জাফর ইকবাল স্যার তাঁর এক সাক্ষাতকারে(এবং মনে হয় এটি তাঁর একটি বইয়েও লিখেছেন) বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের পরে আরও তিনজন সাহিত্যিক নোবেল পেতে পারতেন বলে তিনি মনে করেন; তারাশংকর, অদ্বৈতমল্ল বর্মন ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্যকে অনেকেই নিম্নবর্গ ও উচ্চবর্গের সাহিত্যে ভাগ করে থাকেন। এই তিনজনই নিম্নবর্গের সাহিত্যিক এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা আমাদের দেশে ব্যাপক প্রশংসিত লেখক হলেও মোটেই জনপ্রিয় বইয়ের লেখক নন। কিন্তু সকল ধারনাকে ভন্ডুল করে দিয়ে আনিসুল হকের এক ফেসবুক জরিপে প্রিয় বইয়ের তালিকায় প্রথমে হাজার বছর ধরে এবং এর পরেই পদ্মানদীর মাঝি স্থান করে নিয়েছিল। কলেজ জীবনে আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছিল, সে নাকি জীবনে পাঠ্যবইয়ের বাইরে একটি বই পড়েছে,সেটি হল হাজার বছর ধরে।
এই বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সে মুখস্ত বলতে পারত। পদ্মা নদীর মাঝির ক্ষেত্রেও একথা খাটে কিনা জানি না তবে ক্লাসরুমে দেখেছি, পদ্মানদীর মাঝি সবাইকে ব্যাপকহারে বিনোদন দিয়েছে। শীতল কিংবা হোসেন মিয়ার বাটপারি আমাদের কিছুটা ছুঁয়ে গেছে বটে কিন্তু সবশেষে কপিলা আর কুবেরের গোপন হৃদয়যোগে আমাদের অট্টহাসি আর গোপন শিহরনই টিকে ছিল। আবার গাইড বই পড়তে পড়তে আমরা মোটাদাগের পাঠক থেকে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ অনভূতির সমালোচক হয়ে উঠলাম। তখন শীতলবাবুর নরম মাটিতে পা টিপে টিপে চলে যাওয়া আমাদের কাছে তাৎপর্যপূর্ন হয়ে উঠে।
হোসেন মিয়ার চরিত্র বিশ্লেষন করতে গিয়ে আমরা জানলাম "হোসেন মিয়া স্বপ্নচারী মানুষ"। হোসেন মিয়ার মধ্য দিয়ে নাকি লেখকের ব্যক্তিজীবনে স্বপ্ন প্রকাশ পেয়েছে। হোসেন মিয়ার ময়না দ্বীপে কুবেরের স্থান হলেও সে কপিলাকে 'লগে' নেয় নি বলে আমাদের অনেক দুঃখ ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে 'সুসাহিত্যের' পাঠক হবার বাসনাতেই কিনা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গল্পসমগ্রের অনেকটা পড়ে ফেলি। প্রাগৈতিহাসিক, সরীসৃপের মত প্রতিটি গল্পই জীবন নিয়ে সে সময়ের রোমান্টিক ভাবনাগুলোকে কেমন যেন ধাক্কা মেরেছিল।
যে জীবনবোধের তাড়না মানিকবাবুকে বস্তিতে ঠাই দিয়েছিল,তার নাগাল পেয়েছিলাম তখন। বিনোদন প্রত্যাশী পাঠক সুন্দর স্বপ্নের যে বাস্তবায়ন চায় লেখকের লেখনীতে তাঁর গল্পে সেসবের ঠাঁই ছিল না, ছিল চোর,ডাকাত,খুনে,কেরানী,ভিখারিনীর জীবনের নির্মম বাস্তবতা। একমাত্র ব্যতিক্রম পদ্মানদীর মাঝির হোসেন মিয়া। কেমন যেন খটকা লাগত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজকের ঘটনার রিপোর্ট পড়তে পড়তে মনে হল খটকা দূর হয়েছে।
মানিক বাবু কোন স্বপ্নের কথা লিখেন নি,মানব সভ্যতার বিবর্তনে বারবার ঘটে যাওয়া এক ইতিহাসের গল্প লিখেছেন তিনি, বাঙালি জাতির ইতিহাসের সাথে এ গল্প মিলে গেছে,যেখানে প্রতিটি বাঙ্গালিই কুবের,ভবিষ্যতে হোসেন মিয়ার ভূমিকায় আমাদের জীবনে এ গল্প ফিরে আসবে বলে মনে হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উপলক্ষে গাউন ও উপহার সামগ্রী বিতরন চলছিল। ডিএমসি,সলিমুল্লাহ মেডিকেল সহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত। অথচ এরাই কিনা লাইন ভেঙ্গে একেকজন যতটুকু পেরেছে ততটুকু উপহার নিয়ে ঘরে ফিরেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কয়েকজন মেধাবী চোরকে হাতেনাতে ধরে বলেছেন,"তোমাদের আমরা এই শিখিয়েছি?" ।
ওদের আর কী দোষ,কুবেরদের জীবনটাই যে এমন। হোসেন মিয়া রাত কাটিয়েছিল কুবেরের ঘরে। ঘুমন্ত হোসেন মিয়ার পকেট থেকে পয়সা সরিয়েছিল কুবের। সকাল হতেই কন্যা গোপীসে পয়সায় ভাগ দাবী করেছিল। আজকের কনকো ফিলিপস,নাইকোর মতই ১৬০২(সম্ভবত) সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশে এসেছিল বানিজ্য করতে।
সত্তরের দশকেও এদেশের মানুষ গায়ে কাল সাবান মাখত। লিভার ব্রাদার্স এসে আমাদের সুগন্ধী লাক্সের ছোঁয়ায় ফর্সা করতে শুরু করল। বাটা সুজ এসে খড়মের জুতার বদলে চামড়ার জুতো ব্যবহার করতে শেখাল। ইদানিং নেসক্যাফে শিক্ষাচ্ছে কফি পান। বোধকরি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীও এমন বাহারি পন্যের পসরা সাজিয়ে বসেছিল, নতুবা কেনইবা বাংলা এবং ভারতবর্ষের শাসকরা তাঁদের কুঠি গড়তে দেবেন।
আজকের গওহর রিজভী,মশিউর রহমানদের মত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীও খুঁজে পেয়েছিল মীরজাফর,জগৎশেঠ,রাজবল্লভদের। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে নারীর ভূমিকার ঐতিহাসিক প্রমান রাখতেই কিনা আজকের মতই তাঁরা খুঁজে পেয়েছিল ঘষেটি বেগমকে। মীরজাফর,মীর কাসিমরা ক্ষমতার মসনদে বসতে পারলেও ভোগ করতে পারেন নি। এরপর পদ্মা মেঘনায় অনেক পানি গড়িয়েছে, ফকির মজনু শাহ, তিতুমীরদের মত অনেক বঙ্গভাষীর রক্ত ঝরেছে। আমাদের হ্যাচারী গুলো নাকি নীতিমালা মানে না,তাই আমরা যেমন তাঁদের নিষিদ্ধ করে দিয়ে মুরগীর বাচ্চা আমদানী করি তেমনি, আমাদের লবন চাষীদের মধ্যেও কোন নিয়ম-কানুনের বালাই ছিল না, একারনে দেশী নোংরা লবণ রেখে বিদেশ থেকে জাহাজভর্তি লবণ এনে আমাদের খাইয়েছে।
এক সময়ে এই ‘অভব্য’দের দেশ ছেড়ে তাঁরা ফিরে গেছে নিজ দেশে। পদ্মানদীর মাঝিদের ঘামে যেমন ময়না দ্বীপ কিনেছিলেন হোসেন মিয়া তেমনি অর্ধেক পৃথিবীর তাবৎ কুবেরদের ঘামে নতুন রূপে সেজেছিল ব্রিটেন। কুবেরের ঠাই হয়েছিল ময়না দ্বীপে,দ্বীপের জঞ্জাল সাফ সুতরো করতে , বাস্তবের কুবেররাও মাঝে মাঝে হাওয়াই জাহাজে চেপে লন্ডন যায় হোটেলে কাজ করতে। গল্পের বাকী কুবেররা-গনেশ,নকুলরা- পড়ে থাকে পদ্মানদীর পাড়ে,বাস্তবে বঙ্গোপসাগরের পাড়ে। গল্পের ধনঞ্জয় কুবের একে অপরকে ঠকাতে ব্যস্ত,বাস্তবের কুবেররাও অপরের পকেট মারে, গল্পের গোপীর মতই তাঁরা চুরির টাকার ভাগ চায়,ছোটবেলা থেকে অজস্র কুবেরকে দেখেছি হাসপাতালের করিডোরে পড়ে থাকা অর্ধমৃত মানুষের পকেট হাতিয়ে নিতে।
গল্পের মতই হোসেন মিয়ারা নোউকা নিয়ে আসে,দাদনের টাকা নিয়ে আসে রক্ষাকর্তা হিসেবে। গল্পের মতই আমাদের কুবেররা ধনঞ্জয়ের নৌকা ছেড়ে হোসেন মিয়ার নৌকায় উঠে পড়ে তবু জীবন বদলায় না। আমাদের কুবেররা রবীন্দ্র গবেষণাকেন্দ্রের নামে টাকা মেরে খায়,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে জাপানী প্রফেসরের ব্যাগ-ল্যাপটপ হাপিস করে দেয় আমাদের কুবেররা, আজ আমাদের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ‘মেধাবী’ কুবেররা.........সুন্দরবনের পথে পশুর(কিংবা রূপসা) নদীর বুকে জেগে উঠা চরে নিষিদ্ধপল্লীর ঝুপরিগুলো দেখে মনে হয়েছিল এই বুঝি ‘পদ্মানদীর মাঝি’র কেতুপুর গ্রাম। আজ যেন চারিদিকেই পদ্মাপারের জীবনের ছাপ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।