সমালোচকরা (বইয়ের বা নাটকের) প্রায়ই দুটি তর্ক উত্থাপন করে থাকেন, বলা ভালো, তর্ক একটাই। সমালোচনার সত্যিকার বিষয় ধরা যায় না, এবং পরিণামে, সমালোচনা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। আকস্মিকভাবেই গৃহীত এই সিদ্ধান্তের ভেতরেই প্রথম তর্কটি নিহিত। পর্যায়ক্রমিকভাবে পুনরাবৃত্তিও ঘটে দ্বিতীয় তর্কটির। একটা বই-যে প্রতিবেদনগতভাবেই দার্শনিক তা বুঝার পক্ষে যে কেউই অতি গবেট, না হয় মূর্খ।
এমন স্বীকারোক্তিতেই দ্বিতীয় তর্কটি নিহিত। সেকারণেই, কিয়ের্কেগার্দের ওপর হেনরি লেফেভরের নাটক আমাদের শ্রেষ্ঠ সমালোচকদের মাঝেও (এবং আমি সেসব লোকদের কথা বলছি না, যারা প্রকাশ্যে তাদের মুর্খতা স্বীকার করে) নির্বুদ্ধিতার একটা কপট বিরাগ (এর লক্ষ্য স্পষ্টভাবেই লেফেভরকে নিখাঁদ বুদ্ধিবাদীতার হাস্যকর পাত্র হিসেবে হেয় করা) সৃষ্টি করে থাকে।
তাহলে কেন সমালোচকরা পর্য়াক্রমিকভাবে তাদের অসহায়তার অথবা তাদের বুঝদারীর অপর্যাপ্ততার কথা ঘোষণা করেন? এটা নিশ্চিতভাবেই সদাচরণের মধ্যে পড়ে না : একজন সমালোচক যখন বলেন, অস্তিত্ববাদের কিছুই তার বোধগম্য নয়, তখন তার চেয়ে সুবিধাজনক জায়গায় আর কেউ থাকে না; আর কেউ এমন আয়রনিক হতে পারে না, এবং এ জন্য আর কেউ বেশি স্ব-নিশ্চিত হতে পারে না তার চেয়ে, যে কিনা লাজুকমুখে বলে মহৎ লোকদের দর্শনের সাথে তার পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়নি; এবং তৃতীয় কেউ তার চেয়ে বেশি যোদ্ধা-প্রতীম হতে পারে না, যে কিনা কাব্যিক অনির্বচনীয়তার পক্ষে ওকালতি করে থাকে।
এসবই বস্তুত এই অর্থ স্পষ্ট করে, যে বিশ্বাস করে তার বুদ্ধির এমন নিশ্চিতি যে, একটা কিছু বুঝার ক্ষেত্রে তার অসামথ্যর্কে জানান দেয়ার মধ্যে দিয়ে তার নিজমনের স্বচ্ছতাকে নয়, একজন লেখকের স্বচ্ছতাকেই বরং প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। এ আর কিছুই নয়, জনগণের প্রতিবাদকে নিজের পক্ষে আনতে অশ্লীলতা চালিয়ে যাওয়া, এবং অসহায়তায় দুষ্কর্মে সহযোগিতা দান থেকে বুদ্ধিতে দুষ্কর্মে সহযোগিতা প্রদানের দিকে একে সুবিধাজনভাবে বহন করে চলা।
মাদাম বার্দোরিনের মতো অনেক সালোঁতেই এ ধরণের কাজকারবার সুপরিচিত। 'আমি যার পেশাই হলো বুদ্ধিমান বা বুঝদার হওয়া, বুঝি না কিছুই এ ব্যাপারে; এখন আপনিও এ সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারবেন না; তা হলে দাঁড়াচ্ছে এই, আপনিও বুদ্ধিমান, যতোটা আমি। '
মৌসুমিভাবে ঘোষিত সংস্কৃতির ঘাটতির পেছনের বাস্তবতা হলো সেই প্রাচীন সংস্কার বিরোধী ব্যক্তির পুরাণ, যে-মতে ভাবনাগুলো অনিষ্টকারী, যদি না 'সাধারণ জ্ঞানের' এবং 'অনুভূতি'র দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হয় : জ্ঞান হলো ইবলিশ, উভয়েই এক গাছের ফল। সংস্কৃতি কেবল এ শর্তেই অনুমোদিত যে, নিদির্ষ্টকাল পরপর এর লক্ষ্য এবং ক্ষমতার সীমা সম্পর্কে দেমাগ ঝাড়ে, (এই বিষয়ে মনোবিশারদ এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সম্পর্কে গ্রাহাম গ্রীনের ভাবনা পড়ে দেখতে পারেন); আদর্শগতভাবে সংস্কৃতি একটা মিঠে বাগাড়ম্বরপূর্ণ উৎসারণ, এক ধরনের শব্দ-ব্যবহার-কলা, যেনো তা ক্ষণস্থায়ীভাবে হৃদয়ের সিক্ত হবার সাক্ষ্য বহন করে বেড়ায়। যদিও এই প্রাচীন প্রণয়ী যুগল, হৃদয় এবং মস্তিষ্কের কোন বাস্তবতাই নেই, মূলের দিক দিয়ে কপট বিশ্বসীর ভাবচ্ছবি ছাড়া, এইসব আফিমোপম দর্শনে, এটা শেষপর্যন্ত এবং সবসময়েই শক্তিশালী শাসনব্যবস্থার প্রধান অবলম্বনটি নির্মাণ করে দিয়েছে, এবং এর মাঝে আবেগ, ও অনির্বচনীয়তার দিকে তাদেরকে ছুটতে বলা এবং এসব নিয়ে এগোতে বলার মাধ্যমে বুদ্ধিজীবির হাত থেকে একজন নিজেকে মুক্ত করে নেয়।
বস্তুত, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোন ধরণের সংরক্ষণবাদী পন্থা অবলম্বন করা মানে আসলে একটা সন্ত্রাসবাদী অবস্থানই গ্রহন করা। একজনের পেশাগতভাবে সমালোচক হওয়া এবং ঘোষণা দেওয়া, সে অস্তিত্ববাদ বা মার্কসবাদ (এরা হলো সেই বিশেষ দুই দর্শন যাদের সম্পর্কেই বলা হয়, কেউ স্বীকারোক্তি করে থাকে, তার পক্ষে তা বুঝতে পারা অসম্ভব) সম্পর্কে কিছু জানে না, এর অর্থ সে কারো অন্ধ বা বোবা দশাকে উপলব্ধির একটা সার্বজনীন নিয়মে তাকে উন্নীত করেছে, এবং তাকে অস্তিত্ববাদ এবং মার্কসবাদের জগৎ থেকেই বাতিল করে দিয়েছে : 'আমি বুঝি না, অতএব তুমিই মুর্খ। '
যদি কেউ কোন বইয়ের দার্শনিক ভিত্তিকে ভয় পায় বা তুচ্ছজ্ঞান করে, এবং যদি কেউ ঘন-ঘন দাবী জানায়, তাদের সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার/ না-বুঝার অধিকার তার আছে এবং এ বিষয়ে তার কিছুই বলার নেই, তাহলে কেন আর সমালোচক হওয়া? বোঝা এবং আলো ফেলাই তো আপনার পেশা, নয় কি? আপনি অবশ্যই সাধারণ জ্ঞান দিয়ে দর্শনকে বিচার করতে পারেন; ঝামেলার ব্যাপার, যে সাধারণ জ্ঞান এবং আবেগ দর্শনের দ-ও বুঝে না; দর্শন, অন্যদিকে, তাদেরকে সঠিকভাবেই বুঝতে পারে। আপনি দার্শনিকদের ব্যাখ্যা না করলেও তারা আপনাকে ঠিকই ব্যাখ্যা করবে। আপনি বুঝতে চান না মার্কসবাদী লেফেভরের নাটকটা, কিন্তু আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে, মার্কসবাদী লেফেভর আপনার না-বুঝ অবস্থাটি ঠিকই বুঝতে পারে, এবং সর্বোপরি (কেননা আমি বিশ্বাস করি, আপনি সাংস্কৃতিক জ্ঞানের অভাবে ভোগার চেয়ে ধূর্ততায় অনেক বেশি এগিয়ে আছেন) আপনি এ বিষয়ে সানন্দে 'ক্ষতিশুন্য' স্বীকারোক্তিটাই করলেন।
দ্রষ্টব্য : মাদাম বাদুরিঁ নামের স্যালোঁটি আসলে প্রুস্তের 'এ্যা লা রিসার্সে দ্যু টেম্পস্ পার্দু'তে উল্লেখিত।
উৎস: মিথোলজিজ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।