বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ গলুয়ের ওপর একটা পলিথিনের ব্যাগ পড়ে আছে। টলটলে পূর্ণিমার আলোয় পরিস্কার দেখা যায়- পলিথিনের ব্যাগের ভিতরে কী যেন। অল্প অল্প লাফাচ্ছে।
মিনিট কুড়ি আগে লাটের বিলে গোলাপ মাঝির সঙ্গে দেখা হয়েছিল দুলু ব্যাপারীর । সেই পলিথিনের ব্যাগে ভরে একটা কাল বাউশ নৌকায় তুলে দিল । লাটের বিলের দক্ষিণে খালির চর গ্রামে গোলাপ মাঝির বাড়ি। এই বৃদ্ধ বয়েসেও মনের সুখে লাটের বিলে রাতবিরাতে মাছ ধরে বেড়ায় । গেল আষাঢ় মাসে গোলাপ মাঝির মেজো ছেলের ঘরে এক নাতি হয় ।
কথাটা শোনার পর সোলায়মানকে দিয়ে গোলাপ মাঝির বাড়ি এক বস্তা কাঁঠাল পঠিয়েছিল দুলু ব্যাপারী । গোলাপ মাঝি ঠিকই মনে রেখেছে ।
সোলায়মান যখন দুলু ব্যাপারীর উঠানের ঘাটে নৌকা ভেড়াল, তখন রাত প্রায় এগারোটা। আজ বেলা থাকতে থাকতে খালি বিলের উত্তরে গিয়েছিল দুলু ব্যাপারী। কবিরাজ মকিম উদদীন দীর্ঘদিনের বন্ধু-মানুষ; বর্তমানে রোগভোগে শয্যাশায়ী।
তারেই দেখতে খালি বিলের উত্তরে গিয়েছিল দুলু ব্যাপারী । আল্লা কখন তুলে নেন। মধুমেহ রোগে ভুগে দোহারা মানুষটাকে তক্তার মতন দেখায়। দুলু ব্যাপারীরও বয়স হয়েছে। তবে শরীরে রোগশোক তেমন বাসা বাঁধেনি ।
তবে রাত্রিকালে চোখের দৃষ্টি কেমন ঝাপসা দেখায়।
ভাত খাইবি না সোলায়মান? পলিথিন জড়ানো কাল বাউশটা তুলে নিয়ে নৌকা থেকে নামতে নামতে জিগ্যেস করে দুলু ব্যাপারী।
না গো নানা, আমার আইজ পেড ছাড়ছে। আইজ চিরা খামু।
আইচ্ছা।
তাইলে কাইল সকাল-সকাল আইসা পড়িস। খালির চর যামু গোলাপ মাঝির বাড়ি ।
আইচ্ছা।
সোলায়মান লগি ঠেলে নৌকা ঘুরিয়ে নেয়। সে এখন মাঝির পাড়া যাবে।
সেখানেই তার বাড়ি। জায়গাটা এখান থেকে কাছেই। ব্যাপারী বাড়ির বাঁধা নাইয়া সোলায়মান । দু’বেলা ব্যাপারী বাড়িতেই খায়। অত্যন্ত বিশ্বাসী।
সোলায়মান- এর বাপ হারুন মিঞাও ছিল ব্যাপারী বাড়ির বাঁধা নাইয়া। হারুন মিঞার শরীর এখন অর্থব; নৌকা বাইতে পারে না । জোয়ান ছেলেই এখন সংসার চালায়। তা সোলায়মান দেখতে-শুনতে মন্দ না। লম্বা, শ্যামলা, স্বাস্থ্যবান পেশল শরীর।
মাথায় লম্বা ঝাঁকড়া চুল। সোলায়মান- এর গানের গলা অসাধারণ। বিশেষ করে উজান ধল গ্রামের শাহ আবদুল করিম- এর গান সে চমৎকার গায়। বিলের পানিতে নৌকা বাইতে বাইতে সোলায়মান যকন ধরে-
ফ্রাণ কান্দে মনো কান্দে রে আমার
খান্দে মনো হিয়া
দেশের মানুষ বৈদেশ গেলো
আমারে পাশরিয়া রে ...
তখন ... তখন দুলু ব্যাপারীর বুক কেঁপে ওঠে। বৃদ্ধের জালাল- এর মুখটা মনে পড়ে।
দুলু মিঞা একমাত্র পুত্র জালাল। বিয়ের পর সেই জালাল- এর যে কী মতিভ্রম হল, এক রাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল সে। আজ সাত বছর হল। কিশোর বয়স থেকেই জালাল চমৎকার গান করত। বিশেষ করে হাছন রাজার গান-
বাউলা কে বানাই লো রে / হাছন রাজারে বাউলা কে বানাই লো রে ...
গাইতে গাইতে কী যে ঘোর লাগত কিশোরের।
সেই ঘোরেই হারিয়ে গেল জালাল। এখন নাকি জালাল ধর্মপাশার কোন্ পীরের মুরিদ হয়ে মেঘালয়ের জঙ্গলে আছে। (এসবই বছর দুই আগে দিরাই শরমঙ্গল হাছন মেলায় গোলাপ মাঝির বেয়াই আগর আলীর মুখে শুনেছে দুলু ব্যাপারী) ... নিরুদ্দেশ ছেলের দুঃখে একা একা কান্দে দুলু ব্যাপারী। সে জানে সোলায়মান ও একদিন পালিয়ে যাবে। যাক।
দুলু ব্যাপারীর আপত্তি নাই। গান আর উচাটন মন এ হাওর-বাওর খালবিলের দেশের আলো বাতাসের আর পানির গুণ ...
নৌকা থেকে নেমে মাছসহ পলিথিনের ব্যাগটা এনে দাওয়ার ওপর থপ করে ফেলে দুলু ব্যাপারী । উঠানে চাঁদের আলো থইথই করছে। আমড়া আর তেঁতুল গাছের পাতায় পাতায় অশান্ত বাতাসের সরসর শব্দ। মাঝির পাড়ার দিক থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসে।
শ্বশুরের সাড়া পেয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে দাওয়ার ওপর দাঁড়ায় হীরামন । ঘরে হীরামন- এর মেয়ে আনালি ঘুমিয়ে।
ছেলের বউকে দেখে দুলু ব্যাপারী বলে, গোলাপ মাঝি একখান কাল বাউশ দিল মা। অখন ভালো কইরা রান্ধ । খিদা পাইছে।
হীরামন কোমড়ে আঁচল পেঁচিয়ে এক পা এগিয়ে আসে। তার মুখ চাঁদের আলোয় গনগন করে ওঠে। হীরামন প্রায় চেঁচিয়ে বলতে থাকে, এত রাইতে অখন রানতে বসুম, না? পারুম না। আমি আপনের কেনা বান্দি না। আপনি সারা জীবন আপনার বউরে জ্বালাইছেন, এখন আমারে জ্বালাইতেছেন।
পাটির ওপর ভাত আর লতির তরকারী ঢাকা দেওয়া আছে। যান, খাইয়া শুইয়া থাকেন।
দুলু ব্যাপারীর পায়ের তলার মাটি কাঁপে। আজকাল ছেলের বউ চিৎকার চেঁচামেচি করলেই শরীর কাঁপে। বৃদ্ধের চোখ ভিজে ওঠে।
বুকটা হু হু করে ওঠে। হাওর অঞ্চলে নরম স্বভাবের মানুষ হিসেবে পরিচিত দুলু ব্যাপারী । ছেলের বউকে মুখের ওপর কিছু বলতে পারে না বৃদ্ধ। তাছাড়া বৃদ্ধ কথা বলে কম । যা বলে, ভালো কথাই বলে।
মন্দ কথা বৃদ্ধের মুখে আসে না।
বৃদ্ধর মন খারাপ হলে হাওরের পাড়ে গিয়ে বসে থাকে। এখন সেদিকেই যেতে থাকে দুলু ব্যাপারী । মন ভীষণ অশান্ত। কত কথা বলতে ইচ্ছা করে ছেলের বউ কে।
বলতে পারে না-আরে বান্দি কইলা। আমি কি তোমারে বাইন্দা রাখছি নি? তুমার ইচ্ছা হইলে তুমি কালই বাপের বাড়ি যাও গা। সুলায়মানে দিয়া আসব। খালি মাঝেমাঝে আনালিরে পাঠাইও ... ভাবতেই বৃদ্ধের চোখ ভিজে ওঠে। ছেলেকে না দেখে দিনের পর দিন বেঁচে আছে।
আনালিকে না দেখে একদিন বাঁচবে কী ভাবে ...পাঁচ বছরের আনালি, দুলু ব্যাপারীর কোলে বসে কী সুন্দর গান করে-লীলাবালি লীলাবালি বড় যুবতী ছইলো/ বড় যুবতী ছইলো/ কি দিয়া সাজাইমু তরে?
হাওর পাড়ে এসে উবু হয়ে বসে দুলু ব্যাপারী । পাগলা বাতাস বৃদ্ধকে উড়িয়ে নিতে চায়। ভরা পূর্ণিমায় হাওরের পানি টলটল করে । এই হাওর-এর নাম: ‘বড় উগলা বিল’। উত্তরে ডাহুকা নদী।
এই পূর্ণিমার রাতে সেই ডাহুকা নদীর দিক থেকে উথাল-পাথাল হাওয়া ভেসে আসে । তবু বৃদ্ধের বুকের টনটনানি কমে না। এমন দুঃসহ সময়ে জয়তুনের কথা মনে পড়ে। বৃদ্ধ মৃতা স্ত্রীকে ফিসফিস করে বলে, জালালের বউ আইজ আমারে দুঃখ দিল। একদিন কত শখ কইরা ঘরে তুলছিলাম ...ক্যান, তোমার মনে নাই?
হীরামন- এর বাপের বাড়ি তাড়াল।
জায়গাটা ভুলাই বিল- এর উত্তরে। গোলাপ মাঝির সমুন্ধি আয়াজ আলীর কন্যা হীরামন হাওর অঞ্চলে তার রূপ-সৌন্দর্যর জন্য আলোচিত। কনে দেখতে গিয়ে ভিমড়ি খেয়েছিল দুলু ব্যাপারি। যৌতুক তো নেয়ইনি, উলটো বেয়াইয়ের হাতে একলক্ষ টাকা তুলে দিয়ে হীরামনকে ঘরে তুলেছিল। জয়তুন তখন বেঁচে ছিল।
নাতনীর নাম ‘আনালি’ রেখেই তবে চোখ বুজেছিল জয়তুন । বাড়ির পিছনে পেয়ারা বাগানে জয়তুনের কবর। আজকাল বৃদ্ধের ঘুমের মধ্যে জয়তুন আসে । আজকাল ঘুম বড় মধুর লাগে দুলু ব্যাপারীর। রাত্রে কখনও ঘুম না এলে বৃদ্ধ পেয়ারা বাগানে যায়।
জয়তুন- এর কবর এর পাশে দাঁড়ায়। হাওরের আষঁটে
বাতাস তখন আতরের মিষ্টি গন্ধ ভারী হয়ে ওঠে। পূর্ণিমার বাতাসের রাতে নিঃশব্দে কবেকার মৃত সবা অদৃশ্য পূর্বপুরুষেরা উঠে আসে ... কতকাল আগে তারা এই গান আর ধানের দেশে বেঁচে ছিলেন, এখন তারা গাছপালার ফাঁকে উঁকি দেন তারা, ... বিষন্ন এক বংশধরকে দেখেন ...
দুলু ব্যাপারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
পূর্ণিমায় বড় উগলা বিল থইথই করে। বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ।
বিলের ওই পার আবছা দেখায়। আকাশে গোল একটা চাঁদ খালবিলনদীনালার দেশের ওপর কিরণ ঢালে। এই গান আর ধানের দেশে কত বিল ... আইনাল বিল বড় বিল নিকলী বিল খুলরিন বিল কাঞ্চা বিল বাহুরী বিল ফেলুয়া বিল খালি বিল সন্দুয়া বিল মেওয়া বিল পুনিয়া বিল ভায়া বিল হরিয়া বিল ...আরও কত বিল । বিলের পানিতে কত মাছ। মহাশোল, কাল বাউশ, দেশি পাঙ্গাস, রিটা, আগুন চোখা, ঘোড়ামুখ, ঘাউরা, বাচা, বেতাঙ্গী, গুতুম, দল মাগুল, হাঁড়কাটা।
দুলু ব্যাপারীর বাল্যকালে আরও অনেক জাতের মাছ ছিল। পানি দূষনে এখন সেসব মাছ আর পাওয়া যায় না ...
দুলু ব্যাপারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
তার আপন দুঃখের সঙ্গে হাওরের দেশের দুঃখ কীভাবে যেন মিশে যায় ...
ভরা পূর্ণিমায় বড় উগলা বিলে একটা নৌকা ভেসে যায়।
মাঝির কন্ঠে গান ভেসে আসে-
বাউল আবদুল করিম বলে বুঝে উটা দায়/
কুতা হতে আসে নৌকা কুতায় চলে যায়/
আরে ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নায় .../
চাঁদের আলোয় ভেসে ভেসে কোথায় যেন চলে যায় নৌকা ।
শাহ সাহেবের গান শুনে বৃদ্ধের মনে আর দুঃখের রেষ থাকে না।
কেবল এক প্রকার শূন্যতা থই থই করে এই ভরা পূর্ণিমার রাতে।
খাইতে আসেন আব্বা। রান্ধন হইছে।
হীরামন কখন এসে দাঁড়িয়েছে।
দুলু ব্যাপারী উঠে দাঁড়ায়।
তার বুড়ো হাড় মটমট করে ওঠে। হাঁটুর গিঁটে ব্যথা করলেও তার মনে খুশির বান। হীরামন মাইয়াটা ভালোই। মন করিমপুরের খিরসার মতন বড় নরম । তবে বড় দেমাগী মাইয়া।
রূপের দেমাগ। আরও ভালো ঘরে মাইয়াটার বিয়ে হইতে পারত, সেই দেমাগ, স্বামীর সোহাগ পাইল না, সেই রাগ। শ্বশুরকে ঠাস ঠাস কথা শোনায়। তবে হীরামন- এর আবার অনেক গুণ। রান্নার হাত ভালো।
তবে সোলায়মান- এর সঙ্গে হীরামন যখন রঙ্গঢঙ করে তখন ভালো লাগে না দুলু ব্যাপারীর ...
দুধসাদা চাঁদের আলোয় হীরামন- এর লম্বা ছায়া পড়েছে উঠানে । ছায়ার পিছন পিছন হেঁটে দাওয়ায় উঠে আসে দুলু ব্যাপারী । ওদিকে আমড়া গাছ থেকে সরসর শব্দে কী নেমে যায়। বাড়ির পিছনের কড়–ই গাছে ‘তক্কে’ ‘তক্কে’ শব্দ করে ডেকে ওঠে একটা তক্ষক। বাতাসের ধাক্কায় টিনের ঘর একটু যেন কাত হয়ে পড়ে।
প্লাষ্টিকের বদনায় পানি রাখা ছিল। টুপি খুলে হাতমুখ ধুয়ে নেয় দুলু ব্যাপারী। ডাহুকা নদীর দিক থেকে ছুটে আসা দূরন্ত বাতাসের ধাক্কায় টিনের চালা আবার মড়মড় করে ওঠে। একবার হাওরের দিকে চোখ যায় বৃদ্ধের। জোছনায় চিক চিক করে বিলের পানি।
তবে নৌকা-টৌকা চোখে পড়ে না।
আলু-পটল দিয়ে কাল বাউশের লাল লাল ঝোল রেঁধেছে হীরামন। দুলু ব্যাপারী ঝাল পছন্দ করে। ভাত মেখে মুখে দিয়ে মাথা নাড়ে। ভাতটুকু গিলে বলে, তরকারী বড় সাদের হইছে গো মা।
হীরামন চুপ করে থাকে। মায়ের কাছে রান্না শিখেছে হীরামন। করিমন- এর রান্নার নামডাক ছিল তাড়াল-এ। হীরামন নরম গলায় বলে, আপনার ছেলে কুনওদিন ফিরা আইলে আপনে গোলাপ মাঝি চাচারে কাল বাউশ ধইরা দিতে কইবেন। আমি আলু-পটল দিয়া রান্ধুম ।
এই কথায় দুলু ব্যাপারী কেমন অবাক হয়ে যায়। নিখোঁজ স্বামীকে নিয়ে হীরামন- এর মনে তেমন দুঃখ নাই - দুলু ব্যাপারীর মনে এই রকম একটা সন্দেহ আছে। শ্বশুরবাড়ির উঠান-ভরা বোরো, আমন আর আউশ ধান। বাড়ির পিছনে পয়মন্ত ফলের বাগান । যে বাগানের কাঁঠাল -পেয়ারা- লিচু- জাম বিক্রি করে স্বাচ্ছন্দে সংসার চলে যায়।
শ্বশুরবাড়িতে ভালোই আছে হীরামন। সংসারের হাল তো তারই হাতে ।
দুলু ব্যাপারী বলে, রাইন্ধো মা, রাইন্ধো । জালাল একদিন ফিরা আইব, দেইখো। বলে দুলু ব্যাপারী মাথা নাড়ে।
মাঝির পাড়ার দিক থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসে। টিনের চালের ওপর নাড়িকেল পড়ে। কলাঝোপে একঝাঁক কলাবাদূড় গোত্তা খায়।
হীরামন চুপ করে থাকে। মনে মনে ভাবে, আনালির বাপ ফিরা না আইলে কী।
মনের মধ্যে কোনও দুঃখ নাই। কখনও মনের মধ্যে দুঃখের ভাব হইলে হাওরের উদলা বাতাস সেই দুঃখ কোথায় উড়াইয়া নিয়া যায়। একবার সোলায়মান-এর মুখটা মনে পড়ে যায়। হীরামন শরম পায়।
একটা কথা ভেবে দুলু ব্যাপারী বিস্মিত হয়।
হীরামনের শরীর জুড়ে সোনার বরণ রূপ থই থই। এই রূপ ফেইলা জালালে কুন দুঃখে বিবাগী হইয়া মেঘালয়ের জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে? আশ্চর্য! দুলু ব্যাপারী হাছন রাজার বড় ভক্ত। সেই কথা ভেবে এখন মুখ তুলে বলে, জালালে ঘরের বাইরে যা খুঁইজা মরে তা ঘরের মধ্যেই আছে। হাছন রাজা পিয়ারিরে কুন জঙ্গলের মধ্যে পাইছিল কও তো মা?
শ্বশুরের কথায় হীরামন- এর সারা শরীর শিরশির করে ওঠে। কাঁপা-কাঁপা হাতে শ্বশুরের থালায় মাছের টুকরো তুলে দেয়।
থাউক মা, থাউক, আমারে আর দিও না । যাও, এখন যাও আনালি রে ডাইকা তুল। তখন কী খাইছে না খাইছে। অরে তুইলা মাছ দিয়া ভাত মাইখা খাওয়ায় দাও মা। বলে, ঢক ঢক করে পানি খায় দুলু ব্যাপারী ।
হীরামন উঠে দাঁড়ায়। তারপর চকিত পায়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। ঘরের ভিতর আলো-আঁধারীর খেলা, হাওয়ার খেলা। হীরামন- এর শরীর তখনও কাঁপছিল। আমার শ্বশুর-আব্বায় তখন আমারে পিয়ারি কইল আর আমি এই মানুষটারে তখন কত কথা শুনাইলাম।
হায় আল্লা, আমার মরণ হয় না ক্যান? আইজ রাইতে আমি হাওরে ডুইবা মরুম। হঠাৎ এই ভাবনায় হীরামন কেঁপে ওঠে।
দুলু ব্যাপারীর খাওয়া শেষ। সে দাওয়ার কিনারে উবু হয়ে বসে হাত ধুয়ে নিচ্ছে। ঘরের ভিতর থেকে আনালির চিৎকার ভেসে আসে।
আমি ভাত খামু না, খামু না। আমি ঘুমামু। একটু পর আনালির কান্না শোনা যায়। মনে হয় হীরামন মেয়ের পিঠে ধপ ধপ করে কিল বসায়া দিসে । দুলু ব্যাপারী মুচকি হাসে।
চিৎকার করে বলে, থাউক মা, থাউক। না আইলে নাই, অরে তুমি জোর কইরো না।
হীরামন দাওয়ায় ফিরে আসে।
তারপর এঁটো বাসন কোসন নিয়ে হাওর পাড়ে চলে যায় ধুতে।
দুলু ব্যাপারীর শরীর কাতর হয়ে ওঠে ঘুমে ।
আজকাল ঘুমের মধ্যে জয়তুন আসে । কত কথা বলে জয়তুন। বলে, ও জালালের বাপ, আমার কাছে তুমি চইলা আস।
কী ভাবে আসি। হীরামন আনালি একা হইয়া যাইব না? তোমার ছেলে কত বছর হইল নিরুদ্দেশ।
জয়তুন চুপ করে থাকে। দুলু ব্যাপারী ঘুমের মধ্যে আতরের গন্ধ পায়। জয়তুন বলে, আমি তোমার আসার ব্যবস্থা করতেছি খাঁড়াও।
... অনেক রাতে হাওর পাড়ে এসে দাঁড়ায় হীরামন। উথালপাথাল হাওয়া তাকে ঠেলে দিতে চায়।
বিলের চিকচিকে পানিতে কী যেন খোঁজে। একটা নৌকা এগিয়ে আসে। হীরামন মুচকি হাসে । তার আর মরা হয় না ...
মৃত্যুর আগে ভারি অদ্ভূত এক দৃশ্য দেখেছিল দুলু ব্যাপারী।
এক পূর্ণিমার রাত্রে বৃদ্ধের ঘুম আসছিল না।
তখন প্রায় মধ্যরাত। দাওয়ায় এসে বসেছিল বৃদ্ধ। উথালপাথাল হাওয়ার মধ্যে ঘরের কড়ি-বরগা খরখর করে ওঠে। বৃদ্ধের চোখ হঠাৎই চলে যায় আমড়া গাছের দিকে। ওখানে কারা যেন দাঁড়িয়ে ? বছর কয়েক হল বৃদ্ধের চোখে ছানি পড়েছে।
দীর্ঘদিনের বন্ধু কবিরাজ মকিম উদদীন আরক দিয়েছিল খেতে । ঠিকঠাক খাওয়া হয়নি কখনও।
আবছা অন্ধকারে যেন সোলায়মান আর হীরামন কে চিনতে পারে বৃদ্ধ। প্রচন্ড ক্রোধে মুহূর্তেই দুলু ব্যাপারীর শরীর শক্ত হয়ে যায় । সেই সঙ্গে বুকের কাছে চিনচিনে ব্যথা টের পায়।
... আর তখনই সেই আশ্চর্যের ঘটনাটি ঘটেছিল ...
ধীরে ধীরে একটি নৌকা উঠানের ঘাটে এসে ভিড়েছিল। নৌকা থেকে নেমে এসেছিল এক দীর্ঘকায় যুবক। যুবকের পরনে ছিল পীর-ফকিরের বেশ। মাথায় পাগড়ী, কাঁধে ঝোলা। যুবককে দেখে হীরামন অস্ফুট শব্দ করেছিল।
তারপর মুখে আঁচল চাপা দিয়েছিল।
আর চোখের নিমিষে আমড়া গাছের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সোলায়মান।
হীরামন মাথায় আঁচল দিয়ে এগিয়ে যায় যুবক ফকির এর কাছে। তারপর উবু হয়ে সালাম করে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ফকিরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
হীরামনের কান্নার শব্দ পরিস্কার শুনতে পায় বৃদ্ধ।
দাওয়ায় বসে দূরের মায়াবী দৃশ্য দেখতেই থাকে ... দেখতেই থাকে দুলু ব্যাপারী । তারপর এক সময় চোখের পানিতে ঝাপসা হয়ে যায় দূরের ওই দৃশ্য। ঘন তীব্র আতরের গন্ধ পায় বৃদ্ধ। খুব কাছে জয়তুনের স্পর্শ পায় ...
উৎসর্গ: ব্লগার মহলদার বলরাম।
যার ব্লগ পড়ে সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চল সম্বন্ধে জেনেছি অনেক কিছু ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।