আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুড়িগঙ্গা বুড়ি হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে!

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ বুড়িগঙ্গা বুড়ি হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে! আমাদের জয়েনভেঞ্চার শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিদেশী পার্টনার এসেছেন বাংলাদেশে। তাঁদের নিয়ে সুন্দরবন বেড়াতে গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে যাবার সময় ঢাকা-যশোর বাই এয়ার। যশোর থেকে বাই রোড খুলনা। খুলনাতে রাত যাপনের পর দিন পূর্ব নির্ধারিত আয়োজনমত মংলা হয়ে সুন্দর বন।

আগেই সিদ্ধান্ত ছিল-ফেরার পথে বরিশাল হয়ে ফিরবো। বিদেশী মেহমানদের নিয়ে আমাদের পুর্বপূরুষের ভিটে মাটিতে বেড়িয়ে ঢাকা ফিরবো। যথারিতী খুলনা থেকে “"মাসউদ"” ইস্টীমার/রকেট সার্ভিসে বরিশাল ফিরি একটি চমতকার ভ্রমন আমেজ নিয়ে। গত বছর যখন জার্মানীতে গিয়েছিলাম তখন এই ব্যাবসায়ীই আমাদেরকে জার্মানীর রাইন ও মাইন রিভারে সাইট সিইং করিয়েছিল। "ওদের মাইন ও রাইনের সৌন্দর্য্যে আছে ন্যাচারাল ও আর্টিফিশিয়াল সৌন্দর্যের সমন্বয়।

অন্য দিকে আমাদের দেশের নদিগুলোতে(খুলনার পশুর নদি, রুপসা, বলেশ্বর, কীর্তনখোলা ইত্যাদি) আছে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য"-কথাটা আমার মেহমানদের। আমার মেহমানদের বরিশাল শহর ভাল লেগেছে-সেজন্য আমার মনে মনে বেশ অহংকার! ঢাকা-বরিশাল নৌ রুটের সব থেকে বিলাশ বহুল লঞ্চ সম্ভবত সুন্দর বন-৭। ঐ লঞ্চে ঢাকা ফিরছিলাম চার জন। লঞ্চের কেবিনে ঘুমিয়েছিলাম। এয়ার টাইট রুম-তারপরেও উৎকট দুর্গন্ধে ঘুম ভেংগে গেল ভোর রাতে! অবস্থা আন্দাজ করার জন্য যখন জানালা খুলি-তখন এমন একটা দূর্গন্ধ নাকে ঢোকে মনে হলো এক পশলা “"গন্ধ বৃষ্টি"” এসে সারা শরির ভিজিয়ে দিয়েছে! বায়বীয় গন্ধও যে মানুষের শরির ভিজিয়ে দিতে পারে-তা উপলব্ধি করতে যেতে হবে বুড়িগংগায়! বিদেশী মেহমানরাও গন্ধের উতস খূঁজতে জানালা খুলে যাচ্ছেতাই বিব্রতকর অবস্থায়! নদির পানি যে এতো নোংরা আর দূর্গন্ধময় হতে পারে-তা বুড়িগংগা নদির তীরে নাগেলে অনূমান করাও সম্ভব নয়।

পৃথিবীর প্রায় সব বড় বড় নগরীই কোন না কোন নদীর উপর ভর করে গড়ে উঠেছে। আমাদের প্রিয় ঢাকাও তার ব্যাতীক্রম নয়। বুড়িগঙ্গাকে আশ্রয় করে ঢাকা শহর এর উত্পত্তি। আঠারো শতকের শেষের দিকেও বুড়িগঙ্গা ছিল গঙ্গার মূলধারা যা বর্তমানে ধলেশ্বরীর শাখায় পরিণত হয়েছে। এ বুড়িগঙ্গা দিয়েই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মসলিন,নীল আর পাট।

তারপর যুগে যুগে এ নদীর প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি জৌলুশও বাড়তে থাকে। ঢাকা যেমন হয়ে ওঠে প্রাচ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠে বুড়িগঙ্গার বুক। কোন কোন শাসক বুড়িগঙ্গার দুই তীরে করেছিলেন আলোকচজ্জার ব্যবস্থা। বাঁধ নির্মান করা হয়েছিল লম্বা তীরজুড়ে। যার নাম বাকল্যান্ড বাঁধ,আজ যা শুধুই ইতিহাস।

বুড়িগঙ্গাকে নিয়ে আছে অসংখ্য মিথ। বুড়িগঙ্গার উত্পত্তি সম্পর্কে হিন্দু পুরাণে আছে- ‘মহামুনি জমদগ্নির আদেশে পুত্র পরশুরাম মাতৃহত্যা করে মারাত্মক পাপ করেন। যে কুড়াল দিয়ে পরশুরাম মা রেনুকাকে বধ করেছিলেন,সে কুড়াল তাঁর হাতে আটকে যায়। কোনো ভাবেই কুড়াল হাত থেকে ছাড়তে না পেরে অবশেষে পরশুরাম দুঃখ ও অনুশোচনায় ভারাক্রান্ত হয়ে বনজঙ্গলে ঘুরে তপস্যা করতে লাগলেন। একদিন ব্রক্ষ্মপুত্রের মহাত্মের কথা শুনে আশায় বুক বেধে ব্রক্ষ্মপুত্রের খোজে বের হলেন।

ব্রক্ষ্মপুত্র তখন একটি হ্রদরূপে হিমালয় পর্বতে অত্মগোপন করেছিল। বহু বছর হিমালয়ে নিষ্ফল ঘোরার-পর হিমালয়ের নীচে এক প্রশস্ত হ্রদ দেখতে পেয়ে,পরশুরাম আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রার্থনা করে ঝাঁপ দিলেন ব্রক্ষ্মপুত্রের বুকে। এবং তার পরই হাত থেকে কুড়ালখানা ছুটে গেল। পরশুরাম বুঝলেন তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে। সর্বপাপ হরনকারী এ পবিত্র পানি দুনিয়ার সব মানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য পরশুরাম তার কুড়ালটিকে লাঙ্গলে রূপ দেন।

সে লাঙ্গল দিয়ে ব্রক্ষ্মপুত্রকে টেনে নিয়ে আসেন সমভূমিতে। এভাবে বহুদিন টানার পর বর্তমান লাঙ্গলবন্দে এসে তার লাঙ্গলটি আটকে যায়। পরশুরাম বুঝতে পারেন তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এবার তিনি নদীর মাহাত্ম প্রচারে তীর্থ যাত্রায় বের হন। অন্যদিকে যেখানে এসে ব্রক্ষ্মপুত্র থেকে গেলো তার কাছ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল যৌবনা।

চঞ্চলা,অপরূপ সুন্দরী নদী শীতলক্ষ্যা। শীতলক্ষ্যার রূপ-যৌবনের কথা শুনে তাকে দেখার জন্য শক্তিশালী ব্রক্ষপুত্রের গর্জন শুনে সন্ত্রস্ত হয়ে তার সৌন্দর্য লুকিয়ে এক বৃদ্ধার রূপ ধারণ করে নিজেকে বুড়িগঙ্গারূপে উপস্থিত করে। ব্রক্ষ্মপুত্র আশাহত হয়ে চিত্কার করে উঠল,বহু বৃদ্ধ নারী: কোথায় সেই অপরূপ যৌবনা শীতালক্ষ্যা? লক্ষ্যা মৃদুস্বরে জবাব দিলেন আমিই সে লক্ষ্যা। ব্রক্ষ্মপুত্র ধাবিত হলো লক্ষ্যার দিকে। এবং লক্ষ্যাকে দেখে মুগ্ধ হলো।

সেখানে তাদের মিলন হয়ে ব্রক্ষ্মপুত্র আর শীতালক্ষ্যার পানি এক স্রোতে মিশে গেল। তারই একটি স্রোত বয়ে চলেছে বুড়িগঙ্গা নাম ধারন করে। এ তো গেলো পুরাণের কথা। বাস্তবে বুড়িগঙ্গা ছিল এক সময় বিশাল,গভীর আর প্রসস্ত এক নদী। তার এক তীরে ছিল লালবাগের কেল্লার দক্ষিণ দেয়াল।

অন্য তীর ধু-ধু করত নবাবগঞ্জ চর। ইসলামবাগ ও শহীদ নগরের অস্তিত্ব ছিলনা আঠারো শতকের শেষের দিকেও। তখন বিশাল বিশাল বাণিজ্য জাহাজ নিয়মিত চলাচল করত এ নদী দিয়ে। বুড়িগঙ্গার স্রোত কেড়ে নিয়েছে অনেকের ধন দৌলত আবার দিয়েছেও অনেককে। যুগে যুগে নদীপথে এ নদীর তীরে এসে নেসেছে পৃথিবীর বহ সওদাগার,পরিব্রাজক ও ব্যবসায়ী ।

ব্যবসা বাণিজ্যে ও যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নদীপথ হওয়ায়,বুড়িগঙ্গা ছিল এ অঞ্চেলের মানুষের আশীর্বাদ স্বরূপ। ঢাকার তথা বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ বুড়িগঙ্গার নৌপথেই পরিচালিত হতো। ইসলাম খান চিশতি বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন ১৬০৮ সালে। সুবাদার নিযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছতে পারেননি। তার আগের বছর বাংলায় মোগলদের পরাজিত করেছিল পর্তুগিজরা।

আফগান,পর্তুগিজ ও মগ দস্যুদের পরাজিত করে তিনি ঢাকায় এসে পৌছেন ১৬১০ সালের জুলাই মাসে। রাজধানী ঢাকার রূপকার ইসলাম খান এ বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে এসে পরলেন ঢাকার বুকে। মোগলদের যুগেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল বুড়িগঙ্গা তীরে বেড়ে ওঠা রাজধানী ঢাকা। ’ এ সময় ব্যবসা বাণিজ্য এক অনন্য নগরীর রূপ নেয় ঢাকা। ইংরেজ শাসনামলের শেষের দিকে ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের ধস নামার সঙ্গে সঙ্গে এ নদীর প্রয়োজনীয়তা ও কমতে থাকে।

দিন দিন কমতে থাকে বাণিজ্য জাহাজ চলাচল। তারপরও নৌকার বাহার ছিল বিশাল এ নদীর বুক জুড়ে। বর্ষায় নৌকাবাইচ মুগ্ধ করত নগর বাসীকে। তখন থেকেই অসাধু দখল দারদের থাবা পড়ে বুড়িগঙ্গার দুই তীরে। সংস্কারের অভাবে দুই তীরে জমে পলি।

এই তীর দখলের লড়াইয়ে বুড়িগঙ্গা এখন এক মরা নদী। বুড়িগঙ্গা তীর দখল করে উঠেছে ঘরবাড়ি, কাঁচাবাজার,কাঠ চেরাইয়ের মিল,কলকারখানা। পাকা দালান তুলে সে জায়গা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা এখন পাকাপাকি। অবাক করার মতো বিষয়-এ দখলদারদের সবারই আছে দলিলপত্র। এক শ্রেণীর অসাধু সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী টাকার বিনিময়ে এসব জমির দলিল করে দেয়।

মাঝে মধ্যে কর্তৃপক্ষ অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা নিলেও নানা রকম জাল কাগজপত্র দেখিয়ে "হাইকোর্টের স্থিতি অবস্থা নোটিশ জাড়ি" করে সে উদ্দেশ্য ব্যাহত করে তারা। অন্য দিকে নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিক কোনো নিয়ম না থাকায় প্রতিনিয়ত নদীর পানিতে মিশছে হাজার হাজার টন আবর্জনা। দূর্গন্ধে নদীর তীর এমনকি পোস্তগোলা কিংবা বাবুবাজার ব্রীজেও দাড়ানো কঠিন। এতটাই খারাপ অবস্থা বুড়িগঙ্গার পানির। হাজারিবাগ থেকে বুড়িগংগা চীন মৈত্রী সেতু পর্যন্ত নদিতে কোনো মাছ ও জলজ প্রাণীই নেই।

জলজ প্রানীর সাথে মানুষের প্রানও বিপন্ন প্রায়। সহসাই কার্যকরি কোন ব্যবস্থা না নিলে স্রোতস্বিনী এ নদী হয়তো অস্তিত্বহীন হয়ে পরবে। ঢাকার বুক জুরে বয়ে চলা খালগুলির মতো বুড়িগঙ্গাকেও ইতিহাসে খুঁজতে হবে। তথ্য সুত্রঃ ঢাকার ইতিহাস, লেখকঃ নাযীর আহমেদ ঢাকার পুরোনো কথা, লেখকঃ. মনোয়ার আহমেদ। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।