আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প : সোনার নাকফুল

আমার ভিতরে আমি স্বতন্ত্র জীবন যাপন করি। ছবি : রাষ্ট্রপ্রধান। “আমারে একটা নাকফুল কিন্না দেও” রহিমার এমন আদুরে চাহিদাকে পাত্তাই দেয় না রহিমার মা আমেনা খাতুন। প্রথম দুএকবার চুপ থাকে। রহিমা তখন মাকে জড়িয়ে ধরে খুব আদুরে গলায় আবার বলে “মা ও মা বাপরে কও না একটা নাকফুল কিন্না দিতে” আমেনা এবার কথা না বলে থাকতে পারেন না।

মেয়ের মতই আদুরে গলায় “তোর যখন বিয়া অইবো তখন তোর শ্বশুড় তোরে দিব। বিয়া হইলে এটা পরতে অয়” -“আমি বিয়া করুম না” কিছুটা রাগ নিয়ে। সত্যিকার রাগ। এতটুকু মেয়ে বিয়ে নিয়ে কপট রাগ করা শেখেনি। -বিয়া না করলে ক্যামনে অইবো গো মা? -না আমারে নাকফুল কিন্না দিবা আমি কোহিনুরের লগে মাথায় ফিতা বাইন্ধা মেলায় বেড়াইতে যামু।

-তরে না গতবার মেলা থেইক্কা একটা নাকফুল কিইন্না দিছিল,ওইটাতো রাখতে পারলি না। এবার রহিমা কপট রাগ করে “হেইড্যাতো আছিল টিনের মশকরা,রং উইঠ্যা গেছিল। তারপর নষ্ট হইয়্যা গেছে। এইবার আমারে সোনার একটা নাকফুল কিন্না দিবা কইলাম” -সোনার নাকফুল কিন্না দিমু ক্যামনে আমগো কি হেই ক্ষমতা আছে? -না আমি কিছু জানিনা,আমারে হইলদা রংয়ের সোনার নাকফুল কিন্না দিতে হইবো। দেহ না কোহিনুর হইলদা নাকফুল দেয়” -আইচ্ছা তর বাপরে কমুনি হাঁট থেইক্কা নাকফুল কিন্না আনতে।

আশ্বাসের মাত্রা রহিমা জানেনা,তবে খুশীর মাত্রাটা তৎক্ষনাৎ ছড়িয়ে গেল। গতবার নাকফুল পেয়ে বিশম খাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। ১৫টাকা দিয়ে রহিমার বাবার আনা সে নাকফুল দশ বছর বয়সি রহিমার জীবনটা ক’দিনের জন্য রঙীন করে দিয়েছিল। নাকফুল আনার দুদিন আগেই রহিমা তার চাচীর কাছে নাকফুঁড়িয়ে এসেছিল। মুখে অনেকগুলা আমপাতা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল।

চাচী সুঁই দিয়ে নাক ফুটা করে দেয়। তারপর ফুটোয় কাঠি দিয়ে নাককে নাকফুল পড়ার উপযোগি করে তুলেছিল। শুকানোর পর নাকে নাকফুল দিয়ে রহিমা পুরো পাড়াময় ঘুরে বেড়াত। খেলার সাথীদের নাকফুল দেখানোর বিশেষ কাজটি ছাড়াও সারাদিন নাকফুল নিয়ে অনেক রকম কার্যকলাপ করত সে গোসল করার সময় নাকফুল খুলে রাখত রং উঠে যাবার ভয়ে। পুকুরে গোসল করার আগে সচ্ছ পানিতে নিজের নাকফুল মাখা মুখটা বারবার দেখত,ভেংচি কাটত।

তারপর নাকফুলকে সযতনে খুলে রেখে গোসল করত। লোকজন দেখেলেই রহিমার হাত চলে যেত নাকে। বার বার নাকে হাত দিত, নাক চুলকানোর নাম করে নিজের নাকফুলের অস্তিত্ব দেখিয়ে দিত। একই বাড়ীর কোহিনুরের সোনার নাকফুলের সাথে বারবার নিজের নাকফুল মেলাত। শেষ পর্যন্ত নাকফুলটি বেশীদিন টিকেনি।

নাকফুলের একপাশ হারিয়ে অকেজো হয়ে গিয়েছিল। তার আগে অবশ্য রং উঠে নাকফুলের করুণ দশা হয়ে গিয়েছিল। সোনার নাকফুলের দাবি প্রতিদিন সূর্য্য উঠার মত করে চলছিল। দিনে দুতিনবার নাকফুলের দাবি করে মাকে না জ্বালালে রহিমার ভাল লাগত না। সোনার নাকফুলের অপেক্ষা করতে করতে দুই বছর কেটে গেল।

কিন্তু একটি রুপোর বা তামার নাকফুলও জুটেনি নাকে। এর কারন যতটানা রহিমার বাবার দারিদ্রতা তারচে বেশী অবহেলা। রহিমার বাবা-মা হয়ত ভাবতেন এতটুকু মেয়ে নাকফুল দিয়ে কি করবে। কোন একদিন সকালে রহিমার ফুফু হঠাৎ করেই রহিমাদের বাড়ীতে এসেছে। ফুফুর সাথে রহিমার বাবা মায়ের ফিসফিস করে অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা রহিমা বুঝেনি।

সোনার নাকফুলের দাবি তখন কিছুটা ফিকে হলেও না নাকফুলকে নিয়ে মনের বাসনা বেশ ভালভাবেই মনে আছে। বাসনায় বজ্রপাত দিল রহিমার মা যখন বলল “আগামি শুক্করবার তর বিয়া। পোলা ঢাকায় কাম করে” রহিমা কেবল অবাক হয়েছিল। “আমি বিয়া বমু না” বলে ছুটে চলে গেল। বয়সের সাথে সাথে রহিমার ভাষা বৈশিষ্টও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

বিয়া করবে না বললে কি হবে এ সময়ে বার বছরের রহিমার ভরন পোষন অন্যের হাতে তুলে না দিলে রহিমার বাবার আর যে হচ্ছে না। সংসার টানতে গিয়ে হতশ্রী অবস্থা। মেয়ে যেহেতু হয়েছে,বিয়ে দিয়ে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার সুযোগতো আছেই । তাই যত দ্রুত চাপিয়ে দেয়া যায় ততই ভাল। তাই রহিমাকে রাজি হতেই হবে।

এক্ষেত্রে বাবা-মা সবসময় খাল-ফুফুদের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়। আমেনার ক্ষেত্রেও তাই হল। -দেখ তোর ভালা হইবো,ঢাকায় থাকতে পারবি। -না ঢাকায় যামু না -হুন বেটি,পোলায় তোরে ঘুরাইবো। পোলার নিজের কয়েকটা রিশকা আছে।

ভাড়া দেয়। তোরে টিপ,কিরিম,কাজল কিন্না দিব? রহিমা এবার চুপ। বাঙালী নারী সে যেই শ্রেণীর হোক না কেন প্রসাধনী সামগ্রীর উপর কিছুটা আগ্রহতো আছে। আর আমেনার মত কিশোরীর যে কিনা কোন প্রসাধনীই চোখে দেখেনি তার জন্য আগ্রহটা লোভে গিয়ে ঠেকেছে। কিছুক্ষন চুপ থাকার পর ফুফুর উদ্দেশ্যে “আচ্ছা ফুফু হে কি আমারে সোনার নাকফুল কিন্না দিব? -ওমা দিব না আবার ! নাকফুল ছাড়া কি বিয়া হইবো নাকি? রহিমা এবার উৎসাহিত হয়।

চোখ কিছুটা বড় করে জিজ্ঞেস করে “আইচ্ছা ফুফু ঢাকা শহর কি বিরাট বড়? ফুফু মুখে হাসি দিয়ে হ্যাঁ বলে,বুঝতে পারে রহিমা রাজি হয়ে গেছে। শুক্রবার রহিমার বিয়ে হল। তবে নাকে নাকফুল ছিল না। রহিমার বর জামাল মিয়া নাকফুল দেয়নি। তবে গায়ে মাখার ক্রিম,আলতা এসব দিয়েছে।

রহিমা অবশ্য কিছুই বলেনি। গত দুই বছর সোনার নাকফুলের জন্য অপেক্ষা করতে পেরেছে,আর ক’টা দিন ধৈর্য্য ধরতে দোষ কি? বাবার বাড়ী ছাড়ার সময় রহিমার কান্না কতটা নাকফুলের জন্য, কতটা বাবা মায়ের জন্য তা বোঝা যায়নি। যে কিশোরী নাকফুল নাকফুল বলে মায়ের আঁচল ছিড়তো,সংসারের দায়িত্ববোধে এখন তার নাকে বেয়ে ঘাম আসে। বিয়ের এক বছর হতেই রহিমা এক মেয়ের জন্ম দেয়। আদর করে তার নাম রেখেছে ফুল।

নাকে সোনার ফুল নেই তবে রহিমার বুকে ফুল আছে। এর মাঝে অবশ্যই রহিমা জেনে গেছে জামিল মিয়ার কোন রিকশা নেই। অন্যের রিকশা চালায় সে। সোনার নাকফুল কিনে দেয়ার সামর্থ্য নেই তার। এ নিয়ে কোন উচ্যবাচ্যও করেনি রহিমা।

ফুলের বয়স এখন সাত বছর। স্কুলে যাওয়ার বয়স হলেও স্কুলে যাওয়া তার শুরু হয়নি। রহিমা মনে মনে ঠিক করে রেখেছে আগামি বছর ফুলকে স্কুলে দিবে। কিন্তু তা কতটা সম্ভব জানেনা। একদিন বিকালে রহিমা তার বুয়ার কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার সাথে সাথে ফুল দৌড় দিয়ে আসল “মা মা আমারে একটা নাকফুল কিন্না দিবা? মেয়ের নাকফুলের কথায় রহিমার মায়ের মত ভুল করল না।

নিজের টিনের নাকফুলে হাত দিয়ে মেয়েকে বললেন “ দিমুরে মা দিমু। একটা হইলদা নাকফুল কিন্না দিমু” মায়ের আশ্বাস পেয়েই হইইই করে দৌড় দিয়ে বের হয়ে গেল। কিন্তু রহিমা জানেনা ফুলের নাকফুলের স্বপ্ন রহিমার নাকফুল স্বপ্নের টিনের নাকফুলের মত চাকচিক্যহীন কিনা অথবা পেটের দ্বায়ে অন্যের কাঁধে তুলে দিতে হবে কিনা? কেবল বয়স বাড়ার জন্য অপেক্ষা। এই শ্রেনীর বাবা-মা মেয়ের বয়স গুনেন,মনে মনে দোয়া করেন মেয়ে যাতে শরীরে বাড়ন্ত হয়। ফুলের পেটের দায়িত্বও হয়ত অন্যের হাতে তুলে দিতে পারলেই বাঁচেন রহিমা এবং জামাল মিয়া।

তবে মেয়েরে সোনার নাকফুল বানিয়ে দেয়ার স্বপ্ন ঠিকই মনে মনে করে রেখেছেন। গল্প থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। তবে একজনের উৎসাহে আবার গল্পে ফিরলাম। সে নিশাচর ভবঘুরে । এই গল্পও তার সাথে শেয়ার করে লেখা।

সোনার নাকফুল তাকে উৎসর্গ করলাম। নাকফুল একই সাথে চতুরে প্রকাশিত।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.