আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কর্ণফুলীর কান্নায় আদিবাসীদের নির্বাসন

আমি আছি মানুষের মাঝখানে, ভালোবাসি মানুষকে ভালোবাসি আন্দোলন, ভালোবাসি চিন্তা করতে আমার সংগ্রামকে আমি ভালোবাসি কর্ণফুলী নদীটির নাম কর্ণফুলী হল কেন? নামকরণের ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে জানতে পারলাম বেদনাবিধূর একটা লোককথা। এক রাজকন্যা ভালোবাসতো আদিবাসী এক রাজকুমারকে। রাজকুমারের সাথে নদীতে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর সময় রাজকন্যার কানের ফুল নদীর জলে পরে যায়। ফুলটি তুলতে রাজকন্যা ঝাঁপিয়ে পরে নদীর জলে। ক্রমশ ডুবতে থাকা রাজকন্যাকে বাঁচাতে রাজপুত্রও ঝাঁপিয়ে পরে নদীর জলে।

বাঁচতে পারেনি কেউই। সেই যে রাজকন্যার কানের ফুল হারিয়ে গেল নদীর জলে তখন থেকেই এই নদীর নাম কর্ণফুলী। হায় কর্ণফুলী, নামকরণেই তার হারানোর গল্প। সেই থেকে এই অপূর্ব সুন্দর নদীটি কেবল লিখে গেল হারানোরই ইতিহাস। কান্না আর বেদনার কাব্য।

সময়টা ১৯৫৬ সাল। পশ্চিম পাকিস্তানিদের দোর্দন্ড শাসন চলছে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে। দেশে বিদ্যুতের প্রয়োজন। শুরু হল একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ। বাঁধ তৈরীর জন্য বেছে নেয়া হল অনিন্দ্যসুন্দর একটি পাহাড়ি নদীকে।

হ্যাঁ, রাজকন্যার হারানো কানের ফুল বয়ে বেড়ানো সেই কর্ণফুলী নদীকে। বাঁধটির ভৌগলিক অবস্থান বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায়। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়াটা একটু বলে নেই। কোন নদীর গতি পথে বাঁধ দিয়ে পানিকে সঞ্চয় করা হয়। এরপর বাঁধের কপাটগুলো খুলে দিয়ে সেই সঞ্চিত পানিকে প্রবল বেগে বেরিয়ে যেতে দেয়া হয়।

প্রচন্ড গতিতে বয়ে যাওয়া স্রোতের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ঘুরানো হয় টারবাইন। সেই টারবাইনের ঘুর্ণন শক্তিকে রুপান্তরিত করা হয় বিদ্যুত শক্তিতে। স্বাভাবিক ভাবেই বুঝতে পারছেন বেরিয়ে যাওয়া পানিকে কোথাও না কোথাও রিজার্ভ করতে হয়। যার ফলে জলাবদ্ধতা বা বড়রকমের লেক সৃষ্টি হয়। এজন্যই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জায়গা নির্ধারন করা হয় অনেক সার্ভে করার পর যাতে করে কোন লোকালয় বা ফসলি জমি কিংবা বনজ সম্পদের ক্ষতি সাধিত না হয়।

কাপ্তাই বাঁধ তৈরীর সময় সেরকম সার্ভে অবশ্যই হয়েছিল। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে কি লেখা ছিল সেই রিপোর্টে। ঠিক কোন তথ্যটা রাষ্ট্র পরিচালকদের বুঝিয়েছিল কাপ্তাই বাঁধের জন্য নির্ধারিত জায়গাটি ঠিক আছে। যাই হোক, বাঁধ নির্মানের কাজ চলতে থাকলো। একদিন শেষও হল।

১৯৬২ সাল। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শুরু হল বিদ্যুত উৎপাদনের কাজ। আর একই সঙ্গে শুরু হল কান্নার গল্প, নির্বাসনের গল্প। বাঁধের একপাশে সঞ্চিত পানি যখন ছেড়ে দেয়া হল তার সবটুকুই ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মত ধেয়ে গেল একটা স্বর্গের মত সুন্দর পাহাড়ি জনপদের দিকে। সরল পাহাড়ি মানুষগুলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখল তাদের আবাসকে ডুবে যেতে।

অবিশ্বাসীর মত তাকিয়ে দেখল তাদের জুম চাষের পাহাড়কে তলিয়ে যেতে। দেখল তাদের প্রিয় রাজার রাজবাড়িটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সর্বনাশা পানির তলায়। কাল রাতেও যে কিশোরী মেয়েটি চোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঘুমোতে গিয়েছিল তার চোখ ভরে গিয়েছিল স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়। ছলছলে চোখে হয়ত তাকিয়ে ছিল তার প্রিয় ঘরটির দিকে। যে ঘরটায় শুয়ে সে আর কোনদিন স্বপ্ন দেখতে পারবেনা।

ভাবতে পারবেনা তার প্রিয় মানুষটির কথা। নিমিষেই বেঁচে থাকার সব অধিকার হারানো মানুষগুলো শুধুই ফ্যালফ্যাল করে নীরব তাকিয়ে ছিল। নিজ দেশ ছেড়ে হতে হয়েছিল নির্বাসিত। জনপদটির নাম জানেন? রাঙ্গামাটি, আমাদের সবার প্রিয় রাঙ্গামাটি। হানিমুন করতে, শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি নিয়ে একটু নিঃশ্বাস নিতে যে রাঙ্গামাটি ছুটে যাই সেই রাঙ্গামাটি।

কতটুকু জায়গা তলিয়ে গিয়েছিল জানেন? ৫৪০০০ একর, যার ৪০ শতাংশ ছিল ফসলি জমি। এছাড়া সরকারি সংরক্ষিত বনের ২৯ বর্গমাইল এলাকা ও অশ্রেণীভুক্ত ২৩৪ বর্গমাইল বনাঞ্চলও ডুবে যায়। প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের মোট এক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যূত হয়। আর এসবটুকুর বিনিময়ে সেসময় কতটুকু বিদ্যুত উৎপাদিত হত শুনবেন? ৪০ মেগাওয়াট। চোখ কচলে আরেকবার সংখ্যাটার দিকে তাকান।

ভুল দেখেননি, সংখ্যাটা সত্যি ৪০ মেগাওয়াট। এতটুকু বিদ্যুতের জন্যই সব হারাতে হয়েছিল আদিবাসীদের। তাদের বুকে ব্যথার আগুন জ্বালিয়ে আমরা আমাদের ঘরে জ্বালিয়েছিলাম বৈদ্যুতিক বাল্ব। আমাদের শহরে যখন জ্বলত লাল-নীল নিয়ন আলো তখন অসহায় আদিবাসীদের পেটে জ্বলত ক্ষুধার আগুন। বাস্তুচ্যূত একলাখ মানুষকে ত্রিপুরায় গিয়ে যাপন করতে হয়েছিল শরণার্থী জীবন।

কতটা নির্মম, কতটা অমানবিক সে জীবন তার কোনটাই আমরা জানিনি, বলা ভালো কোনদিন জানতে চেষ্টা করিনি। কিছুকিছু বাঙালী এই বর্বরতার দায় পাকিস্তানীদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজের দায়টুকু এড়াতে চায়। তাদের প্রশ্ন করবো, সেই সময় কোন বাঙালী বুদ্ধিজীবি কিংবা রাজনীতিবিদ কি এই বাঁধ নির্মানের প্রতিবাদ করেছিল? পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের সংগ্রামে আদিবাসীদের ইস্যুটা কি একটা জ্বালানি হতে পারতনা? সামান্য কিছু বিদ্যুতের মোহ বাঙ্গালীদের এতটাই অন্ধ করে দিয়েছিল তারা অসহায় আদিবাসীদের কথা ভাবতেই পারেনি। আর পারবেই বা কেন?? আদিবাসীদেরতো উপজাতি নামক একটা নোংরা শব্দ ব্যবহার করে দেশের দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক বানিয়ে রাখা হয়েছে বহুকাল। ’৭১ এ স্বাধীন হবার পর রাষ্ট্র কি পারত না এই সরল আদিবাসীদের নতুন করে বাঁচার অধিকারটুকু দিতে? কিন্তু লজ্জার হলেও সত্য, আদিবাসীদের মহান নেতা প্রয়াত এম এন লারমার আদিবাসীদের পক্ষে পাঁচ দফা দাবীর জবাবে আমাদের বাঙ্গালীদের মহান নেতা শেখ মুজিব বলেছিলেন তাদেরকেই বাঙালী হয়ে যেতে।

হাস্যকর, কি নির্মম কৌতুক। যে বাঙ্গালীরা নিজেদের জাতিসত্ত্বাকে ছেড়ে পাকিস্তানী হতে অস্বীকার করে যুদ্ধে নেমেছিল তারাই সুযোগ পেয়ে অন্য একটি জাতিকে বলে তাদের জাতিসত্ত্বাকে ত্যাগ করতে। স্বাভাবিকভাবেই আদিবাসীরা এই অনৈতিক দাবী মেনে নেয়নি এবং নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য তারা সংগ্রাম শুরু করে। ঘটে মাষ্টার্স রেভুলুশ্যন। সে আরেক গল্প, সময় করে আরেকদিন বলা যাবে।

আজ আমাদের বাঙালী তরুণ প্রজম্মের কাছে কর্ণফুলীর কান্নায় সৃষ্ট এই কাপ্তাই লেকের নির্মম ইতিহাসটা বলতে গেলে অজানা। তাই আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তাদের সাথে আমাদের সহাবস্থানতো নেই, তাদের প্রতি সমবেদনাটুকুও আমরা দেখাতে পারিনি। অথচ আমরা যদি একটুখানি আদিবাসীদের হাতে হাত রেখে তাদের দাবীর সাথে সংহতি জানাতাম তাহলে বহুকাল ধরে শোষিত মানুষগুলো আরেকটু ভরসা পেত। অভিধান থেকে নয়, চলুন এক লক্ষ নির্বাসিত মানুষের কাছ থেকে জেনে নেই নির্বাসনের অর্থ কি। আদিবাসীদের হাতে হাত রেখে জাগিয়ে তুলি মূমুর্ষ মানবতাকে।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নয়, সংবিধানে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আদিবাসীদের দাবীর সাথে কন্ঠ মিলিয়ে তা ছড়িয়ে দেই সবখানে। তাতে হয়ত আগের প্রজন্মের রেখে যাওয়া ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করতে পারব। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।