"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে IELTS দিলাম, মাত্র তেরো দিন ক্লাস করেই দিলাম পরীক্ষা, তেরো সংখ্যাটা অপয়া হলেও আমার স্কোর ভালোই আসলো শুধু রাইটিং এ একটু খারাপ 5.0. ওভার অল 6.0। ভিসা হয়ে গেলো, আমি তখন হিথ্রো এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন পার করে বাইরে আসছি। চাচা (আব্বুর মামাত ভাই) আসছে আমাকে রিসিভ করতে। চাচা ইয়ং আমাদের মতোই। সে প্রথমেই আমাকে বললো, "থ্রি ডব্লিউ ব্যাপারে সচেতন থাকবা।
" আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম চাচ্চু থ্রি ডব্লিও কি? সে আমাকে এক্সপ্লেইন করলো,
১, Women
২, Weather
৩, Work
এই তিন জিনিসের কোন ভরসা নেই ইউ কে তে। চাচ্চুর এই কথার বাস্তবতা বুঝতে আমার সপ্তাহ খানেকের বেশী সময় লাগে নাই। মেঘধোঁয়াটে দেশ ইংল্যান্ডের আবহাওয়া এই রোদ, এই মেঘ বৃষ্টি। তো এই নিয়ে একটা মজার ঘটনা বলি,
আমি তখন ইয়র্কশায়ারের ব্রাডফোর্ড সিটিতে। ১৭৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী ব্রাডফোর্ড কলেজ ইউনিভার্সিটি সেন্টারের সামনে দাড়াতেই গর্বে বুকের ছাতি ফুলে কিউক্রাডং পর্বত।
কলেজের নতুন আইটি ভবনে (ওয়েস্টব্রুক) আমার ক্লাস। ক্লাসের মাঝে অফিসের মিটিং এর মত টেবিল, ইজি চেয়ার, হায়ার টেকনোলজির ফটোকপিয়ার প্লাস প্রিন্টার, প্রত্যেকের জন্যে পার্সোনাল কম্পিউটার, আর লেকচারের জন্যে প্রজেক্টর। ক্যাম্পাসের ঠিক অপজিটে অন্যতম বিখ্যাত গ্রোভ লাইব্রেরি। এই ভবনে রবীন্দ্রনাথ বটে, আমি হুমায়ুন আহমেদের বইও পেয়েছিলাম।
প্রথম ব্রাডফোর্ডে যেয়ে দুই সপ্তাহ আমি এক পাকিস্তানি ফ্যামিলির সাথে পেয়িং গেস্ট ছিলাম।
তারা বুড়বুড়ি দু'জন। দুই ছেলে লন্ডনের দুই ভার্সিটিতে লেকচারার। বড় মেয়ে আমাদের কলেজের লেকচারার আর ছোট মেয়ে একটা এন জি ও চালায়। পরবর্তিতেও তাদের সাথে আমার অনেক দেখা হয় ছোট শহরটিতে। তারা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন তাদের ছেলে হিসেবে।
গাদ্দারের জাতি পাকিস্তানিদের কোন ছাপ তাদের মাঝে ছিল না। আঙ্কেল পাকিস্তানের লাহোরের হলেও আন্টির জন্ম ছিল ইউ কে তে। তারা দুজন'ও একটা স্কুলের টিচার ছিলেন। অবসর সময়ে এবং পরবর্তিতে দেখা হলে আন্টি তার দুঃখ সুখের অনেক গল্প করতেন। আমি আজীবন তার মমতা ভুলতে পারবো না।
পাহারের উপরে 25, চেরি ফিল্ডের বাসায় তখন আমি তাদের সাথে পেয়িং গেস্ট। প্রথম যেদিন ক্লাসে যাই, সকাল বেলায় দেখলাম ভীষণ রোদ উঠেছে। রোজার ঈদের ঠিক আগের দিন আমার ফ্লাইট ছিল। তো সেদিন ঈদে কেনা আমার শার্ট পড়ে রওনা দিলাম ক্লাসে। একটু হেঁটে পাহারের গায়ের সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠে বাস 610 (সিক্স ওয়ান জিরো বা সিক্স টেন) ধরে পৌঁছে গেলাম সিটি সেন্টারে, সামনে এগিয়ে যেয়ে ড্রাইভারকে বললাম আমি নতুন, আমাকে যেন কলেজের সামনে নামিয়ে দেয়া হয়।
ড্রাইভার আমাকে কলেজের সামনে নামিয়ে দিলো। প্রস্পেক্টাস এবং ইন্টারনেটে দেখা কলেজের ছবির সাথে আমি বাস্তবতা মিলিয়ে নিচ্ছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম। আমি সত্যিই পৌঁছে গেছি আমার ডেস্টিনেশন!
একটু পরে এক শাদা চামড়ার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার কোথায়? ছেলে আমাকে কি বললো কিছুই বুঝলাম না। ভাবলাম ছেলেরা একটু তাংফাং টাইপের হয়, ব্যাপারনা। এবার এক মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার কোথায়? মেয়ে তার বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে অপমানজনক হাসি হাসলো।
তারপরে আমাকে কি বললো তার কিছুই বুঝলাম না, শুধু বুঝলাম আমি এশিয়ান একসেন্টে ইংলিশ বলায় তারা খুব মজা পাচ্ছে। যাইহোক, শেষে নিজেই খুঁজে বের করলাম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার। পাঠকদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে এই ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার কি? এটা হচ্ছে ব্রাডফোর্ড কলেজে ভর্তি হওয়া সকল ফরেইন স্টুডেন্টের সেন্টার। এখানেই সমস্ত ভর্তি প্রক্রিয়া এবং স্টুডেন্টের টোটাল কেয়ার নেয়া হয়। আমি ঢুকেই দেখলাম নীল চোখের স্প্যানিশ মুটকি কিন্তু সুইট মেয়ে ক্যাথেরিন আর্মস্ট্রং বসে আছে।
আমি তাকে বললাম বারবারার সাথে দেখা করতে চাই।
একটু পরে বারবারা এগিয়ে এসে মিষ্টি হেসে বললো, "ওয়েলকাম রিক, হাউ ওয়াজ ইউর জার্নি দেন?" আমি এদের ইংলিশ শুনে পুরাই টাশকিত! আমি এত ভালো ইংলিশ জানি, লিসেনিং এ স্কোর ভালো, আমেরিকান ইংলিশ যেখানে টেবিল টেনিস সেখানে ইয়র্কশায়ার ইংলিশ শুনে আমি হতভম্ব। আমার এতদিনের শেখা ইংলিশ তাহলে হেলাল হাফিজের "অচল প্রেমের পদ্য!"
এবারে ইয়র্কশায়ার ইংলিশের কিছু নমুনা দেই, এরা BUS উচ্চারন করে বুস। Up Staires কে বলে উপস্টায়ারস। আর দুনিয়ার সর্বাধিক প্রচলিত শব্দ FUCKING কে উচ্চারন করে ফুকিং!!! এই যখন অবস্থা আমি তখন হালের বলদ ক্ষেত এশিয়ান।
ক্লাসে কিংবা স্টোরে কিংবা বাসস্টপে এরা যখন ইংরেজি বলতো আমি হা করে থাকতাম, এশিয়ান একসেন্টে ইংলিশ বললে এরা মুচকি হাসতো। শেষে জিদ করে আয়ত্বে আনলাম ফুকিং ইয়র্কশায়ার ইংলিশ।
যাইহোক, পুরনো টপিকে ফিরে যাই, আমি শার্ট পড়েই প্রথম দিন চলে গেলাম ক্লাসে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার থেকে বেড়িয়ে পরিচয় হলো এক বাঙালি ছেলের সাথে। তাকে যখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "আর ইউ বাংলাদেশী?" সে দাম্ভিকতার সাথে উত্তর দিলো, "নো, সিলেটি।
" আমি পুরাই আবুল হইয়া গেলাম! যাইহোক সেই ছেলের নাম আল-আমীন। এখন আমার ভালো বন্ধু। হারামি মাঝে মাঝে আমার ফেসবুকের স্টাটাসের কমেন্টে লেখে, "রিয়েল, ফাঁক ইউ ম্যান! আমার ফোন ধরিস না ক্যেনে বা?"
আবারো টপিক থেকে দূরে সরে গেছি। টপিক ছিল আমি শার্ট পড়েই ক্যাম্পাসে চলে গেছি। আল আমিনের সাথে প্রথম পরিচয়ে কিছুক্ষন কথা হলো।
কথার মাঝে আমাকে বললো, "এইতান খিতা ফড়ছো বা? তোমার শিইত লাগুইন্যা?" আমি মনে মনে হাসি আর বলি, "আবাল কয় কি?! এই রোদের মাঝে শীত! পুরাই বোকচোদ দেখি!" একটু পরে হঠাত করেই শুরু হলো কনকনে ঠান্ডা বাতাস। আকাশ হয়ে গেলো মেঘলা। শীতে আমার শরীরের লোম সব সজারুর মত হয়ে গেলো। কিসের ক্লাস কিসের কি! আমি এক প্যাকেট ব্যান্সন সিগারেট কিনে বাস ধরে বাসায় যেয়ে দিলাম ঘুম। এই হল ইংল্যান্ডের ওয়েদার।
এবার আসি দ্বিতীয় টপিকে। কাজ! ইহা হইতেছে সোনার হরিণ। ইহা পাওয়া যেমন কষ্টের তেমনি পাওয়ার পরে রহিয়াছে হারানোর ভয়। ততদিনে আমি মাস্টার্স করতে আসা রনি ভাই আর সাদ্দাম ভাইয়ের সাথে একটা এপার্টমেন্টে উঠছি। সাথে আছে গেম্বলার মাসুদ।
মাসুদের গ্যাম্বলার নামটা আমাদের দেয়া। ইংলন্ডে প্রফেশনাল জুয়াড়িদের বলে গ্যাবম্লার। মাসুদ সত্যিই ছিল প্রফেশনাল জুয়াড়ি যে জুয়ার নেশায় ইংল্যান্ডের রাস্তায় কয়েকবার লুঙ্গি পড়েই দৌড়ে উইলিয়াম হিলে চলে গেছে টাকা লাগাইতে।
ধুর! বারবার আমি টপিক থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আর করছি খোশ গল্প যা বেয়াই বেয়াইন করে। যাইহোক, সাদ্দাম ভাই আর রনি ভাই আমাকে ভয় দেখাইতে শুরু করলো, এখানে কাজ নাই, খুব খারাপ অবস্থা।
তারা নাকি জুতা একজোড়া করে ক্ষয় করছে কাজ খুইজা, আমারও তেমন করতে হবে। যাইহোক তারা আমাকে কাজ খোঁজার ফরমালিটি শিখিয়ে দিলো। কাজ খুঁজতে যেয়ে বুঝলাম, এইটা আসলেই ভরসালেস। বাংলাদেশ থেকে নেয়া আমার জুতাজোড়ার তলা দিয়ে অচিরেই বাতাসের আনাগোনা শুরু হইল। অবশেষে রনি ভাই তার সাথে সেভিওরসে জয়েন করিয়ে দিলো।
ইংল্যান্ডের রমণীদের তেমন ঘাটাই নাই, সুতরাং এই ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা কম। তবে এদের কিছু কিছু কমন পয়েন্ট তুলে ধরলেই বুঝা যাবে আসল ব্যাপারটা। আপনি যদি বারে কিংবা ক্লাবে আসা কোন মেয়েকে ড্রিঙ্কস করান আপনার টাকায়, তবে সেই মেয়ে আপনার সাথে বেডে যেতেও রাজি। এক্ষেত্রে আপনার খরচ হবে মাত্র পনের থেকে বিশ পাউন্ড। এবা একসাথে একাধিক বয়ফ্রেন্ড রাখাকে ক্রেডিট মনে করে।
আর ডিভোর্সের ব্যাপার নাইবা বললাম, এটা তো পোলাপানের চড়ুইভাতি। তারপরেও সব দেশেই ব্যাতিক্রম আছে।
এবার একটা মজার ঘটনা লিখে শেষ করি। কুরবানির ঈদে চাচ্চু টিকেট পাঠাইছে, আমি বেড়াতে গেছি লন্ডনে। তখন দেশ থেকে চাচ্চুর আরেক ভাই মাত্র লন্ডনে আসছে।
বেচারা তখন ছ্যাকা খেয়ে অস্থির। আমি তাকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পার্কে নিয়ে গিয়ে বিয়ার ৫০০ এম এল ক্যান ধরিয়ে দেই। সে ৫.৫ বিয়ার খেয়ে মাতাল হয়ে বলে, "ভাতিজা! কলিজা ছারখার করে দিয়া গেছে!" একদিন তাকে নিয়ে ঘুরতে গেলাম লন্ডন টাওয়ার ব্রিজ। আসার সময়ে এক লোকের সাথে তার কলিশন হয়ে গেলো। সেই লোক "ফাঁক অব এসহোল" বলে চলে গেলো।
তো সেই চাচা আবার ইংলিশে ব্যাপক দুর্বল। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,"ভাতিজা! কি বললোরে?" আমি কিছুনা বলে বার বার কথা কাটায়া নিলাম, সে আমাকে বার বার ফোর্স করে যে কি বলছে তা তাকে বলতেই হবে। শেষে খাস বাংলায় তাকে বললাম, "তোমারে কইছে, আদাখা বেটা ফাউল। " ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।