আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাযযাদ কাদির

অরুণালোক সাযযাদ কাদির সাহেবের সঙ্গে আমার পক্ষিক বিবর্তন পত্রিকার মাধ্যমে খুব অল্পদিনের পরিচয় হলেও, আমি আগে থেকেই উনার অনেক লেখা/কলাম পড়ার সুযোগ পেয়েছি। সামনা সামনি পরিচয় হওয়ার পর, আমি উনার ভেতর কিছু অসম্ভব গুণ লক্ষ্য করলাম। অনুজদের সাথে চমৎকার মার্জিত আচরণ, লেখার ধরন বুঝিয়ে দেওয়ার অসম্ভব ক্ষমতা, হাসি কথা বলা এসব আমাকে অল্পদিনের মধ্যেই উনার প্রতি কেমন যেন ভাললাগা তৈরি করে দিলো। উনি খুব ভাল লেখেন, ভাষার উপর গবেষণা করেন। এছাড়াও অনেক অনেক গুণ উনার আছে।

আমি ভেবেছিলাম, উনাকে ভাল লাগে বলেই উনি আমি উনাকে গুণীন হিসেবে চিহ্নিত করছি। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো-, আমি উনাকে লক্ষ্য করে আজ একটা লেখা পেয়েছি। লেখাটা পড়ে আমি উনার প্রতি আরও বেশি করে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি। সাযযাদ কাদির সাহেব বর্তমানে দৈনিক মানব জমিনে একটা সম্মানজনক পদে কর্মরত। পাঠকের মেহফিলে আমি সে লেখাটি পেশ করছিঃ স্যারকে যেমন দেখেছি হাসিন আরা (আমি) ঈশ্বরের মুখ দেখিনি কখনও না দেখলেও বুঝি বা চলে।

“ঈশ্বর মানবশিশুকে সবচেয়ে অসহায় আর অসম্পূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন” কিন্তু যিনি অসহায় আর অসম্পূর্ণকে শিল্পীর পরম সাধনায় মানবীয় সত্ত্বায় সম্পূর্ণ করে তুলেছেন সেই ঋষির সান্নিধ্য আজীবন কাম্য আমার। ‘অপর বেলায়’ও ভেসে যাক স্বপ্নের ভেলা শস্য পরিপূর্ণ সোনার তরী পৃথিবীর পথে পথে বিলাক সোনালী ফসল। স্যারের জন্মদিনে এই সশ্রদ্ধ পংক্তিমালা দিয়ে শুরু করছি আজকের স্মৃতিচারণ। ১৯৭৩ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের (অনার্স) ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য সা’দত মহাবিদ্যালয় কলেজ, করটিয়া, টাঙ্গাইল যাই। আমি মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি, যেমন- জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, আবুল হোসেন প্রমুখের নাম মুখস্ত করছিলাম।

বান্ধবী রীনা বললো, ‘সাযযাদ কাদির ও মাহবুব সাদিক নাম দু’টিও আধুনিক কবিদের নামের তালিকায় সংযোজন করে নাও। ’ আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘উনারা আবার কোন কবি?’ রীনা একট ঝাঁঝের সাথে বললো, ‘এই দেশেরই কবি। তোমার ভর্তি পরীক্ষার বোর্ডে আছেন তাঁরা। ’ আমি মফস্বল কলেজের ছাত্রী। এতকিছু জানার সুযোগ হয়ে ওঠে নি তখনো।

চিন্তিতভাবে নামদু’টি মনে রাখার চেষ্টা করলাম। যথাসময়ে আমার ডাক পড়লে কেন্দ্রে প্রবেশ করি। বোর্ডে বসে থাকা সবাই আমার অপরিচিত। সৌজন্য সালাম বিনিময় ও আসন গ্রহণের পর একজন শিক্ষক আমাকে কবি শামসুর রাহমানের কয়েকটি বইয়ের নাম জিজ্ঞেস করলে গড়গড় করে বলে দিয়েছিলাম। বইগুলি পড়েছি কিনা জানতে চাইলে বিনয়ের সাথে বললাম, ‘জ্বি না স্যার, পড়ার সৌভাগ্য হয়নি।

’ তখন একজন তরুণ শিক্ষক বললেন, ‘ও! তুমি বইয়ের নামগুলি এখানে বলতে হবে বলে শুধু মুখস্থ করে এসেছ?’ আমি দমে না গিয়ে বললাম, ‘এই পৃথিবীর কত লেখকের কত বইয়ের নামই আমরা জানি স্যার, সব বই নিশ্চয়ই সবার পড়া হয়ে ওঠে না। সুযোগ এলে অবশ্যই পড়ব স্যার। ’ এবার সাযযাদ কাদির স্যার বললেন, ‘কোন কোন লেখকের বই পড়েছ তুমি বল দেখি। ’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম বললাম আমি। রবি ঠাকুরের কোন বই পরেছি জিজ্ঞেস করায় নৌকাডুবির নাম বললাম।

স্যার তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নৌকাডুবির নায়ক নায়িকা কে?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘এই বইটিতে দুইজোড়া নায়ক-নায়িকা আছে স্যার, হেমনলিনী-রমেশ, নলিনাক্ষ-কমলা। ’ স্যার বললেন ‘তোমার দৃষ্টিতে রমেশ-কমলা নায়ক-নায়িকা হতে পারল না কেন, পরস্ত্রী বলে কী?’ আমি নির্দ্বিধায় উত্তর করলাম, ‘জ্বি স্যার!’ সেসব কথা এখন মনে করে লজ্জায় মরে যাচ্ছি। নায়ক-নায়িকা বলতে হয়তো তখন জুটি বুঝেছি, যাদের সঙ্গে বিয়ে হবে, তারাই বুঝি নায়ক-নায়িকা। কিন্তু আমার ধারণা ছিল ভুল এবং ছেলেমানুষীতে ভরা। সে কথা ভেবেই হয়তো স্যার ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

তাই আমিও অনার্সে ভর্তি হতে পেরেছিলাম দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। রাবণের মতো একজন রাক্ষসও যে নায়ক হতে পারে, মেঘনাদবধ কাব্য না পড়লে সে কথা বিশ্বাস করতাম না। এরপর সাযযাদ কাদির স্যার আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘মেয়েদের একটা পত্রিকার নাম বলো’। ’ সেসময় আমার মেঝভাই প্রায়ই বাড়িতে একটি পত্রিকা আনতেন, নাম ‘ললনা’। আমি মাথায় কিছু না আসায় সেই নামটিই বলে দিলাম।

স্যার খুশী হয়ে মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ললনা। কিন্তু আরেকটি পত্রিকা আছে না মেয়েদের? খুব কমন- বেগম। ’ আমি হঠাৎ মনে পড়ায় বললাম, ‘জ্বি, স্যার। ঈদসংখ্যা বেগম। অনেক পড়েছি।

’ স্যার বললেন, ‘বেগম আর ললনার মধ্যে পার্থক্য কী?’ ওরে বাবা! এ যে দেখছি নিজের জালে নিজেই আটকা পড়ে যাচ্ছি! আমি বললাম, ‘তাবৎ নারীকূলকে বলে ললনা, আর বিবাহিত মহিলাদের বলে বেগম!’ আমার এই জানাটাও ছিল ভুল। মুসলিম মেয়েদের সম্মানসূচক উপাধি হিসেবে নামের শেষে বেগম, আখতার, খাতুন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। স্যার আমার ভুল ধরিয়ে না দিয়ে বললেন, ‘তোমার নামের শেষে তো বেগম আছে, তুমি কি বিবাহিত? সার্টিফিকেটে আমার নামের শেষে বেগম ছিল আর আমি দৈবক্রমে বিবাহিতও ছিলাম। তাই সম্মতিসূচক উত্তর দিলাম। স্যারের প্রথম ক্লাসের দিনেই একটা খটকা বেঁধে গেল।

স্যার ছিলেন দেখতে ছিমছাম। পাজামা, সিল্কের পাঞ্জাবি পরা, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, অত্যন্ত স্মার্ট। গম্ভীর মুখে দ্রুতগতিতে ক্লাসে ঢুকেই বোর্ডের কাছে চলে যেতেন। যে বিষয় পড়ানো হতো, তার নাম লিখে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। সেদিন ছিল চরযাপদের ক্লাস।

দুলু নামের ছেলেটি, চওড়া বুক, উচ্চতায় সবার চেয়ে একটু বেশি, কথায় কথায় অর্থহীন হাসতো। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে বলে ফেললো, ‘স্যার, ‘‘বুদ্ধিষ্টো মিষ্টিক শংশো(!)’’-কি স্যার? বুঝতে পারছি না!’ সে আসলে ঢাকা ইউনিভার্সিটির নির্ধারিত বাংলা অনার্সের সিলেবাসে উল্লেখিত বইসমূহের একটি ‘‘বুদ্ধিস্ট মিস্টিক সংস’’ (বৌদ্ধগান ও দোহা) এর কথা বলতে চেয়েছিল। স্যার ছাত্রটির উচ্চারণের বহর দেখে খুব রেগে গিয়ে বললেন, ‘ফাজলামি করার আর জায়গা পাও না? বসো চুপ করে!’ স্যার যখন পড়াতেন- ‘‘কাআ তরুবর পঞ্চ-বি ডাল। চঞ্চল চীএ পইঠো কাল। ।

’’ স্যারের গাম্ভীরয্য ভেদ করে কি এক রহস্যের জগতে চলে যেতাম আমরা। স্যারের সুমধুর স্নিগ্ধ কণ্ঠে রমরম করে বাজতো- ‘‘উঁচা উঁচা পাবত বসই শবরী বালী মোরাঙ্গি পীচ্ছ পরহীন শবরী গীবত গুঞ্জার মালী’’ তখন গুঞ্জার মালা পরিহিত বালিকাটির সাথে কল্পনায় আমিও উঁচু পর্বত শিখরে উঠে যেতাম সুর্যাস্ত দেখার জন্য। স্যারের বলার ভঙ্গি,বর্ণনা স্টাইল এতটাই প্রানবন্ত ছিল যে চোখের সামনে ছবিগুলি ভাসতে থাকত। যখন সেফোক্লিসের ইডিপাস পড়াতেন, তখন আমার মনে হতো স্যার নিজেই যেনো ইডিপাস। ইডিপাসের স্বভাব বোঝানর জন্য স্যার যখন এভাবে বর্ণনা করতেন, ‘ইডিপাসের শরীরে ছিল রাজরক্ত।

রাজার ছড়ির খোঁচা তার প্রবল ব্যক্তিত্বে আঘাত করে। ’ তখন তিনি আমার চোখে ইডিপাস হয়ে যেতেন। তাঁর প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব আর অনতিক্রম্য গাম্ভীর্য ভেদ করে কোনদিন স্যারের কাছাকাছি যেতে পারিনি। কিন্তু একটা ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা অনুভব করতাম সবসময়। স্যারের খোঁজখবর সবসময়ই পেতাম।

তিনি বিচিত্রায় ছিলেন দীর্ঘদিন জানতাম। কিন্তু কোনদিন দেখা হয়নি। হঠাৎ ২০০০ সালে আমার কর্মক্ষেত্র গাজীপুরের এক বইয়ের দোকানে বই খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়ল স্যারের লেখা ‘অপর বেলায়’। অপেরা নিয়ে কি শক্তিশালী লেখা। এখনো মনে দাগ কেটে আছে বিগতযৌবনা ‘লতিফা’ নামের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি।

বইটি দেখে মনে হল যেন স্যারের দেখা পেলাম। সাথে সাথে বইটি কিনে ফেললাম। এরপর আমার মেয়ে লাবণ্য প্রভা জানালো, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা জার্নালিসম কোর্সে পি, আই, বিতে তাদের ক্লাস নেন সাযযাদ কাদির স্যার। স্যারের কাছে আমার পরিচয় দিলে তিনি খুশী হয়ে গর্ব করে বলেন, ‘মা ও মেয়ের শিক্ষক আমি। ’ একজীবনে দ্বিতীয় প্রজন্মের শিক্ষক হতে পেরে ভারি আনন্দিত হয়েছিলেন তিনি।

পরবর্তীতে আমার ছেলে মিথুন একটি পত্রিকার হয়ে তার সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন তিনি ওর সঙ্গে বেশ খোলাখুলি আলাপ করেন। প্রথমজীবনে প্রচণ্ড গম্ভীর একজন মানুষ এখন ওদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ কথাবার্তা বলেছেন শুনে আমি খুব অবাক হই। এসব শুনে আমার কেবলই মনে হয়, জন্মগতভাবেই মানুষ বন্ধুভাবাপন্ন। শত গাম্ভীর্যর মাঝেও তাই সুযোগ পেয়ে সেই বন্ধুসুলভ মনোভাবটা বেরিয়ে আসে।

তিনি ছিলেন একজন জাত শিক্ষক। পড়ানোর সময় তিনি এততাই আন্তরিক ছিলেন যে প্রতিটি চরিত্র চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠত। গ্রীক নেমেসিস এত সুন্দর করে বোঝাতেন যে আজো হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। এসব কথা লিখতে পেরে আজ অনেকদিন পর নিজেকে ভারমুক্ত মনে হচ্ছে। ১৪.০৪.২০১১ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.