মনের মহাজন খুঁজে ফিরি....
ডেসটিনির গ্রাহক হয়েই সর্বস্ব খুইয়েছেন সোহেল
গোলাম মওলা
মেধাবী যুবক এম মিজানুর রহমান সোহেল ঢাকায় এসেছিলেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। পড়াশোনা শেষ করে ভালো কোথাও চাকরির প্রত্যাশাও ছিল। কিন্তু ডেসটিনিতে নাম লেখিয়ে তার এখন পথে বসার উপক্রম। পড়ালেখাও তিনি শেষ করতে পারেননি। তার জীবনের রঙিন স্বপ্নগুলো এখন বিবর্ণ হয়ে গেছে।
শনিবার যুগান্তর কার্যালয়ে তিনি তার করুণ কাহিনী বর্ণনা করেন।
ডেসটিনির সদস্য হয়ে কিভাবে তিনি প্রতারিত হলেন তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। সোহেল বলেন, ২০০৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে অনার্স পড়তে তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ভর্তির পর পরই তার এক বন্ধু তাকে ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের এমএলএম কোম্পানির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখায়। ওই কোম্পানিটির প্রশিক্ষণে জাদুর মতো চটকদার লোভনীয় কথায় তিনি ডেসটিনির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
২০০৬ সালের ৩১ আগস্ট ২৭৮তম স্টেটমেন্টে ডেসটিনির ঢাকা-৭ অফিসে তিনটি সেন্টার নিয়ে ডেসটিনির সদস্য হন। তার সেন্টারের সিআইডি নাম্বারগুলো হচ্ছে ১১৫৪৮২০, ১১৫৪৮২১, ১১৫৪৮২২। ডেসটিনিতে সদস্য হওয়ার পর তার অফলাইন লিডাররা নিজেদের পকেট ভারি করার জন্য তাকে নানাভাবে ব্যবহার করতে থাকেন। প্রথমে তাকে সপ্তাহে ছয় থেকে ২৪ ঘণ্টা সময় দিলে মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় করা যাবে বলে লোভ দেখায়। পড়াশোনা ও চাকরির পাশাপাশি তিনি ডেসটিনিতে খণ্ডকালীন কাজ শুরু করেন।
কিন্তু খণ্ডকালীন সময়ে তার প্রথম আট মাসে আয় হয় মাত্র ১৮শ’ টাকা। এরপর অফলাইনরা তাকে পরামর্শ দেন, চাকরিটা ছেড়ে পূর্ণ সময় দেয়ার এবং তাতে মাসে তার ৫০ হাজার টাকা আয় নিশ্চিত হবে। তিনি চাকরিটা ছেড়ে দেন। কিন্তু রাত-দিন কঠোর পরিশ্রম করেও তার ভাগ্য খোলেনি। বরং পুরো এক বছর সময় দিয়ে ধার-দেনা করে প্রায় ৪৮ হাজার টাকা খরচ করে ১২ হাজার টাকা আয় করেন।
অফলাইনরা তাকে অভয় দিয়ে বলেন, সবারই প্রথম প্রথম বেশি সময় লাগে, কিন্তু জ্যাম ছেড়ে গেলে দেখবেন প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় করতে পারবেন।
এদিকে তার বাবা-মা বারবার ডেসটিনি করতে বারণ করলেও তাদের কথা অগ্রাহ্য করে তিনি মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় করার প্রতিশ্র“তি দেন। এতে বাবা-মা তাকে টাকা-পয়সা দেয়া বন্ধ করে দেন। এদিকে চাকরি ছেড়ে দেয়ায় তিনি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। কলেজের কয়েকজন বন্ধুর কাছ থেকে ঋণ করে ডেসটিনিতে প্রায় তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করে দুই বছরে সাত সাইকেল তথা প্রায় ৮৮ হাজার টাকা আয় করেন।
ডেসটিনিতে এক ট্রেনিংয়ে অফলাইনরা বলেন, যারা পড়াশোনা করছেন তারা তো পড়াশোনা শেষ করে টাকাই আয় করবেন। সেই টাকা যদি এখনই আয় করতে পারেন, তাহলে পড়াশোনা করে কি হবে? বাংলাদেশে পড়াশোনার কি কোন ভাত আছে? শিক্ষিত বেকাররা ক্রাইম করে। তাই আপাতত পড়াশোনা করে সময় নষ্ট না করে এখানে সিরিয়াসলি সময় দিলে মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় করা অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে যাবে। তাদের কথামতো সোহেল পড়াশোনাও বন্ধ করে দেন। সোহেল আরও বলেন, ডেসটিনির কোন সদস্য যাতে ডেসটিনি ছাড়তে না পারে সে জন্য তারা নানা কৌশল গ্রহণ করে।
প্রথমত, অন্য সব আয় থেকে সদস্যদের সরে আসতে বাধ্য করে। এরপর বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে তা খরচ করাতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। যাতে করে ঋণের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য ডেসটিনির কাজের গতি বৃদ্ধি পায়। এরপর পড়াশোনা বা শখের কোন কাজ থাকলে সেখান থেকেও অব্যাহতির ব্যবস্থা করা হয়। যেন ডেসটিনিতে ফুলটাইম সময় দিতে বাধ্য হয়।
বিয়ে না করে থাকলে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যাতে ঘাড়ে সংসার চালানোর তাগিদ থেকেই ডেসটিনির কাজের প্রতি আগ্রহ বেশি হয়
বই লেখার কারণে মামলা : সোহেল জানান, ২০০৯ সালে তুষার নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তুষার আমাকে ডেসটিনির ওপর একটি বই লিখতে অনুরোধ করেন। তুষারের কথা মতো আমি ডেসটিনি এক্সক্লুসিভ নামের একটি বই লেখি। বইটি বাজারে এলে ডেসটিনির সিনিয়ার ডায়মন্ড ডিস্ট্রিবিউটর আজাদ রহমানের লেখা একটি বই বিক্রি একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।
এ কারণে ডেসটিনির তৎকালীন পরিচালক (মার্কেটিং) গোফরানুল হক কোন প্রকার নোটিশ ছাড়াই আমার বিজনেস সেন্টার বন্ধ করে দেন এবং আজাদ রহমান ডেসটিনির পক্ষে আমার বিরুদ্ধে ৪২০ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। এরপর আয়ের সব পথ বন্ধ হয়ে যায় সোহেলের। আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে সোহেল যুগান্তরকে বলেন, অন্য কোন আয় না থাকায় আমি তখন অর্থনৈতিকভাবে ডেসটিনির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলাম। ওই সময় আমার স্ত্রী-সন্তানসম্ভবা ছিল। আমার দ্বিতীয় কোন আয়ের রাস্তা না থাকায় আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি।
আমার সেন্টার ফেরত পাওয়ার জন্য কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে দখা করতে চাই। এজন্য একটি দরখাস্ত লিখি। কিন্তু তার শিডিউল পেতে আমার ছয় মাসেরও বেশি সময় লাগে। তার সহযোগিতা চাইলে তিনি বলেন, আমি যেন বইটির প্রকাশককে ধরিয়ে দেই। আর এ কাজে সহযোগিতার জন্য তার মোবাইল থেকে দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকার একজন ক্রাইম রিপোর্টারের সঙ্গে আমাকে কথা বলিয়ে দেন।
কিন্তু কোন উপকারই তিনি করলেন না। ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমিনের কথা মতো তার পর থেকে খুঁজতে থাকি ওই প্রকাশককে। ২০১০ সালের ১ এপ্রিল বইটির প্রকাশকের বাড়িও খুঁজে পাই। তখন ডেসটিনির কেউ আমাকে সহযোগিতা করেননি। ওইদিন রাতে মতিঝিল থানার সহযোগিতা চাইলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, কোন লিখিত প্রমাণ না থাকায় আপনাকে সহযোগিতা করতে পারব না।
পরদিন সকালে ডেসটিনির লিগ্যাল এডভাইজারের সহযোগিতা নিলেও তখন ওই প্রকাশক পালিয়ে যায়। সোহেল বলেন, ডেসটিনির কাছে আমার প্রায় আড়াই লাখ টাকা পাওনা রয়েছে।
মার্কেটিং পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছাড়া ওই সেন্টার ছাড়া সম্ভব নয়। ২০১১ সালের জুন মাসে আবারও রফিকুল আমীনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলাম। তাকে বললাম, আপনি যে আমাকে মার্কেটিং পরিচালকের কাছে পাঠিয়েছিলেন তিনি তো আপনাকে ছাড়া সেন্টার ছাড়তে পারবেন না বলেছেন এখন কি করব?
সোহেল বলেন, বইটির প্রকাশক কোটি টাকা আয় করছে তার দেখাদেখি আরও কয়েকজন একই বই প্রকাশ করে চলেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আমাকে দীর্ঘতিন বছর ধরে হয়রানি করছে।
একই কারণে একটি মামলা করে বছরের পর বছর আমাকে ভোগান্তির শিকার করছে। আমি অনেক চেষ্টা করার পরেও যখন আমার সেন্টারটি ছাড়াতে পারলাম না।
তথ্য কনিকা :
দৈনিক যুগান্তরের পহেলা বৈশাখ তথা ১৪ এপ্রিল ২০১২ ইং প্রকাশিত এই লেখাটি দেখুন এখানে এবং প্রিন্টেড ভার্সন দেখুন এখানে । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।