বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ নদীর ধারে ন্যাড়া একটা গাছ। রক্তবর্ণের আকাশে অনেক কাক উড়ছিল। কোথাও এক ফোঁটা বাতাস নেই ।
সন্ধ্যার মতো যেন গাঢ় ছায়ার নদীর ওপারে ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছিল অনিন্দিতা। সে চিৎকার করে ওকে ডাকে। শব্দহীন অন্ধকারের দেশে সে চিৎকার প্রতিধ্বনি তোলে। বারবার। বারবার।
তারপরই আকাশের আলো যেন নিভে যেতে থাকে। চারপাশে কেমন এক গুঞ্জন ...
তার ঘুম ভেঙে যায়। তার চারপাশে সে অন্ধকার টের পায়; মাথার ওপরে ফুল স্পিডে পাখা ঘুরছিল। বাতাসে এয়ার ফ্রেশনারের মৃদু গন্ধ। ক্ষীণ মাথা ব্যথা।
দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলে এরকম হয় তার। গলার কাছে ঘাম। বালিশের পাশে মোবাইল। ওটা তুলে দেখল রাত তিনটা বাজতে দশ মিনিট। একটা টেক্সট ম্যাসেজ এসেছে।
অনিন্দিতা । লিখেছে: আমার রাত কাটে না ...
রাজিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জানলার বাইরে নীরব রাত। থমথম করছিল। একটা সিগারেট ধরায় ।
ল্যাপটপটা বিছানার ওপর । অন করে। অন্ধকারে মৃদু আলো ছড়ায়। ডিসপ্লেজুড়ে অনিন্দিতার সুন্দর মুখ। গত বছর ওরা শিক্ষাসফরে গিয়েছিল সেন্ট মার্টিন ।
সাগরপাড়ের সেই ছবি। তখন কত স্বপ্ন ছিল, আশ্বাস ছিল। আর আজ ... রাজিব- এর বুকের ভিতরে টুপ করে কী যেন খসে পড়ে। সিগারেটে টান দেয় সে। অন্যমনস্কভাবে।
বাকি রাতটুকু আর ঘুম এল না। পর্দা গলে ঘরে ভোরের আলো ঢোকে। ঘুম ঘুম চোখে শুয়েছিল বিছানায়। নিশাত চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল। অনিন্দিতা কে বিয়ে করবে ...এরকম ঘোষনার পর থেকে এ বাড়িতে একরকম একঘরে হয়ে আছে রাজিব।
ছোটবোন নিশাত এরই সাপোর্ট যেটুকু পায় সে । নিশাত লালমাটিয়ায় পড়ে। স্কুল পড়ার সময় অঙ্কে ভীষণ কাঁচা ছিল। (মেয়েবেলায় একবার প্যারাটাইফয়েড হয়েছিল ওর। ) রাজিব ধৈর্য ধরে ওকে অঙ্ক মারপ্যাঁচ শিখিয়ে দিয়েছিল।
নইলে নিশাত এসএসসিটা পাস করত কিনা সন্দেহ। তারপর থেকেই নিশাত রাজিব-এর নেওটা। চায়ের কাপ দিতে দিতে নিশাত একটা দুঃসংবাদ দিল। নাসরীন আপা এ মাসের ২৫ তারিখে আসছে । তখন তোমার বিয়ে ভাইয়া ।
আব্বু পুরান ঢাকার কার সঙ্গে যেন কথাবার্তা বলছে। মেয়ে নাকি খুব নামাজী।
রাজিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
নিশাত দুঃসংবাদ দিয়ে চলে যায়। রাজিব সিগারেট ধরায়।
ধীরে চায়ে চুমুক দেয়। আমি নামাজী মেয়ে নিয়ে কি করব। আমার অনিন্দিতাকেই চাই। অনিন্দিতার বাবা একটা সরকারি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক। ভারি উদার এবং অমায়িক মানুষ।
অধ্যাপক আহমেদ রেজা রাজিবকে আরও সময় দিতে চাইলেও তাঁর ছেলেমেয়েরা চাচ্ছে না। তারা চাইছে তাদের বাবা ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হবেন, লন্ডন-নিউইয়র্ক ঘুরে বেড়াবেন । অধ্যাপক আহমেদ রেজার বড় ছেলে থাকে অষ্ট্রেলিয়া; মেজ ছেলে নিউইয়র্ক; বড় মেয়ে কানাডা, মেজ মেয়ে লন্ডন। রাজীব সবই বোঝে। তবে ওর কিছু করার নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অনেকবারই এ বাড়ি এসেছে অনিন্দিতা । ছোটবোন নিশাত ছাড়া অনিন্দিতা কে এ বাড়ির কারও পছন্দ হয়নি। রাজিব এর বড় বোন নাসরীন কানাডা থাকে। সেই নাসরীন আপাও রাজি না। এ এক রহস্য।
গত বছর রহিম-আফরোজ-এ চাকরি পাবার পর রাজিব মাকে অনিন্দিতা কে বিয়ের কথা বলল। মার মুখ তখন কালো হয়ে যায়। বলে, তোর বাবা রাজি না। আগামী বছর এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে আসবে নাসরীন । তখন তোর বিয়ে।
মুখটা কেমন তেতো হয়ে আছে। আধখাওয়া সিগারেট চায়ের কাপে ডুবিয়ে আরেকটা ধরায় রাজিব। আলকাতরা পোড়া গন্ধ ছড়ায় ঘরে। শরীর কেমন গুলিয়ে ওঠে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও একবার বাথরুমে যায়।
আজ শুক্রবার। বেলা যতই বাড়ছিল রাজিব ততই অস্থির বোধ করতে থাকে। একবার বাজারে যাওয়া দরকার। আজ আবার জুম্মাবার। নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত পরা নাহলেও জুম্মা মিস করে না রাজিব।
অনিন্দিতা জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ... প্রতিমুহূর্তে বড় অসহায় লাগে। শহরটা আর তার মানুষকে বড় কঠিন মনে হয়। (অথচ এরকম ভাবতে চায় না সে ) ...অসহায় মুহূর্তে মসজিদের আতরগন্ধী নিঃশব্দতায় আনত সেজদায় একান্ত প্রার্থনায় মনে গভীর শান্তি জোটে ...
রাজিব তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ড্রইংরুমে মা আর বাবা পাশাপাশি বসে টিভি দেখছে। দৃশ্যটায় কী ছিল, রাজিব একদলা অভিমান টের পায় বুকের ভিতরে।
ওর বেতন ভালোই। তাছাড়া মাস দুয়েক হল অনিন্দিতাও ব্যাংক এশিয়ায় জয়েন করেছে। সে মা-বাবার মতামত অগ্রাহ্য করে অনিন্দিতাকে বিয়ে করে আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতে পারে। কিন্তু তা সম্ভব না । গত অক্টোবরে বাবার একবার মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গেছে।
সমস্যা এখানেই। বাবা ছেলেমেয়েদের অসম্ভব ভালোবাসেন। ছেলেবেলায় এখানে ওখানে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। শৈশবে কক্সবাজারে সমুদ্র দেখার স্মৃতি আজও মনে রেখেছে রাজিব । সেই বাবার কোনও ক্ষতি হোক রাজিব তা চায় না ...
আফরোজা ডাইনিং টেবিলে বসে চা খাচ্ছিল।
রাজিবকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল। রাজিব- এর এই বোনটি ঢাকার একটা প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে পড়ে। আফরোজা যখন কলেজে পড়ে, সে সময় একটা ছেলের সঙ্গে আফরোজাকে বেইলি রোড দেখেছিল রাজিব। সেই কথা বাসায় বলাতে রুবেল ভাই আফরোজাকে বেল্ট দিয়ে মেরেছিল । তারপর থেকে ভাইবোনের কথা বন্ধ।
অনিন্দিতা কে আফরোজার অপছন্দ করাই স্বাভাবিক ।
সোমা ভাবী সোফায় বসে। ফারিয়া কে কোলে বসিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে। রুবেল ভাই মনে হয় ঘরে। ঘুমাচ্ছে? সোমা ভাবিও অনিন্দিতা কে অপছন্দ করে।
এর এক কারণ হয়তো সোমা ভাবী আর আফরোজার সর্ম্পক ভালো। দ্বিতীয় কারণ, অনিন্দিতা দারুন সুন্দরী। যাকে বলে ক্লাসিক বিউটি। ওর চলাফেরায় এক ধরনের শান্ত গাম্ভীর্য আছে। সোমা ভাবী সুন্দরী হলেও শ্যামলা।
হয়তো সে কারণেই সোমা ভাবী জেলাস। আর হয়তো ভাবছে সংসারের কর্তৃত্ব অনিন্দিতার হাতে চলে যেতে পারে। আর রুবেল ভাই তো শতকরা একশ ভাগ Uxorious ... সোমা ভাবির কথায় উঠে আর বসে। তার কথা বলে কী লাভ?
বাইরে এপ্রিল মাসের কটকটে রোদ। রাজিব হাঁটতে থাকে।
সংসারের এতগুলি মানুষ অনিন্দিতা কে মেনে না নিলে মা- বাবাই বা মেনে নেন কীভাবে? হতাশ বোধ করে রাজিব। অনিন্দিতা কে হারিয়ে ফেলবে ভাবতেও পারে না। অনিন্দিতা একটু অন্য রকম। কবিতা লেখে । হঠাৎ হঠাৎ মেজাজ খারাপ করলেও অনেক কনসিডারেট অনিন্দিতা, কখনও সিনক্রিয়েট করে না বা বন্ধুদের সামনে কখনও রাজিব-এর সমালোচনা করে না।
রাজিব জানে, বিবাহিত জীবন অন্য অনেকের তুলনায় অনেক সুখের হবে ওদের। রাজিব জানে, God has a plan ...
বাঁ দিকে রুবি ফার্মেসি। ফার্মেসি থেকে কোটপ্যান্ট পরা ফরসা চেহারার এক যুবক বের হয়ে এল। কামরুল না? তাই তো মনে হচ্ছে। অনেক দিন পর কামরুলকে দেখল রাজিব।
স্কুল জীবনের বন্ধু কামরুল । খিলগাঁও থাকত। দেশের বাড়ি বরিশাল। ওর বাবা খিলগাঁও রেলক্রসিংয়ের কাছে মায়া ফার্মেসি তে বসত।
রাজিব দ্রুত এগিয়ে যায়।
কামরুল ওকে ঠিকই চিনতে পেরেছে। কামরুল হাসে। তারপর পুরনো বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বলে, কেমন আছিস দোস্ত?
এই তো।
কামরুলের শরীর থেকে কেমন ভুরভুর করে সুগন্ধী বেরুচ্ছে ।
অনেকটা পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের মেকআপ-এর মতো ফরসা নরম পেলব গাল।
কোথায় আছিস? জিজ্ঞেস করে কামরুল।
রহিম আফরোজ। তুই?
কথাটা শুনে কামরুল যেন অবাক হল। বলল, সে কী! তুই টিভি দেখিস না? মাই টিভি?
রাজিব বলল, আসলে সময় পাই না দোস্ত।
অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে আটটা ন’টা বেজে যায়। আজকাল টিভি দেখাই হয় না।
কামরুল বলল, আমি রুমন অ্যারোমা নামে মাই টিভিতে একটা প্রোগ্রাম করি।
রাজিব অবাক। ও আচ্ছা।
রুমন আমারই ছদ্মনাম দোস্ত। বলে হাসে কামরুল। তারপর বলে, লোকে এখন কামরুল হাসান মনুকে রুমন নামেই চিনে। এই যে আমার কার্ড রাখ। বলে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে তার ভিতর থেকে একটা সবুজ রঙের ভিজিটিং কার্ড বের করে দিল।
রাজিব ভিজিটিং কার্ডে দ্রুত চোখ বুলায়। অদ্ভূত সব ডিগ্রি । চায়নার সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে কী সব করছে। হিমানী অ্যাগ্রো কেমিকেলস -এর চেয়ারম্যান কামরুল। হেডঅফিস: ৯/২ চাংখার পুল।
রাজিব বেশ মজা পায়। তার বিষন্নতা কাটতে থাকে। স্কুলজীবনে গাধা টাইপের ছেলে ছিল কামরুল। কথায় বরিশালের টান ছিল। ক্লাস টেনে পড়ার সময় ওর চে বয়সে বড় এক খালাতো বোনকে নিয়ে পালিয়েছিল কামরুল।
তার পর আর কোনও খবর জানে না রাজিব। অনেক বছর পর আজই দেখা হল।
কামরুল বলে, দোস্ত, আমি রুমন অ্যারোমা নামে কয়েকটা বিউটি প্রোডাক্ট বাজারজাত করতেছি । এই রুমন ফেয়ার অ্যান্ড সফট উপটানটা রাখ। তোর বউকে কে দিস।
বলে কোটের পকেট থেকে নীল রঙের ছোট্ট একটা বক্স বার করে কামরুল। কামরুলের কন্ঠস্বরে বিজ্ঞাপনের ভঙ্গি স্পষ্ট।
উপটানের বক্সটা নিয়ে রাজিব বলল, চল, দোস্ত। আমার বাসায় চল। আমার বাসা কাছেই।
আইজ না, অন্যদিন। আজ আমার দোস্ত এক ফিলমের নায়িকার সঙ্গে অ্যাপয়েনমেন্ট আছে। আমার অনুষ্ঠানের জন্য কনটাক্ট সাইন করার কথা । আমাকে এখনই উত্তরা যেতে হবে।
নায়িকা? নাম করা কেউ?
না, না।
নাম করা কেউ না। উঠতি নায়িকা। নাম হইল সিন্থিয়া । একটা ছবি করছে মাত্র। তবে চেহারায় চমক আছে।
ফরসা। মুখের কাটিংও ভালো। সিন্থিয়া টিভিতে আমার বিউটি প্রোডাক্ট সম্বন্ধে ভালো কথা বললে প্রোডাক্ট মার্কেটে ভালো চলবে ইনশাল্লা।
ঠিক তখনই রাজিব- এর মাথায় আইডিয়া আসে। সে বলে, তোর প্রোগ্রামে আমার পরিচিত কাউকে চান্স দিবি দোস্ত?
এনি টাইম দোস্ত, এনি টাইম।
তুই হইলি গিয়া মোর স্কুল জীবনের ফ্রেরেন্ড। আমার কাছে তোর খাতিরই আলেদা। বলতে বলতে কামরুল উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
রাজিব দ্রুত ভাবতে থাকে। খালি একটা সিএনজি যাচ্ছিল।
কামরুল হাত তুলে সিএনজি দাঁড় করায়। তারপর সিএনজিতে ওঠার সময় বলে, কার্ডে আমার মোবাইল নাম্বার আছে দোস্ত। ফোন দিস।
কথাটা অনিন্দিতা কে জানাল রাজিব।
অনিন্দিতা ফোঁস করে ওঠে।
তাই বলে মাইটিভি? নেভার। আমার কলিগরা কি বলবে।
প্লিজ, অনি। বোঝার চেষ্টা কর । তোমাকে টিভিতে দেখলে আমার বাসার লোকজন তোমার ওপর ইমপ্রেসড হবে।
শোন, অনি। কামরুলের সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে। কামরুল জাস্ট তোমাকে জিগ্যেস করবে রুমন ফেয়ার অ্যান্ড সফট উপটান মেখে উপকার হয়েছে কি না। তুমি বলবে রুমন ফেয়ার অ্যান্ড সফট উপটান মেখে অল্পদিনের মধ্যেই আমার স্কিন আগের চেয়ে অনেক সফট আর ব্রাইট হয়ে উঠেছে। প্লিজ, এটুকু বললেই চলবে।
অনেক কষ্টে কামরুলকে রাজি করিয়েছি।
ওকে।
তখন মুখে যাই বলুক- ওর প্রোগ্রামে অনিন্দিতাকে নিতে সহজে রাজি হয়নি কামরুল। বোধহয় উঠতি নায়িকা ছাড়াও ওর কাছে সুন্দরী নারীর দীর্ঘ লিষ্ট আছে। সম্ভবত তাদের কাছ থেকে টাকাও পায় ।
এসব কারণেই হয়তো এড়িয়ে যাচ্ছিল কামরুল। তবে হতাশ হয়নি রাজিব । অফিস থেকে লোক পাঠিয়ে কামরুল- এর মালিবাগ- এর বাড়িতে আইপিএস ইন্সটল করে দেয়। হাজার বিশেক টাকার মতো খরচ হল। এরপর কামরুল নিজেই ফোন করে ওর প্রোগ্রামে অনিন্দিতার জন্য দু’মিনিট সময় দেবে বলে জানাল।
অফিসের পর চাঙারপুলে কামরুলের হিমানী অ্যাগ্রো কেমিকেলস -এর হেড অফিসে গিয়ে এক পাতার ক্রিপ্ট নিয়ে এল রাজিব। (রাজিব অবশ্য ওর সঙ্গে অনিন্দিতার সর্ম্পকের ব্যাপারটা কামরুলকে খুলে বলেনি। একেবারে বিয়েতে দাওয়াত দিয়ে সারপ্রাইস দেবে। ) ...
তারপর ধানমন্ডির এক নিরিবিলি কফিশপে বসে রিহার্সেল।
রাজিব ক্রিপ্ট থেকে পড়ে, আজ আমরা মিস অনিন্দিতার সঙ্গে কথা বলব।
আচ্ছা মিস অনিন্দিতা আপনি কি রুমন ফেয়ার অ্যান্ড সফট উপটান ব্যবহার করেন।
হ্যাঁ। করি। (অনিন্দিতা বলে)
ফাইন। আচ্ছা, মিস অনিন্দিতা।
বলুন।
আপনি কি রুমন ফেয়ার অ্যান্ড সফট উপটান ব্যবহার করে কি কোনও উপকার পেয়েছেন?
হ্যাঁ। আমি রুমন ফেয়ার অ্যান্ড সফট উপটান ব্যবহার করে অনেক উপকার পেয়েছি।
যেমন?
যেমন আগে আমার স্কিন শীত কি বর্ষার দিনে খসখসে হয়ে থাকত। তারপর আমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে আমি রুমন ফেয়ার অ্যান্ড সফট উপটান ব্যবহার করতে শুরু করি।
আচ্ছা মিস অনিন্দিতা। আপনি কোন পত্রিকায় রুমন ফেয়ার অ্যান্ড সফট উপটান- এর বিজ্ঞাপন দেখেছেন?
দৈনিক ডেসটিনি।
ওহ্। তারপর কী হল বলুন?
তারপর রুমন ফেয়ার অ্যান্ড সফট উপটান ব্যবহার করে অল্পদিনের মধ্যেই আমার স্কিন আগের চেয়ে অনেক সফট আর ব্রাইট হয়ে উঠেছে।
ধন্যবাদ।
রিহার্সেলের সময় অনিন্দিতা হাসতে হাসতে শেষ ...বলে, তোমার এই বন্ধুকে কোত্থেকে জোটালে?
গড হ্যাজ আ প্ল্যান। রাজিব মনে মনে বলে।
এরপর নিশাত -এর সঙ্গে গোপনে জরুরি মিটিং। তার কারণ আছে। রাজিবদের বাড়িতে মাইটিভি দেখে না।
কাজেই অনিন্দিতার প্রোগ্রাম মিস হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। রাজিব নিশাতকে জানিয়ে দিল, এপ্রিলের সাত তারিখ রাত নটায় মাই টিভিতে অনিন্দিতার প্রোগ্রাম । তুই খেয়াল রাখবি, সবাই যেন অনুষ্ঠান দেখে।
ওকে।
সাত তারিখ সন্ধ্যা সাড়ে আটটার মধ্যে অফিস থেকে ফিরল রাজিব।
তারপর ডেক্সটপের সামনে বসল । রাজিব- এর ডেক্সটপে ইন্টারনাল টিভি কার্ড আছে। অনিন্দিতার প্রোগ্রাম রেকর্ড করবে। জীবনের স্মৃতিময় ঘটনা। হয়তো বহু বছর পর ভিডিও ফাইলটা দেখে তখনকার কোনও বিষন্নতা কেটে যাবে।
কিন্তু ট্রিকসটা কাজ করবে তো? মনে হয় করবে। বাংলাদেশের মানুষ এখন বোকাবাক্সটার মোহে আচ্ছন্ন। বোকা বাক্সের পর্দায় যাদের দেখা যায় তাদের স্বর্গীয় জীব বলে মনে হয়। গত বছর মাঝামাঝি এই অ্যাপার্টমেন্টে কার জন্মদিনে যেন সোলস এর পার্থ বড়ূয়া এসেছিলেন । রীতিমতো হুলুস্থ’ল পড়ে গিয়েছিল তখন।
অনিন্দিতা কে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল। সুন্দর একটা শাড়ি পরেছিল। অনিন্দিতা এমনিতেই অনেক সুন্দরী। টল। ফরসা।
অনিন্দিতা কে স্টুডিওতে নিয়ে গেছেন ওর বাবা । অধ্যাপক আহমেদ রেজার মেয়ের প্রোগ্রামের ব্যাপারে প্রচুর উৎসাহ।
দরজা খুলে গেল। নিশাত উঁকি ছিল। ওর মুখ ঝলমল করছিল।
ফিসফিস করে বলল, ভাইয়া টিভিতে অনিন্দিতাপুকে দেখে সবাই ভীষণ এক্সসাইটেড হয়ে পড়েছে।
রাজিব মুখ টিপে হাসে। তেমনই তো হওয়ার কথা। এরা, এই বোকা বাক্সের মোহে আচ্ছন্ন মানুষেরা সত্যিকার মানুষটাকে কখনও চেনার চেষ্টা করে না । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চেয়ে এদের কাছে কৃত্রিম বানোয়াট উপটানই বড় ...
একটু পর দরজা খুলে যায়।
মা। রাজিব টেবিলের ওপর পা তুলে বসে ছিল। চট করে পা নামিয়ে ফেলে। মা বলে, টিভিতে অনিন্দিতার অনুষ্ঠান ছিল, আগে বলবি না? কন্ঠস্বরে স্পষ্ট বিরক্তি।
কই, আমিতো কিছু জানি না।
এই মাত্র দেখাল। মাইটিভি তে। ভাগ্যিস নিশাত চ্যানেল ঘুরিয়েছিল । মমতাজ বেগম- এর কন্ঠস্বরে চাপা উত্তেজনা।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
রাজিব মুচকি হাসে।
ওদিকে ড্রইংরুমে বসে নিশাত বলে, বাবা, অনিন্দিতাপুর তো একটা টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করার কথা আছে । আমাকে ফোন করেছিল অনিন্দিতাপু । তখন বলল।
বলিস কী! সিরিয়াল নাটক! বাবাকে রীতিমতো আঁতকে উঠতে দেখল নিশাত।
হ্যাঁ। সেই সিরিয়ালে নাকি মোশারফ করিম- এর অভিনয় করার কথা।
বলিস কী! মোশারফ করিম!
হ্যাঁ। তাই তো বলল অনিন্দিতাপু।
নিশাতের বাবার নাম খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান।
ইদানীং ভদ্রলোক বেশ মুটিয়েছেন। মাথার ওপর বোঁ বোঁ করে পাখা ঘুরতে থাকলেও এখন ঘামতে শুরু করেন।
অনিন্দিতার প্রোগ্রামের ভিডিও ফাইলটা ইউ টিউবে আপলোড করছিল রাজিব । আপলোড শেষ হলে ফেসবুকে লিঙ্ক দেবে। ফ্রেন্ড সার্কেলে কী ভীষণ হইচই পড়ে যাবে ।
অনিন্দিতা কে দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছিল। ওর চাপা আনন্দ হয়। রাজিব জানে অনিন্দিতার মতো আর কেউই নেই, এই শহরে, এই দেশে, এই পৃথিবীতে; না তা হতে পারে না। রাজিব জানে- God has a plan for us all ...
দরজা আবার খুলে যায়। মা।
ভীষণ নরম সুরে বলল, তোর বাবা বলল একদিন অনিন্দিতার মা-বাকে দাওয়াত করতে।
আমাকে বল কেন? ইচ্ছা হলে তোমরা কর।
দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
রাজিব ঝুঁকে টেবিলের ওপর থেকে মোবাইল তুলে নেয়। এখনই ফুলচার্জ দিয়ে রাখতে হবে ।
আজ সারারাত কথা হবে ... আজ রাতে আর দুঃস্বপ্ন নয় ...সন্ধ্যার অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া নয় ... গড হ্যাজ আ প্ল্যান ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।