সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ প্রিয় স্বজন, প্রিয় সুহৃদ নাসরিন হক স্মরণে
একজন মানুষ সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠেন তখনই যখন একজন মানুষের বিবেক হয় স্বচ্ছ সৎ ও পবিত্র। একজন ভাল মানুষ যখন শিক্ষায়, মেধায়, মানবাধিকার আদর্শে মাথা উঁচু করে সাধারন মানুষের পাশে দাড়ায়-তখন বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষ আশার আলো দেখে। সেই আলোক বর্তিকা মানুষটি যখন হারিয়ে যায়-তখন আমাদের কষ্ট পাওয়া ভিন্ন কিছু করার থাকেনা। তেমনই একজন মানুষ প্রয়াত নাসরিন হক। নাসরিন হক একজন প্রত্যয়ী, কর্মদ্যোমী দরদী সমাজ সেবক ছিলেন-যা সচেতন মানুষের অজানা নেই।
তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই। তবে সেই শ্রদ্ধেয় মানুষটিকে খুব কাছে থেকে যতসামাণ্য দেখার সুযোগ হয়েছিল-তারই একটি ঘটনা আজ পাঠকদের সাথে শেয়ার করছি।
আমার বড় ছেলের বয়স যখন ৫/৬ বছর তখন মাঝে মধ্যে আমার সাথে মসজিদে যেতো নামাজ পড়তে। ছেলে বাসায় ওর আম্মুর কাছে আমপাড়া পড়া শিখেছে। কিন্তু আমাদের মসজিদের একজন ক্কারীয়ানা হুজুর ওকে আরবী পড়ানোর গৃহশিক্ষক হিসেবে নেয়ার জন্য পীড়াপিড়ীতে শেষ পর্যন্ত রাজী হই।
যখন ক্কারী সাহেব বাসায় এসে আমার ছেলেকে আরবী পড়াতে শুরু করে-তখন আমাদের ফ্ল্যাট বাড়ির ১০ টি পরিবারেরই অবিভাবকগন যারযার শিশু সন্তানকে একসাথে আরবী শিখাতে আগ্রহী হয়। সকলের সিদ্ধান্তমতে আমাদের বিল্ডিং এর ছাদে কমিউনিটি স্পেসে শিশুদের পড়ানোর ব্যবস্থা করাহয়। সৌজন্যতা সরুপ প্রতিদিনই হুজুরকে নানান খাবারে আপ্যায়ীত করা হতো। আপ্যায়ণের কাজটা সাধারনত প্রতি ফ্ল্যাটের গৃহ কর্মীরাই করতো।
আমাদের ফ্ল্যাট বিল্ডিং’র সেই সময়কার দশ ফ্ল্যাট বাসীন্দা সম্পর্কে একটু ধারনা দিচ্ছিঃ দুই জন ব্যবসায়ী, দুইজন জন সচিব পদমর্যাদার সরকারী চাকুরে,একজন প্রবাসী শিক্ষাবিদ, একজন উচ্চপদস্থ্য ব্যাংকার, একজন ইউনাটেড নেশন’র উচ্চপদস্থ্য অফিসার এবং একজন এনজিও’র উচ্চ পদস্থ্য নারী কর্মকর্তা।
৯ জন মালিকের ১০ টি ফ্ল্যাট। গৃহিনীদের পরিচয়ঃ ২ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,একজন উপ সচিব,একজন সরকারী কলেজ শিক্ষক,একজন একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল শিক্ষক, একজন ব্যাংকার,একজন এনজিও’র হাই অফিশিয়াল একজন হাউজ ওয়াইফ। এনজিও নেতৃ সম্পর্কে একটু ধারনা দেই-এই এনজিও নেতৃর নাম ‘নাসরিন হক’।
নাসরিন হক আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে হেলেন ব্রাক, হেলেন ক্লার্ক ইন্টারন্যাশনাল, এসিড সার্ভাইভার্স হিসেবে কাজ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন এবং “য়্যাকশন এইড-বাংলাদেশ” এর কান্ট্রি ডাইরেক্টর থাকা অবস্থায় উনার নিজ ফ্ল্যাট বাড়ির গ্যারাজে নিজ ড্রাইভারের অসতর্কতায়/বিতর্কিত দূর্ঘটনায় ২০০৬ সনের ২৪ এপ্রিল মর্মান্তিক মৃত্যু বরন করেছিলেন। নাসরিন হক বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগে আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র ছিলেন, আমাদের সম্পর্কটা ছিল ভাই বোনের।
আবার নাসরিন আপুর ছোট বোন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার স্ত্রীর ক্লাশমেট। যখন আমার স্ত্রী উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকাতে ছিলেন-তখন নাসরিন আপু ছিলেন আমেরিকাতে তার অভিভাবক। এক কথায় নাসরিন আপু ছিলেন আমার ছোট্ট পরিবারের পরম স্বজন, পরম সুহৃদ। নাসরিন আপু বিদেশ থেকে এসে আমাদের একই ফ্ল্যাট বিল্ডিং এর একটি ফ্ল্যাটে বাস করেছিলেন প্রায় দুই বছর। আমাদের একজন ফ্ল্যাট মালিকের নাম মনে করা যাক-ম রহমান যিনি বিখ্যাত মোটর পার্টস ইম্পোর্টার এবং ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির সাথে জড়িত।
তিনি স্বল্প শিক্ষিত হলেও ব্যবসায়ী হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত। তার স্ত্রীও মস্তবড় লেডি হুজুর। যিনি স্বল্প শিক্ষিত হয়েও উচ্চ শিক্ষিত অন্য সকল মহিলাদের আল্লাহর রাস্তায় আনতে ‘হেদায়েত’ করতে কসুর করেননা। তিনি অন্য সকলকে সপ্তাহে একবার হুজুরের ‘বয়ান’ শোনার প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।
উক্ত “লেডি হুজুর” এর সাথে হুজুরের খুব ভাব! তাঁর মাধ্যমে হুজুর আরজ পেশ করলেন-“গৃহ কর্মীরা আর্থীক কারনে পড়া লেখা করতে পারেনি।
এখন গৃহ কর্তাদের নৈতিক দ্বায়িত্ব ঐসব মেয়েদের অন্তত আল্লাপাকের কালাম শিখিয়ে “দোজাহানের অশেষ নেকী হাসিল” করার সুযোগ নেয়া। মুলত হুজুরের কথায় নয়-প্রত্যেকেই নৈতিক দ্বায়িত্ববোধেই যারযার গৃহকর্মীদেরও আমাদের সন্তানদের সাথে আরবী শেখানোর দ্বায়িত্ব দেয়া হয়।
আগেই বলেছি- ম রহমান গিন্নীর সাথে হুজুরের খুব ভাব(সম্ভবত একই রাজনৈতিক দর্শনের কারন)! স্ব ইচ্ছায় তিনি হুজুরের সাথে বাচ্চাদের আরবী শেখা তদারকী করেন। অন্যদের সাথে চারটি মেয়ে শিশু গৃহকর্মী হুজুরের নিকট আরবী পড়ে-বিশেষ করে অজু করা, সুরা ও নামাজের নিয়ম কানুন শেখে। অভিযোগ-নাসরিন হক আপুর আশ্রিত ঝর্না নামের ১৩/১৪ বছরের কিছুটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মেয়েকেই হুজুর বেশী শেখায়(নাসরিন আপুর বাসায় অনেক অসহায় এসিড দগ্ধ মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছেন)।
প্রাক্টিক্যাল অজু শেখাতে বাথ রুমে নিয়ে যান। মেয়েটি কান্না করতে করতে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে আসে। হুজুর পড়ার রুমে এসে সকলের সামনে শাসিয়ে বলে-“"ঝর্না,তুমি কথা না শোনলে আরো মারবো,বেদ্দপ মেয়েছেলে”!"
নাসরিন আপু কর্মব্যাস্ত মানুষ, বাসায় ফেরেন বেশ রাতকরেই। পরদিন থেকে ঝর্না আর পড়তে যেতে চায়না। কিন্তু জামাত গিন্নী ঝর্নাকে জোড় করে পড়তে পাঠায়।
মেয়েটি অন্য পড়ুয়াদের সামনে হুজুরকে বলে-“"আমি খালাম্মাকে বলে দেবো"”।
তখন হুজুর কোরআন পড়ার সুরে/স্টাইলে বলে-“"আল্লাহহুম্মা ছল্লেয়ালা-সাইয়্যেদেনা…ঐসব কথা বলতে মানা...। ও বান্দাআআআআআআআ, এইইই সব্বব্বব কথাআআআআ কাউকে বললেলেলে হাবিয়া দোজখের আগুনে হাজার বছর জৈলা পুইড়া মরতে হইবে। তোমার মুখ দিয়া কুত্তার বিস্টার গন্ধ বাইর হইবে,তোমার জিহব্বা চৌদ্দ হাত লম্বা হইয়া ঝুইল্ল্যা থাকবে......। ও গুণাগার আওরাত, আর একবারও ঐ কথা মুখে আনবানানানানানানা-আল্লাহ হুম্মাআ ছললে আলা সাইয়্যাদেনা"……।
”
দিনে দিনে ঝর্না মেয়েটি ভয়ে জড়োসরো হয়ে গুটিয়ে থাকে। হুজুরের সব ক্ষুদে পড়ুয়ারা সুর করা ঐ বিশেষ দো'আটাও মুখস্ত করে ফেলে! কিন্তু আমাদের চৌকশ কেয়ার টেকার বিষয়টা “টেক কেয়ার” করে ফেলে। জানাজানি হয়ে যায় সব গৃহকর্তাদের মাঝেও। সিদ্ধান্ত হলো হুজুরকে বিদায় করে দেয়া হবে। কিন্তু নাসরিন আপুর নেতৃত্বে নারীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন-হুজুরকে “মেরামত” করে বিদায় দেবে।
ফ্ল্যাটের পুরুষরা সন্ধার আগে সাধারনত কেউ বাড়ি ফেরেনা। নাসরিন আপুর নেতৃত্বে সকল নারীদের পরিকল্পনায় একদিন শুধু গৃহ কর্মীদের সাথে ঝর্নাও পড়তে এলো। হুজুরতো মহা খুশী! ঝর্ণা যখনই বললো-“"আমি খালাম্মাদের সব বলেদেবো......…”"
অমনি হুজুর বলেন-"“বেদ্দপ আওরাত,আর একটা কতা কৈলি আঁই তর গলা টিপি মারি ফালাইম......"। সেই আগেরমতই কোরআন পড়ার সুর করে বলেন-"আল্লাহহুম্মা সল্লেয়ালা-সাইয়্যেদেনা…ঐসব কথা বলতে মানা…আল্লহুম্মা সল্লেয়ালা-ঐসব কথা বলতে মানা............
……”
পাশে অপেক্ষমান নারীদের স্যান্ডাল পিটুনীতে যখন হুজুর ধরাশায়ী তখন শুরু হলো কেয়ার টেকার’র এর ‘টেক কেয়ার’ এবং সিকিউরিটি গার্ডদের বুটের লাথী…… অবশেষে হুজুর ঐ মুহুর্তেই এলাকা ছাড়া!
ঘটনার পর নাসরিন আপু বলেছিলেন-“"এই ধরনের মৌ লোভী’দের জন্য ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে মানুষের মনে ভুল ধারনা জন্ম নেয়। কিন্তু ঐ কাঠ মোল্লারাই যে ইসলাম ধর্মে কেউনা-সেকথা অনেকেই আমলে নেইনা”"।
নাসরিন আপুর সোস্যাল এক্টিভিটি বেড়ে যাওয়ায় দিন রাত বাড়িতে সমস্যাগ্রস্থ্য মানুষের প্রচন্ড ভীড় হতে থাকলে আমাদের ফ্ল্যাট ছেড়ে একটু দুরেই অন্য একটি ফ্ল্যাটে চলে যান। ২৪ এপ্রিল ২০০৬ অজস্র নির্যাতিত অসহায় নারীর অবলম্বন সকলের প্রিয় নাসরিন আপু, আমার প্রিয় সুহৃদ নাসরিন আপু চলে গিয়েছেন নাফেরার দেশে। রেখে গিয়েছেন অনেক স্মৃতি। মানুষের জন্য তাঁর অফুরান ভালবাসা আর অসংখ্য মহৎ কাজ নিয়ে আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
আপু, তোমাকে খুব মিস করি।
যেখানেই থাকো ভাল থেকো। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।