সামনে পথ আগলে একটা ট্র্যাক থেমে আছে।
বাঁ পাশে রড সিমেন্টের দোকান, ডান পাশে মিষ্টির দোকান। মুনিরা মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাবে। সারা শরীর ভিজে গেছে।
তারপর কীভাবে যেন অ্যাপার্টমেন্টের কাছাকাছি পৌঁছে গেল সিএনজি।
একটা রিকশা থেকে ইলিয়াস চাচা নামছেন দেখে ধড়ে প্রাণ এল মুনিরার।
ইলিয়াস চাচার পরনে কালো রঙের পায়জামা-পাঞ্জাবি। মাথায় কালো পাগড়ী। কাঁধে ঝুলি। মুনিরা স্বস্তি বোধ করে। ইলিয়াস চাচাকে নিশ্চয়ই আল্লাহ পাঠিয়েছেন।
ও চিৎকার করে উঠল, ড্রাইভার সাহেব। সিএনজি থামান। সিএনজি থামান।
সিএনজি থামতেই দ্রুত সিএনজি থেকে নেমে চিৎকার করে উঠল মুনিরা, ইলিয়াস চাচা!
কি হইছে মা? তোমারে এমন উতলা দেখাইতেছে কেন?
জলদি উপরে চলেন চাচা। আমার সর্বনাশ হয়েছে।
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল মুনিরা।
ওদের ফ্ল্যাটটা দোতলায়। সিঁড়ি ভেঙে কখন পৌঁছল বলতে পারবে না। কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলল। মরিয়ম।
স্নেহা কই বলে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকল মুনিরা। রেবেকা কার্পেটের ওপর বসে আছে। পরনে কালো সালোয়ার-কামিজ। ওর সামনে স্নেহা বসে । ওদের মাঝখানে সেই হলুদ রঙের পুতুল।
রেবেকা মুখ তুলে তাকাল। হাসল। হাসিটা ধীরে ধীরে কেমন বিকৃত হয়ে যায়। মুনিরার শরীরের রক্ত জমে যায়। রেবেকা মুখ ঘুরিয়ে কাকে যেন দেখছে।
ইলিয়াস চাচাকে সম্ভবত।
ইলিয়াস চাচা বললেন, আরে এইটা তো একটা জলজ্যান্ত ইবলিস! এইটা এইখানে কেমনে আইল?
মুনিরা চমকে ওঠে।
দূর হ শয়তান! ইলিয়াস চাচা গর্জে উঠলেন।
মুনিরার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। স্নেহা ছুটে ওর মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ইলিয়াস চাচা ঝুলি থেকে কী বার করলেন। মনে হল মেশক মেশানো সুরমা। সেই গুঁড়ো ছুঁড়ে মারলেন রেবেকার দিকে । রেবেকা ভয়ানক কেঁপে উঠে তীব্র চিৎকার করে উঠল। আর ওর চোখ দুটি কেমন লাল হয়ে উঠল।
তারপর চূর্ণ চূর্ণ হয়ে গুঁড়ার মতো মিলিয়ে গেল বাতাসে।
দৃশ্যটা এত ভয়ানক। মুনিরা আর মরিয়ম একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে।
ইলিয়াস চাচা বললেন, বড় বাঁচা বাঁচছ মা।
মুনিরার শরীর তখনও কাঁপছিল।
তারপর সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে সব খুলে বলে।
ইলিয়াস চাচা বললেন, ইবলিশ দুইটা পুইড়া মরলেও ওরা এখনও ওই পোড়াবাড়িতেই আছে মা। ইবলিশগো এখন মরণের দেশে পাঠায় দিতে হইব।
কথাটা শুনে মুনিরার শরীর অবশ হয়ে আসে।
ঠিকানা কও মা।
আমার এখনই ওই পোড়াবাড়িত যাইতে হইব।
চাচা আমি যাব। মুনিরা বলে।
তুমি যাইবা? তুমি ভয় পাইবা না মা?
না। আপনি থাকলে আমি ভয় পাব না।
সিএনজি যখন গলির মুখে থামল তখন সন্ধ্যা। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল । গলিটা ফাঁকা। ঝালাইয়ের লোকগুলি কেও দেখা যাচ্ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে ওরা পোড়াবাড়ির সামনে চলে এল।
অশান্ত বাতাস এসে ঝাপটা মারছে।
ভাঙা দরজার সামনে এসে ইলিয়াস চাচা বললেন, আস মা। ভয় পাইও না। খালি আল্লাহর নাম কর।
মুনিরা ভিতরে পা বাড়ায়।
ওর বুক ভয়ানক কাঁপছে। দোওয়া দরুদ যা জানে পড়ছিল মনে মনে। ভিতরে অন্ধকার। তবে স্ট্রিট লাইটের আলো ভাঙা দরজা-জানালা দিয়ে ঢুকছিল। মেঝেতে ভাঙা ইট।
বালি আর কাঠ ছড়িয়ে। বাতাসে কেমন চুনাপাথরের গন্ধ। একপাশে সিঁড়ি।
এইদিকে আস মা। ইলিয়াস চাচা বললেন।
মুনিরা পিছন পিছন ওঠে। সিঁড়িটা পরিস্কার। মনে হল নিয়মিত ঝাঁট দেওয়া হয়। কে ঝাঁট দেয়? কেউ তো এই পোড়াবাড়িতে থাকে না। তাহলে? মুনিরা ওর হৃৎস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পেল যেন।
দোতলায় মৃদু আলো রয়েছে। তবে আলোর উৎস বোঝা গেল না। সেই বেশ বড় বসার ঘর। সেই পুরনো আসবাবপত্র। মুনিরা সব চিনতে পারল।
দেয়ালে রেবেকার মৃত মায়ের একটা সাদাকালো ছবি। ঠিক তার নীচে শোকেস। তাতে ছোট কাপড়ের পুতুল। হলদে রঙের। কালো সুতার চুল।
কপালে লাল টিপ। ওদিকে একট কালো সোফা। ওদিকে চোখ যেতেই মুনিরা চমকে উঠল। সোফায় গালিব চাচা বসে আছেন। সেই লম্বা-চওড়া বলিষ্ট গড়ন।
আজও সবুজ পাঞ্জাবি পরে ছিলেন। মাথায় উশকো-খুশকো চুল, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, একমুখ ঘন কালো দাড়ি। মিষ্টি কন্ঠে বললেন, বসুন, ইলিয়াস সাহেব। বসুন। আপনার তবিয়ৎ ভালো তো?
দূর হ শয়তান! ইলিয়াস চাচা গর্জে উঠলেন।
গালিব চাচা হো হো করে হেসে উঠলেন। যেন ভারি মজার কথা শুনেছেন। তিনি গড়া চড়িয়ে ডাকলেন, রেবেকা। রেবেকা ...
জ্বী, আব্বাজান। ওপাশের ঘর থেকে রেবেকার কন্ঠস্বর ভেসে এল।
বাড়িতে মেহমান এসেছে। মেহমানদের শরবত দাও।
জ্বী, আব্বা। আনছি।
ওপাশে একটা দরজা।
দরজায় আকাশী রঙের পরদা। পরদা সরে যায়। টুংটাং করে ঘন্টি বেজে উঠল। রেবেকা ঘরে ঢুকল। পরনে কালো রঙের সালোয়ার কামিজ।
কালো ওড়না। হাতে একটা ট্রে। তাতে শরবতের গ্লাস। রং সবুজ রঙের শরবত। রেবেকা ঘরে ঢুকতেই ঘরটা কেমন আশ্চর্য মিষ্টি গন্ধ ভরে উঠল।
গন্ধটা অনেকটা শুকনো গোলাপ পাপড়ির মতো ...
দূর হ শয়তান! ইলিয়াস চাচা আবার গর্জে উঠলেন।
এরই মধ্যে কাঁধ থেকে ঝুলি নামিয়ে নিয়েছেন। ঝুলি থেকে মেশক মেশানো সুরমা বার করে ওদের দিকে ছুঁড়ে মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটা দুলে উঠল। আর চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল।
মুনিরা সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভয়ানক চিৎকার শুনতে পেল। আর প্রচন্ড শব্দ। যেন অন্ধকারে দুপক্ষের তীব্র লড়াই চলছে। মুনিরা ওর চোখে মুখে গরম ভাপ টের পেল। আতঙ্কে মনে হল অজ্ঞান হয়ে যাবে।
ও সরে যেতে চাইল । অথচ ওর পা দুটো সরল না। পা দুটো লোহার মত ভারী ঠেকল।
একটু পর আলো ফিরে এল। মেঝের ওপর দুটো পোড়া শরীর পড়ে রয়েছে।
মুনিরা মুখ ফিরিয়ে নিল।
ইলিয়াস চাচা বললেন, আর কোনও ভয় নাই মা। ইবলিশ দুইটা তাগো দুনিয়ায় ফেরৎ চইলা গেছে।
একটু পর মুনিরা যখন নীচে নেমে এল তখন ওর শরীর প্রচন্ড ক্লান্তিতে ভেঙে আসছিল। পা চলছিল না।
গলার কাছে প্রচন্ড তৃষ্ণা। বারবার স্নেহার মুখটা ভাসছিল। ব্যাগের মধ্যে ফোনটা বাজল। মরিয়ম । মামী?
বল।
ক্লান্ত স্বরে বলল মুনিরা।
আপনের কি আইতে দেরি হইব?
না। কেন?
স্নেহায় খায় না। খালি টিভি দেখে।
আচ্ছা।
না খাক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।