আমরা শুধু আপন মানুষ খুঁজি, আপন মানুষদের খুঁজতে হয় না, তারা পাশেই থাকে !! ভানুগাছ রেলওয়ে ষ্টেশন। প্ল্যাটফর্মের পিলার গুলোর কাছে জটলা বেধে আছে মানুষের। সিট পেতে আগে আগে চলে আসলেও রাফাত টিকিট পায়নি। সাতটার ট্রেন কয়টায় যে আসে!! বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পর সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে তার। পকেট থেকে দুমরে মুচরে যাওয়া বেনসনটা খুলতে খুলতে প্ল্যাটফর্মের পাশের চায়ের দোকানে অর্ডার দিল-"দুধ-চিনি বেশি দিয়ে এককাপ চা দেন।
" ফাইনাল ইয়ার চলছে তার। কয়েকদিন পরে চাকরীতে ঢুকতে হবে। বাবার যে টাকা আছে তা দিয়ে সারাজীবন বসে বসে খেতে পারবে। কিন্তু রাফাত চায় নিজের পায়ে দাড়াতে । সবার আগে ছোট বোনটাকে বিয়ে দিবে।
তারপর নিজে বিয়ে করবে। তার জন্য চাই চাকরী। একটা ভাল চাকরীর জনই চাই মেধা, এপ্রোচিং পাওয়ার, টাকা। কয়েক বছর থেকে নতুন যোগ হয়েছে রিকমান্ডেশন বা সুপারিশ। রিকমান্ডেশন শুধুমাত্র চাকরীতেই লাগে, তা না।
সব কাজ-এমনকি এখন অনেক প্রেম করতেও রিকমান্ডেশন লাগে। এক বন্ধু তার বান্ধবীকে রাফাতের প্রেমিকা বানাতে চেয়েছিল। রিকমান্ডেশন পেয়ে ঐ মেয়ে রাফাতের পিছনে প্রায় ২মাস লেগেছিল। পরে পাত্তা না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে।
রাফাত ছোটবেলা থেকে একটা মেয়েকে ভালবাসে।
তার নাম রূপা। পাশের বাসায় থাকতো । শৈশবে একসাথে কতো খেলাধূলা করেছে। সেই থেকে ভাল লাগা। ক্লাস থ্রীতে মেয়েটার বাবা চাকরীতে বদলী হয়ে রংপুর চলে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হওয়ার পর বাসায় এসে শুনে রূপা তার বাবার সাথে শ্রীমঙ্গল এসেছে। অনেক কষ্টে একে ওকে ধরে রাফাত রূপার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করেছে। রূপা কল রিসিভ করার পর রাফাতের প্রথম কথা ছিল-"তুমি যদি রূপা হয়ে থাক, তাহলে শুনো- আমি তোমাকে ভালবাসি। এতো দিন পর্যন্ত একথা আমি কথা কাউকে বলি নাই। কয়েকদিন পর আমি চাকরি পাব, তারপর আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
তুমি আমার সাথে একটু দেখা করবে?" রূপা কি বলবে কিছু ভেবে পাচ্ছিলনা। "কে আপনি?" রাফাত এক নিঃশ্বাসে বলল-"আমি রাফাত। ছোট বেলায় আমরা একসাথে খেলতাম। তোমার চুলের দু্ই পাশ বেনি করা থাকত। আমার একটা কাল কুকুর ছিল।
তোমার চেহারাটা আমার মনে নেই। তবু তোমায় আমি ভালবাসি, কারণ ছোটবেলায় আমাদের মিছিমিছি বিয়ে হয়ে ছিল। এবার আমি তোমায় সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চাই। " রূপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল-"আপনাকে মনে পড়েছে। কিন্তূ আমি আপনার সাথে দেখা করব না।
সামনের রবিবার আমরা সিলেট যাব। সন্ধ্যা সাতটার ট্রেনে। ওখানে আসবেন । যদি আমাকে চিনতে পারেন তাহলে কথা বলব। " একথা বলে ফোনটা কেটে দিল রূপা।
সেই থেকে মোবাইল সুইচড অফ।
"মামা আফনের চা....ইস্পিশাল! জুরাইয়া যাওয়ার আগে চুমুক মারেন। "-চায়ের কাপ ঠেলে দেয় এগার/বার বছরের একটা রোগা ছেলে। এই চাষ্টলে কাজ করে। "বাহ তুই তো অনেক স্মার্ট, কি নাম তোর?" "জ্বে, গেদন মিয়া" বলে বড় বড় দাঁত বের করে হাসি দেয় সে।
"গেদন কারো নাম হলো? এই নাম থাকলে তো তোর বিয়ে হবে না। " "আমার বিয়ার দরকার নাই, আফনে বিয়া করেন গিয়া" লজ্জ্বায় দৌড় দেয় গেদন। চায়ে চুমুক দিয়ে পুত করে মুখ থেকে বের করে দিল রাফাত। অতিরিক্ত লিকারে গেদন মিয়ার ইস্পিশাল চা তিতা হয়ে গেছে। সিগারেট শেষ করে প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে থাকল সে।
প্ল্যটফর্মের সবাইকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ট্রেনের অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। শুধু রাফাত মনে মনে উত্তেজিত। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে ব্যাথা করছে, কিন্তু মনে এক অদ্ভূত ধরনের ভাললাগা। কষ্টের মাঝেও অনেক সময় সুখ লুকিয়ে থাকে।
রাফাত রূপার মোবাইল নম্বরে আবার ডায়াল করল-সুইচড অফ!! আচ্ছা রূপা কি মিথ্যা বলেছে? ভাবতে ভাবতে প্ল্যাটফর্মের পূর্ব দিকের কোনায় একটা পরিবারকে চোখে পড়ল তার। একটা লাগেজ সামনে রেখে দুইটি মেয়েকে নিয়ে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। ভদ্রলোক পত্রিকা পড়ছেন। মেয়েদুটি বলতে গেলে কিছুই করছে না। বাবার পাশে চুপচাপ বসে আশে পাশের মানুষ দেখছে।
আচ্ছা রূপার কি কোন বোন ছিল-মনে করার চেষ্টা করল রাফাত। রূপার বাবার চেহারাটাও মনে করতে পারছে না। তার শুধু মনে আছে রূপার সাথে তার মিছেমিছি বিয়ে হয়েছে। যাই হোক ভদ্রলোককে গিয়ে জিজ্ঞাস করবে রূপার কথা- মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল রাফাত। পরক্ষনেই বোকামি বুদ্ধি মনে করে উরিয়ে দিল।
কাছাকাছি থাকতে হবে তাদের। দুটো মেয়ে- কোনটা রূপা হতে পারে!! দ্বিধায় পরে গেল রাফাত। অনেক কষ্ট করেও রূপার চেহারাটা মনে করতে পারছে না। মোবাইলটা বের করে আবার ডায়াল করলো-সুইচড অফ।
মোবাইল বের করতে দেখে মেয়ে দুটি কথা বলাবলি শুরু করেছে।
রাফাত নিশ্চিত এখানেই রূপা আছে। আর একটু কাছাকাছি যাওয়া দরকার। এবার ভালভাবে লক্ষ্য করছে রাফাত। দুইটা মেয়েই দাড়াল, পিলারের সামনে দিয়ে হাটছে তারা। একটা মেয়ে দেখতে হালকা পাতলা , খায়না নাকি? মুখে কড়া লিপষ্টিক।
গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা চোখগুলো কাজল করলে আরও ভাল লাগত। টিয়া রঙের সালোয়ার কামিজে ভালই মানিয়েছে। রূপার কাল্পনিক চেহারার সাথে মেলানোর চেষ্টা করল রাফাত। রূপা বোধহয় একটু শ্যামলাই ছিল। রাফাত অনেক ফর্সা।
একদম দুধে আলতা। ছেলেদের রং বেশী ফর্সা হলে মেয়ে মেয়ে লাগে। এই শ্যামলা মেয়েটির সাথে মেয়েটির সবকিছুই কালো। যেমন তার গায়ের রং তেমনই তার সালোয়ার কামিজ। মিচমিচে কাল।
চোখ দুটি বড় বড়। কপালে বড় একটা কাল টিপও আছে। কাজের মেয়ে হবে হয়তো। মেয়েটা স্বাস্থ্যবতী। তাকে হয়তো আনা হয়েছে লাগেজের বোঝা বহনের জন্য।
কাল মেয়েটিকে দেখে রাফাতের খুব মায়া লাগল। কাজের মেয়ে হলেও তার একদিন ঘর সংসার হবে, বাচ্চা কাচ্চা হবে। রিকশাওয়ালা কোন কাল রঙের ছেলের সাথে যদি তার বিয়ে হয়-নিশ্চিত তার সংসার দক্ষিন আফ্রিকার নিগ্রো সংস্করণ হবে। নাহ এসব আবোল তাবোল ভেবে লাভ নেই। রূপা সম্পর্কে আরো নিশ্চিত হতে রাফাত মেয়ে দুটির সাথে কথা বলতে ওদের কাছে যাচ্ছে।
এমন সময় ট্রেন চলে আসল। শালা বেরসিক ট্রেন।
রাত নয়টা। ট্রেন কুলাউরায় এসে থামল। এর মধ্যে রাফাত একটি কথাও ঐ ভদ্রলোক বা দুই মেয়ের সাথে বলল না।
শ্যামলা মেয়েটা কালো মেয়েটাকে বার বার গুতো দিয়ে রাফাতকে এদেখাচ্ছিল। টিকিট না পেয়ে রাফাত সারা রাস্তায় দাড়িয়ে আছে। রূপাদের সীটের কয়েক সাড়ি সামনে। ব্যাথায় পা টনটন করছে, কিন্তু প্রিয়জন পাশে আছে ভেবে সুখে মনবাকুম বাকুম করছে। কূলাউরা ট্রেন থামার পর রাফাতের মাথায় বুদ্ধি এল।
সে ভদ্রলোকটাকে গিয়ে বলল-"আংকেল কোথায় থেকে আসছেন আর কোথায় যাবেন?" মোটা গ্লাসের চশমা উপড়ে তুলে ভদ্রলোক বললেন-"আমরা রংপুর থেকে আসছি আর সিলেট যাচ্ছি" রাফাত মেঘ না চাইতেই তুফান পেল। একটু থেমে আবার বলল-"আংকেল আমাকে একটু পানি দেয়া যাবে?" ভদ্রলোক এবার ভাল করে রাফাতকে দেখলেন। তারপর শ্যামলা মেয়েটিকে বললেন-"মা ছেলেটাকে একটু পানি দেতো। " রাফাত মনে মনে অনেক উত্তেজিত। শ্যামলা মেয়েটা ফিক করে হাসি দিয়ে রাফাতের দিকে পানির ফ্লাস্কটা এগিয়ে দিল।
রাফাত কাপতে কাপতে ফ্লাস্ক নিল। তার এতোদিনের স্বপ্নের রাণী, যাকে ঘিড়ে ভালবাসার জ্বাল বুনেছে। রুপা রুপা রুপা !! নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছেনা রাফাত। এখুনি ওর হাতটা ধরতে মন চাইছে তার। রূপা ফিস ফিস করে কাল মেয়েটাকে কি জানি বলল।
তারপর দুজনে মুচকি হাসি। রাফাত দূর তেকে শুধু চেয়ে থাকল। কি মায়া ভরা হাসি।
রাত দশটায় ট্রেন সিলেট এসে থামল। রূপাদের পিছে পিছে রাফাতও নামল।
নেমেই রূপার বাবা একটা সিএনজি ডাকল। বলি বলি করেও রাফাত তাদের কাছে যেতে পারছে না। বলতে পারছে না-তার পনের বছরের জমিয়ে থাকা ভালবাসার কথা। রাফাত দূরে দাড়িয়ে আছে। সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
সিএনজি ছাড়ার আগে রুপা রাফাতের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। রাফাতের বুক কাপছে!! ভীতুর ডিম তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না-ধিক্কার দিল সে নিজেকেই। মেয়েটা কাছে এসেই ফিক করে হেসে দিল। বলল- "আফা আফনেরে ডাকতেছে!!" তোতলাতে শুরু করল রাফাত। "আ আ..মাকে..মানে তুমি মানে আপনি" "হ রুপা আফা আপনারে ডাকতেছে।
হে সিএনজিতে বইয়্যা আছে। আমার নাম সালমা, আমি আফাগো বাসায় কাম করি"-বলে দৌড় দিল সালমা। রাফাত যেন নড়তে পারছে না। তার পা দুটো অবশ হয়ে আসছে...পড়ে গেল রাফাত। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে রাফাতকে।
আধো জ্ঞান আধো অজ্ঞান। রাফাত দেখতে পেল সিএনজির দড়জা দিয়ে একটা কাল মুটকি মেয়ে বড় বড় চোখ দিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে....এ চাহনিতে মায়া আছে, ভালবাসা আছে!! এবার সম্পূর্ণ মূর্ছা গেল রাফাত !!
আমার এক বন্ধু মনোয়ার রুবেল এর অনুরোধে নাম টা বদলালাম। আর গল্পের ছবি হিসাবে আমার প্রিয় গায়িকা কৃষ্ণকলি ম্যাম এর ছবি ব্যভার করলাম। অনুমতি না নেয়ার জন্য দুঃখিত !! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।