মানুষ হিসাবে দুনিয়াতে আসার একটা বড় সমস্যা হচেছ কিছু কিছু ভুল করলে তা শুধরানো যায় না, আজীবন তার খেসারত দিতে হয়।
দিনবদলের স্লোগানধারী মহাজোট সরকারের ৩৭ মাসে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২১ ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ দুই ইসলামী ছাত্রশিবির নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। এ নিয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ ছাত্রকে হত্যা করা হলো। এছাড়া অন্য আলোচিত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে—রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১, ঢাকা মেডিকেল কলেজে ১, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ১ এবং রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ১ জন।
ছাত্রলীগ-শিবির-ছাত্রদল এবং বাম ছাত্র সংগঠনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও হামলায় এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এতে ওইসব সংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ ছাত্রও হত্যার শিকার হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব হত্যাকাণ্ডের একটিরও বিচার হয়নি; তদন্ত হয়েছে মাত্র একটির। সরকার ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তদন্ত ও মামলার বিচার কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিচার না হওয়ায় অব্যাহতভাবে চলছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড।
সর্বশেষ গতকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ছাত্রলীগ ও শিবিরের মধ্যে দফায় দফায় তুমুল গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় দুই শিবিরকর্মী নিহত হয়েছে। নিহত শিবিরকর্মীরা হলো মুজাহিদ ও মাসুদ বিন হাবিব। মুজাহিদ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এবং মাসুদ ইংরেজি শেষ বর্ষের ছাত্র। মাসুদ সোহরাওয়ার্দী হলের শিবির সেক্রেটারি ছিল। সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা দুই শিবিরকর্মীকে ধরে কুপিয়ে জখম করে।
পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হলে দুজনই মারা যায়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে উভয় সংগঠনের কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল সন্ধ্যায় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৬ ফেবু্রয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে।
এর আগে ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামে ট্রেনে চবি রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মহিউদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
মহিউদ্দিনকে হত্যার পর শিবির তাকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি এবং এ হত্যার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করে। এর প্রায় দেড় মাস পর চবিতে ঘটে আরেক হত্যাকাণ্ড। ২০১০ সালের ২৮ মার্চ রাতে শাটল ট্রেনে করে শহর হতে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে চবি মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র হারুন অর রশীদ কায়সারকে জবাই করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় নগরীর চৌধুরীহাট এলাকায়। একই বছর ১৫ এপ্রিল চবি ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে অ্যাকাউন্টিং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আসাদুজ্জামান নিহত হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পর বেশি ছাত্রহত্যা হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ছাত্রলীগ-শিবির এবং ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে গত তিন বছরে ৩ ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হয় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানী। ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ-শিবির-পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত হয় ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন। একই বছর ১৫ আগস্ট শোক দিবসের টোকেন ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে শাহ মখদুম হলের দোতলার ছাদ থেকে ছাত্রলীগ কর্মী নাসিমকে ফেলে দেয় ছাত্রলীগ সভাপতি গ্রুপের কর্মীরা। ৯ দিন মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন থাকার পর ২৩ আগস্ট নাসিমের মৃত্যু হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালে নির্মমভাবে খুন হয় নিরীহ ও মেধাবী ছাত্র আবু বকর। ২ ফেবু্রয়ারি এফ রহমান হলে ছাত্রলীগ-পুলিশ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে খুন হয় আবু বকর।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ তাদেরই দলীয় কর্মী ও ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদকে হত্যা করেছে। ৮ জানুয়ারি দুপুরে জুবায়ের পরীক্ষা শেষে হলে ফেরার সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা ক্যাম্পাস থেকে তাকে ধরে নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে। ৯ জানুয়ারি ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় সে মারা যায়।
২০০৯ সালের ৩১ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হয় ওই কলেজের ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ ওরফে রাজীব। ২০১০ সালের ১২ জুলাই সিলেট এমসি কলেজে ছাত্রলীগের একপক্ষের হামলায় অপরপক্ষের কর্মী উদায়সীন পলাশ খুন হয়েছে। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর ছাত্রলীগের নির্মম নির্যাতনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রদল নেতা বিডিএস চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবিদুর রহমান নিহত হয়। ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রমৈত্রীর সহ-সভাপতি রেজানুল ইসলাম চৌধুরীকে খুন করেছে ছাত্রলীগ। চলতি ২০১২ সালের ২১ জানুয়ারি পাবনা টেক্সটাইল কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী মোস্তফা কামাল শান্তকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে যুবলীগ।
তদন্তে অগ্রগতি নেই, বিচারও হয়নি : ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মহাজোটের ৩৭ মাসে ২১ ছাত্রকে হত্যা করা হলেও একটি ছাড়া আর কোনোটিরই তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ। এসব হত্যাকাণ্ডের অধিকাংশই ঘটেছে নিজ কিংবা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে আধিপত্য বিস্তার, রক্তক্ষয়ী ও হামলার কারণে।
সরকার ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু বকর হত্যা ছাড়া আর কোনো হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হয়নি। আবু বকর হত্যার ঘটনার পরপরই ছাত্রলীগ এফ রহমান হল শাখার সভাপতি ফারুকসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করা হলেও তারা সবাই এখন জামিনে মুক্ত। সম্প্রতি আবু বকর হত্যার তদন্ত শেষ হলেও তাতে পুলিশ নির্দিষ্ট করে কাউকে অভিযুক্ত করেনি।
আবু বকর পুলিশের টিয়ারশেল, নাকি ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হলো—সে সম্পর্কে তদন্তে স্পষ্ট করা হয়নি। পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে ছাত্রলীগের কারও নামই নির্দিষ্ট করে আসেনি। কারও নাম না আসায় এরই মধ্যে পুলিশের এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ সরকার ও রাজনৈতিক প্রভাবে তদন্তে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ছাত্রলীগের কারও নাম জড়িত করেনি।
হত্যাকাণ্ডের পরপর গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে।
ঘটনার পরপর পুলিশের তোড়জোড় ছিল। ছাত্রলীগ কর্মী হত্যাকাণ্ডের পরপর পুলিশ শিবিরের ওপর যেভাবে ধরপাকড় চালিয়েছে, শিবিরকর্মী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের সে ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গতকালের ২ হত্যাকাণ্ড ছাড়াও এর আগে তিনটি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। ছুরিকাঘাতে নিহত ছাত্রলীগ কর্মী আসাদ, অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা হত্যা করে হারুন অর রশিদ এবং এএএম মহিউদ্দিনকে। কারা, কেন এ তিনটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে—তা গত দু’বছরেও উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক ও নাসিম এবং ছাত্রশিবির সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানী হত্যার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। এছাড়া অন্যসব হত্যাকাণ্ডেরও কোনোটির তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ।
তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় নিহতের পরিবারগুলো হতাশ হয়ে পড়েছে। কবে তদন্ত ও বিচার হবে—তা জানে না পুলিশও। নিহতের পরিবারগুলোর অভিযোগ, তদন্তে সরকার ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তদন্তকাজ মুখ থুবড়ে পড়েছে।
আর বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তদন্তে অগ্রগতি হচ্ছে না, তাই বিচারও হচ্ছে না। একটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হলেও হত্যার সঙ্গে জড়িতদের নাম নির্দিষ্ট করা হয়নি। পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন না দেয়ায় বিচার কাজ বিলম্বিত হচ্ছে।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।