সাইফ শাহজাহান
শুচি সৈয়দ
‘বইমেলায় মূলত বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে ভাবনা বিনিময় ও ব্যবসায়িক যোগসূত্র গড়ে ওঠার কথা। বই বিক্রিটা পরের বিষয়। কারণ মেলায় যে যোগাযোগ হয় তার ভিত্তিতেই পরবর্তীতে বই বিক্রি হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বইমেলার পুরোটাই বিক্রয়কেন্দ্রিক। এখানে বই সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগের বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত।
’ পলল প্রকাশনীর খান মাহমুদ অমর একুশের গ্রন্থমেলা প্রসঙ্গে এ কথা বলেন।
তার মতে, প্রকাশনার ভিতকে শক্ত করতে এই সেক্টরকে অবশ্যই একটি শিল্পের মর্যাদায় নিয়ে যেতে হবে। প্রকাশনা একটি শিল্প হিসেবে বিবেচিত হলে সরকার যথাযথ আইন ও নীতি প্রণয়ন করবে এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট দেবে। এই ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বিদ্যমান।
তিনি মনে করেন, আধুনিক বিপণন কৌশলের মূলমন্ত্র হচ্ছে ভোক্তার দ্বারে পণ্য পৌঁছে দেয়া এবং পণ্যক্রয়ে ক্রেতাকে গড়ঃরাধঃব করা।
আমাদের এখানে বাজার নেটওয়ার্ক যৌথ এবং সমন্বিত নয়। এমন কোনো প্রতিষ্ঠান বা সরকারি উদ্যোগ নেই যাতে করে বইয়ের বাজার দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়। তৃণমূল পর্যায়ে বইকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, প্রকাশক সংঘ, লেখক-পাঠক ফোরামকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বিশেষত বই সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিক দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে তৃণমূল পর্যায়ে কয়েকটি কার্যক্রম করা জরুরি : ইউনিয়ন পর্যায়ে চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে একটি স্বল্পায়তনের গ্রন্থাগার স্থাপন। দেশময় বাজার সম্প্রসারণে স্বল্প ব্যয়ে ডাকব্যবস্থা ও ব্যাংকের চ্যানেল ব্যবহার প্রয়োজন। (উল্লেখ্য, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আশির দশকে ব্যাংকের মাধ্যমে পুস্তক বণ্টনের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল যা পরবর্তীতে ধরে রাখতে পারেনি। )।
বই পড়াকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে পাড়ার ক্লাব, এনজিও, সামাজিক সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করা জরুরি। দেশের পুরনো পাঠাগারগুলোকে কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে প্রচারাভিযান জরুরি। বাজার সম্প্রসারণে ওয়েবসাইট সাপোর্ট, ডাটাবেজ তৈরি আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সম্প্রসারণ প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক বাজার বিস্তৃতিতে আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের উন্নয়ন প্রয়োজন। এতে আমাদের শিশুসাহিত্য ও লোকসাহিত্যের বাজার বিশ্বময় হতে পারে।
সরকারি বই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বইপ্রেমীদের অধিক সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। বাজার বিস্তারে দেশব্যাপী বইমেলা সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, বই সংশ্লিষ্ট বুলেটিন প্রকাশ ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার প্রয়োজন।
তিনি বলেন, আÍপক্ষ সমর্থনের প্রশ্নটি তুলে মনে হচ্ছে বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধ যে, প্রকাশকরা ঠিকভাবে রয়্যালিটি প্রদান করেন না। বিষয়টি অনেকাংশে ঠিক কিন্তু অনেক প্রকাশক হিসাব মাফিক রয়্যালিটি প্রদান করে এমন উদাহরণও অনেক। তবে লেখকদের নিয়েও প্রকাশকদের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে।
প্রকাশকরা সাধারণত লেখকদের সম্মান রক্ষায় ও নিজস্ব সংকোচে কিছু কথা নিভৃতেই চাপা দেয়। আমাদের সমাজে অনেক লেখকই বই প্রকাশনার শুরুতে প্রকাশকদের নানা রকম উৎসাহ যেমন উৎপাদিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয়া, নিদিষ্ট সংখ্যক কপি লেখকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিক্রিসহ নানা সহায়তা প্যাকেজ নিয়ে প্রকাশকদের বই প্রকাশে তাড়িত করে। কিন্তু বেশিরভাগ লেখক বই উৎপাদনের পর প্রকাশকের চৌহদ্দিতে পা রাখে না। বরং এরাই উল্টো লেখক সম্মানী না পাওয়ার দোহাই দিয়ে প্রকাশকদের গালি-গালাজ, খিস্তিখেওড় করে। লেখক গুনতে থাকেন লেখক সম্মানীর টাকার হিসাব, আর প্রকাশক গুনতে থাকে গুদামে কত টাকার বই পোকায় কাটলো, গুদাম ভাড়া, কাগজের দোকানি ও বাইন্ডারের কাছে দেনা।
পাশাপাশি কোন কোন লেখক প্রকাশিত গ্রন্থ নিঃশেষ হওয়ার আগেই অন্য প্রকাশকের মাধ্যমে প্রকাশ করে। কিন্তু প্রকাশকরা সাধারণত এসব নেতিবাচক দিকে সবার নজর আকৃষ্ট করে মানি লেখককে লজ্জা দিতে চায় না। একটি বই প্রকাশনার মাধ্যমে প্রকাশকের যে অর্থলগ্নি ও ব্যবসায়িক স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় তার প্রতি লেখকরা অনেক সময়ই উদাসীন। তবে এ কথাও সত্য, অনেক প্রকাশকের নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ লেখকদের সম্মানহানি করে।
মূলত প্রকাশনা সেক্টর শক্ত ভিতে দাঁড়াতে পারলে এসব সমস্যা থাকবে না।
কারণ বিষয়গুলো তখন একটি কাঠামোর ভেতর নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চলবে।
তার ভাষায়, ‘বইমেলার মাইনাস পয়েন্ট বেশ কয়েকটি। সবচেয়ে বড় সমস্যা বইমেলাকে এখনও বৃহৎ পরিসরে ভাবা হয় না। বইমেলা নিয়ে আমাদের ভাবনার ক্যানভাসটা বিস্তৃত হলে এই মেলাকে কেন্দ্র করে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও প্রকাশনা অনেক বেশি প্রণোদিত হবে। প্রকৃত সৃজনশীল প্রকাশকদের স্টল বরাদ্দ দিলে বইমেলার পরিবেশটা ছিমছাম হবে।
এক্ষেত্রে অনৈতিক ও অযৌক্তিক চাপে স্টল বরাদ্দ থেকে বিরত থাকতে হবে। ’ তিনি বলেন, ‘সামাজিক উন্নয়নে বই পারে মানুষকে ভিতর থেকে জাগিয়ে তুলতে। বই অতীত ও বর্তমানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেয়। কাজেই বইবান্ধব সমাজ বিনির্মাণে আমরা আমাদের সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে কাজ করে যাব। ’
ঙক. কযধহফধশবৎ
প্রকাশকদের অবশ্যই সাংগঠনিকভাবে দক্ষ ও
পেশাদার মনোভাবের হতে হবে
Ñ সাঈদ বারী, সূচীপত্র
শুচি সৈয়দ
অমর একুশের গ্রন্থমেলা প্রসঙ্গে সূচীপত্রের কর্ণধার সাঈদ বারী বলেন, একুশে বইমেলা এখন আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অঙ্গ।
সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উৎসব। কিন্তু একে ঘিরে বেশকিছু সংকট তৈরি হয়েছে, যা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। বইমেলায় জায়গা সংকটÑ এটি এখনকার একটি বাস্তব ও প্রধানতম সমস্যা। এ সমস্যার অতি জরুরি সমাধান প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আমাদের বইমেলার পরিসরের প্রায় ৫০ গুণ বড় পরিসরে আয়োজিত কলকাতা বইমেলা আমাদের চোখের সামনেই উদাহরণ হিসেবে রয়েছে।
বর্তমানে বইমেলার আনুষঙ্গিক যা কিছু সমস্যা, তার অধিকাংশই স্থান-সংকট থেকে উদ্ভূত। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষের ভূমিকা অনেকটাই সীমাবদ্ধ। অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলা একাডেমীতে যে জায়গায় অমর একুশে বইমেলা শুরু হয়েছিল, ত্রিশ বছর পর আজও সেই সীমাবদ্ধ জায়গাতেই তাদের বইমেলা আয়োজন করতে হচ্ছে। অথচ ইতিমধ্যে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা, ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক গুণ। সেদিক থেকে দেখলে তারা অনেকটা অসহায়ও।
তিনি বলেন, পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে বইমেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সব সময়ই আমার কাছে মনে হয়েছে নাজুক! বিশেষ করে একুশে ফেব্র“য়ারিসহ যেসব ছুটির দিনে পাঠক-ক্রেতা-দর্শকের প্রচণ্ড ভিড় হয় (পত্র-পত্রিকার ভাষায়, মেলা জমে ওঠে!), সেদিন সত্যিকার অর্থেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। বইমেলা কর্তৃপক্ষেরও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। বইমেলায় প্রবেশ ও নির্গমনের বর্তমান ব্যবস্থা অপ্রতুল। ফলে নারী, শিশু-কিশোর ও বয়স্ক পাঠক-ক্রেতাদের খুবই ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়। আমি অনেক বইমনস্ক পরিবারকে জানি, গত কয়েক বছর ধরে তারা বইমেলায় আসা বন্ধ করে দিয়েছেন।
কারণ বইমেলায় এসে তারা ভালো পরিবেশ পান না। বঙ্গবাজার আর গুলিস্তানের হকার্স মার্কেটের মতো সারি সারি বুক স্টল (নাকি ঘুপচি ঘর!) দিয়ে বাংলা একাডেমী বইমেলাকে যেভাবে গলি-ঘুঁজির মিলনমেলা করে রেখেছে, তাতে বাণিজ্য মেলার মতো মনের আনন্দে এক স্টল থেকে আরেক স্টলে কিংবা এক প্যাভিলিয়ন থেকে আরেক প্যাভিলিয়নে ঘুরে ঘুরে বই দেখার সুযোগ কোথায়?
তার মতে, আমাদের গ্রন্থ প্রকাশনা শিল্প বর্তমানে যেভাবে ও যে পর্যায়ে বিকাশ লাভ করেছে, তাতে এখনই অমর একুশে বইমেলার জন্য বাংলা একাডেমীর নির্ধারিত জায়গার চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বড় জায়গার প্রয়োজন। বইমেলাকে তার প্রাপ্য বিশালত্ব আর সৌন্দর্য দিতে হলে এটার বিকল্প নেই। বইমেলায় আগত প্রতিটি পাঠক-ক্রেতা-দর্শককে প্রাণভরে শ্বাস নিতে দিতে হবে। বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্যাভিলিয়ন করার সুযোগ দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বই মাত্রই বইমেলার পণ্য হতে পারে। সে হোক না পাঠ্যবই, কারিগরি বই বা ধর্মীয় বই। জায়গার স্বল্পতার অজুহাতে সৃজনশীল বই বিক্রেতা, পাঠ্যপুস্তকের প্রকাশক, বিদেশী বই, নবীন প্রকাশক, অপেশাদার প্রকাশক কাউকেই বইমেলায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা উচিত নয় বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। আর এসব তখনই সম্ভব হবে যখন বইমেলাকে ‘বাণিজ্য মেলা’র মতো বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়া যাবে। আজ না হয় ১০ বছর পর হলেও এটা করতে হবে।
আর ১০ বছর পরে যেটা করতে হবে, সেটা এখন করলে ক্ষতি কী? আসুন, ১০ বছর এগিয়ে গিয়ে আমরা ভাবতে শিখি না কেন? বাংলা একাডেমীতে বরং বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ৭ দিনের একটি বইমেলা করা যেতে পারে।
তিনি মনে করেন, বইমেলার আয়োজনের দায়িত্ব থেকে বাংলা একাডেমীকে অব্যাহতি দেয়ার সময় এসেছে। এটা বাংলা একাডেমীর কাজও নয়। বাংলা একাডেমীর কাজ হল বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা, বই প্রকাশ ইত্যাদি। বইমেলা সরকারি দয়া-দাক্ষিণ্যেও হওয়া উচিত নয়।
বইমেলার আয়োজক হতে পারে প্রকাশকরা নিজেই। [গত কয়েক বছর ধরে বেসরকারি পর্যায়ে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হচ্ছে ঢাকাতেই!] যেমনটি করে থাকে কলকাতা পাবলিশার্স গিল্ড। এজন্য প্রকাশকদের অবশ্যই সাংগঠনিকভাবে দক্ষ ও পেশাদার মনোভাবের হতে হবে। অর্জন করতে হবে রাজনৈতিক দলাদলির ঊর্ধ্বে উঠে একসঙ্গে কাজ করার মানসিকতা। ছোট-বড়, নবীন-প্রবীণ প্রকাশকের ভেদাভেদও ভুলে যেতে হবে।
তবেই বেসরকারি পর্যায়ে বিশাল আয়তনে, বিশাল কলেবরে অমর একুশে বইমেলার আয়োজন সম্ভব।
অমর একুশে বইমেলার জন্য সুপরিসর স্থান যেখানেই বরাদ্দ হোক না কেন, তা অবশ্যই স্থায়ী হতে হবেÑ অন্তত আগামী ২৫ বছরের জন্য হলেও। বইমেলা নিয়ে আমাদের আরও সুষ্ঠু ও পেশাদারভিত্তিক চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে। ভাবা যেতে পারে কিছু মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে।
যেমনÑ বইমেলার জন্য খুব বড় পরিসর নির্ধারণ।
দু’সপ্তাহের বেশি বইমেলার মেয়াদ না রাখা। প্রবেশপথে টিকিট প্রথা চালু। ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে পাঠক-ক্রেতাকে বইমেলায় আসতে উৎসাহিত করা। বইমেলার কোন একটি দিনে শিশুগ্রন্থ দিবস, বিজ্ঞানগ্রন্থ দিবস বা ভ্রমণগ্রন্থ দিবস পালন। দল বেঁধে স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের (স্কুল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে) বইমেলায় আসতে আকৃষ্ট করা।
বইমেলা আর বৈশাখী মেলা এক নয়, এ বোধ আমাদের আজও তৈরি হয়নি
Ñ রবীন আহসান, শ্রাবণ প্রকাশনী
শুচি সৈয়দ
অমর একুশের গ্রন্থমেলা প্রসঙ্গে শ্রাবণ প্রকাশনীর রবীন আহসান বলেন, “একুশের বইমেলা এখন বাংলা একাডেমীর চত্বরে একদম সম্ভব নয়। বইমেলার পুরো পরিবেশ এখন ঝুপড়ি ঘরের দোকানদারিতে পরিণত হয়েছে। প্রকাশক সংস্থার সংখ্যা বেড়েছে এবং বইয়ের সংখ্যাও প্রতি বছর বাড়ছে। কিন্তু গত ২০ বছরে বাংলা একাডেমীতে নতুন নতুন ভবন তৈরির ফলে মেলার জায়গা ছোট হয়েছে। আমাদের ক্ষমতাবানরা সবসময়ই অন্ধ থাকে।
কিন্তু একটি জাতির মেধাবী লেখক এবং বুদ্ধিজীবীরা অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন? মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের হাত ধরে প্রকাশকদের মাধ্যমে যে বইমেলা শুরু হয়েছিল, সেই একুশের বইমেলা বছরের পর বছর আরও সুন্দর হওয়ার কথা। তা না হয়ে মাসব্যাপী ‘বই বাণিজ্য’ দোকানদারিতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও আমরা জাতিকে একটি ভালো বইমেলা উপহার দিতে পারলাম না। বইমেলা আর বৈশাখী মেলা এক নয়, এ বোধ আমাদের আজও তৈরি হয়নি। ”
তার মতে, বইমেলা আর বইয়ের দোকানদারি যে এক নয়, তা শিখতে আমাদের বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই।
পাশের দেশ ভারতের কলকাতা ঘুরে এলেই এটা শেখা যায়। আমি বিশ্বসেরা ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলায় জার্মান সরকারের আমন্ত্রণে পরপর তিন বছর ঘুরে এসেছি। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার চিন্তা দূরে থাক, আমরা অন্তত কলকাতার বইমেলার আদলে মেলা করার সক্ষমতা রাখি। আমাদের প্রয়োজন চিন্তার দারিদ্র্র্য দূর করা। একুশের বইমেলা ১৫ দিন করা দরকার, তাহলে অনেক ধরনের উটকো ঝামেলা দূর হবে।
লেখকরা আগে আগে বই লিখবেন এবং প্রকাশকরা নতুন বইটি দু’মাস আগে ছাপতে চাইবেন। গণমাধ্যমের প্রচারণা দেখে অনেকেই মেলার মধ্যে বই প্রকাশে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, ফলে ভুল বানান আর নিুমানের বাঁধাই নিয়ে শত শত বই বেরুচ্ছে আমাদের বইমেলায়। পাঠক ঠকছে এবং দিন দিন তারা বইমেলা-বিমুখ হচ্ছে।
তিনি বলেন, একুশের বইমেলা নিয়ে সরকারের নতুন পরিকল্পনা দরকার। আমার মনে হয়, আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি! আমাদের কোন স্বপ্ন নেই এ বইমেলা নিয়ে।
৪০ বছর আগে শুরু হওয়া বইমেলা একই রকম থাকবে, আমি এটা মেনে নিতে পারি না। যাদের স্বপ্ন দেখানোর কথা তারা বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে আছেন, তারা অন্ধ। আমি অন্ধকারে আলো খুঁজছি। যদি স্বপ্নের মতো হয় আমাদের একুশের বইমেলা, সবার হাতে বই, ঠেলাঠেলি নয় পাঠক তার প্রিয় বইটি দেখছেÑ শিশুদের জন্য সুন্দর সুন্দর বড় বড় প্যাভিলিয়ন, লেখক-পাঠক আড্ডা হচ্ছে বই নিয়ে। এমন বইমেলার প্রত্যাশা আমার, অন্যদের মধ্যে এ প্রত্যাশা জাগিয়ে তোলার কাজ করছি আমি।
এবারের বইমেলায় তার শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে ২০টি বই প্রকাশিত হচ্ছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বদরুদ্দীন উমরের ‘রচনা সংগ্রহ প্রথম খণ্ড’, ‘নারী প্রগতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোকেয়া হল’Ñ সেলিনা চৌধুরী, ‘বিক্ষোভ সংকলন : সেনা শাসন বিশ্ববিদ্যালয়, ২০ আগস্ট, ২০০৭’ Ñ উদিসা ইসলাম, ‘মিডিয়ার পোস্টমর্টেম’ Ñ তুষার আবদুল্লাহ, ‘গণমাধ্যমের দলীয়করণ’ Ñ নাজমুল আশরাফ, ‘কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল : প্রাথমিক পাঠ প্রথম খণ্ড প্রথম অংশ’ Ñ মূল : রঙ্গনায়াকামা।
প্রকাশকদের হাতে বইমেলা ছেড়ে দেয়া উচিত
Ñ মোস্তফা সেলিম, প্রকাশক, উৎস প্রকাশন
শুচি সৈয়দ
অমর একুশের গ্রন্থমেলা নিয়ে উৎস প্রকাশনের মোস্তফা সেলিম বলেন, “বইমেলার যখন সূত্রপাত হয়, তখন চিত্তরঞ্জন সাহার চারপাশ ছিল শূন্যতার চাদরে ঢাকা। কিন্তু বর্তমানে, যখন স্বাধীনতার চার দশক অতিক্রান্ত, তখন বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা’। এমন ঠাসাঠাসি স্টল, অপরিসর প্রাঙ্গণ মেলা নয় যেন, কমলাপুরের রেলওয়ে বস্তি। এ থেকে পরিত্রাণের কোন উদ্যোগ নেই।
ফি বছর মেলা চলাকালীন এ নিয়ে বাৎচিত হয়। মেলা শেষ হয়, তারপর সব হারিয়ে যায়। নতুন বছর আসে, বাংলা একাডেমী আবার একই আয়োজনের পসরা সাজায়। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। ”
তিনি বলেন, বইমেলা অন্য মেলার মতো চারিত্র্যের নয়।
এখানে গাদাগাদি করে স্টল বানিয়ে দিলেই চলে না। বই অন্যান্য পণ্যের মতো নয়। তা দেখে, নেড়েচেড়ে, বইয়ের মান, উৎকৃষ্টতা বিচারের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আমাদের মেলায় দাঁড়ানোর স্থান কোথায়। ছুটির দিনগুলোতে মানুষের ভিড়ের চাপে বইমেলার স্টলগুলোকে বড় অসহায় মনে হয়।
অপ্রকাশক, এনজিও, বিভিন্ন সংগঠনের স্টল বরাদ্দের ফলে বাংলা একাডেমীর পরিসর দিন দিন প্রকাশকদের জন্য ছোট হয়ে আসছে।
তার মতে, বাংলা একাডেমী জাতির মনন চর্চার একটি প্রতিষ্ঠান। তার ওপর মেলা আয়োজনের দায়িত্ব বর্তেছে। পৃথিবীর সর্বত্র প্রকাশকরাই এ ধরনের মেলার আয়োজন করে থাকেন, বাংলাদেশেই কেবল এর ব্যতিক্রম। সময় এসেছে এর বিকল্প ভাবনার।
প্রকাশকরাও এগিয়ে এসে এর দায়িত্ব বুঝে নেয়া সময়ের দাবি। প্রতি বছরই বাংলা একাডেমী মেলা আয়োজনের নানা ত্র“টি-বিচ্যুতি নিয়ে মিডিয়া গরম রাখেন প্রকাশকরা। কিন্তু এ থেকে মুক্তির পথটি তৈরিতে তারা তৎপর, দেখে-শুনে তা মনে হয় না।
এবারের মেলা নিয়ে তার অভিমত, মেলার পরিসর এখন ছয় ফুট বাই আট ফুট ইউনিটে পরিণত হয়েছে। প্রকাশকরা তাদের চাহিদামতো স্টলের পরিসর বরাদ্দ পাচ্ছেন না।
পাঠক দেখে-শুনে বই কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প এখন অনেক বিস্তৃত। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে এ শিল্পে, অথচ এ উদ্যোক্তারা কেউ চাইলেই মেলাতে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পাবেন না। বাংলা একাডেমীর সীমাবদ্ধতা সবাই জ্ঞাত। এই অল্প পরিসর জায়গায় যে কোন ব্যবস্থাপনায় এর চেয়ে ভালো কিছু উপহার দেয়াও সম্ভব নয়।
তাই বিকল্প ভাবনার সময় এখনই। বাংলা একাডেমীকে এর পরিসর বৃদ্ধির উপায় খুঁজে নিতে হবে। এক্ষেত্রে অনেকেই এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেনÑ ভাষা শহীদের আবেগকে পুঁজি করে। কিন্তু বাস্তবতার কাছে আবেগের কোন মূল্য নেই। ক্রমবর্ধমান এ শিল্পের ভবিষ্যৎ রক্ষায় আমাদের বাস্তবমুখী হতে হবে।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, প্রকাশকদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে এর ব্যবস্থাপনা। বাংলা একাডেমী রেগুলেটরের ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলা একাডেমী তখন তার প্রকৃত কাজে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ পাবে।
একুশে বইমেলা এমন এক নান্দনিক আয়োজন, যা আমাদের দেশপ্রেম ও মাতৃভাষা প্রেমের নবায়ন ঘটায়
Ñ খালেদ হোসাইন, কবি
শুচি সৈয়দ
কবি ও প্রাবন্ধিক খালেদ হোসাইন অমর একুশের গ্রন্থমেলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘বইমেলা’ আর ‘একুশে বইমেলা’র মধ্যে পার্থক্য অনেক। বিভিন্ন প্রকাশক যদি বিক্রির উদ্দেশ্যে কোন একটি জমায়েত রচনা করে, তাকে আমরা বইমেলা বলতে পারি।
এটি একটি মহৎ কাজ সন্দেহ নেই, কিন্তু ‘একুশে বইমেলা’ আমাদের জাতীয় ভাবাবেগকে ধারণ করে আছে। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি হয়ে আছে রক্তাপ্লুত দেশপ্রেমের ইতিবৃত্ত, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অতুলনীয় স্মৃতি। যদিও এ মেলার সূচনা হয়েছে বায়ান্ন’র একুশে ফেব্র“য়ারির অনেক পরে। কিন্তু যে বাংলা একাডেমী চত্বরে এর সূচনা হয়েছিল, তার সঙ্গে আমাদের ভাষা আন্দোলনের সম্মিলিত আকাক্সক্ষার একটি সম্পর্ক আছে। ‘একুশে বইমেলা’ আমাদের মর্মমূলকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেয়।
জড়তা থেকে মনকে মুক্ত করে। আমাদের চিত্তকে মনোলোভনভাবে টানতে থাকে। একুশে বইমেলা এমন এক নান্দনিক আয়োজন, যা আমাদের দেশপ্রেম ও মাতৃভাষাপ্রেমের নবায়ন ঘটায়।
বই কিন্তু সারাবছরই কিছু না কিছু প্রকাশিত হয়। একুশে বইমেলায় হয় অনেক বেশি।
এতে অনেককে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখি। কিন্তু ব্যাপারটিকে আমি উদার চিত্তে প্রসন্ন দৃষ্টিতে দেখতে আগ্রহী। বাংলা নববর্ষের বাইরে এই একটি আয়োজনকে আমার সর্বার্থে অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন মনে হয়। একে উপলক্ষ করে যদি কিছু শিক্ষিত মানুষের আবেগ উথলে ওঠে, তাতে দোষের কিছু দেখি না। অভিযোগ ওঠে, একে কেন্দ্র করে অনেক নিুমানের বই প্রকাশিত হয়।
আমি তা অস্বীকার করি না। কিন্তু যে বই নিুমানের তা মৃত্যু-পরওয়ানা হাতে নিয়েই প্রকাশিত হয়। তার কি সাধ্য আছে মহৎ বইয়ের জায়গা দখল করার? সৎ লেখক ও পাঠকদের ওপর আস্থা রাখা উচিত। মন্দ বইয়ের চেয়ে ভালো বইয়ের বিক্রি অনেক বেশি বলে আমার ধারণা।
আমাদের দেশের জনসংখ্যা অনেক।
সে অনুপাতে পাঠক বা প্রকাশকের সংখ্যা বাড়েনি। কিন্তু যা বেড়েছে, বাংলা একাডেমী চত্বরটি যেহেতু বিশাল নয়, তাকেই ধারণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সুচিন্তিতভাবে এর সম্প্রসারণ হওয়া উচিত।
তার মতে, অনেক আগে মোহিতলাল মজুমদার ‘পুথির প্রতাপ’ নামে এক প্রবন্ধে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে নিুমানের গ্রন্থ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সে তুলনায় মুদ্রণ-ব্যবস্থাপনা অনেক সহজ হয়ে উঠেছে।
তাই পাড়া মহল্লায় এখন আর একুশের স্মরণিকা বের হয় না, পুস্তক প্রকাশিত হয়। তবে স্মরণিকায় হাত পাকিয়ে, আÍপরিশীলনের মাধ্যমে পরিণতি অর্জন করে তারপর বই করার যে রীতি ছিল, তা অনেক ভালো ছিল। কিন্তু ফেলে আসা সেই পথ ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। সময় বদলেছে, পরিপার্শ্বও বদলাবে। এটা স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, প্রকাশকরা বই প্রকাশের ব্যবসাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণার যে দাবি করেন, আমি তা সমর্থন করি। কারণ, অনেক অসাধারণত্ব থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বই একটি পণ্য। এর সঙ্গে বিনিয়োগ, উৎপাদন ও বিপণনের ব্যাপার জড়িত আছে। কিন্তু প্রকাশকরা যাদের লেখাকে পণ্য হিসেবে বাজারে হাজির করেন, সেই লেখকদের প্রতি প্রকাশকদের আচরণ শোভন নয়। লেখকদের বঞ্চিত করে প্রকাশকরা যদি বিত্ত-বেসাত গড়ে তোলেন, তা কেবল অসমর্থনীয় নয়, ঘৃণ্যও।
লেখক-পাঠকের মতো প্রকাশকেরও দায়বদ্ধতা আছে, তা যথাযথভাবে পূরণ করা উচিত। লেখক-প্রকাশকের মধ্যে চুক্তি ও তার বাস্তবায়ন জরুরি।
তিনি জানান, ছোটদের জন্য আমার একটি গল্পের বই আছে। কোন এক মন্ত্রণালয় বইটি কিনেছিল। আমি জেনেছিলাম, এ বাবদ আমি আশি হাজার টাকা পাব।
আমাকে দশ হাজার টাকা তুলে দিয়ে প্রকাশক বলেছিলেন, ‘আমি আর পারমু না। ’ আনন্দ-বেদনা? আমি হতচকিত হয়েছিলাম।
কাদের জন্য লিখে আনন্দ পানÑ এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি প্রথমত নিজের জন্য লিখে আনন্দ পাই। দ্বিতীয়ত, মানুষের জন্য লিখে আনন্দ পাই। আমি ছোটদের জন্য লিখি, বড়দের জন্যও লিখি।
দুটোই আমাকে আনন্দ দেয়। যখন যা লিখি তা লিখেই আমি আনন্দ পাই। আনন্দ না পেলে লিখব কেন, অন্য কোন আনন্দদায়ক কাজ না করে? তবে এখন কবিতায় আমার অনুভূতি সহজভাবে রূপায়িত হয় বলে মনে করি।
তার মতে, ‘বই’ আর ‘ভার্চুয়াল বুক’ এক জিনিস নয়। বই প্রাণবন্তÑ তাকে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, বিছানায় নেয়া যায়।
সার্বক্ষণিক সঙ্গী হতে পারে সে। ‘ভার্চুয়াল বুক’ বইয়ের ছবি। বাস্তব মানুষকে বিয়ে করা যায়, ছবি যায় না। তেমনই ‘ভার্চুয়াল বুক’কে পছন্দ করা যায়, বিয়ে করা যায় নাÑ একান্ত হয়ে ওঠে না সে। অন্তত এখন অব্দি।
এখনও আমার মনে হয় না বই একদিন স্মৃতি হয়ে যাবেÑ কারণ তথ্য-প্রযুক্তির এই তুঙ্গস্পর্শী যুগেও বিশ্বজুড়ে বইয়ের বিক্রি বেড়েই চলেছে।
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’ পড়ে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম, এটি আমি সবাইকে নিবিষ্ট চিত্তে বারবার পড়ার জন্য অনুরোধ করি।
তরুণ লেখকদের প্রতি তার পরামর্শÑ ‘খ্যাতির মোহ আÍাকে অসম্মানিত করে। ’ তরুণ পাঠকদের প্রতি অনুরোধÑ ‘মানব-প্রবাহ অনন্ত হলেও মানব-জীবন অনন্ত নয়। ভালো বই পড়–ন।
’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।