আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: পুরুষ হরিণের চোখে জল

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ কলিং বেল বাজানোর পর একটি কিশোরী দরজা খুলে দিল। আন্দালিব ভয়ানক চমকে ওঠে। শ্যামলা, মিষ্টি চেহারার চশমা পরা কিশোরীর মুখে যেন অবিকল শাহনাজ-এর মুখটাই কেটে বসানো।

কে মেয়েটি? শাহনাজ -এর মেয়ে নয় তো ? শাহনাজ কি এই বাড়িতেই থাকে এখন? কিশোরীর মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আন্দালিব । সেই সঙ্গে পুরনো একটা সুগন্ধও পায় সে। পনেরো বছরের পুরনো মিষ্টি গন্ধ। যে গন্ধের উৎস ছিল শাহনাজ। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকায় কিশোরীর মুখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠেছে।

আন্দালিব দ্রুত বলে ওঠে, এটা অধ্যাপক ফজলুল আজিম -এর বাড়ি না? হ্যাঁ। উনি আছেন? জ্বী, আছেন। আপনি? ভারি মিষ্টি কন্ঠ। অবিকল শাহনাজ-এর কন্ঠস্বরের মতো। আন্দালিব বলল, আমি ... আমি অধ্যাপক ফজলুল আজিম -এর ছাত্র ছিলাম।

মানে ... আমার নাম সাঈদ আন্দালিব। স্যারকে আমার নাম বললেই চিনবেন। বলে কিশোরীর দিকে আপেলের ঠোঙা বাড়িয়ে দেয় আন্দালিব । ঠোঙা নিতে নিতে মেয়েটি হাসল। বলল, থ্যাঙ্কস।

আপনি বসুন। আমি নানাকে আপনার কথা বলছি। বলেই কিশোরী ঘুরে ওপাশের ঘরে চলে যায়। তার আগে ফ্যানের সুইচ ‘অন’ করে দেয়। আন্দালিব ভাবছে, মেয়েটি স্যারকে ‘নানা’ বলল।

তার মানে মেয়েটির মা শাহনাজ? আন্দালিব তার শরীরময় শিহরণস্রোত টের পায়। মাথা সামান্য ঝিমঝিম করছিল তার। বাইরে মধ্যাহ্নের কড়া রোদ। গলিতে অনেকটা হেঁটে এসেছে। ঘামছিল।

কেমন এক ঘোরের মধ্যে সোফার ওপর বসল। মাথার ওপর বনবন করে পাখা ঘুরলেও বসার ঘরে মধ্যাহ্নের গভীর এক নির্জনতা ছড়িয়ে ছিল। আর সেই পুরনো মিষ্টি গন্ধ। যেন এতটা বছর সেই মিষ্টি গন্ধটা এ ঘরেই স্থির হয়ে ছিল। আন্দালিব এসে ঘ্রান নেবে বলে।

দোতলার জানালা দিয়ে হু হু করে রোদ ঢুকেছে ঘরে। নীচের গলির রিকশার টুং টাং শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ঘরে বেশ কয়েকটা বইয়ের আলমারি। তাকে বইয়ে ঠাসা। এসবই আন্দালিব- এর পরিচিত।

অনেক বছর পর পরিচিত বইয়ের আলমারি দেখে সে স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে। পনেরো বছর তো হবেই ... বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নিয়মিতই সে অধ্যাপক ফজলুল আজিম- এর ফ্ল্যাটে যেত । সে সময় বাংলার অধ্যাপক ফজলুল আজিম ফুলার রোডে থাকতেন । লেখালেখি করত আর মেধাবী ছাত্র ছিল বলে অধ্যাপক ফজলুল আজিম আন্দালিবকে বিশেষ স্নেহ করতেন। আন্দালিব ‘হটিট্টি’ নামে একটা ছোট কাগজ সম্পাদনা করত।

অধ্যাপক ফজলুল আজিম তাতে প্রবন্ধ লিখতেন। অধ্যাপক ফজলুল আজিম- এর মেয়ে শাহনাজ একবার ‌'হটিট্টি' তে অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ- এর জীবনী লিখেছিল। শাহনাজ যখন ইকোনমিক্স নিয়ে ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হল - আন্দালিব তখন এম.এ ক্লাসের ছাত্র। পরিচয় অবশ্য তারও আগে থেকেই। গম্ভীর, চশমা পরা, শ্যামলা রঙের আশ্চর্য এক সুগন্ধ ছড়ানো একটা মেয়ে শাহনাজ ।

আন্দালিব তো প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়েছিল। এবং অনিবার্যভাবে (পরবর্তীতে) প্রেমেও পড়েছিল। ... শাহনাজ-এর কি আমাকে মনে আছে? এতদিন হয়ে গেল ... অলখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আন্দালিব । সিগারেটের জন্য হাত চলে গিয়েছিল পকেটে । স্থানকালপাত্র বিবেচনা করে হাতটা থেমে গেল তার।

আফরোজার জন্য উদ্বেগ ফিরে আসে। আন্দালিব- এর ছোট বোন আফরোজা থাকে কল্যাণপুর । বরের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। ঝগড়াঝাঁটি চলছে। জহিরুল শেয়ারে ধার করা লাখ টাকা লস করে বেসামাল।

ঘরে ফেরে না। আফরোজা কেঁদে কেটে অস্থির। আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আফরোজাদের বাড়ি গিয়েছিল আন্দালিব । ফেরার পথে কল্যানপুর বাসস্টপে অনেক বছর পর বাদল-এর সঙ্গে দেখা । তা পনেরো বছর তো হবেই ... বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সহপাঠী ছিল বাদল।

কথায় কথায় ও বলল, আজিম স্যার যে শ্যামলীর রিং রোডে থাকেন, তা জানিস? কথাটা শুনে আন্দালিব কেঁপে উঠেছিল। আজিম স্যারের সঙ্গে কত স্মৃতিময় মুহূর্ত কেটেছে। তাছাড়া স্যারের মেয়ে শাহনাজ কে ভালোবাসত আন্দালিব। শাহনাজ -এর খবর জানার জন্যও কৌতূহল হচ্ছিল। এখন কোথায় আছে, কেমন আছে শাহনাজ? আন্দালিব-এর বুকের মধ্যে নিঃশব্দ হাহাকার আর্তনাদ করে উঠেছিল।

ওপাশের দেয়ালে এক মধ্যবয়েসি মহিলার সাদাকালো ছবি টাঙানো। অধ্যাপক ফজলুল করিম-এর স্ত্রী। অধ্যাপিকা খুরশীদ জাহান । মেয়েদের একটা কলেজে পড়াতেন ভদ্রমহিলা । ভারি অমায়িক ছিলেন।

(দেয়ালের ছবিই বলে দেয় অধ্যাপিকা খুরশীদ জাহান বেঁচে নেই) ... আন্দালিব কে ভীষণ স্নেহ করতেন ভদ্রমহিলা । কখনও এলে না খাইয়ে ছাড়তেন না। প্লাস্টিকের বক্সে বেলের মোরব্বা দিয়ে বলতেন, এটা তোমার মাকে দিও। আন্দালিব মাথা নাড়ত। তোমার মাকে একদিন নিয়ে এসো ।

কেমন? আনব। মাকে আর ফুলার রোডের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়নি। মা হঠাৎ করেই স্ট্রোক করে মারা গেলেন। বাবা মারা গিয়েছিলেন কলেজে পড়ার সময়। আন্দালিব অথই সাগরে পড়েছিল।

তখনও পড়া শেষ হয়নি। ছোট তিন-তিনটে বোন। স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে। বোনদের পড়ার খরচ, সংসার খরচ। আন্দালিব টিউশনি করত।

বোনেরা মায়ের মত শান্ত, অচঞ্চল হয়নি। খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ঝগড়া করত। চেঁচিয়ে পাড়া মাত করত। গ্লাস-প্লেটও ভাঙত। ঘরে-বাইরে তখন তুমুল অশান্তি।

কেবল শাহনাজ-এর সান্নিধ্যে তার শরীর থেকে বেরোনো সেই অদ্ভূত মিষ্টি গন্ধের আঘ্রানে সব জ্বালাযন্ত্রণা ভুলে যেত আন্দালিব । শাহনাজ কে যোগী-ঋষিদের মতন আরাধনা করত সে। কবিতা লিখত। শাহনাজ - এর সঙ্গে মেশার বেলায় অধ্যাপিকা খুরশীদ জাহান কিংবা অধ্যাপক ফজলুল আজিম -কারও কখনও আপত্তি ছিল না। দু’জনে টিএসসির বারান্দায় বসে থাকত, বইমেলায় ঘুরত।

দূর্দান্ত মেধাবী শাহনাজ- এর আবেগ অনুভূতি কেমন যান্ত্রিক ছিল। ওকে ফুল কিনে উপহার দিলেও সামান্যতম উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত না, বরং মুখ তুলে তাকিয়ে থাকত কেবল। বোনদের কারণে এম এ পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়নি আন্দালিব- এর । তিন বোনের মধ্যে সবচে বড় আফসানা। কলেজে পড়ার সময় এক সিলেটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেল আফসানা ।

তারি মামলা-মোকদ্দমা, হয়রানি এবং ফায়সালা একা একা ‘ফেস করে’ আন্দালিব যখন পরীক্ষার হলে বসল তখন কে রবীন্দ্রনাথ আর কে জসীমউদ্দীন তা তার মনে এল না। অধ্যাপক ফজলুল আজিম মুখ ফিরিয়ে নিলেন। (বাংলাদেশের একটা অজ গ্রাম থেকে কেবল মেধার জোরে উঠে এসেছেন, তিনি একমাত্র কন্যার জন্য পাত্র নির্বাচনে কোনও ভুল করতে চাননি ...) তা মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্রই পেয়েছিলেন অধ্যাপক ফজলুল আজিম । ওবায়দুর রহমান। মাইক্রো বায়োলজিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম।

বিয়ের পর শাহনাজ বরের সঙ্গে ইংল্যান্ড চলে যায়। পরম দুঃসময়ে এক আত্মীয়ের হাতে পায়ে ধরে কোনওমতে একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে ঢোকে আন্দালিব । তারপর শুরু হয় তার নিঃস্ব এক তিক্ত জীবন। আপনি বসুন। নানা এখুনি আসবেন।

আন্দালিব চমকে ওঠে। সেই কিশোরী, ঠিক ঘরে ঢোকেনি, পর্দা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক আছে। আন্দালিব বলল। মেয়েটি চলে যায়।

মুহূর্তেই আন্দালিব- এর বুকটা খালি হয়ে যায়। মেয়েটির সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছিল। মেয়েটি কে দেখলেই সেই সুগন্ধ ঘন হয়ে ওঠে। যে সুগন্ধ এক ব্যথার প্রলেপ। ব্যথায় ভরা বড় নিঃস্ব আর শূন্য আজ আন্দালিব- এর জীবন ।

চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়েসেও বিয়ে-থা করা হল না। বছরের পর বছর তিন বোনের স্বার্থে ঘানি টেনে চলেছে। (বোনদের যে আন্দালিব আজও গভীর স্নেহ করে এও এক গভীর এবং বিস্ময়কর সত্য) ... বোনদের মধ্যে মেজটির বিয়ে পাঁচ বছরও টিকেনি। দুই মেয়ে নিয়ে বিয়ের পর ভাইয়ের কাছে ফিরে এসেছে ঝর্না। ঝর্না অসুস্থ।

ডায়াবেটিস আছে। ইদানীং কিডনিতেও জটিলতা ধরা পড়েছে। ঝর্নার বড় মেয়ের নাম সোনিয়া। ক্লাস এইটে পড়ে। ভারি ফুটফুটে বলে সোনিয়াকে নিয়েও সমস্যা।

স্কুলে যেতে আসতে পাড়ার ছেলেরা বাজে কমেন্ট করে ... হাতে ট্রে নিয়ে কিশোরী ঘরে ঢোকে। ঢুকতেই ঘরে হালকা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে যায়। পনেরো বছর আগের সেই পরিচিত সুগন্ধ। ট্রের ওপর একটা গ্লাসে ট্যাং; আরেকটা প্লেটে স্লাইস করে কাটা আপেল। কি নাম তোমার মা? প্রশ্নটা করতে আন্দালিব দেরি করে না।

মুম। কোন্ ক্লাসে পড়? ক্লাস এইট। মুম এর মুখের দিকে আন্দালিব অপলক চোখে চেয়ে থাকে। কী নিটোল নিষ্পাপ মুখ। এরই মধ্যে মুম পোশাক বদলে এসেছে।

সবে ফুল হয়ে ফুটতে শুরু করেছে। এখন সুগন্ধ ছড়াবে। এই বয়েসেই দেখেছিল শাহনাজ কে। আন্দালিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কখন যে টুপ করে মুম চলে গেছে।

মনটা ভারি হয়ে যায় আন্দালিব- এর। তার মুঠোফোন বেজে উঠল। আফসানা। বলল, হ্যালো ভাইয়া? বল। আমার ভাসুর না কাল ঢাকায় যাচ্ছে।

তোমার ওখানে কয়েক দিন থাকবে। বেশ তো। তুই চিন্তা করিস না। আমি দেখব। তুমি কিন্তু নিজে বাসষ্ট্যান্ডে যাবা ভাইয়া রিসিভ করতে।

আচ্ছা, আচ্ছা। যাব। আফসানা সিলেট থাকে। যে আফসানা আন্দালিব- এর এম.এ পরীক্ষার সময় পালিয়ে গিয়েছিল, সেই বোনদের মধ্যে সবচে সুখি। সেই ঝুটঝামেলায় প্রথম শ্রেণি পায়নি ।

অধ্যাপক ফজলুল আজিম মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মাহনাজ ওর জীবন থেকে হারিয়ে গেল। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেল আশ্চর্য সেই মিষ্টি গন্ধ। আফসানা এসব বুঝবে না। আন্দালিব ঠিক করেছিল আফসানার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না।

কিন্তু, ওর দু’ বোন, ঝর্না আর আফরোজা কী চাল চালল-আন্দালিব বাধ্য হল আফসানাকে মেনে নিতে। আফসানার শ্বশুরবাড়ির লোকজন অনেক। তারা ঢাকায় এলে আন্দালিব- এর আরামবাগের বাসায় ওঠে। ওদের জন্য ভালোমন্দ বাজার করতে করতে চোখেমুখে অন্ধকার দেখে আন্দালিব। আফসানা এসব বোঝে না।

আন্দালিব গোপনে ক্ষয়ে যেতে থাকে। তিন বোনের একজনও কখনও বলেনি,‘ভাইয়া তোমার জন্য মেয়ে দেখি। ’ ভাই ওদের কাছে স্বার্থসিদ্ধির উপায় মাত্র। হৃদয়ে গাঢ় অভিমান নিয়ে গোপনে ক্ষয়ে যাচ্ছে আন্দালিব। অধ্যাপক ফজলুল আজিম এলেন।

বৃদ্ধের পরনে চেক লুঙ্গি আর সাদা রঙের ফতুয়া। গায়ের রং ফরসা। গোলপানা মুখে সাদা দাড়ি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। চশমার কাঁচে কুয়াশা লেগে আছে মনে হল।

মাথায় টুপি। হাতে তসবিহ। আশ্চর্য! অধ্যাপক ফজলুল আজিম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় তো ঘোর সংশয়বাদী ছিলেন। ডক্টর হুমায়ূন আজাদ এর কট্টর সমর্থক ছিলেন। ধর্মের বিরুদ্ধে লিখতেন, তর্ক করতেন।

আন্দালিব উঠে দাঁড়ায়। সালাম দেয়। বোস বাবা, বোস। বলে অতিকষ্টে সোফার ওপর বসলেন বৃদ্ধ অধ্যাপক। আন্দালিব বসে।

স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন তো? জিগ্যেস করে। আরে বল কী! তোমাকে চিনব না? এত রোগা হয়ে গিয়েছ? রংটাও মরে গেছে। আল্লাহ না করুক, তেমন কোনও অসুখবিসুখ বাঁধিয়ে বসনি তো? এখন তো চল্লিশেই অনেকে- কথাটা বৃদ্ধ শেষ করতে পারলেন না। কাশতে লাগলেন। আন্দালিব ফ্যাকাশে হাসে।

কী বলবে সে। তার অবশ্য ডায়াবেটিস আছে, এ কথা কি বলা যায়? তাছাড়া আজকাল আফরোজা আর সোনিয়ার জন্য টেনশনে প্রেশারও গোলমেলে হয়ে থাকে। তা থাক কোথায় বাবা? আরামবাগ স্যার। করছ কী? একটা ব্যাঙ্কে আছি স্যার । প্রাইভেট ব্যাঙ্ক ।

বেশ, বেশ। তা লেখালেখি কিছু কর? ছাত্রজীবনে তো ছোট কাগজ সম্পাদনা করতে। লেখাটেখা এখন আর আসে না স্যার। অ। বলে বৃদ্ধ কাশতে লাগলেন।

‘লেখাটেখা এখন আর আসে না স্যার। ’ কথাটা ঠিক এভাবে বলতে চায়নি আন্দালিব। মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল। কথাটা অবশ্য পুরোপুরি সত্য না। ‘পুরুষ হরিণের চোখে জল’ নামে একটি কবিতার বই আর ‘হটিট্টি সমগ্র’ নামে ছাত্রজীবনের সেই ছোট কাগজের সঙ্কলনের পান্ডুলিপি তৈরি।

প্রকাশক পাচ্ছে না আন্দালিব । নিজে ছাপাতে গেলে অনেক টাকা বেরিয়ে যাবে। সংসারের আনুষাঙ্গিক খরচ বাদেও প্রতি মাসে ঝর্নার চিকিৎসা জন্য অনেক টাকা বেরিয়ে যায়। তাছাড়া বছর খানেক আগে আফরোজার কান্নাকাটিতে ওর বর জহিরুলকে তিন লাখ টাকা লোন করে দিতে হয়েছে ... কাশি থামার পর অধ্যাপক ফজলুল আজিম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। তারপর বললেন, লেখা আমারও আসে না বাবা ।

সব সময় মন ভার ভার হয়ে থাকে। সারাক্ষণ খালি খুরশীদ এর মুখটা ভাসে। একটাই মেয়ে। সেই শানুর সংসার টিকল না। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এল।

তার পর থেকে আমার আর কিছু ভালো লাগে না। আন্দালিব তার শরীরে শিহরণ স্রোত টের পায়। শাহনাজ এর সংসার টিকল না মানে? কি হয়েছিল? ওবায়দুর রহমান এত ভালো পাত্র। মাইক্রো বায়োলজিতে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট! তাহলে? প্রতিশোধ নেওয়ার ব্যাপারটা বোধ হয় মানুষের সহজাত। আন্দালিব চাপা আনন্দ টের পায়।

এক কালের ডাকসাইটে অধ্যাপক ফজলুল আজিম এখন বৃদ্ধ। একজন ব্যর্থ ভঙ্গুর মানুষ। যিনি আন্দালিব কে পুত্রসম স্নেহ করতেন, সামান্য বিচ্যূতিতে দূরে ছুড়ে ফেলে আন্দালিব কে প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছিলেন। আন্দালিবও এত বছরে সংসারের ঘানি টেনে ক্ষয়ে গেছে, বুড়িয়ে গেছে। তার হৃদয়ে আর তিনমাত্র মাধুর্য নেই।

তার হৃদয়ে কেবলই তিক্ততার বোধ। সে এককালের শ্রদ্বেয় অধ্যাপক ফজলুল আজিম-এর সংসারের ভগ্নদশায় তীব্র আনন্দ টের পায়। অধ্যাপক ফজলুল আজিম কিছুক্ষণ কাশলেন। তারপর খরখরে কন্ঠে বললেন, শানুর মা তোমার কথা খুব বলত বাবা । খুরশীদ চলে গেছে প্রায় দশ বছর হল।

তখনই শানু ফিরে এল ইংল্যান্ড থেকে। কোলে পাঁচ বছরের মেয়ে। তারপর থেকে ওদের নিয়েই বেঁচে আছি। এখন নাতনীর সঙ্গে গল্প করে আমার সময় কাটে। শাহনাজ একটা এনজিওতে চাকরি করে।

আমরা এখন বেশ আছি বলতে পার। ‘বেশ আছি’ মানে? আন্দালিব ভিতরে ভিতরে চঞ্চল হয়ে ওঠে। আসলেই কি শাহনাজ ভালো আছে? ওর কোনও ক্ষোভ নেই? যন্ত্রণাবোধ নেই? কামনাবাসনা নেই? শাহনাজ বরাবরই চাপা স্বভাবের। সব সময় গম্ভীর হয়ে থাকত। আজ থেকে ১৫ বছর আগে ওরা পাশাপাশি হাঁটত।

আন্দালিব আর শাহনাজ। হাঁটতে হাঁটতে চারুকলা ছাড়িয়ে শাহবাগ। আজিজ সুপার মার্কেট। কখনও রিকশায় নীলক্ষেত। শাহনাজ কথা বলত কম।

বেশির ভাগ সময়ই চুপচাপ থাকত। আন্দালিব কে ভালোবাসত কিনা তা কখনও মুখ ফুটে বলেনি শাহনাজ, ব্যাপারটা বোঝাও যেত না। তবে শাহনাজ এর শরীর থেকে এক আশ্চর্য গন্ধ ছড়াত। যে গন্ধে ডুবে যেয়ে আন্দালিব সমস্ত দুঃখযন্ত্রণা ভুলে যেত। আজ জীবনের ঘোর শূন্যতার মাঝে আবার সেই গন্ধ পেল আন্দালিব।

মুম কে দেখার পর ... ... কলিং বেলটা বাজল। মুম ও ঘর থেকে ছুটে এসে দরজা খুলে দিল। শাহনাজ বসার ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল। কালো পাড়ের সাদা সুতির শাড়ি পরে আছে। কালো ব্লাউজ।

আন্দালিব-এর কেমন শীত শীত করে। তার করতল ভিজে ওঠে। সারা শরীর ভিজে যায়। ‘কেমন আছ বলে’- সে উঠে দাঁড়াতে চাইল। পারল না।

সারা শরীর অসম্ভব ভারী ঠেকল তার। অবশ আর ভারী। শাহনাজ এখনও তাকিয়ে আছে। স্থির হয়ে আছে। দ্রুত সামলে নিল অবশ্য ।

মুম আছে বলেই সম্ভবত। মুম-এর হাতে কী একটা প্যাকেট তুলে দিল শাহনাজ । মুম- এর মুখটা খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল। শাহনাজ দ্রুত পায়ে ভিতরে চলে যায়। মুম ও ওর মায়ের পিছন পিছন চলে যায়।

অধ্যাপক ফজলুল আজিম বললেন, আমার শরীর ভালো না বাবা। হাই ব্লাড প্রেশার। বই লিখব কী । চোখে ভালো দেখি না। বইপত্তরও পড়তে পাড়ি না ...ঘুমের মধ্যে খালি আজেবাজে স্বপ্ন দেখি।

খুরশীদ ডাকে, দেখি গ্রামের বাড়ির খালপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। খালপাড়ে বাঁশঝাড়ে আমার মায়ের কবর বাবা ... বৃদ্ধ এলোমেলো কথা বলে যান। বয়স হলে যা হয়। আন্দালিব দ্রুত ভাবছিল: শাহনাজ কি আসবে? যদি না আসে। মুম বড় হয়েছে।

ও ওর মায়ের অতীত জেনে যাবে? তাই? শাহনাজ তা চায় না। শাহনাজ জানে মুম কে দেখে চমকে উঠেছে আন্দালিব। মুম খেয়াল করেছে। হঠাৎই আন্দালিব-এর বুক অভিমান উথলে ওঠে। আমি তো অধ্যাপক ফজলুল আজিম এর খোঁজখবর নিতে এসেছি।

আর এখন শাহনাজ এর কথাও জানা হল। ওর মেয়েকেও দেখলাম। তাহলে আর আমার এখানে বসে থেকে কী লাভ। আজ আমি উঠি স্যার। বলে উঠে দাঁড়ায় আন্দালিব।

যাবে? আচ্ছা এসো। বলে বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন। ঠিক মতো পারছেন না। কষ্ট হচ্ছে। অসহায় দৃশ্যটা দারুণ উপভোগ করে আন্দালিব।

আন্দালিব একবার অধ্যাপক ফজলুল আজিম কে বলার চেষ্টা করে, আমি এখনও বিয়ে করিনি স্যার। কন্ঠস্বর ঠিক মতো ফুটল না তার। দরজার কাছে পৌঁছে মনে হল: শাহনাজ কি আসবে একবার ? কিংবা মুম? হয়তো শাহনাজ একাকীত্বে ভুগে অনেক বদলে গেছে। অথবা ও আমাকে কখনোই সিরিয়াসলি নেয়নি। আমিই বোকার মতন একতরফা ভাবে যা ভাবার ভেবে গেছি।

বিবাগী পালের মতো গাঢ় অভিমানে আন্দালিব- এর বুক ফুলে ওঠে । একটু পর দরজা খুলে সিঁড়িতে বেড়িয়ে আসে সে। সিঁড়িতে হালকা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে ছিল। পনেরো বছর আগেকার সেই সুগন্ধ। শাহনাজ একটু আগে এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছিল।

তারই সুগন্ধ। জীবন অনেক বদলে গেছে। তবে সুগন্ধ একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এই সব আশ্চর্য কথা ভেবে কেমন এক ঘোরের মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে থাকে আন্দালিব। তার পর নীচের ঝলমলে রোদের ভিতর মধ্যাহ্নের এই নির্জনতায় এসে দাঁড়ায় সে।

কেন জানি-চারপাশ ঝাপসা দেখাচ্ছে ... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.