প্রবাসী আদিম মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে অসংখ্য আলোর বিন্দু দেখে বিস্মিত হয়ে রচনা করেছে তাদের মনগড়া কল্পকাহিনী। কিছু আলোর বিন্দুকে ঘুরতে দেখে তাদের নাম দিয়ছে প্লানেট বা ভ্রমনকারী। রোমান দেব দেবীর নাম অনুসারে নামরকরন করেছে বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রের, যেমন - ভেনাস(শুক্র), ইউরেনাস(আকাশ দেবতা) , মার্স(মঙ্গল) , জুপিটার(বৃহস্পতি) ইত্যাদি। ধর্মগ্রন্থ গুলোতেও এসেছে মহাশুন্য এবং গ্রহ নক্ষত্রের বিষয়। শুন্য থেকে মহাশুন্যে যাওয়ার স্বপ্ন মানুষ দেখেছে অনেক আগে থেকেই।
পৃথিবীর বায়ূমন্ডলের বাইরের জগৎ হল মহাশুন্য । মোটামুটিভাবে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটার উপরের কারমেন( Kármán line,) লাইনের বাইরে থেকেই মহাশুন্যের শুরু। বিমানে করে শুন্যে ওড়া গেলেও বাতাস ছাড়া বিমান অচল। মহাশুন্যে যেতে হলে চাই রকেট। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষন শক্তি অতিক্রম করতে যে গতিবেগের দরকার পড়ে তা শুধু রকেটের পক্ষেই সম্ভব।
নিউটনের তৃতীয় সুত্রই হল রকেটের ভিত্তি। রকেট হল একটা নল যার সামনের দিক বন্ধ , ভিতরে থাকে জ্বালানী। জ্বালানী পুড়ে তা বেরিয়ে আসে প্রচন্ড বেগে পেছনের দিকে আর রকেট ছুটে চলে সামনে।
প্রথম রকেট ব্যবহার হয় চীন দেশে। ১২৩২ খৃস্টাব্দে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বন্দুকের বারুদ পুরে বানানো রকেট ব্যবহার করে চীনারা।
পরবর্তী কয়েক শতাব্দি ধরে এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রকেট ব্যবহারের প্রমান মেলে। বাগদাদ দখলের সময় মোঙ্গলরা রকেটের ব্যাবহার করে। আরবেরা অতি সত্বর রকেটের ব্যবহার শিখে নেয় এবং ১২৬৮’র সপ্তম ক্রুসেডের সময় তা ব্যবহার করে ফরাসী সম্রাট লুই নবমের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ১৭৯২ এবং ১৭৯৯ সালের যুদ্ধে টিপু সুলতান সাফল্যজনকভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক বোঝাই রকেট ব্যবহার করেন।
১৮৯৮ সালে রুশ পদার্থবিদ কনস্ট্যান্টিন সিওলোকভস্কি (Konstantin Tsiolkovsky (1857-1935) প্রথম তরল জ্বালানী ব্যবহার করে রকেটে মহাশুন্যে পৌছানোর সম্ভাবনার কথা বলেন।
ঐ সময় সমস্ত রকেটে কঠিন জ্বলানী যেমন গান পাউডার ব্যবহার করা হত। সিওকোলভস্কিকে মহাশুন্য অভিযানের জনক বলে থাকেন কেউ কেউ।
রাশিয়ান বিজ্ঞানী কনস্ট্যানটিন সিওলোকভস্কি।
এর পর জার্মান বিজ্ঞানী হারম্যান ওবের্থ (Hermann Oberth) ১৯১৭ সালে তরল জ্বালানী ব্যবহার করে রকেট তৈরীর সম্ভাবনার কথা বলেন। তার লেখা বইতে (The Rocket Into Interplanetary Space) রকেটে করে মহাশ্যুন্যে অভিযানের রুপরেখা দেন।
সে বই জার্মানীতে ব্যাপক সাড়া জাগায়। জার্মান সরকার অতঃপর রকেট নিয়ে ব্যাপক গবেষনা শুরু করেন। পরবর্তী উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানী হলেন আমেরিকার বিজ্ঞানি রবার্ট গোড্ডার্ড।
বিজ্ঞানি রবার্ট গোড্ডার্ড( Robert Goddard)
১৬ই মার্চ ১৯২৬ সালে ম্যসাচুসেটসে গোড্ডার্ড রকেটে তরল জ্বলানী ব্যবহার করে তা বায়ুমন্ডলে ১২.৫ মিটার উৎক্ষেপন করেন।
গোড্ডার্ডের রকেটের নকশা।
১৯৩৫ সালে জার্মান সরকার রকেট নিয়ে ব্যাপক গবেষনা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে সামরিক প্রয়োজনে তা তরান্বিত হয়। জার্মানীতেই প্রথম তৈরী হয় রকেট নিয়ন্ত্রিত গাইডেড মিসাইল ভি-১ এবং ভি-২, ভি১ এর গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ৫৮০ কিলোমিটার আর ভি -২ এর ৫, ৩০০ কিলোমিটার । ভি-২ রকেট ছিল এক মোক্ষম অস্ত্র। ১৯৪৪/৪৫ সালের দিকে লন্ডনের উপর নিক্ষিপ্ত কয়েক হাজার ভি-২ মিসাইল ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে বৃটেনের ।
ভি-২ রকেট।
ভি-২ রকেট সামরিক কাজে ব্যবহৃত হলেও তা মহাশুন্য অভিযানে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা দেখা দেয়। ভি-২ রকেটএর প্রধান ব্যাক্তি ছিলেন ওয়ের্নার ভন ব্রন (Wernher von Braun)। ছোটবেলাতে তার রকেট, গোলাবারুদে উৎসাহ দেখে বাবা চিন্তায় ছিলেন ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে। ১৩ বছর বয়সে ব্রন একটা খেলনা ওয়াগন এ রকেট বেধে দিলেন তাতে আগুন ধরিয়ে আর রকেট ৫ ব্লক দূরে গিয়ে পড়ে বিস্ফোরিত হল।
অতঃপর পুলিসে ধরল ব্রনকে । সেই ব্রন মাত্র ২২ বছর বয়সে অর্জন করলেন পদার্থ বিদ্যায় ডক্টরেট। দুই বছর পর হলেন জার্মানীর সামরিক রকেট প্রোগ্রামের ডিরেক্টর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানী যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে নাজীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রকেট বিজ্ঞানীদের কোন ভাবেই শত্রুর হাতে পড়তে দেওয়া যাবে না, সুতরাং তাদের মেরে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ । সৌভাগ্যক্রমে আমেরিকায় পালালেন ব্রন।
অপর কয়েকজন রকেট বিজ্ঞানী পালান রাশিয়াতে।
ওয়ের্নার ভন ব্রন (Wernher von Braun)।
রকেট বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে সব সময় থেকেছে জ্বালানী। কিভাবে আরো শক্তিশালী জ্বালানী পাওয়া যায়? গোড়ার দিকের রকেটগুলোতে কঠিন জ্বালানী ব্যবহৃত হত। এখনকার সময়ের রকেটে তরল এবং কঠিন দুই ধরনের জ্বালানীই ব্যবহার হয়ে থাকে।
জ্বালানীর সাথে অন্য আরো কিছু পদার্থের দরকার পড়ে যেমন অক্সিজেন কারন মহাশুন্যে অক্সিজেন নেই। অক্সিজেন ছাড়া জ্বালানী অচল তাই তরল অক্সিজেন বা অক্সিডাইজার পদার্থ ব্যবহার করার দরকার পড়ে। আর সবগুলোকে একসাথে বলে প্রপেল্যান্ট।
কঠিন জ্বালানীর রকেটগুলোতে জ্বালানী এবং অক্সিজেন একই চেম্বারে ভাল ভাবে মেশানো থাকে। এর কেন্দ্র হল ফাপা সিলিন্ডার।
জ্বালানী থাকে কেন্দ্রের এই সিলিন্ডারকে ঘিরে। জ্বালানী পোড়া শুরু হয় ভিতরের দিকে থেকে আর প্রচন্ড বেগে ধোয়া বেরিয়ে আসে কেন্দ্রের ফাপা নল দিয়ে। রকেট স্টার্ট দিতে আগে ফিউজ ব্যবহার করা হলেও এখন তা করা হয় ইলেক্ট্রনিক্যালী।
কঠিন জ্বালানি ইঞ্জিনের রকেট
তরল জ্বালানীর রকেটে অক্সিজেন এবং জ্বালানী থাকে আলাদা চেম্বারে। এ দুটোকে পাম্পের সাহায্যে পাম্প করে দহন কক্ষে এনে তা পোড়ানো হয়।
পাম্প, ভাল্ভ, আলাদা আলাদ প্রকোষ্ঠের কারনে রকেটের ওজন বেড়ে যায়। তরল জ্বালানীর সুবিধা হল যে এর পাম্পের সাহায্যে জ্বালানীর পরিমান নিয়ন্ত্রন করে গতিবেগ বাড়ানো বা কমানো যায়।
তরল জ্বালানীর রকেট।
জার্মানীর ভি-২ রকেট ছিল এক স্তরবিশিস্ট ইঞ্জিন চালিত। গোড্ডার্ড প্রথম তৈরী করেন একাধিক স্তরের ইঞ্জিন বিশিস্ট রকেট।
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষন শক্তিকে অতিক্রম করার যন্য যে গতিবেগ দরকার(কমপক্ষে ঘন্টায় ৪০,০০০ কিলোমিটার) এক স্তরের রকেটে তা সম্ভব নয়। ইঞ্জিনের প্রথম স্তর যা রকেটকে উপরে নিয়ে যায় তাকে বলে বুস্টার, বুস্টারের কাজ শেষ হলে তা খসে পড়ে। এর পর দ্বিতীয় স্তর, সেটাও কাজ শেষ হলে আলাদা হয়ে যায়। তার পর কাজ শুরু করে তৃতীয় স্তরের ইঞ্জিন।
পালিয়ে যাওয়া জার্মান বিজ্ঞানীদেরকে কাজে লাগিয়ে মহাশুন্য অভিযানে এগিয়ে যায় আমেরিকা,রাশিয়া।
১৯৫৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর মহাশুন্যে রাশিয়ার কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক -১ স্থাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হল মহাশুন্যে মানুষের উপস্থিতি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।