মানব সেবাই আমার মূল ধর্ম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ একটি নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলো রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো দায়িত্ব পালনরত রাষ্ট্রপতির ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যু হলো। এর আগে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দুজন রাষ্ট্রপতির মৃত্যু হয়েছে। সঙ্গতকারণেই, কে রাষ্ট্রপতি হবেন, এ প্রশ্ন তখন ওঠেনি।
অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতির পদ কারো না কারো দখলে চলে গেছে।
জনগণের পক্ষ থেকে বলার কিছু ছিল না, বললেও ক্ষমতা দখলকারীদের তাতে কান দেবার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু, এবার একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই রাষ্ট্রপতির স্বাভাবিক মৃত্যু হলো। স্বাভাবিক কারণেই, জনগণের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে, নানামুখী মতামতের দেখাও মিলছে।
সংবাদপত্রের ওয়েবসাইটে, ব্লগে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নাগরিকরা খোলাখুলি মত প্রকাশ করছেন। নাগরিকদের তরফে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করে তাদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানানো হচ্ছে।
অনেকে প্রস্তাব দেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। কেননা, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সূত্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের পছন্দের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। কারণ, প্রধানমন্ত্রী যাকে বেছে নেবেন তাকে আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যরা ভোট দেবেন এবং তিনিই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। ফলে, আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ নিয়েও নানা জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে।
অনেকেই বলছেন, সংসদের স্পিকার ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদই রাষ্ট্রপতি পদের উপযুক্ত। আবদুল হামিদ ৭ দফা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছেন। স্পিকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে, তার বিরুদ্ধে পক্ষাবলম্বনের গুরুতর অভিযোগ ওঠেনি বিরোধীদের তরফে। স্বভাবসূলভ উইট ও হিউমার সহকারে তিনি অধিবেশন পরিচালনা করেন, সংসদ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তার কৌশল বেশ কার্যকর বলেই প্রতীয়মান হয়।
অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগের বিবেচনায় তার নাম সবার ওপরে থাকা উচিত।
অনেকেই মনে করেন, আরেক বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা সাজেদা চৌধুরীও রাষ্ট্রপতি পদের যোগ্য। তাকে নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রী পছন্দ করেন বলে তার বেশি সম্ভাবনা দেখা হচ্ছে। তিনি যদি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তবে বাংলাদেশ প্রথম বারের মতো একজন নারী রাষ্ট্রপতি পেতে পারে।
আওয়ামী লীগের বিবেচনা মাথায় রেখে আরও যাদের নাম নাগরিকরা প্রস্তাব করছেন তাদের মধ্যে আরেক ডাকসাইটে নেতা মতিয়া চৌধুরীও আছেন।
কেউ কেউ তোফায়েল আহমেদের নামও প্রস্তাব করছেন। অনলাইন মাধ্যমে কেউ কেউ আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামও প্রস্তাব করছেন।
আওয়ামী লীগ ও আওয়ামীপন্থী নাগরিকদের মধ্যে আগামী নির্বাচনের বিবেচনা হয়তো বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। সরকার চায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচনকালীন বিশেষ সরকার ছাড়াই নির্বাচন করতে। তেমনটি ঘটলে এবং প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় নির্বাচন হলে অন্যান্য দেশের রেওয়াজ অনুসারে প্রধানমন্ত্রী সীমিত ক্ষমতা ভোগ করবেন, স্বাভাবিক যুক্তিতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বেড়ে যাবে।
ফলে, আওয়ামী লীগ এমন একজনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করতে চাইবে যিনি নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন।
ওয়ান-ইলেভেনের সময় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে জিল্লুর রহমান যেভাবে সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে দল সামলেছেন তাতে অনেকেই মনে করেন, বয়স সত্ত্বেও নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে জিল্লুর রহমানই সবচেয়ে দক্ষ ব্যক্তি ছিলেন।
এখন যিনিই রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হবেন তার কাছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনকালীন একটা প্রত্যাশা থাকবে। এ প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরই আওয়ামী লীগের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকার কথা। কিন্তু, দলকে নির্বাচনী বৈতরণী পার করিয়ে দেওয়াই কি একজন রাষ্ট্রপতির নির্বাচনকালীন দায়িত্ব।
কিছুদিন আগে প্রয়াত হলেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমমেদ। বিএনপি আশা করেছিল, তাদের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পার করে দেবেন। প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন হয়তো সেটি করতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে না থাকায় সেটি করে উঠতে পারেননি। স্বাভাবিক কারণেই তিনি বিএনপির বিরাগভাজন হন।
এর আগে আওয়ামী লীগ বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছিল, তিনিও নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে আওয়ামী লীগকে বিশেষ সহায়তা দিতে পারেননি। মজার ব্যাপার, বিএনপির দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আব্দুর রহমান বিশ্বাসও বিএনপিকে নির্বাচনী বৈতরণী পার করাতে পারেননি।
একথা সত্য, যে রাষ্ট্রপতিদের কথা বলা হচ্ছে তারা নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারই নির্বাচন তদারকির কাজ করেছে। ফলে, রাষ্ট্রপতির বিশেষ ভূমিকা পালন করার বাস্তবতা ছিল না। এখনকার পরিস্থিতি আলাদা।
দলীয় সরকারের অধীনে দল নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির ভূমিকা রাখা নিশ্চয়ই কঠিন হবে না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রপতি পদটি অত্যন্ত সম্মানজনক। রাষ্ট্রের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তাকে এমন অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয় যা দলমতের উর্ধ্বে। স্বাভাবিক কারণেই, নাগরিকরা আশা করেন, দল একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করলেও তিনি দলীয় মতের প্রতিনিধিত্ব করবেন না। রাষ্ট্রপতি পদটির প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা রক্ষাই তার কাজ।
এমনিতে রাষ্ট্রপতির কাজ সীমিত ও আনুষ্ঠানিক। এমন বাস্তবতায় আত্মসম্মান রক্ষা করাই কঠিন। তারপরও আমাদের রাষ্ট্রপতিরা কাজটি ভালোভাবেই করছেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দায়িত্ব পালনকারী প্রায় সব রাষ্ট্রপতিই জনগণের শ্রদ্ধা পেয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান মারা যাওয়ার পর বোঝা গেল, সাধারণ মানুষের কাছে তিনি অনেকটা গ্রহণযোগ্য হতে পেরেছিলেন।
তার নম্রতা, ভদ্রতা ও দৃঢ়তা মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অভাবিত। যে উদারতা নিয়ে দলটি তাকে সম্মান জানিয়েছে, কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে, শোক প্রকাশ করেছে তেমন উদাহরণ সাম্প্রতিক রাজনীতিতে নেই।
জিল্লুর রহমান বিরোধী দলের কাছ থেকে যে সমীহ আদায় করে নিয়েছেন তা নিশ্চয়ই ভবিষ্যত রাষ্ট্রপতিদের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু বিএনপির এই ইতিবাচক মনোভাবকে স্বাগত জানাতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি দল।
তারা বরং সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। খালেদা জিয়া ও তার দলের নেতারা বঙ্গভবনে গেলে সরকারের পক্ষে কেউ তাদের অভ্যর্থনা পর্যন্ত জানাননি, এমনকি খোঁজ পর্যন্ত করেননি। সরকারের এই মানসিকতা নিয়ে শুক্রবারের সব পত্রিকা সরব হয়েছে।
সরকারের এই অবস্থান স্বাভাবিক কারণেই সকলকে চিন্তিত করেছে। বিরোধী দল যখন এগিয়ে আসছে তখন সরকার কেন পিছিয়ে যাবে?
দেশে রাজনৈতিক সংকট চলছে।
এ সংকট মোচনের দায়িত্ব সর্বাগ্রে সরকারেরই। সরকারের কর্তব্য, আলোচনার জন্য পরিস্থিতি তৈরি করা এবং সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানো। কিন্তু সরকার তা করতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। আলোচনার তাগিদ থাকলেও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কোনো আলোচনার আশাও আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অনিবার্য সে আলোচনাই যখন হচ্ছে না, তখন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে না তা নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায়।
অথচ নতুন যিনিই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন তার মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। এই মেয়াদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই ক্ষমতায় থাকতে পারে।
প্রতিবেশী ভারতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিরোধীদের মত নেওয়া হয়। আমাদের দেশে সে রেওয়াজ নেই। কিন্তু, সরকার বদলের কথা চিন্তা করেও কি এবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে বিরোধীদের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া যায় না? নাগরিকদের মধ্যে দুএকজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের কথোপকথনের সম্ভাবনার মধ্যে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের সম্ভাবনাও দেখছেন।
তাদের মতে, একজন দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা হলে এবং নির্বাচনের সময় তিনি প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করতে পারলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তবর্তী সরকারের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।
দলীয় সরকার দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় নির্বাচন হতে পারবে। নির্বাচন কমিশন ও রাষ্ট্রপতির অধীনস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরেপেক্ষতা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। আওয়ামী লীগ যদি আর অন্তবর্তী নির্বাচনী ব্যবস্থায় ফিরতে না চায় তবে তাদের কর্তব্য হবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে বিএনপি সহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা।
দলনিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়।
কিন্তু প্রক্রিয়াটি শুরু করাই কঠিন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়াও রাষ্ট্রপতি পদটিতে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদেরই মনোনয়ন পাওয়া উচিত। কিন্তু, এ আহবান কি অরণ্যে রোদন নয়?
আলঙ্কারিক এ পদটিতে এমন ব্যক্তিদের অধিষ্ঠিত হওয়া উচিত যারা জাতিকে নির্দেশনা দিতে পারবেন, তরুণদের কাছে আইকন হিসেবে প্রতিভাত হবেন, সংকটের সময় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবেন। সেজন্য সরকার ও বিরোধীদের কাছে তার সমান গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। কিন্তু নির্বাচনী বৈতরণী পার করানোই যেখানে রাষ্ট্রপতিদের কাজ, সেখানে নিরপেক্ষ ব্যক্তি মনোনয়ন পাবেন কী করে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।