ইতিহাস বিকৃতি ও ভোরের কাগজের পাঠক মন্তব্য
ফকির ইলিয়াস
================================
প্রিয় পাঠক, একটি জরুরি বিষয় নিয়েই আজকের এই লেখা। বিষয়টি হচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ইতিহাস বিকৃতি। ইন্টারনেটের কল্যাণে বাংলা লেখা এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। যে কেউ ফোনেটিক বাংলায় যা কিছু ইচ্ছে লিখতে পারছি। অনলাইন কম্যুনিটি এখন একটি সবল গণমাধ্যম।
ব্লগ, অনলাইন দৈনিক, ডিসকাশন ফোরাম, ইত্যাদিতে এই প্রজন্মের অনেকেরই রয়েছে প্রাত্যহিক অংশগ্রহণ। মতপ্রকাশের তাৎক্ষণিক এই গণমাধ্যম কিছু কিছু লেখক, মন্তব্যকারীকে কিছুটা বেহিসেবী করেও তুলছে। কথাটি খুব দৃঢ়তার সঙ্গেই বলা যায়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অর্থ এই নয় অশ্লীলভাবে, ছদ্মনামে গালিগালাজ করা। আমরা দেখছি ব্লগ, ছদ্মনামে লেখা কিংবা মতপ্রকাশের দরজা বেশ অবারিত করেই দিয়েছে।
ফলে একেকজন কোনো কোনো ব্লগে অনেকগুলো নিক নাম ব্যবহার করে বহুরঙ ধারণ করার প্রয়াসী হচ্ছে। বিষয়গুলো আমাদের জন্য কিছুটা ভয়ের কারণও বটে।
বাংলাদেশের বিশ কিছু দৈনিক তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কলামগুলোর শেষ দিকে পাঠক মন্তব্য লেখার সুযোগ করে দিয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এসব কমেন্টগুলো বিনা মডারেশনেই অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে। এবং ডিসপ্লেতে থেকে যাচ্ছে।
আমি দৈনিক ভোরের কাগজের একজন নিয়মিত লেখক। দীর্ঘদিন থেকেই এই কাগজে আমার মেধা ও মনন দিয়ে লিখে আসছি। লেখকদের কলামগুলোর পেছনে পাঠক মন্তব্যের সুযোগ জুড়ে দেবার পর দূষিত মানসিকতা সম্পন্ন একটি বিশেষ শ্রেণী বেশ হামলেই পড়েছে। এরা প্রতিনিয়ত মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবারবর্গসহ বর্তমান কেবিনেটের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে নানা রকম দুর্গন্ধযুক্ত মন্তব্য করে যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই।
বিষয়টি যে আমি দেখিনি তা নয়।
কারণ আমি আমার সৃজনশীল পাঠককে সবসময়ই গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কিন্তু ঐসব নালায়েক, অধমদের কথার জবাব কখনো দেবার প্রয়োজন মনে করিনি। কিন্তু এদের বিষদাঁত ক্রমশ বেড়েই চলেছে। যা এই সমাজ, এই প্রজন্ম, এই অনলাইন কম্যুনিটির জন্য খুবই শঙ্কার কারণ।
সম্প্রতি একজন ভুক্তভোগী পাঠক আমাকে একটি ইমেইল করেছেন।
আমি এখানে তার ইমেইলের গুরুত্বপূর্ণ অংশটি তুলে ধরতে চাই । তিনি লিখেছেন-
‘ফকির ইলিয়াস ভাই,
সালাম নিবেন। আশা করি ভালো আছেন। ভাই আপনি তো পত্রিকায় লেখালেখি করেন সে অনেকদিন যাবৎ দেখছি। একটি বিষয়ে আপনার কাছে জানতে চাই, আপনি কি ভোরের কাগজের মন্তব্য কলাম পড়েন।
যদি না পড়েন আপনার কাছে বিশেষ অনুরোধ রইলো পড়বেন। আমার ভীষণ দুঃখ লাগে যখন আওয়ামী লীগের প্রাক্তন মন্ত্রীর পত্রিকায় স্বাধীনতার বিকৃত ইতিহাস এবং প্রধানমন্ত্রীকে, জামাত সমর্থক একই ব্যক্তি বিভিন্ন নামে সারাদিন অশালীন ভাষায় লিখে। আমি বিভিন্ন ছদ্মনামে অনেক বিষয়ে মন্তব্য লিখলে আমার পরলোকগত বাবা-মা, বোনসহ স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে অশালীন ভাষায় গালাগালি করে লিখে। আমি এ ব্যাপারে সম্পাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখার পর আমার মন্তব্য কলামে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আমি ভোরের কাগজের মন্তব্য কলামের প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদীদের কতিপয় মন্তব্য কপি করে দিচ্ছি।
আপনার কাছে অনুরোধ রইলো এ কারণে যে আপনি তো ভোরের কাগজে লেখালেখি করেন। আপনি যদি সম্পাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখেন তাহলে হয়তো এগুলো মাননীয় সম্পাদকের নজরে আসবে। পাঠক হিসেবে আমি ভোরের কাগজকে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিষবাষ্প ছড়াবার ফোরাম হিসেবে দেখতে চাই না । মহান ভাষা আন্দোলনের মাসে স্বাধীনতার, মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই পত্রিকার সুদৃঢ় অবস্থান দেখতে চাই। পরিশেষে আপনার অনন্ত মঙ্গল এবং দীর্ঘায়ু কামনা রইলো।
’
যিনি লিখেছেন, তিনি ভোরের কাগজের একজন সচেতন পাঠক, তা বুঝাই যাচ্ছে। তিনি বিদেশের একটি দেশে থাকেন। আমি সঙ্গত কারণে তার অধিক পরিচয় এখানে দিতে চাই না।
॥দুই॥
বলা দরকার বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বেশ কঠিন সময় পার করছে। আমাদের চারদিকে বিষধরদের উদ্যত ফণা।
এরা সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে সন্দেহ নেই। তাই প্রতিটি সচেতন মানুষকেই পা ফেলতে হবে খুব সাবধানে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কখনোই বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতি, স্বাধীনতার মহানায়কদের অবমাননা, মুক্তিসংগ্রামের চেতনার বিরোধিতা কিংবা রাজাকার-আলবদরদের পক্ষে সাফাই গাওয়াকে গ্রাহ্য করে না, করবে না।
তাহলে এসব মন্তব্যের নামে যারা নানা রকমের কুৎসা রটনা করতে চাইছে তাদের প্রকৃত মতলব কী? অন্যান্য দেশের মতো সাইবার ক্রাইম বাংলাদেশেও বেশ পাখনা মেলতে শুরু করেছে। যেহেতু ছদ্মনামে অন্যের চরিত্র হরণ কঠিন কোনো কাজ নয় তাই অনেকেই এই সুযোগ নিতে চাইছে।
রাজনৈতিক কুমতলবও হাসিল করতে চাইছে কেউ কেউ। আর সে কারণেই গোটা বিশ্বজুড়ে অনলাইন সীমাবদ্ধতা আইন নিয়ে বেশ তোড়জোড়ই শুরু হয়েছে।
সাইবার পরিসর, ওয়েবের বিস্তীর্ণতা ও মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে মন্তব্য, ব্লগের অপব্যবহার এবং সাইবার অপরাধের পরিমাণও লক্ষণীয় হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইটি এক্সপার্টরা এই অপরাধসমূহকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করছেন। সংস্থা কিংবা ব্যক্তির অর্থনৈতিক তথ্য-অর্থ চুরি, কোড, কপিরাইট ছিনতাই, হ্যাকিং ও প্রযুক্তিগত ভৌত ও অভৌত স্থাপনার ক্ষতিসাধন, রাজনৈতিক ও সামাজিক হুমকি, যৌন নির্যাতন ও অবমাননা।
রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লোভে সামাজিক অপরাধসমূহ সাধারণ ব্যবহারকারীদের সঙ্গে অহরহ সংঘটিত হচ্ছে। ওয়েবে হত্যার হুমকি; যৌন হয়রানি এবং ছবি ও পরিচয় পর্নোগ্রাফিতে ব্যবহারও সমাজকে বিচলিত করছে। প্রোফাইল ও কপিরাইট হ্যাকিং, ব্লগারদের মানবীয় অনুভূতির সঙ্গে আর্থিক প্রতারণা, ইমেইল অ্যাড্রেস স্প্যামারকে প্রদান, পাইরেসি, রাষ্ট্র ও সংবিধানের অবমাননা, সাম্প্রদায়িক নিগ্রহ ইত্যাদি সংঘটিত হলে বাস্তব জীবনের মতোই মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। এসব অপরাধ দমনের জন্য আইন প্রণেতাদের এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একযোগে গবেষণা পরিচালনা করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করা জরুরি বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তা করতে না পারলে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে জাতীয় উন্নয়নের পরিবর্তে বাধাগ্রস্ত হতে পারে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার।
বিঘ্নিত হতে পারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন।
ভোরের কাগজের মন্তব্য প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। যারা কাগজে কলাম লিখেন, তারা তাদের মেধার উন্মেষ ঘটিয়েই তা লিখেন। ছদ্মনামে যে কেউ তাই গালিগালাজ করে তা খারিজ করে দেয়ার কোনো রেওয়াজকে অনলাইন কম্যুনিটি পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে না।
তাই আমি ভোরের কাগজের সম্মানিত সম্পাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এখানে তুলে ধরতে চাই।
১। প্রতিটি কলামের মন্তব্যগুলোকে মডারেশনের আওতায় আনা হোক। এই সময়ে অনেক ব্লগও সৃজনশীলতা রক্ষায় এই কাজ শুরু করেছে। যদি কেউ অশালীন ভাষা ও বক্তব্য দেয়, তা ডিলিট করা হোক। তাদের আইপি ব্যানসহ মন্তব্য করার ক্ষমতা রহিত করা হোক।
২। ভোরের কাগজের আইটি টিমকে নিয়মিত মন্তব্যগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
মন্তব্য কলামে একটি নিয়মাবলী পোস্ট করা হোক। যাতে মন্তব্যকারী তা মেনেই মন্তব্য করেন।
৩।
কোনো পাঠক মন্তব্য যেন কোনোভাবেই রাষ্ট্র, সমাজ, সভ্যতা, বাঙালি সংস্কৃতির চেতনাবিরোধী না হয়। এ বিষয়ে যতোটুকু কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা ভোরের কাগজের আইটি টিমকে নিতে হবে।
বলে রাখা দরকার, এই নিয়মনীতিগুলো বাংলায় প্রকাশিত প্রতিটি দৈনিকের অনলাইন ভার্সনেরই মেনে চলা দরকার। কারণ কোনো অপশক্তি, মন্তব্যের নামে তাদের নগ্ন পেশিশক্তি এভাবে দেখাতে পারে না।
লেখক-পাঠক সম্পর্ক কখনই সাংঘর্ষিক নয়।
কিন্তু যারা অযথা গায়ে পড়ে ঝামেলা করতে চায় তাদের উদ্ভট মানসিকতা কোনো মানুষেরই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।
নিউইয়র্ক, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২
===========================================
দৈনিক ভোরের কাগজ/ ঢাকা / ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২ শনিবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।