আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গীতার শুরু এবং শেষে যেভাবে কালেমা এবং মুহাম্মাদ সা. সংযোজন করা হল

পথ্য তো রোগীরও লাগে না ভালো! যদিও এটা তার রোগ সারিয়ে তুলতে সাহায্য করবে,তথাপিও! যে গীতার কথা বলছিলাম 'যথার্থ গীতা'। ভাষার দিক থেকে বলুন কিংবা শ্লোকের দিক থেকে বলুন পুরাপুরিই অপরিবর্তনীয়। পূর্বগুলির সাথে তেমন কোন পার্থক্যই চোখে পড়ে না। গীতা শাস্ত্রী শ্রীজগদীশ চন্দ্র ঘোষ এবং শ্রী স্বামী শিবানানন্দের গীতায় যা রয়েছে, এটাতেও তাই রয়েছে, ছকে বাঁধা ৭০০ শ্লোক, ১৮ অধ্যায়, ভাষা সংস্কৃত, অনুবাদ হিন্দি কিংবা বাংলা অথবা ইংরেজি। অনুবাদে কিছুটা তারতম্য থাকলেও মূল ভাবধারায় তেমন কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না।

তবে এটাকে যথার্থ বলার কারণ কি, তবে কি পূর্বগুলি যথার্থ ছিল না? লেখকের নামে ভিন্নতা রয়েছে বটে কিন্তু কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের কাছে শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত গদগুলো কৃষ্ণকালীনমুনি মহর্ষি বেদব্যাস দ্বারা শ্রুত হয়ে স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয়ে কালে কালে একইভাবে লিখিত হয়ে আসছে একই ধারায়, গতানুগতিকভাবে লিখিত এই গীতাগুলোর একটিতেও মুসলিম কিংবা জনাব মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কিত কিছু পাওয়া না গেলেও 'যথার্থ গীতা' নামক গীতার শুরু এবং শেষে সুপরিকল্পিকভাবে মুসলিম এবং জনাব মুহাম্মাদের নাম সংযোজন করা হয়েছে। আর এটাই বুঝি গতানুগতিক গীতাকে নব্যরূপ প্রদান করেছে 'যথার্থ গীতা' নামে। আসুন দেখা যাক, 'যথার্থ গীতা' তে কালেমা এবং মুহাম্মদ সা. সর্ম্পকে কি বলা হয়েছে? 'যথার্থ গীতার' শুরুতে (সুচিপত্রের পূর্বে) প্রাককথনে কালেমার অর্থ করা হয়েছে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ'- প্রতিটি অণু-পরমানুতে খোদা (ঈশ্বর) পরিব্যাপ্ত, একমাত্র তিনিই পূজনীয়। মুহাম্মাদ আল্লাহর সংবাদবাহক।

(স্বামী অড়গড়ানন্দ লিখিত, ২৪ শে জুলাই, ১৯৮৩ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত যথার্থ গীতার প্রাককথন (ক-ণ) এবং উপসংহার পৃষ্ঠা ৩৫১-৩৫৭ দ্রষ্টব্য) উপরোক্ত অনুবাদে খোদা/ঈশ্বর টীকা-১ দেখুন শব্দ দু'টি ব্যবহার করা হয়েছে যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার গুণবাচক নিরানব্বই নামের মধ্যে পরে না। তবে পারিভাষিক অর্থে অনুবাদের তাগিদে উক্ত শব্দ ব্যবহার করাতে কোন ওযর বা আপত্তি নেই কিন্তু যখন বলা হয় প্রতিটি অণুতে-পরমাণুতে তখনই বিকৃতির শুরু। এভাবে একে একে বহু ইশ্বর আমার উপাস্যের আসন দখল করতে আসে। সাড়ে তেত্রিশকোটি উপাস্যের আদলে উক্ত অনুবাদটি যথার্থই বটে? লা = নেই/নাই, ইলাহা = ইলাহ/উপাস্য, ইল্লাল্লাহ = আল্লাহ ছাড়া/ব্যতীত ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) এর মতে, "যে বিশ্বাস করে না যে আল্লাহ স্ব-সত্ত্বায় আরশের উপরে আছেন (অর্থাৎ বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ স্ব-সত্ত্বায় সর্বত্র বিরাজমান) সে কাফির। " টীকা-২ দেখুন (মুখতাসার আলউ'লু ১৩৬ পৃঃ) উল্লেখ্য 'স্রষ্টা সর্বত্র বিরাজমান' কথাটি গীতার ১১ অধ্যায়ের ৩৮ নং শ্লোকের আদলে জুড়ে দেওয়া হয়েছে টীকা-২ দেখুন।

এবার আসুন দেখা যাক বেহেস্তী হুর এবং জনাব মুহাম্মাদ সা. এর স্ত্রী- বিষয়ক অবিবেচনা সম্পর্কে যথার্থ গীতার উপসংহারে কি বলা হয়েছে? "অবিকশিত ও পথভ্রষ্ট গোষ্ঠীগুলিকে সভ্য করার জন্য মহম্মদ বিবাহ, তালাক, উইলের কাগজ দেনা-পাওনা, সুদ, সাক্ষী, প্রতিজ্ঞা, প্রায়শ্চিত্ত, অন্নসংস্থান এবং মূর্তিপূজা, ব্যভিচার, চুরি, মদ, জুয়া, মা-ঠাকুরমার সঙ্গে বিবাহ করতে নিষেধ করেছিলেন। সমলৈঙ্গিক এবং রজস্বলা স্ত্রীর সঙ্গে মৈথুন নিষেধ করে, রোজার দিনগুলিতেও এই নিয়ম শিথিল করেছিলেন। স্বর্গে বহু সমবয়স্ক, অপূর্ব সুন্দরী ও কিশোর বালকদের প্রলোভন দিয়েছিলেন। এটা ধর্ম ছিল না, এক প্রকারের সামাজিক ব্যবস্থা ছিল। এইরুপ কিছু কিছু বলে তিনি বাসনায় নিমজ্জিত সমাজকে সেদিক থেকে বিমুখ করে নিজের দিকে উন্মুখ করার চেষ্টা করেছিলেন।

স্ত্রী-জাতিকে নিয়ে কোন চিন্ত্মাই করেননি যে, তারা স্বর্গে গিয়ে কতগুলো পুরুষ লাভ করবে?" 'যথার্থ গীতা'র এই অযথার্থ বক্তব্যের দ্বারা বোঝা যাচ্ছে রাসূলুল্লাহ সা. এবং ইসলাম পরকালের ব্যাপারে নারীদেরকে ঠকিয়েছে। পুরুষদেরকে বেশি পুরস্কার দিয়েছে এবং নারীদেরকে বঞ্চিত করেছে। অথচ বাস্ত্মবতা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামই একমাত্র জীবন ব্যবস্থা যা নারী জাতিকে এই দুনিয়ার জীবনে এবং পরকালীন জীবনে তাদের প্রকৃত সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করেছে। মহানবী সা. ই একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যিনি নারী জাতিকে লাঞ্চনা অবমাননার অতল থেকে তুলে এনে তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের সকল সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার।

দুনিয়ার জীবনে নারী জাতির সম্মান, মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়টি অন্য কোথাও আলোচনা করা যাবে এখানে কেবল উপরোক্ত আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিক পরকালীন জীবনে নারীদের ব্যাপারে ইসলামের বক্তব্য তুলে ধরা হচ্ছে। ইসলামের দৃষ্টিতে। পৃথিবীর সকল সৃষ্টির মধ্যে সেরা সৃষ্টি হচ্ছে মানুষ। একজন মানুষ তার বিশ্বাস ও কর্মের আলোকেই মহান আল্লাহর কাছে মূল্যায়িত হবে। জন্মগতভাবে সে কি পুরুষ, না নারী -পরকালীন সফলতা-ব্যর্থতার ক্ষেত্রে সেটি মুখ্য নয়।

ইরশাদ হয়েছে, يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ. অর্থ: "হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। " (সুরা আল-হুজরাত: ১৩) আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ ও সফল হওয়ার মানদন্ড নির্ধারণ করা হয়েছে তাকওয়া তথা খোদভীতিকে। তাই একজন নারী একজন পুরুষ হতেও শ্রেষ্ঠ হতে পারে।

উপরের আয়াতে এ বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে পুরুষদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। অপর এক আয়াতে সৎকর্মশীল পুরুষ এবং নারী উভয়ের জন্যই পরকালে সমান প্রতিদানের অঙ্গীকার করে ঘোষণা করা হয়েছে, مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ. অর্থ: "যে মুমিন অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমি তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব। " (সুরা আন-নাহল: আয়াত ৯৭) আরো ইরশাদ হয়েছে, وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا. অর্থ: "আর পুরুষ কিংবা নারীর মধ্য থেকে যে নেককাজ করবে এমতাবস্থায় যে, সে মুমিন, তাহলে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি খেজুরবীচির আবরণ পরিমাণ যুল্‌মও করা হবে না। " (সুরা নিসা: আয়াত ১২৪) অন্যত্র আরো ইরশাদ হয়েছে, إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا. অর্থ: "নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও নারী, মুমিন পুরুষ ও নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, বিনয়াবনত পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, সিয়ামপালনকারী পুরুষ ও নারী, নিজদের লজ্জাস্থানের হিফাযতকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, তাদের জন্য আল্লাহ মাগফিরাত ও মহান প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন। " (সুরা আহযাব: আয়াত ৩৫) উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা এটা পরিস্কার হয়ে গেছে যে, ইসলাম বা মহানবী সা. পরকালীন জীবনের কল্যাণ ও পুরস্কার লাভের ক্ষেত্রে নারী জাতির প্রতি বিরূপ কোনো আচরণ করে নি।

বরং পুরুষের মতোই তার জন্যও সমান সুযোগ ও সফলতার দ্বার উন্মুক্ত করে রেখেছে। জান্নাতী পুরুষ হোক বা নারী -তার জন্য সমান পুরস্কার ও নিয়ামতের ব্যবস্থা থাকবে। জান্নাতীরা যা চাইবে, তাই পাবে। তাদের সকল কামনা-বাসনাই মহান আল্লাহ তা'আলা পূর্ণ করবেন। কোনো কিছুরই অপূর্ণতা থাকবে না।

বিষয়টি পরিস্কার করে দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, وَأَمْدَدْنَاهُمْ بِفَاكِهَةٍ وَلَحْمٍ مِمَّا يَشْتَهُونَ (২২) অর্থ: "আর আমি জান্নাতীদেরকে অতিরিক্ত দেব তাদেরর ইচ্ছানুরূপ ফলমূল ও গোশ্‌ত (তারা যা চাইবে, যতো চাইবে)। " (সূরা তূর, আয়াত ২১) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي ظِلالٍ وَعُيُونٍ (৪১) وَفَوَاكِهَ مِمَّا يَشْتَهُونَ (৪২) كُلُوا وَاشْرَبُوا هَنِيئًا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ (৪৩) إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ (৪৪) অর্থ: "আর নিজদের বাসনানুযায়ী ফলমূল-এর মধ্যে। (তাদেরকে বলা হবে) 'তোমরা যে আমল করতে তার প্রতিদানস্বরূপ তৃপ্তির সাথে পানাহার করো। সৎকর্মশীলদের আমরা এমন-ই প্রতিদান দিয়ে থাকি। " (সূরা মুরসালাত, আয়াত ৪১-৪৪) এবার আসুন দেখা যাক, হুর সম্পর্কিত কুরআন কি বলে? প্রিয়নবী সা. সাহাবীদেরকে জান্নাতের নিয়ামত সম্পর্কে তাই বলেছেন, যা তাঁকে মহান আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন।

আর রাসূলের উপর ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ কুরআন আজ পর্যন্ত্ম সম্পূর্ণ অক্ষত, অপরিবর্তনীয় হয়ে আছে আমাদের মাঝে। পবিত্র কুরআনের চার জায়গায় হুর এর কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে যথাক্রমে: حُورٌ مَقْصُورَاتٌ فِي الْخِيَامِ (৭২) فَبِأَيِّ آَلاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (৭৩) অর্থ: "জান্নাতীদের জন্য থাকবে হূর, তাঁবুতে থাকবে সুরক্ষিতা। সুতরাং তোমাদের রবের কোন্‌ নিআমতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে?" (সূরা আর রাহমান, আয়াত ৭২-৭৩) অন্যত্র- وَفَاكِهَةٍ مِمَّا يَتَخَيَّرُونَ (২০) وَلَحْمِ طَيْرٍ مِمَّا يَشْتَهُونَ (২১) وَحُورٌ عِينٌ (২২) كَأَمْثَالِ اللُّؤْلُؤِ الْمَكْنُونِ (২৩) جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (২৪) অর্থ: "আর জান্নাতীদের জন্য থাকবে তাদের পছন্দমত ফল। আর পাখির গোশ্‌ত তাদের চাহিদা মতো।

আর থাকবে ডাগরচোখা হূর -যেন তারা সুরক্ষিত মুক্তা। এসকল কিছু (দুনিয়াতে তাদেরকৃত) আমলের প্রতিদান। " (সূরা ওয়াকিয়া, আয়াত ২০-২৪) উপরোক্ত দুই আয়াতে জান্নাতীদের জন্য এক বিশেষ নিয়ামত বা হুর প্রদানের কথা বলা হয়েছে। নিম্নের দুই আয়াতে এই হুরদের সাথে জান্নাতীদের বিবাহের কথা বলে ঘোষণা করা হয়েছে, إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي مَقَامٍ أَمِينٍ (৫১) فِي جَنَّاتٍ وَعُيُونٍ (৫২) يَلْبَسُونَ مِنْ سُنْدُسٍ وَإِسْتَبْرَقٍ مُتَقَابِلِينَ (৫৩) كَذَلِكَ وَزَوَّجْنَاهُمْ بِحُورٍ عِينٍ (৫৪) يَدْعُونَ فِيهَا بِكُلِّ فَاكِهَةٍ آَمِنِينَ (৫৫) অর্থ: "নিশ্চয় মুত্তাকীরা থাকবে নিরাপদ স্থানে। বাগ-বাগিচা ও ঝর্ণাধারার মধ্যে।

তারা পরিধান করবে পাতলা ও পুরু রেশমী বস্ত্র এবং বসবে মুখোমুখী হয়ে। এরূপই ঘটবে, আর আমি তাদেরকে বিয়ে দেব ডাগর নয়না হূরদের সাথে। সেখানে তারা প্রশান্তচিত্তে সকল প্রকারের ফলমূল আনতে বলবে। " (সূরা দুখান, আয়াত ৫৪) অন্যত্র বলা হয়েছে, إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَنَعِيمٍ (১৭) فَاكِهِينَ بِمَا آَتَاهُمْ رَبُّهُمْ وَوَقَاهُمْ رَبُّهُمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ (১৮) كُلُوا وَاشْرَبُوا هَنِيئًا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ (১৯) مُتَّكِئِينَ عَلَى سُرُرٍ مَصْفُوفَةٍ وَزَوَّجْنَاهُمْ بِحُورٍ عِينٍ (২০) অর্থ: "নিশ্চয় মুত্তাকীরা (থাকবে) জান্নাতে ও প্রাচুর্যে। তাদের রব তাদেরকে যা দিয়েছেন তা উপভোগ করবে, আর তাদের রব তাদেরকে বাঁচাবেন জ্বলন্ত আগুনের আযাব থেকে।

তোমরা তৃপ্তি সহকারে খাও ও পান কর, তোমরা যে আমল করতে তার বিনিময়ে। সারিবদ্ধ পালঙ্কে তারা হেলান দিয়ে বসবে; আর আমি তাদেরকে মিলিয়ে দেব ডাগরচোখা হূর-এর সাথে। " (সূরা তূর, আয়াত ১৭-২০) হুর শব্দটির অর্থ কি? যার দু'টি অর্থ 'আহওয়ার' এবং 'হাওয়ার'। প্রথমটি পুরুষের ক্ষেত্রে আর পরেরটি মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর হুর শব্দটি বৈশিষ্ট্য বহন করে 'হাওয়ার'-এর।

এ শব্দটি দ্বারা বড়, সাদা, সুন্দর চোখ এবং বিশেষত: সাদা রং-কে বোঝায়। কোরআনের বিভিন্ন স্থানে জান্নাতীদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার ও পুরস্কার হিসেবে সুরা বাকারার ২৫ ও নিসার ৫৭ নং আয়াতে "আযওয়াজুম মুতাহহারা" প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, وَبَشِّرِ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ كُلَّمَا رُزِقُوا مِنْهَا مِنْ ثَمَرَةٍ رِزْقًا قَالُوا هَذَا الَّذِي رُزِقْنَا مِنْ قَبْلُ وَأُتُوا بِهِ مُتَشَابِهًا وَلَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَهُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (২৫) অর্থ: আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে তুমি তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। যখনই তাদেরকে জান্নাত থেকে কোন ফল খেতে দেয়া হবে, তারা বলবে, 'এটা তো পূর্বে আমাদেরকে খেতে দেয়া হয়েছিল'। আর তাদেরকে তা দেয়া হবে সাদৃশ্যপূর্ণ করে এবং তাদের জন্য তাতে থাকবে পূতঃপবিত্র সঙ্গী।

এবং তারা সেখানে হবে স্থায়ী। " (সূরা বাকারা, আয়াত ২৫) وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا لَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَنُدْخِلُهُمْ ظِلًّا ظَلِيلًا (৫৭) অর্থ: "আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, অচিরেই আমি তাদেরকে প্রবেশ করাব জান্নাতসমূহে, যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা হবে স্থায়ী। সেখানে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্র স্ত্রীগণ এবং তাদেরকে আমি প্রবেশ করাব বিস্তৃত ঘন ছায়ায়। " (সূরা নিসা, আয়াত ৫৭) উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে ব্যবহৃত "আযওয়াজ" এবং এর পূর্বে উল্লেখিত হুরদের সাথে বিবাহ দেয়ার বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত 'যাওজ' শব্দের অর্থ হলো সঙ্গী বা সাথী।

কোরআনের অনুবাদকারী মুহাম্মাদ আসাদ তার অনুবাদে হুরের অনুবাদ করেছেন 'ঝঢ়ড়ঁংব্থ (বিপরীত লিঙ্গের সাথী) এবং জনাব আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী সাহেব তার অনুবাদে হুর শব্দটির অনুবাদ করেছেন 'ঈড়সঢ়ধহরড়হ' বা সঙ্গী হিসেবে। অতএব, হুরের অর্থ হলো সঙ্গী বা সাথী। এই হিসেবে অনেক মুফাসসিরীন জান্নাতে হুর পাওয়ার ব্যাপারে বলেছেন যে জান্নাতে পুরুষের জন্য বড় সুন্দর চোখ বিশিষ্ট নারী আর নারীদের জন্য বড় সুন্দর চোখ বিশিষ্ট সুদর্শন পুরুষ থাকবে। আবার অনেকে মত ব্যক্ত করেছেন এই বলে যে, জান্নাতে জান্নাতীদের সকল চাওয়া পাওয়া পূর্ণ করা হবে। সেখানে জান্নাতী মহিলারা তাদের স্বামীদের নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে।

অন্য পুরুষ সঙ্গীর কোনো প্রয়োজন বা চাহিদা তারা অনুভব করবে না। তাছাড়া, মুহাম্মাদের উপর নাযিলকৃত কিতাবের কোথাও কোন সংখ্যা উল্লেখ করে বলা হয়নি যে পুরুষগণ এত এত সংখ্যায় বড় সুন্দর চোখ বিশিষ্ট রমণী পাবেন? সুতরাং, "তারা স্বর্গে গিয়ে কতগুলো পুরুষ লাভ করবে?" কথাটির যথার্থতা 'যথার্থ গীতা'র কোথায়? এমন নির্বুদ্ধিতা ও বোকার মতো হাস্যকর বক্তব্য কোনো ঐশী গ্রন্থে থাকতে পারে না। এটা কেবল বিভ্রান্ত মানুষদের তৈরী মানহীন কিচ্ছা-কাহিনীতেই মানায়। এবার দেখি জান্নাতে হুর বা স্ত্রী গ্রহণের সংখ্যা সম্পর্কে কি বলা হয়েছে কোরআনে? পবিত্র কোরআনের যে চার জায়গায় হুর ("আযওয়াজুম মুতাহহারা/ 'আহওয়ার' এবং 'হাওয়ার') সম্পর্কে বলা হয়েছে তার কোনটিতেই নির্দিষ্ট সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। তবে একথা স্বীকার্য যে হাদীসে এর সংখ্যা মিলে।

তবে, কিছু কিছু হাদীস সম্পর্কে মতভেদও রয়েছে, জাল, জইফ এবং মুখরোচক হাদীস সমাজের যত্রতত্র প্রচলিত রয়েছে। হাদীসে ৭০ বা ৭২ সংখ্যা মিললেও বাইবেলের এই সংখ্যা কিন্তু ৭০ এর চেয়ে বেশী এবং তা নির্দিষ্ট করেই বলা হয়েছে। এখানে গীতার কথা বলা হল না এই কারণে যে গীতা জাতিস্মর (পুন:জন্ম) মতবাদের কথা বলে, আর গীতা মতে এই ধরণীর গুরুত্ব সর্বাধিক। তাই তো পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পাপীরা বারবার ফিরে আসে এই ধরণীর বুকে, আবার প্রায়শ্চিত্ত হবার পর পুণ্যময় আত্মা মানুষ রুপে ফিরে আসে একই ধরণীতে। সুতরাং স্বতন্ত্র অপর কোন নরকের অস্তিত্ব থাকার কি প্রয়োজন? যেখানে স্বর্গের পাত্তা নেই সেখানে কে কত সংখ্যায় নারী বা পুরুষ পাবে সে বিচার-বিশ্লেষণের কি দরকার? কেননা, 'যথার্থ গীতায়' স্বর্গ সম্পর্কে বলা হয়েছে 'ন-অস্তি' (এ অধ্যায়ের শেষে দেখুন) যেগুলোর অস্তিত্ব নেই।

আসুন বাইবেলের কথায় ফিরে আসি। বাইবেলে বলা হয়েছে ১০০ গুণের কথা। একজন স্ত্রীর পরিবর্তে দেওয়া হবে ১০০টি। ম্যাথিউ রচিত সুসমাচারের ১৯ নম্বর অধ্যায়ের ২৭,২৮,২৯ নং গদে সদাপ্রভু ঈশ্বরের বার্তা বাহক সত্যের আত্মা মসীহ তার অনুচারীদের প্রশ্নের উত্তরে বললেন: পৃথিবীতে আমার অনুসরণ করতে গিয়ে একজন স্ত্রী ত্যাগ করলে জান্নাতে তোমরা ১০০ গুণ বেশী পাবে। Mathew 19[27] Then answered Peter and said unto him, Behold, we have forsaken all, and followed thee; what shall we have therefore? 28 And Jesus said unto them, Verily I say unto you, That ye which have followed me, in the regeneration when the Son of man shall sit in the throne of his glory, ye also shall sit upon twelve thrones, judging the twelve tribes of Israel. 29 And every one that hath forsaken houses, or brethren, or sisters, or father, or mother, or wife, or children, or lands, for my name’s sake, shall receive a hundredfold, and shall inherit everlasting life. ১৯:২৭ তখন পিতা তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'দেখুন, আমরা সবকিছুই ত্যাগ করে আপনার অনুসরণ করেছি; তবে আমরা কী পাব?' ২৮ যীশু তাঁদের বললনে, 'আমি তোমাদের সত্যি বলছি, তোমরা সকলে যারা আমার অনুগামী হয়েছ, নবসৃষ্টি-কালে যখন মানবপুত্র নিজের গৌরবের সিংহাসনে আসীন হবেন, তখন তোমরাও ইস্রায়েলের বারোটা গোষ্ঠির বিচার করার জন্য বারোটা সিংহাসনে আসন নেবে।

২৯ আর যে কেউ আমার নামের জন্য বাড়ি, কি ভাই, কি বোন, কি পতি, কি মাতা, কি স্ত্রী, কি জমি-জমা ত্যাগ করেছে, সে তার শতগুণ পাবে, ও উত্তরাধিকাররূপে অনন্ত্ম জীবন পাবে। " (ম্যাথিউ ১৯ নম্বর অধ্যায়, ২৭-২৯ নং গদ) প্রধান প্রধান ধর্মগুলি পরমেশ্বরের সাথে সাথে স্বর্গ-নরকের অস্ত্মিত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করলেও 'যথার্থ গীতা' কেন 'ন-অস্ত্মির' দাবিতে বলবৎ রয়ে গেল? আসুন দেখা যাক 'ন-অস্ত্মি' সম্পর্কে যথার্থ গীতা কি বলে: মূল মনুস্মৃতি গীতা একমাত্র পরমাত্মাকে সত্য বলে, তাঁতে বিলীন করিয়ে দেয়। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত প্রায় ১৬৪ টি স্মৃতিতে পরমাত্মাকে লাভ করার উপায়ের উপর আলোকপাত করা হয়নি এমনকি পরমাত্মার নাম উল্লেখ পর্যন্ত্ম করা হয় না। স্বর্গপ্রাপ্তির প্রলোভন দেখায়। "ন অস্ত্মি"- যেগুলির অস্ত্মিত্ব নেই সে সমস্ত্ম লাভেরই জন্য প্রোৎসাহিত করে।

-যদি স্বর্গের কোন অস্ত্মিত্ব নাহি থাকে, তবে স্বতন্ত্র কোন নরকেরও অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। আবার এই পৃথিবীকেই যদি নরক বলা হয় তবে কোন অপরাধে সকল সৃষ্টি নরকে? (কেননা, গীতার উপসংহার বলা হয়েছে: শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, বহু চিত্তবিভ্রান্ত, মোহজালে আবৃত আসুরী স্বভাবযুক্ত মানুষ অপবিত্র নরকে পতিত হয়। প্রশ্ন স্বাভাবিক যে, নরক কিরুপ ও কাকে বলে? এই ক্রমেই স্পষ্ট করেন যে, যারা আমাকে দ্বেষ করে, সেই নরাধমদিগকে আমি বারংবার আসুরী যোনিতে নিক্ষিপ্ত করি, অজস্র আসুরী যোনিতে নিক্ষেপ করি। এটাই নরক। নরকের দ্বার কি? বলেছেন- কাম, ক্রোধ ও লোভ এই তিনটি নরকের দ্বার স্বরূপ [গীতা-১৬ : ১৯-২১]।

এদের সাহায্যেই আসুরী সম্পদের গঠন হয়। অতএব বারংবার কীট-পতঙ্গ, পশু ইত্যাদি যোনিতে জন্মগ্রহণ করাই নরক। ") তাহলে অপর কথায় জগতের সকল কীট-পতঙ্গ আর পশুরা নরক! তবে, পুরুষ কীট-পতঙ্গ আর পশুরা নয়, কেননা তাদের যোনি নেই। কেবলমাত্র স্ত্রী কীট-পতঙ্গ আর পশুরা। সে যাই হোক, যোনী শব্দটির বিবিধ বিশ্লেষণ থাকতে পারে, কিন্তু কীট-পতঙ্গ বলতে অন্য কিছুকে বুঝায় না; আর কীট-পতঙ্গের যোনী বলতে বিশেষ কিছু নির্দেশিত করে বলে কারো জানা আছে বলে মনে হয় না।

যোনী শব্দটি না হয় বাদই দেয়া হল। তারপরও প্রশ্ন রয়ে যায়- এই সমস্ত্ম কীট-পতঙ্গ আর পশুরা কেনই বা আসুরী হতে যাবে? এদের কোনটিই কি স্রষ্টার পবিত্র সৃষ্টি হতে পারে না? যোনীযুক্ত প্রাণী, সে কীটই হোক অথবা জন্তু কিংবা মানুষ-সে/ইহা নারী প্রকৃতির। তবে কি পক্ষান্তরে নারীকেই অসুরী বলা হচ্ছে? (নারী তোমাকে বলছি দেখুন) তাছাড়া, শব্দ চয়নের দিক থেকেও স্ত্রী-বাচক শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে (সেই নরাধমদিগকে আমি বারংবার আসুরী যোনিতে নিক্ষিপ্ত করি)। অসুর শব্দের স্ত্রী-বাচক অসুরী; অসুরের প্রকৃতিকে আসুরী বলা হয় না বাঙলা অভিধানুসারে। আভিধানিক অর্থে বলুন আর শাব্দিক অর্থেই বলুন যোনী শব্দটি স্ত্রী-বাচক শব্দের পাশাপাশিই রয়ে যায়, ততসঙ্গে কাম শব্দটিও সম্পর্কযুক্ত।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভাষ্যে কাম, ক্রোধ ও লোভই নরকের দ্বার। এসবের মাধ্যমেই মানুষ পাপাচার করে, পাপের দরুন নর থেকে নরাধমে পরিণত হয়। যুগে যুগে নরাধমদেরকে প্রায়াশ্চিত্যের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয় এই ধরাধামে। এই প্রক্রিয়াকে গীতা পুন:জন্ম (জাতিস্মর) বলে। বাসাংসি জীর্ণনি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি নরোঃ পারানি।

তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী২২ [এখানে, বাসাংসি : বস্ত্র, জীর্ণানিঃ জীর্ণ বা ময়লাযুক্ত, সংযাতিঃ গ্রহণ করা বা পরিগ্রহ করা, গৃহ্নাতিঃ গ্রহণ করে বা গৃহীত হয়] অর্থ: "যেমন মনুষ্য জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে সেরূপ আত্মা জীর্ণ শরীর পরিত্যাগ করে অন্য নতুন দেহ পরিগ্রহ করে। " (সূত্র : শ্রীমদ্ভগবদগীতা, লেখক: শ্রীজগদশ চন্দ্র ঘোষ এবং শ্রী স্বামী শিবানানন্দ, অধ্যায়ঃ ২- সংখ্যাযোগ, পৃষ্ঠাঃ ৩১, শ্লোক-২২) আরো বলা হয়েছে : জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুধ্রুর্বং জন্ম মৃতস্য চ। তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি২৭ "যে জন্মে তার মৃত্যু নিশ্চিত, যে মরে তার জন্ম নিশ্চিত; সুতরাং অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে তোমার শোক করা উচিত নয়। " ২৭। (সূত্রঃ শ্রীমদ্ভগবদগীতা, লেখকঃ শ্রীজগদশ চন্দ্র ঘোষ এবং শ্রী স্বামী শিবানন্দ, অধ্যায়ঃ ২-সংখ্যাযোগ, পৃষ্ঠাঃ ৩৩, শ্লোক-২৭) অর্থাৎ যার জন্ম আছে তার মৃত্যুও আছে -চিরন্ত্মন কথা।

কিন্তু পরের শ্লোকে বলা হচ্ছে মৃত্যুর পর এই ধরাধামে বারবার ফিরে আসার কথা। শুধু কি তাই, বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানীদের সকল প্রমাণাদি ভুল প্রমাণিত করার জন্য এই একটি শ্লোকই যথেষ্ট- তাও আবার খ্রীষ্টের জন্মের ৩১৩৮ বছর আগেই - যখন বিজ্ঞান শব্দেরই উৎপত্তি হয়নি। এই পৃথিবীর লীলা নিয়ে সবচাইতে বড় গবেষণা হলো - বিগ্‌-ব্যাং থিওরি। অসংখ্য পর্যবেক্ষণ ও পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে এই মহাবিশ্বের শুরু ও শেষ আছে এবং একটি কেন্দ্র থেকে বিশাল বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। বিস্ফোরণের এই কেন্দ্রকে বিজ্ঞান শূন্য বা কিছুই না (Zero Volume) বলে আখ্যায়িত করেছে।

বস্তুত: এটা ছিল বিগ-ব্যাং সূত্রের দাবি। বিগ্‌-ব্যাং থিওরি প্রসঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানী স্টেফেন হকিংস (Stephen Hawking) এ ব্রিফ হিসট্রি অব টাইমস (A brief History of Time: page-181) গ্রন্থের ১৮১ পৃষ্ঠায় বলেনঃ "মহা বিস্ফোরণের পর মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ মাত্রা যদি এক সেকেন্ড বা তার শত লক্ষ ভাগের এক ভাগও হেরফের হতো তাহলে তা আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছার পূর্বেই নতুন করে পূর্ণাঙ্গভাবে পুনর্গঠন করতে হত। " এই মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত সম্প্রসারণ হচ্ছে। প্রত্যকটি গ্রহ-নক্ষত্র একে অপর হতে দূরে সরে যাচ্ছে। আর এই সম্প্রসারণশীলতাই বলে দেয় যে একদিন এই মহাবিশ্ব ধ্বংস হবে।

একটি বেলুনের কথাই ধরি, যখন বেলুনে বায়ুর সঞ্চার করা হয়, তখন বেলুনের গায়ের বিন্দুগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যায় এবং বেলুনটি আকারে বড় হতে থাকে। বড় হতে হতে এমন একটা পর্যায়ে উপনীত হয় যখন বায়ুর চাপে বেলুনটি ফেটে যায়। ঠিক তেমনি সম্প্রসারণশীল এই মহাবিশ্বও একটি চরম সীমায় উপনীত হবে। আর সেই দিনই হবে তাবত জগতের ধ্বংস। এটা বিজ্ঞানের কথা।

এছাড়াও রয়েছে গ্রীনহাউস ইফেক্ট (Green House Effect); যার মূল উপাদান হল ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন (CFC) গ্যাস। যা ওজোন স্ত্মরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আর এই ওজোন স্ত্মরটি সূর্য হতে নির্গত অতি বেগুনী রশ্মিকে বাধা প্রদান করে। যা ওজোন স্তর ভেদ করে পৃথিবীতে পতিত হলে বাসযোগ্য এই পৃথিবী মনুষ্য বাসের অযোগ্যে পরিণত হবে। অধুনা বিজ্ঞান বলছে, পৃথিবীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO2), নাইট্রোজেন (N) এবং মিথেন (CH4) গ্যাসের আধিক্য দিন দিন বেড়েই চলেছে।

যার ফলে পৃথিবীর ওজোন স্ত্মরে ফাটল দেখা দিয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে মহাবিপর্যয়ের সেই দিন আর বেশি দূরে নয়। পৃথিবী প্রতিনিয়ত ধ্বংসের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। বিগ্‌-ব্যাং এবং গ্রীনহাউস ইফেক্ট মতে এই পৃথিবী একদিন না একদিন ধ্বংস হবে। তখন গীতার এই শ্লোকের সত্যতা কোথায় দাঁড়াবে? তাহলে কালের প্রবাহে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে গীতার শ্লোকগুলো? অবশ্য যখন পৃথিবীতে মানুষ থাকবে না, থাকবে না পৃথিবী নামক গ্রহটি তখন গীতার শ্লোকের কি দরকার? কিন্তু জন্মান্ত্মবাদের কি হবে? জন্মান্ত্মবাদের পুন: পুন: জন্ম কোথায় সংঘটিত হবে? পৃথিবী ধ্বংসের সময় পর্যন্ত্ম যদি একটা পাপীও থাকে তবে তার কৃতকর্মের শাস্ত্মি স্বরূপ আসুরী যোনীতে পুন:জন্মগ্রহণ করে প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ কোথায়? তার জন্য তো পাপমুক্ত হবার রাস্ত্মা খোলা রইল না।

তবে কি পৃথিবী ধ্বংসের সময় কোন পাপী থাকবে না? সব যদি ভাল হয়ে যায় তবে তাদের ভাল কাজের মূল্যায়ন কিভাবে হবে (যেহেতু স্বর্গের ব্যাপারে 'ন-অস্ত্মি' যার অস্ত্মিত্বই নেই বলা হয়েছে)? মহাভারতে বর্ণিত দশরথপুত্র ভরতের পুন:জন্ম এবং কৌরব জননী গান্ধরীর ৫০ বার পৃথিবীতে ফিরে আসার সত্যতা কিভাবে প্রমাণ করবে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ গুলো? যেখানে বিগ্‌-ব্যাং এবং গ্রীনহাউস ইফেক্টের সত্যতা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। পৃথিবী ধ্বংসের পর গীতার জন্মান্ত্মরবাদ কোথায় ঘটবে? পৃথিবী ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে সকল জীবের মৃত্যু ঘটবে, গ্রহ-নক্ষত্রের অস্ত্মিত্ব থাকবে না। গীতা মতে পুন:জন্ম যদি সত্য হয় তবে আত্মা নবদেহ ধারণ করে কেনো পৃথিবীতে আসবে? যেখানে গ্রহ-নক্ষত্র, চন্দ্র-সূর্য, গ্যালাক্সির কোনো অস্ত্মিত্ব থাকবে না। ধরে নিলাম, বারবার ফিরে আসে এই ধরাধামে, তবে যেরূপে যায় সেরূপে নয়- হয়ত বা জীবনানন্দের মত শালিক হয়ে, হয়ত বা দশরথপুত্র ভরতের মত হরিণ হয়ে। কিন্তু এ আসার মধ্যে স্বার্থকতা কোথায়? উৎকৃষ্ট জীব নিকৃষ্ট হয়ে ফিরে আসবে এবং পূর্ব জীবনের কোনো কথাই তার স্মৃতিতে থাকবে না।

এমনকি সে বুঝতেও পারবে না যে তার পূর্ব রূপ কেমন ছিল, কোন অপরাধে এমন হীনজীব হয়ে আসতে হল? হয়ত পাপের দরুণ এমন হীন জীব হয়ে পুন: পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে পূর্বের জন্মের কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে। কিন্তু দশরথপুত্র ভরত তো কোনো পাপ করেননি। রামায়ণের চরিত্রগুলোর মধ্যে ভরতের চরিত্রই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট এবং তিনি ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের ভ্রাতা। যার প্রতি ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বদাই ছিলেন সন্তুষ্ট। একজন ভগবানের ভ্রাতা, কি এমন পাপ করেছিলেন যে তাকে হরিণ হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে হল? আর ভগবানের ভ্রাতাকে তো ভগবানই বলা যায়।

কারণ, মানুষের পেট থেকে মানুষই জন্মে; গরু-ছাগল তো নয়। যার যেমন বৈশিষ্ট্য সে সেরূপই জন্ম দেয়। যেহেতু রাজা দশরথের ঘরে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম, সেহেতু রাজা দশরথের ঔরস্যে কৈকয়ী এবং কৌশলা দেবীর গর্ভ থেকে উৎপন্ন সকল পুত্রই ভগবান হওয়ার দাবি রাখে। সুতরাং বলা চলে ভগবান ভরতেরও ভুল হয়েছিল। ভগবানরাও তাহলে ভুল করেন? তাদের ধর্ম মতে কেউ কেউ নাকি মানুষ হয়েও পুন:জন্ম গ্রহণ করেছেন।

যেমন দশরথপুত্র ভরত মৃত্যুর পর হরিণ হয়ে পুন:জন্ম লাভ করার পর মুনি-ঋষিদের বেদ শ্রবণে পুণ্যি অর্জন করে বামন হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মৃত্যুর পর এই পুন: পুন: ফিরে আসাকে জাতিস্মর বলে ব্যাখ্যা করেছে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রগুলো। এখন প্রশ্ন হল- পৃথিবীর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত্ম কোনো মানুষ গত হবার পর তার পূর্ব স্মৃতি নিয়ে, পূর্ব রূপ নিয়ে ফিরে এসেছে কি? সত্যিই যদি সেরূপে ফিরে এসে তার পূর্বের জন্মের সব কিছু সবিস্ত্মারে বর্ণনা করতে পারত, তবে আজ ইতিহাসের দরকার হত না, দরকার হত না এতসব কাগজ-পত্রের প্রমাণাদির। মিথ্যা হয়ে যেত নৃ-বিজ্ঞান, বস্তুবিজ্ঞান, জোত্যির্বিজ্ঞান। পুন:জন্মা ব্যক্তিই বলে দিতে পারত তার যুগে কৃষ্ণ ছিল, কৃষ্ণের ১৬,১০৮ টীকা-৩ জন স্ত্রী ছিল অথবা রাক্ষস রাবণের দশ মাথা ছিল? তাহলেই তো আজ সে সব বিষয়ে প্রশ্নের অবতারণা হত না।

আমার তো মনে হয় গীতার ঐ শ্লোকের সঠিক অর্থ ভিন্ন রকম হওয়া উচিত। হয়ত অর্থটাও ঠিকই আছে, কিন্তু মানুষের বুঝাতে ভুল রয়েছে। গীতার ঐ শ্লোকে তো এটা বলা হয়নি যে মানুষ মরার পর আবার যখন জীবিত করা হবে। তখন এই ধরাধামে ফিরে আসবে? বরং বলা হয়েছে, যে জন্মে তার মৃত্যু নিশ্চিত, যে মরে তার জন্ম নিশ্চিত; সুতরাং অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে তোমার শোক করা উচিত নয়। এটা তো খুবই স্পষ্ট -'যে মরে তার জন্ম নিশ্চিত।

' আর এটা পরম সত্যও বটে। নয়ত ভালো মন্দের, পাপ-পুণ্যের হিসেব-নিকেশ কিভাবে হবে? পৃথিবীতে যে একটা মানুষকে খুন করে খুনের দায়ে ফাঁসিতে চড়ল, আবার কেউ হাজারও মানুষ মেরে একই শাস্ত্মি পেল -এটা কি সঠিক বিচার হলো? এটাকে কি ন্যায় বিচার বলবেন? না বলেও উপায় নেই? কারণ আদালতের উচ্চ চেয়ারে বসা ঐ লোকটার হাতে তো এমন কোনো শক্তি নেই যে, হাজার মানুষের জান হরণকারীকে হাজারও বার মারবেন আর জীবিত করবেন। আবার যে মানুষটি ক্ষমতার জোড়ে জবরদখল করে নিল অসহায়ে সকল কিছু। কিংবা কেউ অপরের ভয়ে অনিচ্ছায় কোনো অন্যায় করে বসল, আর তাকে শাস্ত্মিও দিয়ে দেয়া হলো। সে প্রকৃত অপরাধীর নাম স্বীকার না করেই শাস্ত্মি মাথা পেতে নিতে রাজি হয়ে গেল।

নয়ত যে তাকে ঐ অন্যায় কাজে বাধ্য করেছে সে হয়ত তার পরিবার প্রিয়জনদের এমন কিছু ক্ষতি করবে যার ফলাফল হবে এই শাস্ত্মির চেয়ে আরো নির্মম, আরো কঠোর, আরো হৃদয় বিদারক। এরূপ হাজারো বিচার আদালতে উঠে আবার তার শাস্ত্মিও হয় একতরফা। কখনো টাকার জোড়ে আবার কখনো শক্তির জোড়ে। এ তো শুধুই বিচারের নামে প্রহসন। এ জীবনে অনেকে অনেক কিছুই পেল আবার কেউ কিছুই পেল না।

আবার কেউ এতটাই পেল যে সেসবের ব্যবহার করল অন্যায়ভাবে। আবার কেউ পাওয়ার আগেই বিলিয়ে দিল। আর যারা কিছুই পেল না কিন্তু সেই ভগবানের নাম জপতপ করতে কম করল না। আবার ভগবানের নামে শিরনি দিতেও কম করল না। বরং যেটুকু দিলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, সেটুকু দিয়েও ভগবানের সৃষ্টির সেবা করে এই ধরাধাম ছেড়ে চলে গেল -সেকি কিছুই পাবে না? সুতরাং এমন এক বিচারের জায়গা, এমন এক প্রতিদানে জায়গা, এমন এক স্রষ্টা থাকা দরকার যেখানে বিচারের তাগিদে মানুষকে বারবার জীবন দেয়া যাবে এবং মানুষের অন্ত্মরের ভিতরটা যাচাই-বাছাই করে পৃথিবীতে যা জানা যায় নি বা যার প্রকাশ করা হয়নি বা প্রকাশ পাবার মতো নয় সেই সব বিবেচনা করে সঠিকভাবে বিচার কার্য সমাধা করা হবে।

আবার যে পেয়ে অপব্যয় করল তার জন্যই শাস্ত্মি, আর যে না পেয়েই ওপারে চলে গেল তার জন্যও থাকবে উপযুক্ত প্রাপ্য। তা না হলে এই জীবন আর জীবনে উদ্দেশ্য সবই মিছে, সবই বিচারের নামে অবিচার, অত্যাচার। গীতাতে তো এটাই বলা হয়েছে- এই জীবনের পর আরও একটা জীবন আছে। যে জীবনে প্রত্যেকের প্রতিটি বিষয়ের হিসাব গ্রহণ করার তাগিদে তাদেরকে পুনরায় জীবিত করা হবে এবং তাদের কৃতকর্ম অনুয়ায়ী স্বর্গে বা নরকে পাঠানো হবে। আর যদি বলা হয় পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য পুনরায় জীবন দান করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে; তবে নরকের কি প্রয়োজন? আর যদি বলা হয় এই পৃথিবীটাই নরক তবে স্বতন্ত্র কোনো স্বর্গের অস্ত্মিত্বই অস্বীকার করা হবে।

কারণ যাকে নরক বলা হবে তাকে তো আর স্বর্গ বলা যায় না। তাছাড়া ঐ যিনি মানব ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের সবচাইতে আলোচিত খুনি হিটলা।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৫৩ বার     বুকমার্ক হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।