::::: দেখবো এবার জগতটাকে :::::
রাতের বাসটা শ্রীমঙ্গলে আমাদের কোনমতে নামিয়ে দিয়েই দ্রুত মৌলভীবাজারের দিকে ছুটে পালালো, ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে চারটার মতো বাজে। আমরা ৩জন, আমি দৈনিক আমার দেশের কার্টুনিস্ট রকিবুল আর ফান ম্যাগাজিন ভিমরুলের একজন লেখক নাম মাসুম বিল্লাহ।
হঠাত করেই আয়োজন। সবাইকে জানানোর জন্যে ২৪ ঘন্টা সময়ও পাইনাই। সঙ্গে এক ছোট ভাইএর যাবার কথা ছিল।
রওনা হবার আগে আগে তারই টিকেট কাটবার কথা। সন্ধ্যা বেলায় সে ফোন করে জানালো চৈত্রের ভীষন রোদে সে নাকি মীরপুরে মাথা ঘুড়ে পড়ে গেছে। সে বাদ। রকিবুল কোন মতে শেষ মুহুর্তে দৌড়া দৌড়ি করে টিকেটের ঝামেলাটা মেটালো। বিস্তর ঝামেলা শেষে আমরা শ্রীমঙ্গলে তখনো ভোড়ের আলো ফুটতে অনেক বাকী।
বাজারে মানুষতো মানুষ একটা ঘেঁয়ো কুকুরও নেই। একটা পরিত্যাক্ত বেঞ্চীতে আলো না ফোটা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে প্রথম যেই নাস্তার দোকানের ঝাপ খুললো সেটাতেই আমরা ঝুপ করে বসে পড়লাম। রুটি ডালভাজা আর ডিম পোচ সাবার করতে না করতেই দেখি আকাশ ফর্সা হয়েছে। আমরাও পথে নামলাম। লাউয়া ছড়া অনেকবারই আসা হয়েছে।
কিন্তু কোনবারই কেন যেন ঘোরা হয়নি। প্রথম বার দুঃখতো সারাজীবন কষ্ট দেয়। ভানুগাছা রোডে ক্যামেরা কাঁধে হাটছিলাম। কোত্থেকে এক পিকনিকের দল ফুল ভলিউমে মাইকে হিন্দি গান বাজাতে বাজাতে সংরক্ষিত বনে এসেছে বনভোজনে। তাদের গানের অত্যাচারে ১ দল উল্লুক বেড়িয়ে এল একদম সামনে।
নিজের বোকামীর জন্যে হাতের মধ্যে সুপারজুম ক্যামেরা থাকা সত্তেও একটা ছবিও তোলা হয়নি।
সিদুঁরে সহেলী বা স্কারলেট মিনিভেট।
রাবার বাগান
সোজা হেটে রেলস্টেশনের পাশ দিয়ে রাস্তায় নামলাম আমরা। সূর্য উঠি উঠি করতে করতে কোন ফাঁকে উঠে গেল টেরও পেলাম না। শ্রীমঙ্গল বাজারের ঘুম ভেঙ্গে কেবল আড়মোড়া ভাঙ্গছে তখন পুরোপুরি উঠে বসেনি।
শ্রীমঙ্গল বাজার থেকে লাউয়াছড়ার সদর দরজা মোটে আট কিলোর পথ। চৈত্রের রোদের তেজ জেঁকে বসার আগেই বনে ঢুকে পড়বো। চা বাগানে ঢুকে ঢুকতে না ঢুকতেই ঘুমভাঙ্গা পাখিদের ডাকা ডাকি কান ঝালাপালা করার দশা। একটা ইলেক্ট্রিকের তাড়ের গায়ে গম্ভীর মুখে তিলা ঘুঘু (স্পটেড ডোভ) রাজকীয় স্বরে ঘুঘুঘুঘু করে চলছে। খুব পাশেই একগাদা লাল পেটের বাংলা বুলবুল নিজেদের মাঝে প্রচন্ড ঝগরা বাঁধিয়েছে, তাদের চিতকারে যেন কান পাতা দায়।
সকালের সোনালী আলোয় একদুজন করে বেড়িয়েছে মর্ণিং ওয়াকে। আরেকদল ঠেলে ভ্যানে আনারসের পাহাড় নিয়ে ছুটছে শ্রীমঙ্গল বাজারের দিকে। চা বাগানের পরে রাবার বাগান, আর এদুটোর মাঝে কিছু ক্ষেত। মনে হয় অনেকদিন পানি জমা ছিল। শুকনো খটখটে ঘেসো জমিতে ধবধবে সাদা একপাল বড় বড় বক উড়া উড়ি করতে দেখে দূর থেকে মনে হলো যেন সাদা তুলোর ফুল ফুটে আছে।
এগুলো খুব সাবধানি কাছে এগুতে দেখলেই ফুরুত পারবে। খোলা জায়গা বাদ দিয়ে পা টিপে টিপে জংলার মধ্যে দিয়ে ছোট্ট টিলাটা পার হতেই দেখলাম বকদের দলে যেন ফুল ফুটে আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ডাহুক, কিন্তু সাদার গায়ে উজ্বল বাদামী আর কালো ডানার হট্টিটি (রেড ওয়াটলেড ল্যাপউইং) তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে উঠলো –“হট-টি-টি-টি-টি-টি... নিজের পরিচয় জানিয়ে দিল জোরে সোরেই। হট্টিটি পাখি ডাহুকের মতোই। আমাদের সাহিত্যে কবিতায় গানে ভালো মতই উপস্থিত।
কিন্তু ইদানিং কালে ডোবা নালার অভাবে পাখিটা আমাদের মতো শহুরে মানুষদের কাছে অচেনাই। কাছে গিয়ে জমির আইলে লুকিয়ে ছবি নেবার প্রস্তুতি নিতে না নিতেই আমাকে দেখে ফেললো। আর সাথে সাথেই অপুর্ব কাজ করা দুই ডানা তুলে উড়াল দিল। শুন্য পথে ফাস্ট শাটার স্পিডে ক্রমাগত একটানা শাটার টিপে গেলাম। প্রিভিউ দিয়ে দেখি বেশীর ভাগই ঝাপসা হয়ে গেছে, কয়েকটা ছবিতে ফোকাসটা ঠিক ঠাকই হয়েছে।
রাবার বাগানে কিছু রাবারের ছবি নিলাম। অর্থাৎ তরল রাবার, গাছ থেকে গলে গলে গলে সাদা কষ মাটির পাত্রে জমা হচ্ছে। লজ্বাবতীর গোলাপী ফুলে লাজুক মৌমাছির ম্যাক্রো শট তুললাম একটা।
তিলা ঘুঘু বা স্পটেড ডোভ।
দার্শনিক বাঁদর।
স্কারলেট মিনিভেট বা সিদুঁরে সহেলী
Green Billed Malokoha সবুজ ঠোঁট মালকোহা।
নীলকন্ঠ টিস্টলের নাম ডাকের পরে গ্রীন কন্ঠ নামের একটা চায়ের দোকান হয়েছে, বেশ অনেক দিনই হলো। নীলকন্ঠ ৫ রঙ চাএর জবাবে এরা বিক্রি করে সাত রঙ চা। শুনেছি ইদানিং আরো কটা চা এর দোকান হয়েছে। গ্রীনকন্ঠের সামনে একটা বিশাল হোটেল বানানো হচ্ছে দেখলাম, লোকজন বললো ফাইভ স্টার।
বনের এত কাছে এত বড় আয়োজন দেখে খারাপ লাগলো। বড় টিলা গুলো পার হতে না হতেই সূর্য রোদ ছড়াতে শুরু করলো। দ্রুত হেটে বনের সীমানায় ঢুকে পড়লাম। শ্রীমঙ্গল ভানুগাছা রোড। এই রাস্তাটা কখনোই ফাঁকি দেয়নি।
এখানে উল্লুক দেখেছি, হনুমান দেখেছি এমনকি একবার লজ্বাবতী বানর (লীফ মাঙ্কি-দেখতে অনেকটা পান্ডার মতো। খুবই সুন্দর) এই রাস্তার পাশে গাছে ঝুলতে দেখেছি। এবারে তোলার মতো লেন্স আছে কিন্তু কিছু পেলাম না।
বেতবনের কাছা কাছি আসতে গিয়ে মাথার উপরে সবুজ গাছের ফাঁকে লালচে আভা দেখে আন্দাজের উপরেই টেলি ধরলাম। খুব ছোট চড়ুই সাইজের পাখি, বসেছেও অনেক অনেক উপরে।
কোন মতে ফোকাসে ধরেই ক্লিক। পরে প্রিভিউটা বড় করে দেখি স্কারলেট মিনিভেট। এটার খুবই সুন্দর একটা বাংলা নাম আছে- ‘সিঁদুরে সহেলী’। উজ্বল সিঁদুর রঙ এর শরীর ডানাটা বেগুনি ধরনের নীল। রঙ এর কারনেই সহেলীর এই নাম কিন্তু মজার ব্যাপার সহেলী বললেও আদতে এরা পুরুষ পাখি।
স্কারলেট মিনিভেট পুরুষরা উজ্বল সিঁদুরে রঙ এর হয়, আর তাদের সহেলী অর্থাৎ গার্লফ্রেন্ডের রঙ হয় হলদে রঙ এর। খুব কাছেই পাশের খাঁদে পাতার ভেতরে একটা মহিলা সহেলীকেও দেখলাম। অনেক যত্ন করে ফোকাসে নিয়ে শাটার টেপার আগমুহুর্তে ফুরুত।
গোলাপী ফুলটা লজ্বাবতী গাছের ফুল।
বুনোপথ।
মাথার উপরে উজ্বল বর্ণীল একটা ঈগল চক্কর খাচ্ছিলো। সূর্যের আলোয় রেড ইন্ডিয়ানদের পোষাকের মতো নকশা করা মোহনীয় দুই ডানার দিকে নজর ছিল। হঠাত মাঝখানে একটা ডানা ঝাপটা দেখলাম। একটা অনেক উচু গাছের মগডালে পাতার আড়ালে মিশে থাকা মহা সুন্দর পাখিটাকে চিনতে পারলাম না। সাদা পেট, নীলচে পিঠ, আর লম্বা লেজ সাদা কালো নকশাদার।
ছোট্ট সুন্দর বাঁকানো ঠোঁট দেখেই বুঝলাম শিকারী পাখি। খুবই সুন্দর, অভিজাত সাবলীল দেহভঙ্গী। পরে জেনেছিলাম পাখিটার নাম গ্রীন বিলড মালকোয়া, বাংলা নাম সে অনুযায়ী সবুজ ঠোঁট মালকোহা। একজন নামজাদা পাখি বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এর আঞ্চলিক কোন বাংলা নাম নেই? উনি বললেন, সেটা নাকি এক্সপার্টদের কাছে গ্রহনযোগ্য হবেনা। বাংলাপিডিয়াতে এই নাম দিয়েছে তাই আমাদের এটাই ডাকতে হবে।
আলফা মেল।
আমি হব সকাল বেলার পাখি...
অবশেষে লাউয়াছড়ার জঙ্গলে এসে হাজির। গেট দিয়ে সোজা ঢুকলাম। বাংলাদেশে বনগুলোতে যা হয়। টুরিস্টরা পিকনিক স্পট বানিয়ে ফেলে।
সারাদিন চেচা মেচি করে, বনের ভেতরে বনভোজন করে। ওয়াইল্ড লাইফ থাকলেও পালাতে দিশে পায়না, ফিরে এসে ধুর, কিসের বন, একটা বান্দর পর্যন্ত নেই। দুরাগত উল্লুকের ডাক শোনা যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছে খুব কাছেই কিন্তু জানি উল্লুকের পাল ডাকছে নিঃসন্দেহে মাইলখানেক দূরে। বীট অফিসের পড়েই রেল লাইন, রেল লাইনের ওপাশে একটা চা এর দোকান।
আমরা চা খাচ্ছিলাম, এমন সময় হুম হাম শব্দে দিগবিদিক কাঁপিয়ে ট্রেন আসতে শুরু করলো। লাউয়া ছড়াতে গেলে সবাই জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে ট্রেন ছুটে আসছে এই ছবিটা তুলে। আমরাও ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম ক্যামেরা নিয়ে।
লাউয়াছড়ায় ঘোরার অনেক গুলো ট্রেইল আছে, আধাঘন্টার ট্রেইল। একঘন্টার ট্রেইল, ৩ ঘন্টার ট্রেইল।
গলায় ঝুলানো জিপিএসএ সব রেকর্ড আছে। জিপিএস আছে হারানোর ভয় নেই, এই ভরসাতেই নিয়মিত ট্রেইল বাদ দিয়ে ঢুকলাম কাঠুরেদের পায়ে চলা পথ দিয়ে। ইচ্ছে ছিলো মাগুরছড়ার ওদিকে বড় একটা চক্কর দিয়ে ঘুরে ঘুরে খাশিয়া’দের গ্রামের ওদিক দিয়ে বেরুবো। ভেতরে প্রজাপতির মেলা। একটু এগুতেই একটা ভীমরাজ দেখলাম।
গাছের অনেক উচুতে অন্ধকারে প্রায় মিশে গেছে। শাটার টিপলাম, কিন্তু রেজাল্ট আসলো হতাশাজনক। খুব কাছেই উল্লুকের অনেকগুলো ডাক শুনলাম, একসাথে সোরগোল করছে। ট্রেইল ছেড়ে জঙ্গুলে রাস্তায় ঢুকে শুধু পিপড়ার কামড় খাওয়াই সার হলো। একটা উল্লুকও পেলাম না।
সঙ্গীদের খামোখাই ভুগিয়ে মারলাম। প্রায় চারটার দিকে ফিরে আসার সময় বীট অফিসের কাছেই প্রকান্ড একগাছে প্রায় ২৫/৩০টা মোটাসোটা বানরের দল পেয়ে গেলাম। তাদের ফটোসেশন করে তৃপ্ত থাকতে হলো। উল্লুক বা লজ্বাবতী বানর এযাত্রায় কপালে আর জুটলো না।
কুটুম্ববাড়িতে খেয়ে দেয়ে বিকাল ৫টার বাসে চাপলাম।
শেষ হলো ১২ ঘন্টার ফটোওয়াক। রাত ১০টাতেই চলে এলাম ঢাকায়।
হট্টিটি
হট্টিটি
হট্টিটি
উড়াল দেবার আগে হট্টিটি।
ক্যামোফ্লেজড পোকা।
ইস আমার যদি ডানা থাকতো, আমি এই স্টাইলে উড়তাম।
লোকাল ট্রেইন
কানাকুয়ো বা কুবো বা গ্রেটার কাকুল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।