আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সব্বাই করে বলে,সব্বাই করে তাই

বলি হচ্ছেটা কী? পরীক্ষার মরশুমে সর্বত্র এত হৈ-চৈ কেন? প্রকৃতির নিয়ম মেনে দিব্যি তো পুর্ব দিগন্তে সুর্য উঠছে,পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে ; লোকে জন্মাচ্ছে, বড় হচ্ছে, বিয়ে করছে, বাপ-মা হচ্ছে, বুড়ো হচ্ছে, মারা যাচ্ছে, তারপর কেউ স্বর্গে যাচ্ছে, কেউ নরকে, কেউ বা এই মুহূর্তে বাজার ভাল বলে ভূত হয়ে ঝুলে থাকাটাই পছন্দ করছে। তাহলে, পুর্বপুরুষদের নিয়ম মেনে নকল করতে অসুবিধেটা কোথায়? আগের প্রজন্ম যা যা করেছে, আমি কিম্বা আপনি যখন সেই কাজগুলোই যখন করি,তখন আমার-আপনার জীবনই তো সবচেয়ে বড় টোকাটুকির কারখানা ! বাবা ডাক্তার তো ছেলেকে ডাক্তার হতেই হবে, বাবা ইঞ্জিনিয়ার হলে সন্তানকে বুয়েটের চৌহদ্দি মাড়াতেই হবে। মা গায়িকা হলে মেয়ে তো রুনা লায়লা ! আর নৃত্যশিল্পি হলে হাঁটতে শেখার আগে হামাগুড়ি দিতে হবে,কত্থক কিংবা ভরতনাট্যমের তালে তালে। আর মা কিংবা বাবার মধ্যে কেউ যদি অভিনেতা-অভিনেত্রী হন, তবে তো কথাই নেই,আদরের সন্তানটির দুধের দাঁত পড়বার সময় না দিয়েই তাকে পর্দায় মেলে ধরা হবে। তো এই যে এত কিছু হচ্ছে এগুলো বুঝি নকলনবিশি নয়? দেখবার চোখ আর একটু প্রসারিত করলে, পাড়ার একটি গলির কোন মেয়ে সাতানব্বই শতাংশ নম্বর পেয়েছে ,ব্যস আশেপাশের পাঁচটা গলির পনেরোজন মা ঝাঁপিয়ে পড়লেন তার নোটসের খাতা হাসিল করার জন্য।

ওই মেয়েটি পরীক্ষায় যে প্রশ্নের উত্তরে যা লিখেছে, বাকি সবার ছেলে-মেয়েকেও ঠিক তাই তাই লিখতে হবে, তবে না সাতানব্বই শতাংশ হতে পারবে ! এই নাটক থুড়ি যুদ্ধে নেমে সেই ব্রিলিয়ান্ট মেয়েটির মা-বাবাকে পটানোর জন্য তরকারির দাম থেকে শুরু করে চায়ের দোকানের বিল পর্যন্ত মিটাতে কার্পন্য করেন না নোটসপ্রার্থী বাবা-মায়েরা। কিন্তু, নিজেদের বাচ্চাদের এরা ঠিক কী করতে উৎসাহিত করেন ? জবাবে কেউ চুপ থাকবেন, কেউ বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলবেন-বালাই ষাট। ব্যাপারস্যাপার দেখে ওপার বাংলার নাটকের একটি পংক্তি মনে পড়ে গেল, ‘সব্বাই করে বলে, সব্বাই করে তাই’... । সত্যি ভাবতে বসলে ঝিম ধরে যায় যে, আমাদের জীবনের কত কিছু আমরা শুধু একটিমাত্র কারণে করি,সেই কারণটা হল-অন্য সবাই করে তাই। এবং কী আশ্চর্য অন্য সবাই যেভাবে করে, আমরাও কাজগুলো কম-বেশি ঠিক সেভাবেই করার চেষ্টা করি।

মানে, শীতের বিয়ের নেমতন্নে কোট-টাই পরে কেতা নেওয়া লোকটা মরা বাড়িতে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আসে কেন, জিজ্ঞেস করলে আমতা আমতা যে উত্তর পাওয়া যাবে তাও হয়ত হরেদরে ওটাই,- ‘সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই...’ তাহলে সবার দেখাদেখি পাশ করতে চাওয়ার মধ্যে এমন কোন অপরাধ আছে? না অপরাধ নেই যদি তুমি সৎ পথে অর্থাৎ পরীক্ষার সময় বইখাতা না খুলে এবং পাশের পরীক্ষার্থীর খাতা না দেখে নিজের মেধায় উত্তরপত্র ভরাবার চেষ্টা করো। এটাই মোদ্দা কথা। কিন্তু এটা তো আইনের কথা, প্রশাসনের কথা। এই দুটি বস্তুর সঙ্গে আমজনতার আটপৌরে জীবনের সম্পর্ক তো দা-কুমড়ো ! আইনের সুবিচার ও প্রশাসনের ভরসা যে পায় নি, সে এই কথাগুলো মানবে কেন? বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে? আচ্ছা,একবার ভাবুন তো, যে ছাত্র-ছাত্রী দিনের পর দিন দেখেছে যে ক্লাসে স্যার আসল নোটসগুলো দেন না, ওগুলো পাওয়া যায় স্যারের গোয়াল ঘরে ভরতি হয়ে মাসে হাজার টাকা নজরানা দিলে। সে কেন স্যারের উপদেশে মজে প্যান্টের গোপন পকেট কিংবা মোজার ভিতর থেকে নকলের কম্পোজ ফেলে দেবে ? অথবা যে ছাত্র-ছাত্রী জুতোর সুকতলা ক্ষয় করেও হারানো নম্বরপত্রের ডুপ্লিকেট বের করতে পারেনি, পেরেছে যেদিন এক নেতার ‘হাতা’কে টাকা খাইয়ে সঙ্গে নিয়ে গেছে, সে পুলিশের কথা মেনে কেন শান্ত-শিষ্ট হয়ে থাকবে? থাকবে না বলেই পরীক্ষার মরশুমে টোকাটুকির ধুম পড়ে ।

ব্যাপারটি সত্তর-আশির দশকের রিপ্লে বলে চালানোর চেষ্টা হলেও, এ আসলে চলতি সময়ের পণ্য। হ্যাঁ, বীজটা সত্তর দশক থেকে ধার করা, কিন্তু গাছটা আজকের। স্মৃতির পাতা হাতড়ে দেখুন,সেই যুগে টোকাটুকি ছিল একটা ব্যক্তিগত উদ্যোগ। ষন্ডামার্কা একটা গুণ্ডা পরীক্ষা হলে বসে টেবিলে ছোরা গেঁথে টোকাটুকি করলেও, হল থেকে বেরিয়ে ছোরাটা লুকিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে যেত কারণ, নিজের কাজের পক্ষে সামাজিক সমর্থন জোগাড় করা তার জন্য ছিল না। কিন্তু এখন ছোরার দরকার হয় না কারণ, টোকাটুকি এই মুহূর্তে একটি সামাজিক উদ্যোগ।

তাই জানালা দিয়ে, দরজা দিয়ে, নকলের যোগান আসছে, তাতে বাধা পড়লে মোবাইল তো আছেই, আর গার্ড দেওয়া মাষ্টারমশাই-ম্যামেরা হাবা হয়ে তাকিয়ে দেখছে । কারণ,তারা জানে, সফল হওয়ার এই যেন-তেন-প্রকারের চেষ্টাকে অলক্ষ্যে সমর্থন করছে গোটা সমাজব্যবস্থা। সাফল্য এবং টোকাটুকির এই লাইলি-মজনু সম্পর্কে যতি টানি একটা গল্প শুনিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার এক সুন্দরী বান্ধবী পড়াশোনায় কাঁচা ছিল বলে তাকে হামেশাই বলতাম-‘পরীক্ষায় ফেল করলে দেখিস,সবাই তোকে নিয়ে হাসবে। ’ ফেল না করলেও মেয়েটি খুব খারাপ রেজাল্ট করেছিল।

কিন্তু কিছুদিন পরই হঠাৎ মেয়েটির ছবি দেখা যেতে লাগল শহরের বড় বড় রাস্তার মোড়ে, বিরাট সব বিলবোর্ডে। একটি মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির পণ্যের মডেল হিসেবে সে আত্নপ্রকাশ করেছিল। এই ঘটনার কয়েকমাস পর একদিন আমার সেই বান্ধবী আমায় ফোন করে বলল, ‘রুমু, তুই ঠিকই বলেছিলি। এখন আমায় দেখে সবাই আমার মতো করে হাসার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি আর কাউকে দেখে হাসি না।

রোদচশমা চোখে দিয়ে বিএমডব্লিউতে চড়ে বসি। ’ এটাও তো গণ-টোকাটুকি, নাকি? আপনারা কী বলেন? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।