আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রলাঁ বার্থ: না-এই না-ওই জাতের সমালোচনা

এল এক্সপ্রেসের (দৈনিক পত্রিকা) প্রথম দিকের এক সংখ্যায় সমালোচকের বিশ্বাসের (বেনামা) পেশা সম্পর্কে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। ভারসাম্যপূর্ণ অলংকারের বুননে চমৎকার ছিলো অই লেখাটি। রচনাটির ভাব এমনই যে, সমালোচনা অবশ্যই ‘না-ঘরকা, না-ঘাটকা’ ধরনের কিছুই হতে হবে। এর অর্থ, সমালোচনার না হওয়া চলবে প্রতিক্রিয়াশীল, না কমিউনিস্ট, না হওয়া চলবে ভিত্তিহীন, না রাজনৈতিক। এই-যে নামের তালিকাভিত্তিক উন্মাদনা, তা ব্যাপকভাবে যুক্ত থাকে দ্বিগুণ বর্জনের এক রীতির সাথে।

আমরা আগেও অনেকবার এই উন্মাদনার মুখোমুখি হয়েছি। এই বর্জনের রীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা কলাকৌশল নিয়েই আমরা এখানে আলোচনা করছি। একসময় মনে করতাম, এই কৌশলটাকেই সম্পসারিত অর্থে পাতি-বুর্জোয়া প্রথা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। একটা মানদণ্ডের সাপেক্ষেই কেউ সমস্ত ধরনের পদ্ধতিকে বুঝে নেয়, তার কাছে যেটা সেরা মনে হয় সেটাকেই তার উভয় পাশে এনে জড়ো করে, নিজেই যেনো পরিণাম-না-জানা সর্ব-নিয়ন্তা একজন, জন্মসূত্রেই এক আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী, যা খুবই আদর্শমানের এবং একবারেই সঠিক, ওজন পরিমাপে ক্ষেত্রে যেমন নিক্তির ডাঁটই বিচারক। এ ধরনের হিসেবনিকেশের অবিচ্ছেদ্য ত্রুটিসমূহ মূলত যেসব শর্ত ব্যবহৃত হয় তাদের নৈতিকতার মাঝেই বিরাজমান থাকে।

একটা আদিম সন্ত্রাসী কৌশল অনুসারে (কেউ স্বেচ্ছায় সন্ত্রাসবাদ থেকে পালাতে পারে না), একজন নাম দিচ্ছে তো সে একইসাথে বিচারও করছে। এই নাম-শব্দটি, যার ওপর প্রাধান্য-প্রাপ্ত শাস্তিযোগ্যতার ভার চাপানো, একটা না একটা মানদণ্ডকে নমিত করতে প্রায়-স্বাভাবিকভাবেই আবির্ভূত হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সংস্কৃতি মতাদর্শসমূহের বিরোধী হবে। সংস্কৃতি মহৎ ও সর্বজনীন এক বিষয়, সামাজিক নির্বাচনের বাইরে এর অবস্থান : সংস্কৃতি একেবারেই নির্ভার। এর বিপরীতে, মতাদর্শসমূহ দলীয়লোকজনের তৈরি : তাই, মানদণ্ডগুলোর অধীন, এবং এদের দ্বারা বহিস্কৃত! কঠোর দৃষ্টিতে, সংস্কৃতির উভয় দিকই বাতিল হয়ে যায় (না-বুঝেই যে, সংস্কৃতি শেষ বিশ্লেষণে নিজেই একটা মতাদর্শ)।

এমনভাবে প্রত্যেকটি বিষয় ঘটে যেনো এর এক পাশে ভারি, কঠিন শব্দাবলি (মতাদর্শ, প্রশ্নোত্তরে শিক্ষাদান, সমরশক্তি), মানদণ্ডের অপমানকর খেলার রসদ যোগায়; এবং অন্য পাশে হালকা, বিশুদ্ধ, নির্বস্তুক শব্দাবলি, ঐশ্বরিক আইনের ভিত্তিতে মহৎ, বচনের তিক্ত নিয়মকে পরিহারের দৃষ্টিকোণ থেকে মহিমান্বিত (এডভেঞ্চার, আবেগ, বিশালত্ব, গুণ, সম্মান), মিথ্যেসমূহের বাজে হিসেবনিকেশেরও উর্দ্ধে তুলে রাখা। শেষ দলের শব্দসমূহ পূর্বের দলের শব্দসমূহকে ধসিয়ে দেয়, বাতিল করে দেয় : এমনসব শব্দ আছে যারা অপরাধী এবং অন্য শব্দরা আছে যারা অপরাধী শব্দের বিচার করে থাকে। বলা বাহুল্য, তৃতীয়পক্ষের নিখুঁত নৈতিকতা অলঙ্ঘনীয়ভাবেই নতুন স্ববিরোধের দিকে ঠেলে দেয়, মোটমুটি সরলভাবেই, কেউ সেই স্ববিরোধকে নেয়াহেত জটিলতার নামেই যতোটা চালাতে চায়। সত্য, আমাদের বিশ্বকে বিকল্পায়নের একটি ধারাবাহিকতা হিসেবে বেশ ভালভাবেই গণ্য করা যায়; কিন্তু আপনি নিশ্চিত হতে পারেন, এ কেবল এক বিচার-বিহীন বিভাজন; বিচারকদের কোন মুক্তিই নেই : তারাও সঠিকভাবে এবং সত্যিকার অর্থেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধমাত্র। এ ছাড়া, এই না-এটা, না-ওটা জাতের সমালোচনা কোন পাশে অবস্থিত তা বুঝতে এ জাতের সমালোচানার মাঝে আর কোন্ কোন্ পুরাণের আবির্ভাব ঘটে তা লক্ষ্য করাই যথেষ্ট।

সময়হীনতার পুরাণ শ্বাশত ‘সংস্কৃতি’র পক্ষে যুক্তি উত্থাপনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখে। সময়হীনতার পুরাণ সম্পর্কে অধিক না-বলে আমাদের এই না-এটা না-ওটা ধরনের পাণ্ডিত্যে, আমি দেখতে পাই, বুর্জোয়াদের দুটি সাধারণ পুরাণ নীতিবিরোধী হলেও সুবিধাজনক বলে বিরাজ করছে। প্রথমটা, স্বাধীনতা সম্পর্কে নির্ধারিত একটা বিশ্বাস, যেটা ‘পূবর্ত সিদ্ধ ধরনের বিচারবোধের বিরোধিতা’র বেশে বিরাজিত। এখন সাহিত্যগত বিচারে কোন বিষয় যে সমগ্রতার অংশ তার সবটাই বিচার্য, এবং যে পদ্ধতিটি অনুপস্থিত তার সাপেক্ষেও-- বিশেষ করে যখন সেটি বিশ্বাসেরই ব্যাপার-- যেটা খুবই সুনির্দিষ্ট একটা পদ্ধতি থেকে সৃষ্ট, যেটা এ ক্ষেত্রে একটা খুব সাধারণ বুর্জোয়া মতাদর্শেরই ধরনমাত্র (অথবা সংস্কৃতির, যেভাবে আমাদের বেনামা লেখকগণ বলতে পারে)। এমনকি বলা যায়, মানুষ যখন তার প্রাথমিক স্বাধীনতাকে ঘোষণা করে যে, তার অধীনস্ততা সবচেয়ে কম বিচ্যুত, তখনও একই ব্যাপার ঘটে।

কেউ কোন ধরনের ভীতি ছাড়াই সবসময়েই পবিত্র সমালোচনার চর্চাকারী কাউকে অস্বীকার করতে পারে, যে পবিত্র সমালোচনা কোন ধরনের পদ্ধতিগত নির্ধারণ থেকে মুক্ত : না-এটা না-ওটা জাতীয় সমালোচক-বাহিনী নিজেরাই একটি পদ্ধতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেটা তাদের অপরিহার্য পদ্ধতিটি নয়, যার প্রতি তারা অনুগত্য ঘোষণা করে। মানুষ, ইতিহাস, ভাল, মন্দ, সমাজ ইত্যাদি সম্পর্কে পূর্ব-ধারণা ছাড়া কেউ সাহিত্য বিচারে নামতে পারে না : এমনকি সরল এডভেঞ্চার শব্দটির ক্ষেত্রেও, আমাদের না-এটা না-ওটা জাতীয় সমালোচকরা ঐ সব বাজে নোংরা পদ্ধতিসমূহের বিরুদ্ধেও উপদেশ বর্ষাতে একে এমন উদ্যমে ব্যবহার করেন যা ‘কোন বিস্ময় জাগায় না’, যতো ঐতিহ্য, যতো সর্বনাশ, যতো নিয়মানুগ সূচির কথাই বলেন! যেকোন ধরনের স্বাধীনতাই শেষাবধি কোন পূর্বপরিচিত সঙ্গতিবোধকে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করে, যেটা পূর্ব-প্রদত্ত কোন স্বতঃসিদ্ধই। তাই স্বাধীনতা, সমালোচকদের জন্য, প্রতিজ্ঞাকে বর্জন নয় (অসম্ভব!), তার নিজের প্রতিজ্ঞা পালন করাই, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হোক বা না-হোক। * আমাদের রচনায় দ্বিতীয় বুর্জোয়া লক্ষণ হলো সানন্দে লেখকের শৈলীর বরাত দেয়া যেনো তা সাহিত্যের এক শাশ্বত মূল্য। এবং এরপরও, ইতিহাসের প্রশ্নে নিরীক্ষিত না-হয়ে কোন কিছুই গৃহীত হতে পারে না; এমন কি ভাল লেখাও নয়।

শৈলী মোটামুটি একটি সমালোচনাগত মূল্য হিসেবে গৃহীত, এবং শৈলীর নামে অভিযোগ উত্থাপন শুরু হলো সে-সময়ে যখন কয়েকজন লেখক ক্ল্যাসিক বলে অভিহিত পুরাণের সর্বশেষ এই দৃঢ় ভিত্তিটির ওপর আঘাত হানলো, যারপরনাই, এটি একটা নির্দিষ্ট প্রত্ন-আগ্রহ প্রদর্শনে পরিণত হয় : না, আরো একবার শৈলীর কাছে ফিরে আসা কোনভাবেই এডভেঞ্চার হতে পারে না! বলা ভাল, স্তাদালের জাদু-আকষর্ণের বিরুদ্ধে (এতো একবোরেই স্তাদালের মতো পড়তে!) এলাঁ রব গ্রিয়ের প্রাসঙ্গিক-প্রতিবাদ এল’ এক্সপ্রেসের পরবর্তী এক সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছিলো। শৈলী এবং মানবতার একটা নির্ধারিত ধরনের সমন্বয় (যেমনটা আনাতোল ফ্রাঁসের রচনায়) আর-যাই-হোক ‘সাহিত্যের’ একটি ভিত্তি হিসেবে আর যথেষ্ট নয় কোনভাবেই। এমনকি এই ভয়ও পেতে হয় যে, বহু বানোয়াট মানবকর্মের সাথে আপোস করার ফলে শৈলী শেষাবধি এমন কিছুতে পর্যবসিত হয় যাকে একটা পূর্বত-সিদ্ধ বলেই সন্দেহ হয় : শৈলী এমন একটা মূল্য, তা যেভাবে হোক না কেন, যা লেখকের কৃতিত্ব হিসেবেই বিবেচিত হবে, যে লেখক কিনা সঠিক মূল্যায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এর অর্থ এই নয় যে, সাহিত্য কিছু রীতিমাফিক করণকৌশল ছাড়া অস্তিত্ববান থাকতে পারে। কিন্তু ভালো লেখার বিপরীত, সঠিকভাবে বললে, খারাপ লেখা নয় : আজকাল তা বস্তুত কেবলই লেখা।

না-এটা না-ওটা ধারার সমালাচকদের প্রতি যথোচিত শ্রদ্ধা রেখেই এ কথা বলা যায়। এ ধারার সমালোচকরা অপরিবর্তনীয় বলে গণ্য দ্বি-খন্ডিত এক বিশ্বের বিশেষজ্ঞ, যেখানে তারা ঐশ্বরিক সজ্ঞার (ডিভাইন ট্রান্সেডেন্স) প্রতিনিধিত্ব করতে পছন্দ করেন। সাহিত্য এমন পরিস্থিতিতে ঢুকছে যা কঠিন, নিয়ন্ত্রিত, ও নশ্বর। সাহিত্য যে-প্রতিরোধ রচনা করছে তা আর কোনভাবেই এর অলঙ্কার নয়, নিজের চামড়াই বরং: আমি ভয়ই পাচ্ছি, নতুন এক না-এটা না-ওটা জাতের সমালোচনা এক মৌসুম পরেই হয়তো শুরু হবে। * পাসক্যালের প্রতিজ্ঞার একটি উল্লিখন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।