“এভাবে আর কতকাল চলবে? আমিতো আর পারি না। ”
“যতদিন আমাদের দ্বারা সম্ভব। ”
“কোন মা কি পারে?”
“কোন বাবাও পারে না। কিন্তু আমরা অম। আমরা অম বলেতো যে পৃথিবীতে আসতে চায় তাকে থামিয়ে রাখা ঠিক না।
”
রাইমা এবার তার ষষ্ঠ সন্তান জন্ম দেবে। আগের পাঁচটির একটিও কাছে নেই। সব দত্তক দিয়েছে। তার স্বামী জিংরা। গরীব।
পাহাড়ের ঢালে কাজ করে। দৈনিক আয় পঞ্চাশ টাকা। পঞ্চাশ টাকায় সংসার চলে না। কখনও খেয়ে কখনও না খেয়ে। কিন্তু ভালোবাসার কোন কমতি নেই।
বোঝেনইতো কেন এতোগুলো সন্তান। এমনিতেতো আর হয়নি।
বেশি সন্তানের জন্ম দেয় মূর্খরা। কিন্তু জিংরা বেশি সন্তানের জন্ম দিয়েও জ্ঞানী।
তাদের প্রথম সন্তান তিন মাস ছিল তাদের কাছে।
মায়ের কোল আলো করে সে পৃথিবীতে এসেছিল। কিন্তু তিন মাসেই সে মায়ের আদর সোহাগ থেকে বঞ্চিত হলো। শূন্য হলো মায়ের পূর্ণ কোল। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো অন্যত্র।
প্রথম ছেলেটি নিয়েছে রাজ নারায়ণ সেন।
দশ বছরের দাম্পত্য জীবনে মায়ারাণী একটি সন্তানও দিতে পারেনি। শুধু ভালোবাসার টানে খুব কম সংসারই টেকে। সংসার টিকে থাকার জন্য দলিল চাই। আর সে দলিল হলো সন্তান। মা হতে না পারলে মেয়েদের সব রূপগুণ তুচ্ছ হয়ে যায়।
ভালোবাসায় ভাঙ্গন ধরে। জীবনে নেমে আসে অন্ধকার।
রাজ নারায়ণও বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে নিজে ভয় পেয়ে গেল। দোষ যদি তার হয়।
তার এক বন্ধু তাকে এধরনের একটি বুদ্ধি দিয়েছিল। তার দোষ হলে বউ ছেড়ে যেতে পারে। বউ ছেড়ে গেলে মান-সম্মান থাকবে না। মান-সম্মানের ভয়ে সে ডি,এন.এ পরীা করেনি। বউকে বলেছিল, “তোমাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি তাই দ্বিতীয় বিয়ের ইচ্ছে নেই।
একটা দত্তক নেই। ”
মূর্খ নারীও তাই বুঝেছিল। সে জানতো না তার স্বামীর এ ভালোবাসার পিছনে লুকিয়ে আছে অন্য রহস্য। যার আড়ালে রয়েছে গুপ্ত কারণ কোন ভালোবাসা নেই।
জিংরাকে কতগুলি টাকাও দিয়েছিল।
ত্রিশ হাজার। ছেলের সাথে কোনদিনই যোগাযোগ করতে পারবে না। রাজ নারায়ণ বলেছিল, “এ ছেলেকে তোমরা কখনই দেখতে পারবে না। ”
“তাকি করে হয় বাবু? আমাগো ট্যাকা লাগবে না। ট্যাকা দিয়া হামরা কি করতাম?”
“সুন্দর দেখে একটা ঘর তোল।
”
“হামরা ঘর দিয়া কি করতাম বাবু? যারা সন্তান পালন করতে পারে না তারা ঘর দিয়া কি করুম? আমাগো শুধু খবর দিয়েন ছেলেডা কেমুন আছে। ”
“তা হলে আমরা তোমার ছেলেকে নিতে পারব না। অন্য কাউকে দিয়ে দিও। ”
“আপনে পারতেন বাবু? ঐ ট্যাকা আপনে নিয়ে যান। ওরে ভালো মত মানুষ কইরেন।
মানষের মত মানষ। আমরা ওয়ারে দেখতে চাইব না। "
জিংরার সে কান্না লুকিয়ে গেল রাইমার দর্শনে। সে কাঁদলে রাইমা স্থির থাকতে পারবে না। চাপা কাঁন্নার আড়ালে রাইমাকে বুঝিয়ে ছিল তাদের সন্তান সুখে থাকবে।
দ্বিতীয় সন্তানটি নিয়েছিল গাফ্ফার চৌধুরী। বেচারা তিন মাস অন্তঃসত্ত্বা অবস্থা থাকাকালীন সময় থেকে বাচ্চা নেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। সব ব্যয় ভারও বহণ করেছিল। জিংরা একটু ভালো-মন্দ খাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।
তৃতীয় সন্তানটি নিয়েছিল মিস্টার হার্ভে।
হার্ভে বলেছে, যখন খুশি তার মেয়েকে দেখতে পারবে। মেয়েটির নাম জিংরাই দিয়েছিল, শিলা। হার্ভে সে নাম পরিবর্তন করেনি। এই একটি সন্তানের নামই জিংরা দিয়েছিল। শিলাকে দিয়ে রাইমা একটু কম কেঁদেছিল।
ও হয়তো বুঝেই ছিল, এটাই তাদের জন্য নিয়ম। এটাই তাদের জন্য সকল ধর্মে সার বাণী। রাইমা বুঝেছিল নিজে কেঁদেও যদি অন্যেকে সুখী করা যায় সেটাই প্রকৃত সুখ। তাদের জীবনের সুখ এর ভিতর দিয়েই বয়ে নিতে হবে। এ কান্নার অন্তরালেই তাদের স্বর্গ সুখের ঠিকানা।
চতুর্থ সন্তানটি নিয়েছিল সুনীল মুখার্জী। বেচারা অবিবাহিত, অধিক সম্পদের মালিক। বাড়িতে অনেক চাকর-বাকর। তারপরও কেন জানি দত্তক নেওয়ার অনুভব করল। জন্মের একদিন আগেও বেচারা এসেছিল।
রাইমা নীরবে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। রাইমার কাছে এরাই যেন যম। যম নিলে তবু একদিনের কান্না। এ শোক সারা জীবনের। শুধু সান্ত্বনা ওরা বেঁচে আছে।
তার সন্ত্বানেরা ভালো আছে।
পঞ্চম সন্তানটি নিয়েছিল সত্যিকারের একজন। যার জন্য তাকে একবারই শোক পেতে হয়েছে। রাইমাও প্রায় মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছিল। সেরে উঠতে অনেক দেরী হয়েছিল।
কারণ জিংরা যে ভালো মন্দ খাওয়াতে পারে নাই। অন্যান্য সন্তান নেওয়ার সময় সবাই কিছু না কিছু দিয়েছে। আর এ সন্তানটি যে নিয়েছে সে বিনিময়ে কেবল চোখের জলই দিয়ে গেছে। রাইমা সব সময় বলতো, এদের চেয়ে যমে নিলেও শান্তি। কিন্তু ও এবার বুঝল তার ধারণা মিথ্যে।
কেবল এই সন্তানটিই যেন তাকে সত্যিকারে কাঁদিয়ে গেছে। একটা সব হারানো বেদনা ওকে আরো মৃত্যু দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল।
ষষ্ঠ সন্তানটি ওর গর্ভে। জিংরা রাইমার কোল ঘেঁষে বসেছে। নীরবে তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে।
সে জ্যোতিতে কোন অহংকার নেই, কোন প্রত্যাশা নেই। রাইমা বলল, “একে আমরা দেব না। ”
“পারবা বাঁচাইতে?”
“মায়ের কোল সবচেয়ে নিরাপদ। খাইবার না পারলেও মনে সাহস পাবে। সে বাঁচতে চাইব।
মনুষ্যেত্বের পূর্ণ অহংকারে সে মাথা খাড়া করবো। ”
“ওরা কি বাঁইচা নাই?”
“কেবল বাঁচার জন্যি ওরা বাঁইচা আছে। গাছের গোড়ায় পোকা লাগলেও বেঁচে থাকে, গাছ শক্ত হয় না। ”
জিংরারও প্রত্যাশা এবারের সন্তানটা তারা রাখবে। যত কষ্ট হোক তাকে বাঁচাইয়া রাখবে।
না হোক সে ওদের মত। মা-বাবার আদর পাবে, ভালোবাসা পাবে।
অন্যান্য বারের মত আজও জিংরা কাজে যায়নি। আজকের সন্তানটি তাদের হবে। ওরা তাকে ওদের মত করে তৈরি করবে।
জিংরা উঠানের পাশে গাছ তলে বসে আছে। হঠাৎ কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। নতুন মুখের কান্না। একজন এসে তাকে খবর দিল তার ছেলে হয়েছে। জিংরার মুখে হাসি ফুটে উঠল।
তাদের ছেলে হয়েছে। জিংরার যেন তর সহ্য হচ্ছে না। এটা যেন তার সত্যিকার নিজের ছেলে। এ ছেলেই তাকে বাবা বলে ডাকবে।
একে একে সবাই বেরিয়ে গেল।
জিংরা ঘরে ঢুকল। ছেলেটি হাত পা নেড়ে নতুন পৃথিবীকে স্বাগতম জানাচ্ছে। জিংরা রাইমার পাশে বসে রাইমার মাথায় হাত দিল। আস্তে করে ডাকল, “রাইমা, রাইমা। ”
রাইমা কোন ডাক শুনল না।
জিংরা গা ধরে ঝাঁকি দিল। রাইমা তবু নড়ল না। জিংরা চিৎকার দিয়ে উঠল। তারপর রাইমার গায়ের সাথে এলিয়ে পড়ল।
রাইমা তার স্বপ্ন ভেঙ্গে চলে গেল।
সে কোন সন্তানেরই মা ডাক শুনতে পেল না। সন্তানটা নিয়ে জিংরা পড়ল বিপদে। কিভাবে তাকে বাঁচাবে। কাজ বন্ধ দিলে দুজনেই মরবে আর কাজে গেলে ছেলেটা মরবে। জিংরার জীবনে মহাবিপদ নেমে এলো।
জিংরা ছেলেটাকে দত্তক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। পাশের বাড়ির ঝুমুরীকে ছেলেটা দিয়ে দিল। রাত্রে জিংরা একাকী খুশী মত কাঁদল। সে কান্নায় তার বুক শীতল হলো না। তার চাই আরো কান্না অথবা রাইমাকে।
রাইমা আর কোনদিন ফিরবে না। আর কেউই তার কাছে ফিরবে না। পৃথিবীতে সে একা।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জিংরা রাইমার কবরের কাছে গেল। অনেকণ বসে থাকল।
তারপর আর তাকে দেখা যায় নাই।
ত্রিশ বছর পর হঠাৎ তাকে হাসপাতালে দেখা গেল। ডাক্তার তাকে উঠতে নিষেধ করল। কিন্তু তার প্রচণ্ড ুধা লেগেছে। ডাক্তারকে সে কথা বলল না।
তার পাশে বেডে শুয়ে আছে আরেক ভদ্রলোক। তার ছেলে তার জন্য অনেক খাবার নিয়ে এসেছে। জিংরা সেদিকে নীরবে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, তার কে আসবে।
জিংরা মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিল কেউ না।
“আমার কেউ নাই। ”
“পাশের বেডে আমার বাবা আছেন। আপনিও ভালো হয়ে যাবেন। ”
“লাভ নেই। ”
“শিলা ম্যাডাম খুব ভালো ডাক্তার।
”
জিংরার চোখে জল ভরে এলো। রাইমার কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল তার সে হাসি মাখা দিনগুলি।
“আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসি?”
জিংরা নীরবে তাকিয়ে থাকল। ছেলেটা চলে গেলে জিংরা উঠে বসল।
দেখল পাশের বেডের রোগীটি মাথা কাত করে আছে। তাকে দেখে জিংরার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হলো, বাবু।
রাজনারায়ণ বাবু চলে গেছে। ছেলেটা খাবার নিয়ে ফিরে এসে দেখল তার বাবা মারা গেছে।
সে কান্না সংবরণ করতে পারল না। জিংরার মুখে হাসি ফুটে উঠল কিন্তু চোখের জল গড়িয়ে গেল। রাইমা তার সস্তানের মা ডাক শুনতে পারেনি। সেও শুনতে চায় না। ছেলেটিকে বলতে পারবে না সে তার ছেলে।
ছেলেটির আনা খাবার তার খেতে ইচ্ছে করল না। তবু তা ছিড়ে ছিড়ে মুখে দিল। এতোটুকুও ফেলে দিল না।
ডাক্তার তাকে দেখতে এলো। জিংরা নীরবে তাকিয়ে আছে।
“ওষুধ আনাইছেন?”
জিংরা মাথা ঝাঁকিয়ে না জবাব দিল।
“ওষুধ না হলে চলবে?”
“চলবে। শুনেছি আপনি অনেক বড় ডাক্তার। কোন রোগীই মরে না। শুধু একবারের জন্য পারবেন, ঐ লোকটাকে বাঁচিয়ে আমাকে মৃত্যু দিতে? ওর অনেক আছে আমার কিছু নেই।
”
“ওনার বাঁচার মত রোগ ছিল না। এখানে ছিল বলে এতোদিন বেঁচে ছিলেন। ”
“সেটাও অনেক। মিস্টার হার্ভেও এমন কথা বলেছিল। ”
“মিস্টার হার্ভে!”
“ভদ্রলোকের সাথে আমার আনেক দিন আগে দেখা হয়েছিল।
তাকে আমি অনেক দিন খুঁজেছি। ইংল্যাণ্ড থেকে এদেশে এসে ছিলেন। ”
“আমার বাবাও একজন ইংরেজ এবং হার্ভে। আমি অবশ্য তার নিজের মেয়ে নই। ”
“আপনার বাবাকে বলবেন জিংরা নামের কাউকে চেনে কিনা।
চিনলে আমার সাথে দেখা করতে বলবে। দেখবে আমি ভালো হয়ে গেছি। ”
পরের দিন মিস্টার হার্ভে হাসপাতালে এলেন। বেচারা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। অনেক কষ্ট করে এলেন।
জিংরার কে এসে দেখলেন জিংরা খাটের নিচে উপুর হয়ে পড়ে আছে। মিস্টার হার্ভে মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন তাকে। তার চোখে জল চলে এলো।
“বাবা, তুমি কাঁদছ?”
“শুধু কি আমি একা কাঁদব? তুই কাঁদবি না? কান্না তো তোর প্রয়োজন। ”
“কেনো বাবা?”
“কারণ, ও-ই তোর সত্যিকারের বাবা।
”
২৭ জুন ২০১১ইং,
যোগেশ সরকারের বাড়ি ,
কেরাণীগঞ্জ,
ঢাকা-১৩১০।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।