আকাশ ভরা গাঙচিল
ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসার আগ পর্যন্ত কখনো এক কাপ চাও বানাই নাই। কিন্তু এখানে আসার পর রীতিমত রান্নার কলা কৌশল শিখে গেছি। যদিও প্রথম রান্নার অভিজ্ঞতা একদম সুখকর ছিল না। একদিন তিনটা আলু সেদ্ধ করতে দিয়েছি। সেদ্ধ কখন হবে কখন হবে এই আশায় উত্তপ্ত পানির দিকে তাকিয়ে আছি।
আলু সেদ্ধ হবার কোন নাম গন্ধ নেই। ভাবলাম ঘুরে আসি একটু। বাইরে থেকে এসে দেখি তিনটা আলু ৪ টা হয়ে গেছে। বিস্ময়ে চোখ আমার আলুর মতোই বড় বড় হয়ে গেছে। আলু ঠাণ্ডা হবার পর দেখি বর সাইজের একটা আলু ফেটে গিয়ে দুই টুকরা হয়ে গেছে।
এই ঘটনা বাড়িতে শোনার পর সবাই প্রচুর হাসাহাসি করেছিল। এখনো মনে পড়লে হাসে। ২য় রান্নায় বানালাম চা। এখানে কোন সমস্যা হয়নি। একবারেই ঝাক্কাস চা করে ফেলেছিলাম।
তখন ছিল সিলেটের কনকনে শীত। গরম পানি করতে দিয়েছি গোসল করার জন্য। বাথরুম থেকে এসে গলায় গামছা পেঁচিয়ে গামছার এক দিক গুটিয়ে জ্বলন্ত চুলার উপর থেকে হাঁড়ি নামাতে গিয়ে গামছার চিকন সুতোয় দাউ দাউ করে আগুন ধরে যায়। আমি গরম পানি ভর্তি হাঁড়ি হাতে নিয়ে কি করবো বুঝতে পাড়ছি না। পরে দ্রুত হাঁড়ি আগের জায়গায় রেখে গলায় প্যাঁচানো গামছা খোলার চেষ্টা করছি।
কিন্তু কিছুতেই গামছা খুলতে পাড়ছি না। এইদিকে আগুন বেড়েই যাচ্ছে অন্যদিকে মানুষের আগুনে পুড়ে যাবার ঘটনা ভেবে বিশাল ভয় পেয়ে গেছি। ভাগ্য ভাল ছিল যে কারণে গামছার আগুন বুক পর্যন্ত আসার আগেই গলার প্যাঁচ খুলে ফেলেছিলাম। তারপর কান মলা দিলাম পরবর্তীতে আর চুলা বন্ধ না করে চুলার কাছে যাবার মতো সাহস না দেখাব না।
নতুন বাড়ি থেকে এসেছি।
খিদা লাগলেই বাইরে যেতে হয়। বন্ধুরা বিস্কিট এনে রেখে দিত। খিদা পেলে খেত কিন্তু বিস্কিট আমার কাছে বিরক্তিকর একটা খাবার। ভাবলাম নুডলস বানাবো। বাড়িতে দেখেছি কিভাবে বানায়।
অনেক ভাব টাব নিয়ে নুডলস বানাতে গিয়ে কিচেন থেকে যে প্রডাক্ট নিয়ে এলাম সেটাকে কেউ নুডলস বলে নুডলসকে লজ্জা দিল না। সবাই ঝাল হালুয়া খেয়ে নুডলস খাবার ইচ্ছা লুকিয়ে ফেলে চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। একদম প্রথম দিকের কথা যে কারনে আজকের এই বন্ধুরাই মারকাট টাইপের আচরণ সেদিন সেদিন করেনি।
একটু একটু করে অনেক কিছু রান্না করতে শিখে গেলাম। এর মাঝে আছে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা সেমাই, সুজি আর তরকারি পছন্দ না হলে ডিম ভেজে ভাত খাওয়া।
আমি চমৎকার ডিম ভাজি করতে পাড়ি। তেল একটু বেশি পরিমানে দিলে ডিম ভাজি এতো সুন্দর ফুলে ফেপে মোটা হয়ে যায়, দেখতেই মনে হয় এখনই খেয়ে ফেলি। খেতে দেরি অবশ্য হয় না।
এর কিছুদিন পর শিখলাম দুধ জাল দেয়া। ঝরঝরে সাদা ভাত রান্না করা শিখলাম নিজে নিজে।
একদিন ভাত রান্না করতে গিয়ে ইচ্ছে করেই প্রচুর পানি দিয়ে ফেলেছিলাম আর সাথে চামচ দিয়ে একবারো নারা দেই নাই। ফলাফল ঝরঝরে সাদা ভাত। ওয়াও...
ভাত হল কিন্তু এবার ডাল রান্না করা দরকার। বাড়িতে ফোন দিলাম কি করে ডাল রান্না করতে হয়। কানে ফোন চেপে রেখে ডিরেক্সন শুনছি আর ডালের জন্য মসলা দিচ্ছি।
বেশ কিছুক্ষণ পর দেখি নাইস ডাল হয়ে গেছে। একদম বাড়িতে যেমন হয় ঠিক সেরকম এবং অবশ্যই মেসের বুয়ার চেয়ে সুন্দর।
গত বছর ঈদে প্রজেক্টের কাজের জন্য বাড়িতে যাইনি। তাই নিজেকেই রান্না করতে হবে। ডাল, ভাত, ডিম ভাজি পাড়ি কিন্তু খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে।
পূর্বের মেসের এক ছেলের সাথে জয়েন্ট খিচুড়ি রান্নার অভিজ্ঞতা দিয়ে এবার একা একাই লেগে গেলাম খিচুড়ি রাঁধতে। পেঁয়াজ, মরিচ ভেজে নিয়ে তাতে হলুদ, লবন দিয়ে চাল ডাল ভেজে নিলাম। একটু পর তাতে পানি ঢেলে দিয়ে ছোট ছোট আলুর টুকরা ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করছি। অনেক ক্ষণ পর হাঁড়ীর উপরের ঢাকনা ক্যার ম্যার করে পড়ার শব্দে ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে দেখি খিচুরির পানি লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে পরে যাচ্ছে। আগুনের তাপ কমিয়ে দিলাম।
এরপর একটু একটু করে সময় যাচ্ছে আর আমার সাধের খিচুড়ি ওরিজিনাল খিচুরির রঙ ধারন করছে। তখন আমার আনন্দ দেখে কে! খিচুড়ি রান্না শেষ। এবার রাধলাম আলু ভাজি। প্রথম দিকে আলু ভাজির সব আলুগুলো একসাথে জয়েন্ট হয়ে থাকত। মনে হতো শয়তান আলু গুলোর মাঝে আন্ত আণবিক শক্তি প্রচুর।
কোন ভাবেই এই শক্তিকে হারাতে পারিনি। একদিন বুঝলাম আলু অনেক ছোট করে কাটতে হয় এবং কাটার পর খুব ভাল করে ধুয়ে নিতে হয়। ব্যাস এই বুদ্ধিতেই নাইস আলু ভাজি করে ফেললাম। এবার খাওয়ার পালা। পাবলিক পালাবে কোথায়? এমন চমৎকার খিচুড়ি আমি আমার মার হাতেও খাইনি।
অসাম খিচুড়ি। এমন মজার রান্না যে, রাতেও এই খিচুড়ি খেলাম। তারপর শান্তির একটা ঘুম দিয়ে সকালে উঠে মেজাজ চরমে, আজ তো রান্না করার ইচ্ছে হচ্ছে না।
সেদিন তিনজন মিলে রান্না করলাম সিদল ভর্তা। এই রান্না অনেক সহজ।
শুঁটকি শুধু গরম পানিতে ধুয়ে নিতে হবে যেন আইশ না থাকে। তারপর কিচেনে যত মসল্লা থাকবে তার সবগুলোই পরিমানে একটু বেশি বেশি করে দিয়ে তেলে ভাজতে হবে। প্রথমেই কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ কুঁচি ভেজে নিতে হবে তারপর সেখানে যাবতীয় মসলা দিতে হবে। সব কেমিক্যাল নিজের সাথে বিক্রিয়া করা শুরু করলে তাতে ধুয়ে রাখা শুঁটকি ছেড়ে দিয়ে চামচ দিতে গুরা করতে হবে। একটু সময় পরই সুন্দর সিদল ভর্তা হয়ে যাবে এবং শুধু মাত্র সেই ভর্তা দিয়ে পুরা ২ প্লেট ভাত অনায়াসে খাওয়া যাবে তৃপ্তি নিয়ে।
আমরাও সেদিন গপ গপ করে খেয়ে ফেলেছিলাম।
অনেক ভাবার পর কি করে নুডলস বানাতে হয় তা আবিষ্কার করলাম। যেমন নুডলস খুব অল্প সেদ্ধ করতে হবে। তারপর কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ কুঁচি ভেজে নিয়ে তাতে ডিম ভেঙ্গে ছেড়ে দিতে হবে এবং পেঁয়াজ মরিচের সাথে সুন্দর করে মিশাতে হবে। মিশে গেলে পানি ছাড়িয়ে রাখা সেদ্ধ নুডলস ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ ভেজে নিতে হবে।
তারপর আবার গপ গপ...
এই টাইপ নুডলস রান্নায় সাকসেস হবার পর ২য় পদ্ধতি শিখলাম আমার এক ফ্রেন্ডের কাছ থেকে। ম্যাগি নুডলসের ছোট প্যাকেটের সব নুডলস পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। সেদ্ধ হয়ে গেলে তাতে মসলা ছেড়ে দিতে হবে। এই টাইপ নুডলস রান্না করতে সর্বোচ্চ ৫ মিনিট লাগবে। এই রান্নাকে আমি একটু মডিফাই করলাম।
যেমন কেউ যদি নুডলসের ঝোল খেতে চায় তবে পানির পরিমান একটু বাড়িয়ে দিতে হবে। শুধু পানির পরিমান বারালেই চলবে না সাথে একটু লবন এবং শুকনা মরিচ গুরা দিয়ে দিতে হবে। সাথে নুডলসের সাথের দিয়ে দেয়া মসলা তো আছেই। আর কেউ যদি সেম মেকানিজমে শুকনা নুডলস খেতে চায় তবে পানি খুব কম পরিমানে দিতে হবে এবং বাদ বাকি প্রসেস সেম শুধু রান্না করার পর কিছু সময় রেখে দিতে হবে যেন অবশিষ্ট পানিও শুকিয়ে যেতে পারে। আমি সব সময় এই শেষের দুই টাইপের নুডলসই রান্না করি এবং সকালের নাস্তায় হাফ বয়েল ডিম এবং নুডলস খাই।
সব দিন না, মাঝে মাঝে, যেদিন বুয়া আসে না।
আমার নিজের রান্না বান্নার ইতিহাস নিয়ে একটা পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে ছিল। অত্যধিক অলস হওয়ার কারণে লেখাও হয়নি, পোস্ট দেয়াও হয়নি। শশী যেবার সিলেট এসেছিল এই পোস্ট সে সময়ই লেখা। কিন্তু অত্যধিক বড় হয়ে যাওয়ায় সে পোস্ট সামুতে আর পোস্ট করতে পারিনি।
আজকে অনেক দিন পড় ব্লগার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ইচ্ছে হল। তাই অপ্রকাশিত পোস্টের চুম্বক অংশ নিয়ে হাজির হলাম। এখানে একটা কারণ অবশ্য আছে। কিছুদিন আগে মনে হল, বেঁচে থাকতে হলে যে সব প্রয়োজনীয় কার্যকলাপ আয়ত্তে রাখতে হয় আমি সে সব কার্যকলাপে সিদ্ধহস্ত। সুতরাং কেউ পাশে না থাকলেও অন্তত বেঁচে থাকতে পাড়ব।
আর বেঁচে থাকাই মানব জীবনের সার্থকতা। বেঁচে থাকুন আর মন ভরে খান। আমিও খাই। এখন ক্ষুধা না লাগলেও খাই। খাওয়া ছাড়া আমি আর কোন কিছুতেই সুখ পাই না...
উৎসর্গঃ ব্লগের জনপ্রিয় সব রেসিপিদাত্রী আপু এবং কিছু সংখ্যক ভাইয়ার উদ্দেশ্যে আমার এই পোস্ট।
তাঁদের রেসিপি পোস্টে আমি রাগ, দুঃখ, কান্নার ইমো দেখিয়ে আসতাম, সাথে মাইনাচ দিতে ভুলতাম না। আজ আমি নিজেই মাইনাস খাবার জন্যে রেডি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।